মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৯+১০
মোনা ফোন হাতে নিয়ে চিন্তাগ্রস্থ চিত্তে বসে রইলো।জ্যাকের কাছে ফোন দেওয়াতে কি মনে করলো এই নিয়ে শঙ্কিত হলো মোনা। মোনা ফোন দিয়েছে প্রিন্সেস সুস্থ হয়েছে কিনা তা জানতে। জ্যাক কি ভাবছে?মোনার এখন মনে হচ্ছে ফোন দেওয়া বোধ হয় অনুচিত হয়েছে।মোনা যখন এমন সব চিন্তায় বিমগ্ন ছিলো তখন ফোন বেজে উঠল। জ্যাক ফোন দিয়েছে। মোনা নিদারুণ এক অস্বস্তিপূর্ণ অবস্থায় পড়লো।প্রথম বার ফোন রিসিভ করল না, দ্বিতীয় বার কল দেওয়ার পর রিসিভ করল।ওপাশ থেকে জ্যাক মৃদু গলায় বলল,
-“আজও কি পথ হারিয়েছেন মোনালিসা?”
মোনা হেসে ফেলে,
-“প্রতিদিন কি মানুষ পথ হারায়?”
এরপর উত্তর আসতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগলো। জ্যাক ওর কর্মচারী’দের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে গেলো। কিছু সময় এভাবে কেটে গেলো। জ্যাক তাঁদের সাথে কথা বলা শেষ করে বলল,
-“স্যরি। যা বলতে ছিলাম।”
কি বলতে ছিলো জ্যাক বোধ হয় ভুলে গেছে। কিছুক্ষণ ভেবে মনে করে বলল,
-“প্রতিদিন মানুষ পথ হারায় না, কিন্তু ভীতু রমনীরা হারায়।”
মোনা আবারও হেসে উঠে প্রত্যুত্তরে। জ্যাক বলে,
-“ভিঞ্চি বোধ হয় আপনায়ই এঁকেছিল, কয়েক’শ বছর পর আবার পৃথিবীতে ফিরে আসলেন।”
মোনা খাটের সম্মুখে থাকা ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকায়। তারপর আপন মনে হেসে দেখে আসলেই কি ওর হাসি সুন্দর? না..আর পাঁচটা মানুষের মতই। নিজের হাসিতে তেমন কোন বিশেষত্ব খুঁজে পেলো না।
-“আচ্ছা বলুন প্রিন্সেস কেমন আছে? সুস্থ হয়েছে তো? আপনার কন্যা কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে।”
জ্যাক কৌতুক ভরা গলায় বলে,
-“মেয়ের বাবা সুন্দর, মেয়ে তো সুন্দর হবেই।”
-“আপনি তো বেশ মজা করতে পারেন! আমি তো ভেবেছিলাম এখানকার মানুষ গুলো সব যান্ত্রিক।”
-“এবার দেখলেন তো এখানকার মানুষ গুলো যান্ত্রিক না? এখন আপনার এই ভাবনার পরিবর্তন ঘটান।”
-“আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। প্রিন্সেস সুস্থ হয়েছে?”
-“হ্যাঁ আমার প্রিন্সেস এখন সুস্থ। আর শুনুন প্রিন্সেস ওর মায়ের কার্বন কপি।”
মোনা থেমে গেলো। কোন কথা এখন আর খুঁজে পেলো না। মোনা কে নিরুত্তর দেখে জ্যাক আবার বলল,
-“কি হলো মোনালিসা?চুপ কেন?”
মোনা কথা খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলো। এভাবে শব্দহীন থাকা বেখাপ্পা লাগে। মোনা বলে,
-“আচ্ছা রাখছি তাহলে এখন।”
-“একদিন কোন রেস্তোরাঁয় আসুন মিট করি।”
-“আসতে পারি কিন্তু শর্ত আছে।”
-“কি শর্ত?প্রিন্সেস কে নিয়ে আসতে হবে? আচ্ছা ঠিক আছে।”
মোনা চমকে গিয়ে বলল,
-“আপনি কিভাবে বুঝলেন?”
-” গেস পাওয়ার।”
মোনা ফোন রাখল। জ্যাকের ভিতর ফর্মালিটিজ আছে প্রচুর। কিন্তু মোনা চিন্তায় পড়ে গেলো। রেস্তোরাঁয় কি যাবে? বাসা থেকে কি বলে বের হবে? আর ও একা কিভাবে যাবে রেস্তোরাঁয়?
হঠাৎ রুমের বাইরে কোলাহলের শব্দে মোনার এসব ভাবনার সমাপ্তি ঘটে।হাবিব সাহেব,প্রিয়ম, এরিক কেউ’ই বাসায় না। লিলি বেগম গেছে পাশের বিল্ডিং-এ, সাথে নিশান কেও নিয়ে গেছে। মোনা চকিত হরিণীর মত কান খাঁড়া করে শোনার চেষ্টা করে। পুরুষ কন্ঠে হিন্দিতে কি যেন বলছে মোনা বুঝতে পারল না। তবে বেশ কয়েকজন মানুষ হবে। মোনার রুমের দরজায় এসে টোকা দেয়। ইংরেজি’তে মোটা গলায় বলে,
-“রুমে কেউ আছেন?”
এটা প্রিয়মের গলা না, না হাবিব সাহেবের, না এরিকের। মোনা ঘাবড়ে যেতে লাগল। অপরিচিত এত জন মানুষ বাসায় কেন? আর বাসা পুরো খালি। মোনা খাটের উপর শক্ত হয়ে বসে রইল। কিছুতেই দরজা খুলবে না। রুমের বাইরের মানুষ গুলো ব্যগ্র গলায় ডাকছে। মোনা নিজের সিদ্ধান্তে অনড়, চুপচাপ বসে রইলো। মোনার রুমের সামনে এসে একজন বলল,
-“রুম ভিতর থেকে লক করা। ভিতরে নিশ্চয়ই কেউ আছে। কিন্তু সাড়া দিচ্ছে না।”
বাহির থেকে এমন ভাবে ডাকছে মনে হয় কোনো বিপদ পড়েছে। ওপাশ থেকে ধৈর্যচ্যুত হয়ে বলল,
-“প্রিয়ম এক্সিডেন্ট করেছে, ভিতরে কেউ থাকলে আসুন আমাদের সাহায্য করুন।”
মোনা চমকে গেলো।প্রিয়মের সাথে সম্পর্ক যতই মন্দ হোক তাই বলে এক্সিডেন্ট করলে মোনা খুশি হবে এমন টাও না। মোনা দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে আসে। প্রিয়মকে সোফার উপর শুইয়ে রাখা হয়েছে। মাথায় ব্যান্ডেজ করা।মোনা কিছুটা আঁতকে উঠল।তিনটা ছেলে দাঁড়ানো। প্রিয়মের বন্ধু হয়ত। একজন বিরক্ত গলায় বলল,
-“এতক্ষণ ধরে ডাকছি আপনাদের, অথচ রুম বন্ধ করে বসে আছেন?”
মোনা ইতস্তত বোধ করে বলল,
-“ঘুমিয়েছিলাম। কিভাবে হয়েছে এক্সিডেন্ট?”
কেউই মোনার কথার উত্তর দিলো না।উল্টো জিজ্ঞেস করল,
-“আংকেল, আন্টি, এরিক উনারা কোথায়? আপনি প্রিয়মের কাজিন?”
-“উনারা কেউই বাসায় না।হ্যাঁ কাজিন।”
-“শোয়ানোর মত জায়গা পাচ্ছিলাম না, রুম সব কয়টা বাহির থেকে লক করা। আর আপনার টা ভিতর থেকে।”
মোনার রুমে নিয়ে প্রিয়মকে শোয়ানো হলো। এতগুলো ছেলের ভিতর মোনা প্রচন্ড অস্বস্তি বোধ করল। লিলি বেগম পাশের বিল্ডিংএ যাবে বলেছে। পাশে তো অনেক বিল্ডিং, মোনা কোন বিল্ডিংএ খুঁজবে?মোনা এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল। প্রিয়মের বন্ধুরা অনেকক্ষণ ছিলো, মোনার দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। মোনা কে ইন্ডিকেট করে কি কি যেন বলেছে মোনা বুঝতে পারল না। জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রিয়মের বন্ধুরা চলে যাওয়ার আগে বলল,
-“ওর খেয়াল রেখেন।”
মোনা মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
-“আচ্ছা।”
সবাই চলে যাওয়ার পর মোনা দোটানায় পড়ে গেল। প্রিয়মের পাশে বসবে? কিছু জিজ্ঞেস করবে? মোনার দারুণ অস্বস্তি লাগছে। প্রিয়ম ক্ষীণ গলায় বলল,
-“মোনা?”
প্রিয়মের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে বোধ হয়। মোনা গিয়ে প্রিয়মের মাথার কাছে বসল।
-“মেডিসিন নিয়েছেন?”
-“হুঁ। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে,কথা বলতে তীব্র কষ্ট হচ্ছে। আম্মু-আব্বু, এরিক কোথায়?”
-“কেউই বাসায় না।”
প্রিয়ম ব্যথাতুর মুখে ভ্রু কুঁচকে চোখ বুঁজে রইল। মোনা দেখলো প্রিয়মের পা কেটে জখম হয়েছে অনেকখানি। হাতের কনুইয়ের কাছে ও কেটে গেছে খানিকটা। চোখের উপরে থেঁতলে গেছে অনেকখানি। প্রিয়ম কে এত কাছ থেকে মোনা দেখেনি আর কখনো। প্রিয়ম আবার বলে,
-“মোনা?”
-“হুম।”
-“মাথাটা একটু টিপে দেও।ব্যাথায় ফেটে যাবে মনে হচ্ছে। মেডিসিন নিয়েছি তাও কমছে না।”
মোনা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলো। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল দ্বিধা ভরা মনে।
-“কি হলো?দিবে না?”
মোনা প্রিয়মের মাথায় হাত দিতে গিয়েও থেমে যাচ্ছে। দ্বিধান্বিত মনে আস্তে আস্তে চুল টেনে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর মোনা দেখল ঘুমিয়ে গেছে প্রিয়ম। মোনার এতক্ষণ হাঁসফাঁস অবস্থা হয়েছিল। এতক্ষণে যেন স্বস্তি পেলো। মোনা রুম থেকে বের হয়ে বাসার গেটের কাছে গেল লিলি বেগমের খোঁজে। মোনা দেখল লিলি বেগম নিশান কে নিয়ে আসছে বাসার দিকে। নিশানের হাতে আইসক্রিম। নিশান হাসছে,আর লিলি বেগম কি যেন বলছে। নিশানের মুখটা খুব হাস্যেজ্জ্বল মনে হলো।
-“তোকে তো কত করে বলেছিলাম গেলি না। নিশান কে নিয়ে কত জায়গায় ঘুরে আসলাম, কত কি খেলাম।”
মোনা ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে রইল।কিছুটা গম্ভীর ভাব চেহেরায়। লিলি বেগম মোনার দিকে তাকিয়ে বাসার ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলল,
-“মোনা মন খারাপ তোর?প্রিয়ম তোকে কিছু বলেছে?ও বাসায় এসেছে?”
-“না খালা প্রিয়ম ভাই এক্সিডেন্ট করেছে।”
লিলি বেগম আঁতকে উঠলো। মুখ’টা মুহূর্তেই পাণ্ডুবর্ণ ধারন করলো। প্রচণ্ড ভয়বিহ্বল গলায় বলল,
-“কি বললি? প্রিয়মের কি হয়েছে? প্রিয়ম ঠিক আছে তো? ওর কিছু হয়নি তো? প্রিয়ম কোথায়?”
-“খালা ভয় পেয়ো না। তেমন কিছু হয়নি। উনি বাসায়।”
লিলি বেগম উদ্ভ্রান্তের মতো বাসায় ঢুকল। প্রিয়মের কাছে গিয়েই কেঁদে উঠলো। সন্তান যত অবাধ্য হোক না কেউ, মায়েরা কখনো সন্তানদের ঘৃনা করতে পারে না।মোনা রুম থেকে বের হয়ে গেলো। আজ ওর মায়ের কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়ে গেল। মোনার জ্বর হলে সারারাত পাশে বসে থাকত মা নামক মানুষটা, একটু মাথা ব্যাথা হলে ব্যাকুল হয়ে যেত। মা নামক মানুষ গুলো সকল কিছুর ঊর্ধ্বে।
___
জ্যাক ফোন করেছে রেস্তোরাঁয় যাবার জন্য। মোনা কে বলেছে মোনা চিনে আসতে না পারলে বাসার সামনে আসবে গাড়ি নিয়ে। মোনা বলেছে যেতে পারবে না, ওর খালাতো ভাই মারাত্মক ভাবে আহত হয়েছে। মোনার ভার্সিটি তিন দিন পর তখন মিট করবে। মোনা দুইটা মিথ্যা বলেছে। প্রথমত প্রিয়ম মারাত্মক ভাবে আহত হয়নি , আর মোনা যে প্রিয়ম এক্সিডেন্ট করেছে বলে যাবেনা এমনটাও না। মোনা যায়নি হাবিব সাহেবের ভয়ে, লোকটা যা ইচ্ছে তাই বলে। তাছাড়া লিলি বেগম হাজার টা প্রশ্ন করবে। মোনা ভেবে দেখল এত ঝামেলার চেয়ে ভার্সিটি তে যখন যাবে তখন মিট করাই শ্রেয়। হঠাৎ মোনার কানে বিদ্ধ হলো,
-“মোনাপু।”
মোনা পিছনে ফিরে তাকায়। এটা এরিকের গলা তা মোনা জানে। নয়ত এভাবে মোনা কে এ’বাড়িতে বা এই কান্ট্রি তে কেউই ডাকেনা। মোনা একটু হেসে বলে,
-“হ্যাঁ বলো।”
-“প্রিয়ম ভাই ডাকছে।”
এক্সিডেন্টের পর প্রিয়মে কি হলো কে জানে। কারণে অকারণে ডাকবে মোনা কে। কখনো বলবে,এক গ্লাস পানি দেও নয়ত বলবে আমার মোবাইল টা খুঁজে পাচ্ছিনা। এছাড়াও নানান ওজর। মোনা বিরক্ত গলায় বলল,
-“কি হয়েছে?ডাকলেন যে?”
প্রিয়ম চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
-“মাথাটা ওইদিনের মত ব্যাথা করছে টিপে দেও না একটু।”
মোনা ফ্যাকাশে মুখে তাকায়। তীব্র বিরক্তি নিয়ে বলে,
-“আমি খালাকে ডেকে দিচ্ছি।”
প্রিয়ম জোর গলায় মোনা’কে সতর্ক করে বলে,
-“না, না খবরদার।আমি তোমায় বলছি। অসুস্থ মানুষের প্রতিও তোমার দয়া হয়না?”
মোনা চুপ থাকে। প্রত্যুত্তর করতে ইচ্ছে হয় না। প্রিয়ম মোনার উত্তরের অপেক্ষায় থেকে নিরাশ হয়ে কিছুক্ষণ পর আবার বলল,
-“কি দিবে না?আমি কিন্তু আবার তোমায় ওভাবে পার্টিতে নিয়ে যাবো।”
মোনার মুখ গম্ভীর হয়ে যায়।প্রিয়ম হেসে বলে,
-“না,না আর কখনো ওমন করব না তোমার সাথে।”
এই বলে মোনার হাত ধরে পাশে বসায়। এই জাটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ লাল করে তাকায়। মোনা চুল টেনে দিচ্ছে, প্রিয়ম চোখ বন্ধ করে আছে। প্রিয়মকে এক এক সময় এক এক রকম মনে হয় মোনার। কয়েকদিন পর পর মনে হয় জিন পরিবর্তন হয়। প্রিয়ম ঘুমিয়ে গেলে মোনা প্রিয়মের রুম থেকে বের হয়ে যায়।
____
দুইদিন পেরিয়ে যায়। প্রিয়ম একদম সুস্থ হয়ে উঠে। মোনার কাল থেকে ভার্সিটি। মোনা ভাবছে খাপ খাওয়াতে পারবে তো নিজেকে? নতুন জায়গা, নতুন সব মুখ মোনার একা একা থাকতে হবে। মানুষের সাথে তেমন মিশতে পারে না।
রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়লো মোনা। আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুমাবে ভেবেছে। রাত জাগতে জাগতে চোখের নিচে কালি জমে গেছে। এত দুঃখ বিলাস করে কি হবে? দুঃখ কি প্রশমিত হবে? হবে না মোনা জানে। তবুও অতীতের কথা ভুলতে পারছে না। মোনার অতীত বিবর্ণ হয় না, প্রতিনিয়ত যেন আরো রঙিন হয়। মোনার বুক চিঁড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসতে চাচ্ছে। দুঃখকে প্রশ্রয় দিতে নেই, লাই পেয়ে বসে। মোনা আজ তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে যায়। ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়। ঘুমের মাঝে মোনার মনে হলো দুইটা হাত মোনার শরীরে বিচরণ করছে। নিশান প্রায়ই ঘুমের ভিতর মোনার শরীরে হাত-পা তুলে দেয়। এটা নিশানের হাত না। এটা পুরুষ্ঠ হাত, নোংরা স্পর্শ। মোনা যেন জমে বরফ হয়ে গেলো। মোনা চিৎকার করতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। ভয়ে, আতঙ্ক মোনার গলা রোধ করে রেখেছে। মোনা আস্তে চোখ খুলে, একটা মুখ ওর চোখের সামনে আবছা বুঝা যাচ্ছে। মোনা দিশেহারা চিৎকার করে উঠে ,চাপা একটা চিৎকার। তীক্ষ্ণ আর্তনাদের মত একটা শব্দ বেরিয়ে আসে। লোকটা মোনার মুখ চেপে ধরে। মোনার শরীরের সব শক্তি যেন ফুরিয়ে গেছে। অবশিষ্ট ক্ষীণ শক্তি টুকু দিয়ে মোনা লোকটার বুকের উপর লাথি দিতেই প্রচণ্ড ব্যথায় মোনার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়।মোনা রুম থেকে তড়িৎ বেগে প্রাণপণে কাঁপা কাঁপা পায়ে বেরিয়ে যায়। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা আলোতে মোনা স্পষ্ট লোকটার মুখ দেখেছে।বাসার সবাই সজাগ হয়ে যাবে মোনার চিৎকারে, এই ভেবে লোকটা চোরের মত বের হয় যায় রুম থেকে। মোনা রুমে ঢুকে লাইট অন করে দুর্বল হাতে। রাতে দরজা আটকাতে ভুলে গিয়েছিলো। মোনা এলোমেলো পায়ে গিয়ে দরজা আটকিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ফ্লোরে বসে পরে। কোন চিৎকার দেয় না মোনা। মুখে ওড়না গুঁজে অসহায়ের মত কাঁদছে। মোনার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মোনা কিছু ভাবতে পারছে না, মোনার ভাবনা শক্তি অবশ হয়ে গেছে যেন। মোনার মর্মদেশ জুড়ে তীব্র যন্ত্রনা হচ্ছে।শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরায় আতঙ্ক,ভয়, লজ্জা অনুভূত হচ্ছে। মোনা শুধু ভাবছে এই বাসা থেকে সকাল হওয়ার আগে’ই চলে যেতে হবে। এই মানুষ গুলো থেকে নিজেকে আড়াল করতে হবে।
(চলবে)
মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১০
জীবনের আঠারোটা বসন্ত পেরিয়েছে এমন পরিস্থিতির স্বীকার হয়নি কখনো মোনা। শুধু একবার বাসে বসে হেনস্থার স্বীকার হয়েছিল। এক বয়স্ক লোক মোনার পিছনের সিটে বসেছিল, লোকটা বার বার ঘাড়ের কাছে হাত দিচ্ছিল। মোনা প্রথম ভেবেছিল অনিচ্ছাকৃত ভাবে হয়ত, কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছে এটা অনিচ্ছাকৃত স্পর্শ না। মোনা চেঁচিয়ে উঠলো, লোকটাকে কড়া কিছু কথা বলল। লোকটা দমে গেল। মোনা অবাক হয়ে যাচ্ছিলো, লোকটার বয়স মোনার বাপের বয়সের থেকেও বেশি হবে। অথচ লোকটা কত নিকৃষ্ট, জঘন্য।
আমরা নারী,আমাদের অনেক কিছু বুজেঁ সহ্য করতে হয়। ধর্ষিতা হলেও সমাজের কাছে বলা যায় না! অথচ ধর্ষক বুক ফুলিয়ে থাকে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এসবের জন্য দায়ী। মোনা সারারাত মুখে ওড়না গুঁজে কেঁদেছে, আবার কখনো তীব্র কষ্টে চাপা চিৎকার দিয়েছে, আর্তনাদ করেছে। মোনার কাছে প্রতিটি মূহুর্ত ঘন্টাসম মনে হয়েছে, আজ যেন সকাল হতে খুব বেশি সময় লাগছে। মোনার হাত-পা কাঁপুনি থামছে না যেন। বার বার আতংকে মোনার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠছে। এমন ভয়াবহ রাত মোনার জীবনে আজ নিয়ে তিনবার এসেছে! ওর মা’কে যেদিন মেরে ফেলেছিল, আর একবারের কথা মোনা মনে করতে চাচ্ছে না। মোনা আজকের রাতের কথা কারো কাছে বলতে পারবে না,এমন বিশ্রী কথা কিভাবে বলবে? কেউ জানবে না এ কথা। মোনার চোখ লাল হয়ে ফুলে গেছে, প্রচণ্ড ভাবে প্রদাহ হচ্ছে চোখে। কান্নার ফলে মাথা তীব্র ভাবে ব্যথা করছে। মোনার চোখ দু’টো একবারে ছোট হয়ে গেছে । মোনা চোখ মেলে তাকায়, দেখে সকাল হয়ে আসছে। মোনা উঠে দাঁড়ায়, তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। এ বাসার মানুষের ঘুম ভাঙতে অনেক দেরি। মোনা নিশান কে জোর করে ঘুম থেকে টেনে তুলে। মোনার এমন আচরণের কারণ বুঝতে পারছে না নিশান।
মোনা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। জ্যাক’কে কি বলবে?জ্যাক যদি কোন সাহায্য না করে? তাহলে কি হবে,কোথায় যাবে?
নানান শঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে যায় মোনা।জ্যাকের ঘুম এত তাড়াতাড়ি ভাঙে না। মোনা জ্যাকের নম্বরে ডায়েল করে অনেকবার, ফোন রিসিভ করছে না। মোনা হতাশ হয়ে ফোন হাত থেকে রেখে, ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। নিশান মোনার দিকে তাকাচ্ছে বার বার। কিছু বলতে চাচ্ছে ও। কি হয়েছে মোনার জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছে।
জ্যাকের নম্বরে আবার ফোন দিতে সংকোচ হচ্ছে। এত স্বল্প পরিচয়ের একজন মানুষের কাছে এভাবে হেল্প চাওয়া? রাতের কথা ভাবতেই সমস্ত সংকোচ কেটে যায়। আবার ফোন দেয় জ্যাকের নম্বরে। তিন বারের মাথায় ফোন রিসিভ হয়। মোনা কিছুটা স্বস্তি বোধ করে। ফোন রিসিভ করে ওপাশ থেকে কথা বলছে না,হয়ত সদ্য ঘুম ভাঙার ফলে। মোনারও কথা বলতে ইতস্তত বোধ হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ঘুম জড়ানো গলায় জ্যাক বলে,
-“কে বলছেন?”
মোনা কণ্ঠ’টা দুর্বল শুনাচ্ছে।একটা অস্থির ভাব বিদ্যমান গলায়। উতলা হয়ে বলে,
-“জ্যাক আমি মোনালিসা বলছি। আমার একটু হেল্প লাগবে, ইমেডিয়েটলি! প্রীজ না করবেন না।”
মোনার গলা শুনে মনে হচ্ছে খুব গুরুত্বর কিছু ঘটেছে। জ্যাক কিছু’টা বিগড়ে যায়। চমকানো গলায় বলল,
-“মোনালিসা কি হয়েছে আপনার?আর ইউ ওকে? কোন বিপদে পড়েছেন?”
-“আমি খুব বিপদে পড়েছি। প্লীজ আমায় হেল্প করুন।”
মোনার ঘাবড়ে যাওয়া গলা শুনে জ্যাক তড়াক করে বিছানা ছাড়ে। জিজ্ঞেস করে,
-“পথ হারিয়েছেন?”
-“না বাসা হারিয়েছি।”
-“আপনি কোথায় আছেন?বলুন আমায়। আমি আসছি। আপনি এত নার্ভাস হবেন না। এড্রেস দিন।”
এত’টা ক্লেশ, পীড়া কিংবা আতঙ্কের মাঝেও মোনা ভরসা পেল।
-“ওইদিন যে বাসায় আপনি পৌঁছে দিয়েছিলেন,ওই বাসার কাছাকাছি আসুন। বাসার সামনে আসতে হবেনা।”
জ্যাক তাড়াহুড়ো গলায় বলে,
-“আসছি,আসছি। ওয়েট।”
মোনা এক মুহূর্ত নষ্ট না করে নিশান কে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। গেট থেকে বেরুতেই দেখে একটু দূরে জ্যাক গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মোনা ভরসা পেলো,আস্থা পেলো। দ্রুত পায়ে জ্যাকের কাছে গেলো। জ্যাক ভ্রু কুঁচকে তাকালো মোনার দিকে।মোনার হাল দেখে বলল,
-“একি অবস্থা। কি হয়েছে আপনার?কোন সমস্যা হয়েছে?”
মোনা এসবের জবাব না দিয়ে বলল,
-“একটা উপকার করতে পারবেন?থাকার জন্য আমায় একটা বাসার ব্যবস্থা করে দিন।আমি বিপদে পড়েছি খুব।”
-“বিপদের কথা পরে শুনবো। গাড়িতে উঠুন।আগে আমার বাসায় চলুন। আরে আমি তো আছি,এত অস্থির কেন হচ্ছেন?”
জ্যাক নিশানের দিকে তাকালো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। মোনা নিস্তেজ গলায় বলল,
-“আমার ভাই।”
জ্যাক ফের নিশানের দিকে তাকিয়ে এক চিলতে হাসি দিলো। মোনা ক্লান্ত শরীর নিয়ে গাড়িতে উঠলো। জ্যাক গাড়ি স্টার্ট করলো। মোনা ফ্যাকাশে মুখে বসে থাকে। আজ ভার্সিটি তে যাওয়ার কথা ছিলো। জীবনের ঘোড় ঘুরতে এক মুহূর্তও লাগেনা। মোনা ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলছে। মোনা জ্যাকের দিকে তাকিয়ে নিরুপায় হয়ে বলল,
-“একটা বাসায় ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন না?আর একটা পার্টটাইম জব। আপনি তো এখানকার পরিচিত।”
প্রত্ত্যুতরে জ্যাক হাসলো। কিছুক্ষণ পর বলল,
-“একটা কথা বলুন তো সত্যি করে, আপনি সাথে আসলে কি হয়েছে? ওইদিন রাতে কি হয়েছিল?আর আজকেও বা কি হয়েছে? আমার উপর ভরসা রাখুন।সব সমস্যার সমাধান করে দিবো।”
মোনা জ্যাকের দিকে নিঃসাড় দৃষ্টিতে তাকালো। জ্যাক বলল,
-“আচ্ছা থাক, বাসায় গিয়ে শুনবো।”
মোনা কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থাকলো। মাথায় নানা রকমের চিন্তা ঘোরপাক খাচ্ছে। মোনা অসহ্য হয়ে যাচ্ছে।জ্যাকের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আবার বলল,
-“জ্যাক বললেন না তো? হেল্প করবেন?”
-“যদি না করি তাহলে কোথায় যাবেন বলুন তো?”
মোনার গলা ধরে আসছে। জ্যাক হেল্প না করলে কোথায় যাবে? মোনা আতংকিত হয়ে যায়। ত্রসন হয়ে মন্থর গলায় বলল,
-“বাংলাদেশ ফিরে দিতে হবে।”
জ্যাক বাসার কাছে এসে গাড়ি থামালো। মোনা আর নিশান কে গাড়ি থেকে নামতে বলল। নিশান বিরক্ত হয়ে মোনার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। মোনা নিশান কে নিয়ে জ্যাকের পিছনে পিছনে গেলো।
-“রুম তো চিনেন নাকি?রুমে যান রেস্ট নিন। সব কথা পরে শুনছি।”
মোনা নিশান কে নিয়ে রুমে গেলো। মোনার ভয় যে পুরোপুরি কমে গেছে তাও না। মোনা অনিশ্চিয়তায় ভুগছে। শুধু ভাবছে এই গল্পে শেষ কথায়? জীবনটা দিন দিন জটিল হয়ে যাচ্ছে। জটিল ধাঁধায় পড়লো মোনা।
মোনা রুমে এসে খাটে বসলো। জ্যাক’কি আসলেই এত ভালো মানুষ? নাকি এই রূপের পিছনে,অন্য রূপ আছে? মোনা জীবনে এতসব বিপদে পড়েছে যে মানুষ কে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় খুব। জ্যাক যদি জিজ্ঞেস করে কি বিপদে পড়েছে তাহলে কি বলবে?এসব কিছুতেই বলা যাবে না। বিচিত্র রকমের চিন্তা-ভাবনায় প্রিন্সেসের কথা জিজ্ঞাস করতে ভুলে গেছে মোনা।
___
লিলি বেগম দশটার দিকে ঘুম থেকে উঠে। মোনা তো এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না। লিলি বেগম মোনার রুমে গেলো। মোনা,নিশান কেউ নেই রুমে। লিলি বেগম ছাদে গেলো,পুরো বাড়িতে খুঁজলো। কোথায়ও দেখলো না। বাসার বাইরে তো কখনো যায়না ওঁরা। লিলি বেগম প্রিয়মের রুমে গেল দ্রুত। প্রিয়ম ঘুমাচ্ছে। প্রিয়ম কে ঘুম থেকে তুলে চিন্তিত মুখে জিজ্ঞাসা করল,
-“মোনা কোথায়?নিশান কোথায়? ওদের তো দেখছি না।”
হঠাৎ ঘুম ভাঙার কারণে প্রিয়ম কিছুই বুঝতে পারলো না। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে রইলো লিলি বেগমের দিকে কিছুক্ষণ। বিরক্ত ভরা গলায় বলল,
-“আম্মু! কি শুরু করলে সকাল সকাল? আমি বলবো কিভাবে?”
প্রিয়ম আবার ঘুমানোর জন্য চোখ বুঁজে। লিলি বেগম চিৎকার করে উঠে,
-” নিশান আর মোনা কে কোথায়ও দেখছি না। আর তুই বলছিস জানিস না? কোথায় নিয়ে গেছিস ওদের বল?”
প্রিয়ম চোখ খুলে হতাশ ভঙ্গিতে তাকায় লিলি বেগমের দিকে।ঘুমে প্রিয়মের চোখ আবার লেগে আসছে।ঘুমে জড়াগ্রস্থ মস্তিষ্কে লিলি বেগমের কথা যেন বুঝতে পারলো না।
(চলবে)
।