যখন এসেছিলে অন্ধকারে
১৫।।
ইমরান বাংলাদেশে ফিরেছে। একেবারে ফেরেনি। একটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং এনালিস্টের পোস্টে এক বছরের কন্ট্রাক্ট সাইন করে এসেছে। এই এক বছরে দেশের সমস্ত পাট চুকিয়ে অনিকে সাথে করে, ইউরোপের কোথাও পাড়ি জমাবে, যেখানে কাজের স্বাধীনতা আছে, এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ আছে, কোনো পরীক্ষামূলক স্ট্রাটেজি ফেইল হলেও নতুন উদ্ভাবনের কদর হবে।
অনিকে নিয়েই ফিরবে ও। পাঁচ বছরে অনিকে ভুলে থাকার কষ্টসাধ্য কাজটা সফলভাবে করে ফেলেছে। নিজের স্বপ্নপূরণের মাঝে বাধ সাধতে দেয়নি ওকে। মার্কেটিংএ পোস্টগ্রাড শেষ করার পর, ম্যানেজমেন্ট স্কিলের উপরেও আরেকটা পোস্টগ্রাড করে ফেলেছে।
দেশ ছাড়ার পরে প্রথম প্রথম ইমরান খুব ভয়ে ভয়ে ছিলো, কখন সাইদা জবাবদিহি চাইবেন। আতঙ্কে ফোন করাও বন্ধ রেখেছিল কিছুদিন। জাপান পৌঁছে আটদিনের মাথায় ফোন করেছিল, কিন্তু সাইদা খুব স্বাভাবিক ছিলেন। এতদিন পরে কেন ফোন করল ইমরান সেই কৈফিয়ত নিয়েছিলেন শুধু। ইমরান নিশ্চিন্ত হয়েছিল, অনি কাউকে কিছু বলেনি। আরও কয়েকবার ফোন করেও ইমরান সাইদার কাছে কিছুই শোনেনি। খুব আগ্রহ হতো অনির কোনো সংবাদ পেতে। নিজেই তাই উপযাচক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘পলাশডাঙার সবাই কেমন আছে, মা।’
‘আছে। ভালোই আছে সবাই।’
‘অনি?’
‘সেও ভালো আছে। ওকে নিয়ে ভাবার দরকার নেই তোAsha
সে আমি ব্যবস্থা করেছি। নিজের পড়াশোনা মন দিয়ে করো। যেন একবারে পাশ করতে পারো। ফেল করে একক্লাসে দুইবার থেকে দেশে আসতে যেন দেরি না হয়। দেশে ফিরলে তারপর যা করার দরকার, করা যাবে।’
ইমরান আশ্বস্ত হয়েছিল। নিজের কাজেই মনঃসংযোগ করেছিল। অনির চিন্তা, ওর সাথে একটু কথা বলার জন্য মন চঞ্চল হলে মনকে কঠিন করে আটকাতো আর দিন গুণত, এই তো আর কয়েকটা দিন। বাড়িতে ফোন করাও মাসে, তিনমাসে এসে ঠেকেছিল, অনির খেয়ালে যেন বিপর্যস্ত না হতে হয়, সেই কারণে।
এই পাঁচবছর অনিকে ভুলে থাকলেও দেশে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই গেঁয়ো অনিকে মাথা থেকে নামাতে পারছে না একটা মূহুর্তের জন্যও। পাঁচ বছরে অনেক বড় হওয়ার কথা ওর, হয়তো সাইদা নিজের মতো করে অনেককিছু শিখিয়েও নিয়েছেন। তবে অনি যদি কিছু না শেখে, আগের মতোই থাকে, ঠিক যেভাবে রেখে গিয়েছিল ও সেইরকমই বেশি ভালো লাগবে ইমরানের। সেই অনিই তো ওর কল্পনা জুড়ে রাজত্ব করে।
অতিআগ্রহে নির্ধারিত সময়ের পনেরোদিন আগেই বাংলাদেশে নেমেছে ইমরান। ভেবেছিল অনিকে বাড়িতেই পাবে। খুব উত্তেজনা কাজ করছিল মনে মনে। আশাভঙ্গ হয়েছে। অনি নেই। তবে বাড়িতে বেশ সাজসাজ রব। সবার কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়ে মনও বেশ চনমনে। শুধু অনির অভাব ছিলো। মুখ ফুটে বলতে পারছিল না। নিজের বাড়িতেই কেমন একটা নতুন জামাই, নতুন জামাই মনে হচ্ছিল নিজেকে। আড়ষ্টতা কাজ করছিল।
মায়েরা নাকি সন্তানের বুকের ভেতরটা পড়ে ফেলতে পারেন। বইপত্রে ব্যাপারটা জানলেও আজকে ইমরানের বিশ্বাস হলো কথাটা। সাইদা বাইরে যাওয়ার কাপড় পরে তৈরি হয়ে এসে বললেন ‘আমরা পলাশডাঙা যাচ্ছি, ইমরান। বেয়াই সাহেব একেবারে ছাড়ছেন না।’
অনির বড়চাচা বেলায়েত শিকদারকে সাইদা বেয়াই বলেন জানা আছে ইমরানের।
ইমরান লাজুকমুখে বলল ‘আমার যাওয়ার দরকার আছে?’
‘না। তুই গিয়ে কী করবি? তুই যাবি এটা তো তারা জানে না। কী করতে কী করবে আবার৷ আমরাও আজ যেতাম না। কিন্তু বেয়াইসাহেব অনেক আগে থেকে কথা নিয়ে রেখেছেন। দিনে দিনেই চলে আসব। দুপুরে খেয়েই বউকে নিয়ে চলে আসব।’
‘আচ্ছা, তবে এই ব্যাপার। মা অনিকে আনতে যাচ্ছে!’ মনে মনে তখনই গোটাকতক লাড্ডু খেয়ে ফেলল ইমরান।
*****
নিজের পড়াশোনা, কাজ সবসময়ই ইমরানের কাছে সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি পেয়েছে। ব্যাক্তিগত জীবন, পরিবার এসব কিছুরই মূল্য ওর কাছে কখনোই ছিলো না। অথচ আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনে ও কিছুতেই কাজে মনোঃসযোগ করতে পারছে না। বারবার বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। অনির জন্য অপেক্ষার আর তর সইছে না। নিজের এতটা অধৈর্য চরিত্রের সাথে আজই পরিচয় হলো ওর।
অফিসে আজ প্রথম দিন। এলিভেটর স্পিচ দেওয়ার পর হাই অফিসিয়ালরা উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছে ইমরানকে। গতকয়েকবছরের মার্কেট এনালাইসিস রিপোর্ট ওর অফিসরুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। অফিসরুমটাও সুন্দর। বিশাল কর্পোরেট ভবনের ছয়তলায় খুব স্মার্ট অফিস। কনফারেন্স, কনফিডেনসিয়াল মিটিংগুলোও এই ফ্লোরেই সংঘটিত হয়।
নতুন একটা মার্কেটিং প্রমোশনাল ক্যাম্পেইন ডিজাইন করেছে কোম্পানির মার্কেটিং এন্ড প্রমোশন টিম। সেটার লঞ্চিং ডিসকাশন করার জন্য লাঞ্চের পরে মিটিং শুরু হলো। আটজন মডেল নিয়ে শুরু হচ্ছে এই ক্যাম্পেইন। এর আগে শুধু লাক্সকেই দেখা গেছে একসাথে এতজন মডেলকে ব্র্যান্ড প্রমোশনে কাজে লাগাতে। তবে লাক্স থেকে এই ক্যাম্পেইনটা আলাদা। লাক্স এর বিজ্ঞাপনে ওয়ার্লডজুড়ে সেরা তারকাদের এম্বাসাডর করা হয়। আবার ফ্রেশ ফেসেরও ভ্যালু আছে মডেলিং ইন্ডাস্ট্রিতে। রাতারাতি তারকাখ্যাতি পেয়ে যায় কেউ কেউ।
মার্কেটিং এনালাইসিস বলছে, এতে করে তারকারাই বেশি ফোকাস পান, প্রডাক্ট গৌণ হয়ে যায়। এই কোম্পানিটি একটু ভিন্ন পথে হাঁটছে। আটজন মডেলকে চুক্তিবদ্ধ করা হচ্ছে, যারা না ফেমাস না ফ্রেশার৷
তবে টিভি কমার্শিয়ালগুলো তৈরি করতে এপয়েন্ট করা হয়েছে বেস্ট এড এজেন্সিকে। একটা পাঁচতারকা হোটেলে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মডেলদের সাথে কোম্পানির চুক্তিসই অনুষ্ঠান হবে।
পুরো ডিজাইন অল্প কথায় ব্রিফ করলেন প্রোমোশন এন্ড মিডিয়া ম্যানেজার, তারপর প্রজেক্টর ফেলে বড় স্ক্রিনে একে একে ভেসে আসতে লাগল মডেলদের নাম, ফটো, ভিজ্যুয়াল পোর্টফোলিও। তিন নম্বর ফটোটা পর্দায় ভেসে আসতেই ইমরানের দুটো হার্টবিট মিস হলো। মডেল অনামিকা। একদম অনির মতো দেখতে। তবে অতটা বুনো সরলতা নেই চেহারায়। চর্চিত মুখশ্রী আর আবেদনময়ী চোখ। ঠোঁটের কোণায় তাচ্ছিল্য সারা পৃথিবীর দিকে। সংক্ষিপ্ত পোশাকে দুর্দান্ত সাহসিকতা।
পর্দায় একটা একটা ভিডিও ক্লিপ ভেসে আসতে আসতে ইমরান শিওর হলো, এ মেয়ে পলাশডাঙার এনায়েত শিকদারের মেয়ে অনন্যা শিকদার নয়, ইমরানের পরিত্যাক্তা বিবাহিতা অনি নয়! এ গ্ল্যামার দুনিয়ার এক ঝলমলে আলো, অনামিকা!
*****
বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের অফিসটাতে বসে আছে অনি। আরও অনেকেই আছে। ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হিসেবে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটির সাথে খসড়াচুক্তি সম্পাদন করতে এসেছে। চুক্তিপত্র পড়ে, সব টার্মস এন্ড কন্ডিশন, ক্লজগুলো ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারবে কীনা তাই সবাইই কাউকে না কাউকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। অনির সাথে সবসময়ের জন্যই পরশ আছে ছায়ার মতো। বারবার স্ন্যাকস, কফি সার্ভ করা হলেও সবাই ছটফট করছে, মূলকাজ হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। এখানে যারা আছে সবার জন্যই এটা জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ। বড় সুযোগ। শেষমূহুর্ত পর্যন্ত সবাই টেনশনে।
অনি হাতের আঙুল মটকাচ্ছে বারবার। অস্থির হচ্ছে। বারবার উঠছে বসছে। পরশ কয়েকবার চুপ করে বসতে বলল ওকে, কিন্তু ওর অস্থিরতা কমছে না। এতদিন পরে স্বপ্নটা দরজার ওপাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তাকে ছুঁয়ে না দেখার আগে আকুলতা কমছে না। কিছুক্ষণের ভেতর সবার সাথে পরিচয় করে নিলো অনি। ইইন্ডাস্ট্রিতে টুকটাক কাজ করার সুবাদে সবার মুখচেনা ছিলো, আলাপ ছিলো না। এর আগে স্ক্রিনিটেস্টে আসা হয়েছিল, একটা ফটোশুট হয়েছে, পোর্টফলিও জমা দিতে হয়েছে। এর আগের সব কাজের রেকর্ড দিতে হয়েছে। সবাইকে আলাদা করে ডাকা হতো তখন। এবারই সবাই একসাথে এসেছে। ওদেরকে বেয়ার ফেসে আসার জন্য ইন্সট্রাকশন দেওয়া হয়েছিল আগেই। একেবারে অল্প সাজে এসেছে সবাই। কিন্তু স্মার্ট আর গ্লামারাস লুক আনার চেষ্টায় কমতি নেই কারোরই। অনি পরেছে একটা সুতি তাঁতের শাড়ি, ফুলস্লিভ ব্লাউজের পিঠ অনেকটাই খোলা। শাড়ির আঁচলটা একটা মোটা দড়ির মতো পাঁকিয়ে কাঁধের উপর ফেলে রেখেছে যে কেউ দেখে বলবে, আঁচলটা না থাকলেও উনিশ-বিশ কিছু হতো না। তবে এখানে মডেল যারা এসেছে সবার ড্রেস আপ একইরকম কাছাকাছি বলে আলাদা করে কাউকেই চোখে পড়ছে না। মেকআপহীনতাকে পোশাকে এডজাস্ট করে নেওয়ার চেষ্টা সবার মাঝেই। তবে একেবারে প্রসাধনবিহীন ও কেউ নয়। হালকা ঠোঁটরঞ্জক, কাজল, কপালের মাঝখানটায় একটা টিপ – অনি এভাবেই নিজেকে সাজিয়ে ফেলেছে।
‘অনি, চুপচাপ এসে বস একজায়গায়। তুই এত ছটফট করছিস কেন?’
‘দাঁড়াও ভাইয়া। এখনো ডাকছে না কেন, বলো তো?’
‘কাউকেই তো ডাকেনি। সময়মতো ঠিকই ডাকবে।’
‘এটা তো একটা বড় প্রতিষ্ঠান। এদের কাজ তো সময়মতো হওয়ার কথা। তাই না? বিকেল চারটায় আসতে বলে সন্ধ্যে সাতটা বাজিয়ে ফেলা, কেমন না? কাউকে দেখছিও না, জিজ্ঞেস করব!’
‘অনি তুই বস এখানে।’
‘একটু ভেতরে গিয়ে দেখি?’
‘কোন ভেতরে?’
‘আরেহ, এইপাশ থেকে তো আসলাম আমরা। ওইপাশে দেখো আরেকটা গেইট। ওইপাশে কেউ আছে অবশ্যই।’
‘এটা রাজন মানিকের স্টুডিও না, অনি। এটা একটা কর্পোরেট অফিস। মন চাইলেই যেকোনো জায়গায় যে কেউ ঢুকে যেতে পারে না।’
‘আরে আমি তো ঢুকব না। কাউকে দেখলেই শুধু জানতে চাইব, আমাদের কখন ডাকবে।’
‘অনি, অন্য কেউ তো তোর মতো করছে না। চুপ করে বস…’
পরশের কথা মুখেই থাকল, অনি চঞ্চল পায়ে উঠে চলে গেল!
*****
বিশাল লবিতে এসে পড়ল অনি। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ডানদিকে গিয়ে লম্বা একটা করিডোর, আর বাঁদিকে আড়াআড়ি আরেকটা লম্বা প্যাসেজ চলে গেছে। সামনে কাচের পুশডোর।
ও পুশডোরে ঠেলতেই খুলে গেল। একটা ছোটো রিসিপশন ডেস্ক। চারটে চেয়ার পাতা। কিন্তু কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। অনি অবাক হলো, এ কেমন অফিস?
জোরে জোরে ডাকল ‘কেউ আছেন?’ দুবার ডাকলে একজন বেরিয়ে এলো।
‘কার কাছে এসেছেন। অফিস আওয়ার তো শেষ। আজ আর কারো সাথে দেখা হবে না।’ রিসিপশন ডেস্কে বসতে বসতে লোকটা জানতে চাইল।
‘আমরা অনেকক্ষণ বসে আছি। কাউকেই তো দেখছ না আমাদের এটেন্ড করতে।’
‘ওহ। নতুন মডেল আপনি?’ অনিকে আপাদমস্তক দেখে নিলো লোকটা।
‘জি।’
‘স্যাররা তো সবাই মিটিংএ আছেন। আপনাদের রিফ্রেশমেন্ট এর ব্যবস্থা করা হয়েছে তো।’
‘হ্যাঁ। সেটা করা হয়েছে। কিন্তু কী হবে না হবে। কী করতে হবে, কেউ তো কিছু জানাচ্ছেন না।’
‘আর একটু অপেক্ষা করুন, কিছুক্ষণের ভেতর মিটিং শেষ হবে। তখন আপনাদের বুঝিয়ে দেওয়া হবে সবকিছু।’ বলতে বলতে লোকটা নিজের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
অনি আর কিছু বলার না পেয়ে জানতে চাইল ‘আমাকে একটু ফ্রেশ হতে হবে। ওয়াশরুমটা কোনদিকে জানাবেন?’
লোকটা একটু বিরক্ত হলো। চোখ কুঁচকে জোরে হাঁক দিলো ‘সামাদ?’
পিয়নের মতো ড্রেসআপে একটা লোক এলো। ‘এই ম্যাডামকে একটু ওয়াশরুম দেখিয়ে দাও। আবার সাথে করে এখানে নিয়ে এসো।’ রিসিপশনের লোকটা বুঝিয়ে দিলো পিয়ন সামাদকে।
রিসিপশন পার হয়ে আরেকটা বড় দরজা। এটা টেম্পারড গ্লাসের ট্রান্সপারেন্ট ডোর। ওপাশটা দেখা যাচ্ছে। সারি সারি টিপটপ আর স্মার্ট ওয়ার্কস্টেশন সাজানো। এখানেও কেউ নেই। অফিস ছুটি হয়ে গেছে। যারা আছে তারা সম্ভবত মিটিংএ আছে।
দরজা দিয়ে ঢুকে ডানদিকের ছয়টা ওয়ার্কস্টেশন পার হয়ে একটা ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলো সামাদ। অনি ওয়াশরুমে ঢুকে নিজের চুলগুলো একটু সেট করল। লিপিস্টিকেও একটা রিটাচ দিলো। শাড়িটা পিনআপ করা যদিও তাও একটু ভাঁজগুলো টেনে ঠিক করল।
বেরিয়ে এসে আর সামাদকে পেলো না। এদিক ওদিক তাকালো। ‘ভাই, আছেন?’ ডাকল দুবার।
সামাদকে না পেলে এই শুনশান নীরব অফিস থেকে বেরোবে কী করে? একে ফিঙারপ্রিন্ট একসেস ছাড়া দরজা খুলবে না, আর এতগুলো ওয়ার্কস্টেশন একটা গোলোকধাঁধাঁ হয়ে রয়েছে, এর ভেতর দরজাটা কোনদিকে তাও তো খুঁজে পাচ্ছে না।
অনি প্রায় কেঁদে ফেলবে, তখন ওই ওয়ার্কস্টেশনগুলোর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো সামাদ ‘হইছে ম্যাডাম? চলেন?’
‘আপনি কোথায় ছিলেন?’
‘দেরি হইছে বুঝি? স্যার ডাকছিলেন। এসি বন্ধ করবেন, রিমোট পাইতেছিলেন না।’
‘কোন স্যার? স্যাররা সবাই না মিটিংয়ে?’
‘হ্যা। কিন্তু ইনি নতুন আসছেন। আজই জয়েন করেছেন। প্রথমদিন কাজ কম থাকে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যায় সবাই।’
‘কোথায় উনি? একটু কথা বলা যাবে? আমাদের কাজ কখন শুরু হবে একটু জেনে নিতাম।’
সামাদ নাটক সিনেমার পোকা। সেই সূত্রে অনিকেও দেখেছে পর্দায় কয়েকবার। আজকে সামনাসামনি নায়িকা দেখে ওর অন্যরকম লাগছে। আনন্দ হচ্ছে। বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে কতরকম করে বলবে, এসব ভেবে রাজি হয়ে গেল। ওয়ার্কস্টেশনগুলোর উল্টোদিকে আলাদা আলাদা কেবিন। এরই একটা দেখিয়ে দিলো অনিকে।
অনি আঙুলে দুটো টোকা দিতেই ভেতর থেকে আওয়াজ এলো ‘কাম ইন।’
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই অনি চমকে উঠল।
ইমরান!
পরশ ইমরানের কথা বললে প্রথমে নামটা চিনতে পারেনি ও। মাঝখানে অনেকগুলো দিন কেটে যাওয়ায় সত্যি সত্যিই ও ভুলে গিয়েছিল ইমরান নামটাকে। কিন্তু জীবনের সবচাইতে বড় সত্যিটা তো না চেনার অভিনয় করা যায় না। অন্তত নিজের কাছে তো একেবারেই না। সেদিন একের পর এক সব পুরোনো স্মৃতিগুলো ফিরে এসে ওকে আঘাতে আঘাতে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল। সব ঝেড়েপুছে আজ ও এখানে এসেছে। ইমরানকে চিনতে ওর একটুও দেরি হলো না।
কিন্তু এখানে এতবড় চমকের জন্য ও মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল!
ইমরানের অবস্থাও তথৈবচ। প্রথমদিনের কাজ বুঝে নিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। আজ ওর এমনিতেও তাড়া আছে। বাড়ি গিয়ে অনিকে পাবে বলে। ওর মা অনিকে আনতেই পলাশডাঙা দিয়েছে। সেই দেখা কেমন হবে, কীভাবে কথা বলবে, অনি কী বলবে, ও অনিকে কী বলবে, পাঁচ বছরে অনির অভিমান কতখানি জমেছে, সেই মান কীভাবে ভাঙাবে ভেবে রোমাঞ্চিত হয়েছে বারবার।
এইভাবে এখানে অনিকে দেখে বিশ্বাস করতে পারল না। এতদিনের অপেক্ষায় সবকিছু ওর কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। এই অনি নিশ্চয় মানবী নয়, কল্পনা মনে হচ্ছে ওর।
ও চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো। এতদিনের সংযম ভেস্তে গেলো। অনির মুখটা হাতের তালুতে আটকে নিজের ঠোঁটটা ডুবিয়ে দিলো অনির দুঠোঁটের মাঝখানে…
চলবে…
Afsana Asha