#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[২০]

টেবিলের উপর রাখা সাদা ঝকঝকে গ্লাসটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে গলা ভেজালো নাতাশা। বুকের ব্যাথা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। একমাত্র ছেলেটা ভাবল না মায়ের কথা। ভাবল না। চলে গেল।
জিনিয়া স্যুপের বাটি নিয়ে ধীরে ধীরে এসে বসল নাতাশার মাথার কাছে। বলল,
‘ স্যুপটা খেয়ে নিন ছোটমা।
নাতাশা জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই মেয়েটা তার একটু ও অযত্ন হতে দেইনি এখানে আসা পর্যন্ত। তাকে থেকে যাওয়ার কত আকুতিমিনতি। কিন্তু সে এখানে থাকবে কি করে? মা হারা নোরার কাছে তার ফুপীই তার মা। নোরাকে ছেড়ে কি করে থাকবে নাতাশা? তাকে যেতেই হবে। ছেলেটা ভাবল না কারো কথা। একটা মেয়ের জন্য চলে গেল সবাইকে ছেড়ে।
জিনিয়া তাকাল নাতাশা বেগমের দিকে। ছেলে চলে যাওয়ায় একেবারে ভেঙে পড়েছেন তিনি। কেন এমনটা হলো? সোরা নাহিলের হতে পারত।
স্বর্ণের মোটা দুইটি বালার একটি তিনি জিনিয়াকে দেন। অপরটি নাহিলের বউয়ের জন্য রেখে দেন। এটি তিনি নোরাকেই পড়াবেন। এই বালা দুটো মা মারা যাওয়ার আগে দিয়ে গিয়েছেন নাতাশাকে। এত মোটা বালা আজকাল কেউ পড়েনা৷ তাছাড়া মায়ের জিনিস বিক্রি করতে ও ইচ্ছে হয়না। জিনিয়া আর নোরাকে দিলে তারা সেটা যত্নে রাখবে।

_________

বাড়ির সবাই কেমন নিস্তেজ নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। জিনিয়া সাগর সাহেব আর সাজেদ সাহেবকে দেখল সোফায় বসে থাকা অবস্থায়। টিভিটা এমনি এমনি চলছে, জিনিয়া রিমোট টিপে টিভি বন্ধ করে ঘরে গেল৷ সাহিল বসে রয়েছে জানালার কাছে চেয়ারে। জানালা দিয়ে ডুকে পড়া বাতাসে চুল উড়ছে। জিনিয়া ঘাড় ধরে ডাকল সাহিলকে। উঠে দাঁড়াল সাহিল৷ জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ সোরা তার সব হয়ে গেল? মা, বাবা,ভাই পরিবার কেউ না? সোরার কারণে সব ছেড়ে ছুঁড়ে তাকে চলে যেতে হলো?
জিনিয়া চুপ করে থাকল। অনেক্ক্ষণ পর বলল,
‘ যা হয়েছে তা হয়ে গিয়েছে। নাহিল ভাইয়া ফিরবেন। দেখবেন হুট করে একদিন চলে আসবেন তিনি। মন খারাপ করবেন না প্লিজ। সবাই কেমন মনমরা হয়ে আছে। আমার একটু ও ভালো লাগছেনা।
সাহিল বুকে টানল জিনিয়াকে। জিনিয়া প্রশ্ন করল,
‘ আপনি যদি আমাকে হারাতেন, তাহলে কি করতেন?
‘ তুমি কি বলেছ আমি শুনিনি।
জিনিয়া পড়ে রইল সাহিলের বুকে। আবারও মিনমিন করে বলল,
‘ আপনি কিছুই করতেন না। সীমান্তর সাথে না হয়ে যদি আপনার মতো কারো সাথে আমার বিয়ে হতো আপনি কিছুই করতেন না। আপনি খুশি হতেন। আপনি আমাকে চাননি। আমি একপ্রকার জোর করে আপনার হয়েছি।
সাহিল ছেড়ে দিল জিনিয়াকে। গটগট পায়ের আওয়াজ তুলে চলে গেল। দরজাটা ও জোরে বন্ধ করল।
জিনিয়া সেদিকে তাকিয়ে থাকল। ঠিক কথাই তো বলেছে সে। এখন এত রাগ কেন?

________________

চোখের নিচে একগাদা কালি। গায়ের শাড়িটা ও ময়লা হয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। মোবাইলের স্ক্রিনে মেয়েকে দেখার সাথে সালেহা কেঁদে ডাকল,
‘ আনু? আমার আনু।
আনহার চোখ থেকে টপটপ জল পড়ল। সে ঠোঁট বাঁকিয়ে কেঁদে ডাকল,
‘ মা, ও মা। কেমন আছ তুমি? আমি তোমার কাছে খুব শীঘ্রই ফিরব মা। তুমি কি খাবে বলো? মা? কি খাবে তুমি? আমি আসার সময় আনব।
সালেহা তার পাশে দাঁড়ানো সিফাতকে দেখে ভয়ে ভয়ে বলল,
‘ কিছু খাবনা। সব খা,,খাওয়াই এরা। সব। তুই শুধু আয়।
আনহা বলল,
‘ তাহলে তুমি কাঁদছ কেন মা? কেন কাঁদছ? মা? আমাকে সত্যি করে বলো তোমার কি খেতে ইচ্ছে করে? সত্যি করে বলো মা।
সালেহা কিছুই বললেন না। শুয়ে পড়লেন বেডে।
সিফাত ভিডিও কল বন্ধ করে। আবার কল দেয়। আনহা তেজী গলায় বলল,
‘ আমার মায়ের যা খেতে ইচ্ছে করে তাই খাওয়াবে সিফাত।
সিফাত হেসে উঠল। বলল,
‘ না খাওয়ালে তোমার মা বলত না? এত ফটরফটর করো কেন? কোনো কাজের কাজ তো করতে পারছ না। আমি কি সেখানে তোমাকে নাইওর করতে পাঠিয়েছি?
আনহা রেগে উঠে।
‘ মুখ সামলে কথা বলো সিফাত। কি শুরু করেছ? টাকা লাগবে আমার তাই তোমার চাকরাণী করছি।
‘ এই তুমি না বলো আমাকে ভালোবাস? এই তোমার ভালোবাসা? টাকার জন্য করছ তুমি সব?
আনহা কোনোকথা বলল না আর।
ইন্সপেক্টর ইশতিয়াক তালুকদারের নিহত হওয়ার খবর নিউজে না দেখানো পর্যন্ত টাকা হাতে পাবেনা আনহা। কিন্তু মা না বাঁচলে তার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে। মাকে তার বাঁচাতেই হবে।
আনহা নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে লাগল।
সিফাত আনহাকে বলতে না দিয়ে সোজাসাপটা বলে দিল,
‘ তোমাকে আর সময় দিতে পারব না আমি। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে পাওনা নিয়ে যাও। আমার হাতে আর বেশি সময় নেই।
শুনতে পেয়েছ?
আনহা ছোট্ট করে আওয়াজ করে বলে, হুহহ।
সিফাত বলল,
‘ তোমার মাকে আর বেশিদিন রাখতে পারব না আমি। এই হসপিটালের অনেক খরচ।
আনহার মাথায় হাত চেপে ধরে বলে,
‘ আমার কাজ সাড়তে দেরি হলে কি করবে?
‘ কি করব জানিনা। কিন্তু হসপিটালে রাখতে পারবনা।
‘ কিভাবে মারব আমি অফিসারকে? আমি কোনো সুযোগই পাচ্ছিনা। তুমি যেমন ভাবে মারতে বলছ, মানে যাতে কেউ সন্দেহ না করে, যাতে সবার সেটি মার্ডার মনে না হয়। সবাই মনে করে সেটি জাস্ট এক্সিডেন্ট। এটা কি করে সম্ভব? দেখো আমি ধরা পড়া মানে তুমি ধরা পড়া। তাহলে হুটহাট কাঁচা কাজ তো আমি করতে পারব না তাইনা?
সিফাত রাগে চেঁচিয়ে উঠে।
‘ তোমাকে শুধু বলেছি মেরে আসতে। কিন্তু কারো যাতে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ না হয়। জায়িদ মরার আগে জানতে পারলে ও সমস্যা নেই। সে তো মরবে। কিন্তু বাকিরা যাতে কেউ কিচ্ছু জানতে না পারে। সেটা কিভাবে সম্ভব সেটা তোমার ব্যাপার। আমার না। আমার তো মনে হচ্ছে তুমি মারতেই চাইছ না জায়িদকে। কি সমস্যা তোমার?
আনহা ও সমান তালে চেঁচিয়ে উঠে,
‘ কি বলতে চাইছ তুমি?
সিফাত হাসে হো হো করে। হাসি থামাতে থামতে বলে,
‘ পুলিশ অফিসারের প্রেমে পড়ে গেলে নাকি? আমাকে ভুলে।
আনহা তোতলায়। মিথ্যে কথা। এটা কি করে সম্ভব? আমার জীবনে আবেগের কোনো জায়গা নেই। আমার পৃথিবীতে মা নামক শব্দটা আর কোনোকিছুর জায়গা নেই। আমি একমাত্র তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম কোনো এক বিশেষ জায়গা। কিন্তু তুমি তার যোগ্য নও। তুমি ভালোবাসা নয়, ভালোবাসা কি সেটা ও বুঝোনা। তুমি আমাকে শুধু ব্যবহার করতে জানো। তোমার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার দিনটাই কুক্ষণ ছিল। আর এই যে এই এত বড় সমস্যায় না পড়লে আমি বুঝতে ও পারতাম না তোমার মতো লোক কারো ভালোবাসা ডিজার্ভই করেনা। অন্তত আমি এই এমন মানুষকে ঘেন্না করি। তুমি নিতান্তই ঘৃণ্য একটা মানুষ। নাহলে সৎ পুলিশ অফিসারকে মারার জন্য উঠে পড়ে লাগতে না।
‘ বাহ বাহ বাহ তার এত নাম গাইছ কেন বলোতো আনহা? কেন গাইছ?
এই উল্টাপাল্টা কিছু শুনলে না লাশ ফেলব আমি তোর। মনে রাখিস। যে কাজ করতে পাঠিয়েছি শুধু সেই কাজ করে আমার কাছে ফিরবি তুই। মনে থাকবে?
আনহা রেগে ফোন কেটে দেয়।
‘ এমন চরম বেয়াদব লোককে আর যায় করা যায়, কিন্তু ভালোবাসা যায়না। মায়ের অসুস্থতার জন্য তাকে এই হীন নিচু লোকটার কথা শুনতে হচ্ছে। নাহলে,
বারান্দা থেকে কেউ একজন ডাক দেয় আনহাকে।
‘ এই মেয়ে এমন সময় বাইরে কি করছ তুমি? ছাদে কথা বলতে বলিনি বলে সেজন্য বাইরে চলে যাবে? আশ্চর্য!
আনহা কোমরে হাত দিয়ে উপরে তাকায়। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলে,
‘ রাস্তায় চলে যায় দাঁড়ান।
গর্জন ভেসে।
‘ এই মেয়ে বাইরে পা রাখলে খবর আছে। দাঁড়াও।
জায়িদ নিচে নেমে এল। আনহা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো। জায়িদ এসেই বলল,
‘ যার সাথে কথা বলছ তার কাছে যাওনা। সে তোমাকে জায়গা দেয়না?
আনহার ভ্রু কুঞ্চন হলো।
‘ কার সাথে কথা বলছি?
‘ ওই, এখন যার কথা বলছিলে? সবসময় যার সাথে কথা বলো। তার কাছে যাও।
‘ সে তো দেশে থাকেনা। দেশের বাইরে থাকে। কিভাবে যাব?
জায়িদ আঁড়চোখে তাকালো।
‘ দেশের বাইরে থাকে? কি করে?
‘ আপনি জেনে কি করবেন? সবকিছুতে নাক গলান কেন?
‘ নাক গলাব কেন? জাস্ট কিউরিসিটি। এনিওয়ে আমি তোমার ব্যাপারে অত ভাবিনা। এমনি কথার কথা জিজ্ঞেস করলাম।
আনহা হাসল। বলল,
‘ অফিসার একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
জায়িদ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
‘ কি?
আনহা হাসল গা দুলিয়ে। বলল,
‘ আপনি কি কখনো কারো প্রেমে পড়েছেন? না মানে কাউকে কখনো ভালোলেগেছিল?
জায়িদের কাশি উঠে। দুই তিনবার কেশে গলা পরিষ্কার করে জায়িদ। বিরক্তি ভঙ্গিতে বলে,
‘ এটা কেমন প্রশ্ন?
‘ তেমন প্রশ্ন। ভীতুরা এসব প্রশ্ন এভয়ড করে।
‘ আমি মোটেও ভীতু না। পঁচানোর চেষ্টা করছ?
‘ মোটেওনা। আনসার করুন। পঁচবেন না।
জায়িদ পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়াল। বলল,
‘ ওসব প্রেম ট্রেম নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? ওসব তোমাদের মতো বেকার মানুষদের কাজ। বেকার মানুষরা টাইম পাস করার জন্য ওসব ফালতু পন্থা অবলম্বন করে।
আনহার রাগ লাগল।
‘ আমি বেকার।
জায়িদ হাসল।
‘ বেকার বলেছি তাই রাগ লাগছে?
আনহা ও হাসল। বলল,
‘ আপনি খুব কম হাসেন অফিসার। এটা মোটেও ভালো লক্ষ্মণ নয়। আমি মনে হয় এই প্রথম আপনার হাসি দেখলাম।
জায়ি মাথার চুলে হাত বুলালো। বলল,
‘ তাই নাকি? অনেক বড় মহৎ কাজ করে ফেলেছ আমার হাসি দেখে। এবার বলো এখান থেকে কবে যাচ্ছ?
‘ চাকরি হয়ে গেলেই চলে যাব। আমি এখন এই বাড়িতে আন্কেল আর আন্টির পারমিশনে আছি। আপনার না।
জায়িদ বলল,
‘ বুঝতে পেরেছি। চাকরি হয়ে গেলেই চলে যাবে? কোথায় থাকবে আইমিন কোন জায়গায়?
‘ এখানেই। ঢাকায়। ঢাকার বাইরে না।
‘ ভালো। এই জীবনে তোমার চাকরি হবে বলে মনে হয়না।
আনহা কোমরে হাত দিয়ে নাক ফুলিয়ে তাকায়।
‘ যাব না এই বাড়ি থেকে। আপনার বিয়ে খেয়ে যাব। আপনার বউকে একটু জ্বালিয়ে যাব। আহা কি মজা হবে তখন?
‘ জাস্ট শাটআপ। একদম ফালতু কথা বলবেনা। এসব বিয়ে টিয়ে করছে কে?
আনহা চুপসে গেল।
‘ বেয়াদব লোক। কিভাবে ধমক দিল।
জায়িদ রাগ মেশালো কন্ঠে বলল,
‘ ওসব কথা মায়ের সামনে একদম তুলবেনা। বুঝেছ? নাহলে এক চড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দেব।
‘ এত সাহস পান কই হ্যা? দাঁত ফেলে দেব মানে কি? আমি আপনার বিয়ে করা বউ? যে কথায় কথায় ধমকান? একশবার বলব, হাজারবার বলব। দাঁড়ান আন্টিকে বলি।
আনহা আন্টি আন্টি ডাকতে ঘরের ভেতর চলে যায়।
জাহেদা দৌড়ে এসে বলে, কি হয়েছে রে? চিল্লাচ্ছিস কেন?
আনহা বলল,
‘ তোমার ছেলে নাকি বিয়ে করবে?
জায়িদ রাগে কথা বলতে পারল না।
জাহেদা খুশি হয়ে গেল। খুশিতে চোখমুখ চকচক করে উঠল। খুশিতে আপ্লূত হয়ে জাহেদা বলে উঠল,
‘ কাকে? কাকে? কাকে বিয়ে করবে? তোকে? বলেছে?
আনহার হাসিহাসি মুখ অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন শুনে চুপসে যায়। মলিন হয়। চোখঘুরিয়ে আনহা তাকায় জায়িদের দিকে।
আনহা তাকাতেই জায়িদ চোখ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। জাহেদা শাড়ির আঁচল মুখে গুঁজে। জায়িদের পেছনে এসে দাঁড়ায় শফিক সাহেব। সবটা শুনেছেন তিনি।
জাহেদা এগোয় আনহার দিকে। আনহার মুখ ছুঁতেই দুই তিন পা পিছু হাঁটে আনহা। বলে,
‘ আন্টি,,, আসলে আমার প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে ।
দৌড়ে চলে গেল আনহা।
জাহেদা দৌড়ে ছেলের কাছে যায়। জায়িদের মুখ ছুঁতেই জায়িদ তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে বলে,
‘ আম্মা! আম্মা তুমি আর কাউকে পেলে না? অন্যের জিনিস। দোহাই আম্মা এসব ভুলে ও মাথায় এনোনা।
বলেই চলে গেল জায়িদ। জাহেদা হা করে দাঁড়িয়ে থাকে। শফিক সাহেব এগিয়ে আসে। সোফায় বসতে বসতে বলে,
‘ ” অন্যের জিনিস ” কথাটার মাঝে গোলমাল আছে জাহেদা। আনহার সাথে কথা বলে দেখো। ওর মায়ের সাথে কথা বললেই হয়ে যাবে। আর না হলে নেই।
জাহেদা এগিয়ে যায় শফিক সাহেবের দিকে। বলে,
‘ ছেলের বউ হিসেবে আমার আনহার মতই কাউকে চাই। এমন মেয়ে আর কোথায় পাব? এমন হাসিখুশি মেয়ে আমার জায়িদের জন্য চাই।
শফিক সাহেব হাসেন। বলেন,
‘ আনহাকেই বলে দেখো। তার কাছে আছে কিনা।
জাহেদার মুখ কালো হয়ে যায়।
‘ আনহা আমাকে বলল না ওর বিশেষ কেউ আছে। এত কথা বলল কিন্তু ওটা তো বলল না। ও মেয়ে খারাপ না। বংশ পরিচয় নেই কিন্তু মেয়ে তো ভালো। আমার মনেহয় ওর মা সুস্থ হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ওদের বাড়িঘরের ঠিকানা ও পাওয়া যাবে। মেয়েটা তার বাবাকে ফিরে পাবে। আমরা মেয়েটার পাশে দাঁড়াতে পারি না?
শফিক সাহেব মাথা নাড়েন।
‘ মেয়েটা সাহায্য নেবে বলে মনে হয় তোমার?
জাহেদা মাথা নাড়ায়৷
‘ সীমান্তর চেইনটা দিয়েছিলাম। সেটা কাল ফেরত দিয়ে দিল আবার। প্রথমে নিয়েছিল আবার ফেরত কেন দিল বুঝলাম না।
শফিক সাহেব বলেন,
‘ বাদ দাও। ওই মেয়েকে বাদ দাও। সাজেদের বউয়ের ভাইঝি একটা আছে না? নোরা? মেয়েটার কথা বলছিল কাল সাগর জায়িদের জন্য। মেয়েটাকে কি দেখব?
জাহেদা হু বলে আওয়াজ করে ছোট্ট করে। শফিক সাহেব বলেন
‘ আচ্ছা সাগরের সাথে গিয়ে মেয়ের বাবার সাথে কথা বলে আসব।
জাহেদা থেমে থেমে হাঁটে। আনহার উপর সব রাগ গিয়ে পড়ল। প্রয়োজন ছাড়া কোনোকথা বললেন না সারাদিন। আনহা পিছু পিছু ঘুরল। কথা বলার চেষ্টা করল। জাহেদা অনেকক্ষণ পর মুখে খুলে বলল,
‘ তোর কেউ আছে আমাকে আগে বলিসনি কেন? তোকে ঘিরে কত স্বপ্ন দেখে ফেলেছি। মন ভাঙলি আমার।
আনহা আর কোনো কথা বলতে পারল না। নিজের উপর ঘৃণা লাগতে শুরু করল। এ কাদের ঠকাচ্ছে সে? কাদের? চোখে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামল আনহার। জাহেদা আনহাকে বলল,
‘ আর কাঁদতে হবেনা। তোকে কি বকেছি আমি?
আনহা দৌড়ে চলে গেল ঘরের দিকে। সিঁড়ির মাঝপথে জায়িদের সাথে দেখা। গায়ে পুলিশের ড্রেস৷ তড়িঘড়ি করে নামল জায়িদ। পকেটে ফোন গুঁজে ক্যাপ মাথায় দিতে দিতে বলল,
‘ আম্মা কোথায়? তাড়াতাড়ি এসো। আমি বেরোচ্ছি।
জাহেদা আসলেন৷
‘ আজকে না ডিউটি নেই আব্বা।
জায়িদ ব্যস্ত জবাব দিল।
‘ কিডনি পাচার চক্রের একটা দলের একজন ধরা পড়েছে আম্মা৷ তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। আমার অনেক কাজ। এর কাছে এই কিডনি পাচারের মাস্টারমাইন্ডের ইনফরমেশন পাওয়া যাবে।
আনহা চলে গেল নিজের ঘরে। সিফাতকে ফোন দিল। সোজাসাপ্টা বলে দিল,
‘ আমাকে অন্য একটা কাজ দাও। আমি মারতে পারব না অফিসারকে। এক মাকে বাঁচাতে অন্য মায়ের বুক খালি করতে পারব না আমি।
হিংস্র জানোয়ারের মতো ক্রোধ নিয়ে চিৎকার করে উঠল সিফাত।
‘ তাহলে তোর মা মরবে। এবার তোর সিদ্ধান্তঃ কি করবি তুই? জায়িদকে মারবি নাকি তোর মাকে?
আনহার কান্নার আওয়াজ পৌঁছাল না সিফাতের কানে।
আনহা বুদ্ধিমান মেয়ে। সে বলল,
‘ আমি অফিসারকে বলে দেব সবকিছু। তোমার নাম ও বলে দেব। যে তুমিই আমাকে পাঠিয়েছ৷
হাসির আওয়াজ ভেসে আাসে।
‘ যাহ বলে দে। সিফাত নামে আমাকে কেউ চেনেনা। হা হা হা। যাহ বলে দে।
আনহা ওড়নায় মুখ গুঁজে কাঁদে।
সিফাত হাসতে হাসতে বলে
‘ তোর মায়ের লাশ দেখার জন্য রেডি হ।
কিছুক্ষণের মধ্যে একটি ভিডিও পাঠায় সিফাত। তার মাকে হসপিটালে ফেলে রাখা হয়েছে একটি অন্ধকার কেবিনে। কাঁদছে সেখানে সালেহা। শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। পানি চাইছে, খাবার চাইছে।
আনহার বুক কেঁপে কেঁপে উঠল। সে নিজেকে শক্ত খোলসে আবদ্ধ করে নিল আবার। সিফাতকে বলল,
‘ আমি মারব। মেরে ফেলব অফিসারকে। মেরে ফেলব৷ তুমি আমার মাকে খেতে দাও। যেটা খেতে চায় সেটা খেতে দাও। এত কষ্ট দিওনা আমার মাকে। আমি মেরে ফেলব অফিসারকে৷ খুন করে ফেলব।

___________

কনস্টেবল রবিন রিমান্ডে রাখা আসামীকে কয়েক ঘা মারার পরেও কোনো তথ্য বের করতে পারল না। জায়িদ আসলে রবিন জায়িদের হাতে লাঠি তুলে দিল। জায়িদ ও কয়েক ঘা দিলে ও আসামি মুখ খুলল না। কিছুক্ষণের মধ্যে লোকটার মুখ থেকে সাদা ফেনা বের হলো। ডক্টর এসে চেক করতে বলল,
‘ ওনাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে খাবারের মধ্যে দিয়ে।
জেলে দেওয়া খাবারে বিষ? কে দিল?
জায়িদকে জেরা করা হলো উপর থেকে। তার অসচেতনতা আসামির মৃত্যুর কারণ বলে দায়ী করা হলো। জায়িদের রিকুয়েষ্টে তাকে শেষ সুযোগ দেওয়া হলো নইলে এত খাপছাড়া কাজের জন্য তাকে অফিসার পদ থেকে বরখাস্ত করা হবে। চিন্তায় মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম জায়িদের। খাবারে কে বিষ দিল? এই আসামির জন্য খাবার তো জেল থেকে দেওয়া হয়েছে। বাকিরা ও খেল কিন্তু তাদের তো কিছু হয়নি।

বারান্দায় দাঁড়ানো ছিল জিনিয়া। আনহাকে ডুকতে দেখা গেল তাদের বাড়ির গেইট ঠেলে। এ মেয়েটা এত রাতে কোথায় গিয়েছিল? আনহার পরপর জায়িদ আসে। গেইট ঠেলে ডোকার আগে ওই বাড়ির বারান্দায় জিনিয়াকে দেখে ডাকে,
‘ জুননু খেয়েছিস?
জিনিয়া গলার আওয়াজ বড় করে বলে,
‘ এখন গিয়ে খাব। তোমার অপেক্ষায় ছিলাম৷ আসামির কাছ থেকে কোনো তথ্য পেয়েছ ভাইয়া?
জায়িদ বলল,
‘ না রে। বিষ পেটে যাওয়ায় মারা গেছে আসামি। দোষটা আমার উপর চাপল।
জিনিয়ার মন খারাপ হলো।
‘ চিন্তা করোনা ভাইয়া। সব ঠিক হয়ে যাবে। খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো। জায়িদ বলল,
‘ আচ্ছা। তুই খেয়ে নে। যাহ। এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকিস না।
আনহার কথা আর বলল না জিনিয়া। ভাইয়া আবার চিন্তায় পড়বে।
স্যুটকেস গুছিয়ে নিল আনহা। এ বাড়ি ছেড়ে পালানোর মোক্ষম ব্যবস্থা করে রাখল। খাবার টেবিলে জায়িদের পাতে জাহেদা তুলে দিচ্ছে এটা ওটা। রোজকার ভাতের পরে দুধ খাওয়ার জন্য গ্যাসের চুলার উপর দুধ গরম হচ্ছে। সেই দুধের উপর একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল আনহা।
জাহেদা আনহাকে ডাক দিল,
‘ আনহা তোর আন্কেল আর জায়িদের দুধ ঢেলে আন মা।
আনহা চমকালো। ট্রেতে ঢালল দুই গ্লাস দুধ। এক গ্লাস বাকি রেখে অন্য গ্লাসে মিশিয়ে দিল হাতে গুজে রাখা সিফাতের দেওয়া ঔষধ। ভাতের টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ালেন শফিক সাহেব। আনহার হাতের ট্রে থেকে দুধের গ্লাস নিয়ে যেতে যেতে বললেন,
‘ তোর আন্টি আর তুই খেয়ে নিস।
আনহা উদভ্রান্তের মতো হেঁটে গেল জায়িদের কাছে। জায়িদের সামনে ট্রে রাখল আওয়াজ করে। জায়িদ চোখ তুলে একবার তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেলল। জাহেদা ডাক দিল,
‘ খাওয়া শেষ করে মোবাইল নিয়ে পড়লি আব্বা? দুধটা খেয়ে নে আগে।
জায়িদ নাকমুখ কুঁচকে কিছু বলার আগে জাহেদা ধমক দিল,
‘ চড় খাবি জায়িদ, তুই ছোট বাচ্চা না যে রোজ রোজ তোকে নিয়ে আমি চিল্লাচিল্লি করব। সোজা খাবি। ঘুম ভালো হওয়ার জন্য অন্তত খা। আর পারিনা আমি এদের নিয়ে। একটা শ্বশুড়বাড়িতে কি খায় কে জানে? আরেকটাকে নিয়ে আছি আমি। যেন আমি তাদের দুধের গ্লাসে বিষ মেশাই।
বকবক করতে করতে জাহেদা চলে গেল উপরে। জায়িদ উঠে দাঁড়াল বিরক্ত নিয়ে । আনহাকে জিজ্ঞেস করল,
‘ খেয়েছ?
আনহা মাথা নাড়াল।
দুধের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠল জায়িদ। আনহা দৌড় লাগাল তার পিছুপিছু। জায়িদ ততক্ষণে নিজের ঘরে পৌছে গেছে।
সাথে সাথে কাজ করবে বলেছিল সিফাত। বুক ধড়ফড় করে উঠল আনহার। সাদা কাফনে মোড়ানো জায়িদকে ভাবতেই গাল ভিজে উঠল। দরজা ঠেলে জায়িদের ঘরে ডুকে পড়ল আনহা। হাত ফোন পড়ে গেল জায়িদের। চোখে অন্ধকার দেখল। দুধের গ্লাসটা ধপ করে রাখল টেবিলের উপর। আনহা তার ঘাড় ধরে কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে ডাকল
‘ অফিসার আপনার কি খারাপ লাগছে? ভীষণ খারাপ লাগছে?
জায়িদ গলায় হাত দিল। কিছু বলতে পারল না।
আনহার উপর ঢলে পড়ল। আনহা দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরল তাকে। তার কাঁধে ঝুঁকে মাথা এলিয়ে দিয়েছে জায়িদ। আনহা কেঁদে উঠল আওয়াজ করে। টেবিল হাতড়ে গ্লাসটা নিয়ে নিল হাতে। ঢকঢক করে খেয়ে নিল বাকি দুধটুকু। গলা জ্বলে উঠল। কলিজা যেন মোচড়ে উঠল। মাথা ঘুরল। চোখে অন্ধকার দেখল।
তরতর কাঁপতে কাঁপতে সে বিড়বিড় করল,
‘ মা? মা আমায় ক্ষমা করো। তোমায় শেষ রক্ষা করতে পারলাম না আমি। পারলাম না। এতবড় পাপ করে বেঁচে থাকতে পারলাম না আমি।
কোনোমতে হেঁটে বিছানার কাছে গেল আনহা। মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে।
জায়িদকে বিছানায় শোয়াতেই ঢলেপড়ল জায়িদ। হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা আনহার ওড়না। আনহা ছাড়াল না। ঢলতে ঢলতে গিয়ে দাঁড়াল দরজার কাছে। সর্বশক্তি দিয়ে ডাকল,
‘ মা? মা অফিসারকে বাঁচাও। মা অফিসারকে আমি বিষ,
আর কিছু বলতে পারলনা আনহা। দরজার কাছে বসে পড়ল। মাটিতে শুয়ে পড়ল। গাল দিয়ে সাদা ফেনা বের হলো।
জাহেদা এসে চমকে গেল আনহাকে এভাবে দেখে। চিউকার দিয়ে ডাকল শফিক সাহেবকে। শফিক সাহেব আসল দৌড়ে। জাহেদা জায়িদকে ডাকতে দৌড়ে ঘরে ডুকল। ছেলের ও একই অবস্থা দেখে পৃথিবী হয়ে উঠল অন্ধকার। তিল তিল করে বড় করে তোলা বুকের মানিককে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে বুক ফাটিয়ে কেঁদে উঠল জাহেদা। ছেলেকে বুকে টেনে নিল। ডাকল,
‘ আব্বা, এই আব্বা বকেছি বলে রাগ করেছিস? কথা বলিস না কেন আব্বা? এই জায়িদ? আব্বা ওঠ। এই আব্বা।
জায়িদ চোখ খুলল না। শফিক সাহেব আনহাকে ডাকতে ডাকতে জ্ঞান হারালেন। দরজার সাথে হেলান দিয়ে তিনি ও পড়ে রইলেন। জাহেদা জায়িদকে রেখে দৌড় লাগালেন বাড়ির বাইরে। গেইট খুলে চিৎকার করে ডাকল,
‘ জুনু, জুনুরে তোর ভাই। তোর ভাই কথা বলছেনা আমার সাথে।
জিনিয়া বের হয়ে এল ঘর থেকে। সাহিল, সাগর সাহেব আর সাজেদ সাহেব।
সাহিল তরিনা খাতুনকে ধরিয়ে দিয়ে আসলেন জিনিয়াকে।
জিনিয়া কারো কথা শুনল না। দৌড়ে চলে আসল নিচে। গেইট খুলে পাগলের মতো হন্য হয়ে দৌড়াল।
‘ আনহা কিছু করেছে? আনহা করেছে সব।
কিন্তু ঘরে ডুকে দরজার কাছে পড়ে থাকতে দেখে ভুল ধারণা উঁবে গেল জিনিয়ার।। জায়িদের কাছে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল জিনিয়া।
‘ ভাইয়া তুমি কিছুক্ষণ আগে না আমার সাথে কথা বললে? এই ভাই? তোমাকে কে পুলিশের চাকরি করতে বলেছে? কে বলেছে?
সাহিল ছাড়িয়ে নিল জিনিয়াকে। জিনিয়া সরতে চাইল না। সাহিল রেগে বলল,
‘ ওদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে জিনি। পাগলামি করবেনা একদম।।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here