মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২৫+২৬
মোনা বাসায় আসে। রাত একটু বেশি হওয়া গেছে অন্যান্য দিনের তুলনায়। নিশান ভয় পাচ্ছে নিশ্চয়ই। মোনা এসব ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। বাসায় ঢুকে দেখে নিশান বই খাতা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। মোনা জিজ্ঞেস করল,
-“ভয় পেয়েছিস নিশান?”
নিশান হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে না বলে। ইশারায় বলে,
-“এই বাসায় এখন আর ভয় করে না।”
মোনা ছোট একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ব্যাগ’টা বেড সাইডে রেখে, গোসল করার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। শরীর ক্লান্ত খুব আজ। প্রিয়মের কথা ভেবে ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলল। সব সময়ই তো অবজ্ঞা করেছে,তবুও কেন আজকাল নিজেকে প্রিয়মের প্রতি দুর্বল মনে হয়। মোনা লম্বা শাওয়ার নিলো। ভেজা চুল গুলো হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকাচ্ছে। মোনা বুঝতে পারেনি প্রিয়ম ওঁর অহরহ চিন্তার কারণ হয়ে উঠবে। মোনা বুঝতে পারেনি প্রিয়মের এমন আচরণ ওঁর জীবনে প্রভাব ফেলবে। মোনার কাউকে বিশ্বাস করার সাহস নেই। মোনা চায় না ওঁর ভালা থাকা কিংবা খারাপ থাকা কারো উপর নির্ভর করুক। মোনা চায় না কাউকে এমন ভাবে আপন করতে যাতে সে নিজেকে গুটিয়ে নিলে মোনা অসহায়, দুর্বল হয়ে যাবে।
মোনা মোবাইলের ব্যাটারি, সিম কার্ড খুলে রাখলো। বারান্দার দরজা’টা বন্ধ করে দিলো। সারারাত দাঁড়িয়ে থাকুক বারান্দার নিচে প্রিয়ম, মোনা আর কখনো বারান্দায় যাবে না। প্রিয়ম ওর ফোনে কল কিংবা ম্যাসেজ কিছুই যেন দিতে না পারে। মোনা সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল হতে চায়। কারো অনুপস্থিতি যেন মোনা’কে দুঃখ না দেয়, কেউ নিজেকে গুটিয়ে নিলে মোনা যেন কষ্ট না পায়।একা বাঁচতে শিখতে চায়,একা পথচলা শিখতে চায়। আর কখনো প্রিয়ম’কে নিয়ে কিছু ভাববে না। রাতে হয়ত বারান্দার নিচে এসে প্রিয়ম দাঁড়িয়ে ছিলো নয়ত ছিলো না।
মোনার ওসব ভাবতে চায় না।
পরের দিন ভার্সিটি’তে যায়। রাস্তায় জ্যাকের সাথে দেখা হয়। জ্যাক মোনা’কে ভার্সিটি’তে পৌঁছে দেয়। শ্রুতি মোনার উপর রাগ। মোনা গিয়ে স্যরি বলে। শ্রুতি বলে,
-“ভুল আমারই হয়েছে, আমি বুঝতে পারিনি প্রিয়ম’কে তোমার এত অপছন্দ।”
মোনা অস্থির হয়ে বলল,
-“শ্রুতি বাদ দেও ওসব, ওই বিষয়ে আর কথা না বলি।”
শ্রুতি অনেকক্ষণ কথা বলল না। মোনার মুখে চিন্তার ছাপ। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও মাথায় চিন্তা আসে। শ্রুতি ইতস্তত বোধ করে বলল,
-“আচ্ছা মোনা,আজ যার সাথে গাড়ি’তে আসলে সে কে?”
মোনা হাসলো। অনেকক্ষণ চুপ থাকল। কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মোনা’কে নিরুত্তর দেখে শ্রুতি আবার একই প্রশ্ন করল। মোনা এবার বলল,
-“লোক’টা জ্যাক। আমার খুব ভালো বন্ধু।”
শ্রুতি সন্দিহান গলায় বলল,
-“আমার মনে হয় তুমি মিথ্যা বলছো।”
মোনার মুখে বিরক্ত ভাব ফুটে উঠে। মোনা স্বাভাবিক গলায় বলল,
-“পৃথিবী’তে প্রেম-ভালোবাসার ঊর্ধ্বে একটা জিনিস আছে,সেটা হলো বন্ধুত্ব। আজকাল মানুষ—”
কথা’টা পুরো শেষ করল না মোনা। বাকি টুকু অস্পষ্ট ভাবে বলল। শ্রুতি বুঝলো না।
-“তোমায় প্রায়ই ভার্সিটি’তে পৌঁছে দিতে দেখি। জ্যাক ও কি তোমায় বন্ধু ভাবে?”
-” জ্যাকের সাথে আমার এখানে আসার পরপরই পরিচয়। চমৎকার একজন মানুষ জ্যাক। জ্যাক কখনো আমায় অন্য ভাবে ট্রিট করে নি।জ্যাকের অমায়িক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাই বলে তাঁর সাথে প্রেম এমন’টাও না। আমি এটা ভুলেও কখনো ভাবিনি। আমার ধারণা জ্যাকও না। সবচেয়ে বড় কথা আমার ইমাজিনাশোনে জ্যাক শুধু মাত্র একজন বন্ধু হিসেবেই আসে।”
অবশেষে শ্রুতি’কে বুঝাতে সক্ষম হলো জ্যাক মোনার বন্ধু। শ্রুতি অত্যাধিক কৌতুহলী। এত কৌতুহলী মানুষ মোনার পছন্দ না।
মোনা জানে ভার্সিটি শেষে দেখবে প্রিয়ম দাঁড়িয়ে আছে। মোনা আজ প্রিয়মের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়। মোনা চায় না আর কখনো প্রিয়মের সামনে পড়তে কিংবা প্রিয়মের সাথে কথা বলতে। মোনা কারো মায়াজালে আবদ্ধ হতে চায় না।
কয়েকদিন চলে যায় প্রিয়ম কোন ভাবেই মোনার সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। মোনা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ভার্সিটি’তে দেখে না, মোনার অফিসে দেখে না, বারান্দায় দেখে না, ফোন অফ। এখন মোনার বাসায় যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রিয়ম যেন তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে। মোনা’কে দেখার তৃষ্ণা প্রিয়ম’কে গ্রাস করছে। প্রিয়ম মোনার বাসায় যায়, বাসা তো বাহির থেকে লক করা। মোনা কি বাসা বদলে ফেলেছে? পাশের ফ্ল্যাটের এক ভদ্রলোকের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে বাসা পরিবর্তন করেনি। প্রিয়ম এবার হতাশ হয়ে গেলো। বাসায় নেই মোনা, ভার্সিটি শেষেও দেখে না। কি অদ্ভুত ব্যাপার!
লিলি বেগম বিছানায় গোছাচ্ছে। জানালার পর্দায় ময়লা জমেছে সেগুলো পরিষ্কার করছে। হাবিব সাহেবের জামা-প্যান্ট বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পড়ে আছে। লিলি বেগম সেগুলো গুছিয়ে রাখছে। এমন সময় প্রিয়ম ঢুকে লিলি বেগমের রুমে। লিলি বেগম নিজের কাজে ব্যস্ত থাকল, প্রিয়মের দিকে না তাকিয়েই বলল,
-“কিছু বলবি?”
প্রিয়ম কিছু’টা অস্বস্তি বোধ করছে। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল,
-“আম্মু মোনা, নিশান ওঁরা কি আগের বাসায় থাকে না?”
লিলি বেগম এ পর্যায়ে প্রিয়মের দিকে তাকালো। সন্দিহান হয়ে বলল,
-“ওঁদের দিয়ে তোর কি দরকার?”
-“আমার আবার কি দরকার? ওঁদের বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম ভাবলাম ওঁদের একবার দেখে আসি। তা দেখি দরজা লক করা।”
-“আমি তো কালকেও গেলাম। বাসা চেঞ্জ করলে তো আমায় বলত।”
প্রিয়ম আর কোন প্রশ্ন না করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। প্রিয়ম বুঝতে পারলো মোনা শুধু ওঁর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, লিলি বেগমের থেকে না। প্রিয়ম ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলে। রুমে গিয়ে নিজের ল্যাপটপ অন করে। গান শুনে। প্রিয়মের ভালো লাগছে না, যেন বিরক্ত হয়ে গেলো। খুব কষ্ট করে বাজে অভ্যাস গুলো থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। প্রিয়ম মোনার সাথে কিছু’টা মিথ্যা বলেছে। ও নাইট ক্লাবে যায় না, মেয়ে’দের সাথে আড্ডা দেয় না। অভ্যাস এত সহজে ছাড়া সম্ভব না। প্রিয়ম এসব আগের তুলনায় কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পুরোপুরি ছাড়তে পারেনি।
—–
মোনা কিচেনে নাস্তা বানাচ্ছে। তাড়াহুড়ো হাতে নাস্তা বানাচ্ছে। ভার্সিটি’তে যাবে। আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। প্রিয়মের থেকে পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে মোনা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মোনা কিচেনের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। বাসার নিচে প্রিয়ম। হাঁটার গতি দেখে বুঝা গেলো মোনার বাসার দিকে আসছে। মোনার দৌড়ে রুমে গিয়ে নিশান’কে শিখিয়ে দেয়,’ প্রিয়ম ভাই আসলে বলবি আমি বাসায় না। ভার্সিটি’তে চলে গেছি।’ মোনা প্রিয়মের মুখোমুখি হতে চায় না। মোনা ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। খানিক বাদেই কলিং বেল বেজে ওঠে। নিশান দরজা খুলে মোনার শিখানো কথা বলল। নিশানের ইশারা ইঙ্গিতের কথা প্রিয়মের বুঝা কষ্টসাধ্য। নিশান লিখতে শিখেছে, খাতায় লিখে প্রিয়ম’কে দেখালো,’ মোনা আপা বাসায় না।’
প্রিয়মের মুখে হতাশার ছায়া নেমে আসে। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। মোনা আড়াল থেকে সব দেখছিলো। কারো থেকে এভাবে পালিয়ে বেড়ানো, এমন লুকোচুরি খেলা এই সমস্যার সমাধান হতে পারে না। সেটা মোনা জানে।তবুও মোনার কেন জানি ইচ্ছে হচ্ছে না প্রিয়মের মুখোমুখি হওয়ার।
সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই তখন। খানিবাদে মোনা অফিস থেকে বের হলো। চারপাশে তাকিয়ে ট্যাক্সি খুঁজছে। মোনার পাশে কেউ একজন এসে দাঁড়ালো। ভারী গলায় বলল,’মোনা।’
মোনা পাশ ফিরে তাকায়। প্রিয়ম দাঁড়ানো। মোনার চোখ মুখের অবস্থা তখন সঙ্গিন। মোনা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে একবার তাকালো প্রিয়মের দিকে। প্রিয়মের গলার স্বর ক্রমশ ভারি হচ্ছে যেন। গাঢ় স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-“পালিয়ে বেড়াচ্ছো কেন?আমার প্রেমে পড়ে যাবে সেই ভয়ে?”
মোনা উত্তর দিলো না। অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রিয়ম পুনরায় বলল,
-“মোনা কিছু বলছি আমি তোমায়। তুমি কি ভেবেছো খুঁজে পাবো না তোমায়?”
মোনা কি যেন চিন্তা করল। হঠাৎ করে বলল,
-“আচ্ছা চলুন আমরা কোথায়ও গিয়ে বসে করে কথা বলি।”
খুব সহজ গলায় বলল মোনা। প্রিয়ম এমন প্রস্তাবে চমকালো কিছু’টা। কাছের এক রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল। মোনা সাবলীল গলায় বলল,
-“হ্যাঁ, এটা সত্যি। আমি আপনার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আপনার জায়গায় যে কেউ থাকলেও আমি ঠিক এভাবে পালিয়ে বেড়াতাম।কারণ আমি কাউকে বিশ্বাস করতে চাই না, আমার অস্তিত্বে কাউকে জড়াতে চাই না।”
মোনার কথা গুলো কঠিন লাগলো প্রিয়মের কাছে। বলল,
-“তার মানে আমার ধারণা ভুল। আমি ভেবেছি তুমি আমায় অপছন্দ করো। আমি বুঝতে পারিনি তুমি পুরুষ বিদ্বেষী। কেন তুমি বিশ্বাস করতে ভয় পাচ্ছো?কেন তোমার পুরুষ সমাজের উপর এত ঘৃণা?”
প্রিয়মের কথার তাৎক্ষণিক উত্তর দিলো না মোনা। উদাস মনে কি যেন ভাবছে।
-“আমিও ভেবেছিলাম আমি আপনায় অপছন্দ করি। কিন্তু পরে বুঝেছি, শুধু আপনায় নয়। আমি অন্তত ভালোবাসার বিষয়ে কোন পুরুষ’কে বিশ্বাস করতে পারব না। আমি পুরুষ বিদ্বেষী নয়,আমি ভালোবাসা বিদ্বেষী। কোন পুরুষের প্রেয়সী হওয়ার সাহস আমার নেই।”
এমন গুরুত্বর মুহূর্তেও প্রিয়ম একটু কৌতুক করে বলল,
-“তুমি পুরুষের ভালোবাসা বিদ্বেষী, তো কি আমি মেয়ে হয়ে যাবো?”
খানিকক্ষণ পর প্রিয়ম আগের ন্যায় গম্ভীর হয়ে যায়। আহত গলায় বলল,
-“তোমায় না দেখে আমার কত’টা কষ্ট হয়েছে সে তুমি বুঝো? কেন ভয় পাও তুমি ভালোবাসায়?একবার ভালোবাসা’কে সুযোগ দিয়ে দেখো অন্তত।”
প্রিয়ম মোনার হাত দুটো গভীর অনুরাগে চেপে ধরে অস্থির স্বরে বলল,
-“আমায় একবার বিশ্বাস করো মোনা, আমি কখনো তোমার বিশ্বাস ভাঙবো না। তুমি জানো না আমি তোমায় কত জায়গায় খুঁজেছি। কত বার তোমার বাসায় গিয়েছি। কত রাত তোমার বাসার বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কত বার তোমার ফোন বন্ধ হওয়ার সত্ত্বেও কল করেছি।”
মোনার নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিজের সিন্ধান্তে অটল। যেনো আবেগ অনুভূতি শূন্য একজন মানুষ। প্রিয়মের এত অনুনয় মোনার মন ছুঁতে পারছে না।
-“আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারব না, ভালোবাসতে পারবো না। আমার যেতে হবে এখন। আপনি প্লীজ আমার সামনে আসবেন না। এইটুকু বলার জন্যই আমি এখানে এসেছি।”
প্রিয়মের চোখ টলমল করছে। মোনা তাকালো সে দিকে একবার। মোনার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠল। কোন এক অজানা কারণে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভূত হলো। প্রিয়মের চোখের দিকে আর দ্বিতীয় বার তাকালো না মোনা। মোনা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি নিলো। প্রিয়ম বাঁধা দিলো না। মোনা’কে অস্থিরতা তাড়া করে বেড়াচ্ছে যেন। প্রিয়মের টলমল করা চোখ অবচেতন মনে মোনার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তীব্র এক যন্ত্রনার মুখোমুখি হলো মোনা। হাজার চেষ্টা করেও সেখান থেকে বের হতে পারছে না কোন ভাবেই। নিজের চিন্তা ভাবনা গুলো বার বার দিশেহারা হয়ে ছুটে যাচ্ছে প্রিয়মের দিকে। মোনা ওঁর চিন্তা ভাবনা গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
(চলবে)
মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২৬
মাঝরাত তখন। মোনা ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ মোনা ধড়পরিয়ে উঠে বসে। বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছে। ভয়ে মোনা আড়ষ্ট হয়ে আছে। হাত-পা নাড়াতেও ভয় করছে। মোনার পুরো শরীর ঘেমে একাকার। তীব্র একটা ভয় যেন মোনা’কে জড়িয়ে রেখেছে। খাট থেকে নেমে লাইট জ্বালানোর সাহস টুকু হারিয়ে ফেলেছে। হাত-পা ঈষৎ কাঁপছে। মোনার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে যেন। মোনা সাহস সঞ্চয় করে, খাট থেকে নেমে লাইট জ্বালালো। টেবিলের উপর রাখা এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে ফেললো। ভয়ে গলা শুকিয়ে মোনা তৃষ্ণার্ত হয়ে গেছে। মোনা ইমরুল চৌধুরী’কে স্বপ্নে দেখেছে। যেভাবে ছুরিঘাতে খুন হয়েছে, ঠিক সেই চেহেরা দেখেছে। গলা বরাবর ছুরির যে ভয়ঙ্কর আঘাত’টা ছিলো সেটাও স্পষ্ট দেখেছে মোনা। মোনার শ্বাস ভয়ে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোনার মনে হচ্ছে ও আশেপাশে তাকালেই দেখবে ইমরুল চৌধুরীর লাশ। মোনা তীক্ষ্ণ চাপা আর্তনাদ করে ওঠে। ইমরুল চৌধুরীর ক্ষত-বিক্ষত লাশ’টা মোনার গলা টিপে ধরেছে। মোনার মনে হচ্ছে এটা স্বপ্ন না, মোনার বাস্তবে দম বন্ধ হয়ে এসেছিল। মোনা থরথরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ফ্লোরে বসে পড়লো। ভয়ে মোনার শরীর অবশ হয়ে আসছে। উদভ্রান্তের মত হয়ে যায় মোনা।মোনা কাঁপা কাঁপা হাতে লিলি বেগমের ফোনে ডায়েল করে। কয়েকবার রিং হওয়ার পর লিলি বেগম কল রিসিভ করল। এত রাতে মোনা কল দিয়েছে দেখে কিছু’টা আতংকিত হয়। ঘুম জড়ানো চোখে ফোন রিসিভ করল। মোনা তীক্ষ্ণকন্ঠে আর্তনাদের মত বলল,
-“খালা আমায় মেরে ফেলবে,খালা তুমি তাড়াতাড়ি আসো। যেভাবে পারো আসো।”
মোনার গলার আওয়াজ’টা জোরালো না। প্রচন্ড ভীতি মোনায় আড়ষ্ট করে রেখেছে, মোনার গলায় আস্ত হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে যেন। হঠাৎ ঘুম ভাঙার ফলে লিলি বেগমের মস্তিষ্ক জড়াগ্রস্থ হয়ে রইল যেন। বুঝে উঠতে সময় লাগলো কিছু’টা। সে সময় টুকু পার হওয়ার পর লিলি বেগম দিশেহারা হয়ে গেলো। বিধ্বস্ত গলায় বলল,
-“মোনা কি হয়েছে তোর?কি বলছিস?কে মারবে তোকে?”
মোনা আর কিছু বলতে পারলো না।ভয়ে ভিতর থেকে কথা বের হচ্ছে না। লিলি বেগম প্রচণ্ড ভাবে আঁতকে উঠল, অস্থির হয়ে উঠে। মোনার নম্বরে বার বার ডায়েল করছে, ওপাশ থেকে কল রিসিভ হচ্ছে না।লিলি বেগম দ্রুত বিছানা ছাড়ে, মুহূর্তে’ই মনের ভিতর নানান শঙ্কা জাগে। কেউ মোনার বাসায় গিয়ে মোনা’কে মেরে ফেলছে? লিলি বেগম কিছু ভাবতে পারছে না , চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে যেন।প্রবল ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কোন উপায় না পেয়ে প্রিয়মের রুমে যায়। আতঙ্কগ্রস্ত গলায় প্রিয়ম’কে ডেকে তুলে। এভাবে ঘুম ভাঙানোর ফলে প্রিয়ম হতবিহ্বল হয়ে যায়। ঘুম ঘুম চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় লিলি বেগমের দিকে। লিলি বেগম শঙ্কিত গলায় বলল,
-“মোনার যেন কি সমস্যা হয়েছে, আমায় একটু ওঁর বাসায় দিয়ে আয়।”
প্রিয়ম চমকে গিয়ে অনার্গল ভাবে জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে মোনার?লিলি বেগম উত্তর দিচ্ছে না। চেহারায় স্পষ্ট ভীতি, শঙ্কা, আতঙ্কের ছাপ। পথ যেন ফুরায় না।প্রিয়ম অধৈর্য হয়ে বলল,
-“কি হয়েছে তা তো বলবে?”
লিলি বেগম মন্থর গলায় বলল,
-“জানি না,আগে চল।”
কলিং বেলের শব্দে মোনা প্রাণ ফিরে পায়। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে লিলি বেগমের গায়ে ঢলে পড়ে। নিশান নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছে। চারদিক শুনশান। লিলি বেগম কিছুই বুঝে উঠে পারছে না। এ মুহূর্তে লিলি বেগম আর কিছু ভাবছে না, শুধু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মোনা ভালো আছে এই ভেবে। মোনার শরীর শীতল হয়ে গেছে যেন। প্রিয়ম কি হয়েছে কিছুই বুঝতে না পেরে মোনার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।এখন কিছু জিজ্ঞেস করে উত্তর পাওয়া যাবে না,তাই কিছুই জিজ্ঞেস করল না। মোনার নিস্তেজ শরীর’টা লিলি বেগমের বুকে লেপ্টে আছে। লিলি বেগম অস্থির গলায় অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“মোনা কে মারবে তোকে?আমি এসেছি। ভয় পাস না।”
প্রিয়ম লিলি বেগমের পাশে বসে। চারদিকে তাকায়। চারদিকের পরিবেশ খুব স্বাভাবিক। প্রিয়ম লিলি বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“মোনা বাজে কোন স্বপ্ন দেখেছে হয়ত। ভয় পেয়েছে ভীষণ। চারদিকের পরিবেশ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।”
লিলি বেগম স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মোনার দিকে। মোনা নিস্তেজ, ক্ষীণ গলায় বলল,
-“খালা আমায় মেরে ফেলবে। আমার গলা টিপে ধরেছে। আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এসেছে। কি বিভৎস চেহেরা। নিশান’কে
ও মেরে ফেলবে। প্রতিশোধ নিবে।”
মোনার কথা শুনে ভাঁজ পড়ে লিলি বেগমের কপালে। মোনার কথা বুঝতে পারলো না। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বুঝতে পারলো মোনা খারাপ কোন স্বপ্ন দেখেছে। স্বপ্ন দেখে কেউ এত ভয় পায়?লিলি বেগমের কাছে অযৌক্তিক লাগলো। মোনা’কে যতটুকু চিনে তাতে কোন ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেও এত’টা ভয় পাওয়ার কথা না। প্রিয়ম হতাশ ভঙ্গিতে তাকালো লিলি বেগমের দিকে। বলল,
-“বুঝতে পেরেছো ও স্বপ্ন দেখেছে?”
মোনার নিস্তেজ হয়ে যাওয়া শরীর’টা খাটে শুইয়ে দিলো। লিলি বেগম প্রচন্ড ভয় পেয়েছিল। অবচেতন মনে নানান আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। প্রিয়ম’কে বলল,
-“মোনা জব শেষে রাতে বাসায় ফিরে।মোনা খুব স্ট্রং, সাহসী মেয়ে। স্বপ্ন দেখে ও এত ভয় পাবে?”
লিলি বেগম পাশের রুমের দিকে পা বাড়ায়।পানির জগ আনার জন্য। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আসা মোনার মুখের দিকে তাকালো প্রিয়ম। চোখ গুলো বন্ধ, ভয়ের রেশ যেন এখনো কাটে নি। প্রিয়মের ইচ্ছে হলো মোনার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ানোর। কি হবে না হবে ,এসব না ভেবে প্রিয়ম মোনার মুখের দিকে ঝুঁকে কপালে চুমু খায়। মোনা হয়ত সজাগ নয়ত সজাগ না।
লিলি বেগম পানি নিয়ে আসে।লিলি বেগম আসার আগেই প্রিয়ম দূরত্ব রেখে বসেছে মোনার পাশে। লিলি বেগম আহত গলায় বলল,
-“এত রাতে কি পাগলামি করল মেয়ে’টা দেখলি?কত ভয় পেয়েছি।”
লিলি বেগম মোনার পাশে শুয়ে পড়ল।প্রিয়ম পাশের রুমে গিয়ে শুইলো। প্রিয়ম মনে মনে পুলকিত হচ্ছে। কত কাছ থেকে দেখেছে মোনা’কে। কপালে চুমু খেয়েছে। প্রিয়ম কত মেয়ের ঠোঁটে চুমু খেয়েছে কখনো এমন অনুভূতি হয়নি। হৃৎপিণ্ড শীতল হওয়ার মত অনুভূতি। সামন্য কপালে চুমু খাওয়ার মাঝে এত সুখ নিমজ্জিত?
রাত আর খুব বেশি বাকি নেই। লিলি বেগম নামাজের জন্য উঠে। মোনার গায়ে হাত দিয়ে দেখে জ্বলে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।এখনো যেন ভয় কাটে’নি। লিলি বেগম মোনার নাম ধরে ডাকছে। কোন সাড়া নেই। লিলি বেগম চমকে যায়। মোনা অচেতন হয়ে আছে। লিলি বেগমের বুকের ভিতর ধ্বক করে হয়ে। স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছে ভেবে লিলি বেগম অত’টা ভাবেনি রাতে। কিন্তু এখন মোনার অবস্থা খুব খারাপ মনে হচ্ছে। কি হয়েছে রাতে মোনার সাথে?লিলি বেগম কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। রাতের ন্যায় হন্তদন্ত হয়ে প্রিয়ম’কে ডেকে তুলল। মোনার অবস্থা দেখে প্রিয়মও বিগড়ে যায়। কি হয়েছে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। স্বপ্ন দেখে কেউ এত ভয় পায়? প্রিয়ম মোনা’কে পাঁজাকোলে নিয়ে এলোমেলো পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামলো। গাড়ি’তে উঠালো, হসপিটালে নেওয়ার উদ্দেশ্যে। মোনার নিস্তেজ হওয়া শরীর’টা মোমের পুতুলের ন্যায়। লিলি বেগম দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে। প্রিয়মের মুখ’টাও রক্তশূন্য হয়ে আছে যেন।
দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা ধরে অচেতন হয়ে আছে মোনা। জ্বরের তাপমাত্রা যেনো ক্রমশ বাড়ছে। নিশান বিধ্বস্ত মুখে লিলি বেগমের পাশে বসে আছে। শূন্য দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। বার বার নিশানের চোখ ভিজে যাচ্ছে। মোনাই একমাত্র আশ্রয়স্থল, একমাত্র ভরসা নিশানের।
মোনার হুঁশ ফিতরে সময় লাগলো বেশ। জ্বর ধীরে ধীরে কমে আসছে। লিলি বেগম বার বার অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করছে,
-“কি হয়েছিল তোর?কি স্বপ্ন দেখেছিস মোনা?”
মোনা নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কোন জবাব দিলো না।মোনা’কে বাসায় নেওয়া হলো। প্রিয়ম বার বার লিলি বেগম’কে বলেছিল,
-“আমাদের বাসায় নিয়ে চলো।”
মোনা এই গুরুত্বর অবস্থায়ও তীব্র প্রতিবাদ করলো। লিলি বেগমের বাসায় যাওয়ার ব্যাপারে মোনার এত বিমুখতা লিলি বেগম’কে ভাবায় মাঝে মাঝে।
মোনা দিনের বেলায়ও যেন ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। বার বার আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বলে ওঠে,
-“খালা, আমি চোখের উপর শুধু বাবার বিভৎস মুখ দেখি। আমায় বোধ হয় মেরে ফেলবে।”
লিলি বেগম এখন মোনার পাশেই থাকতে হয় সারাক্ষন।লিলি বেগম ভাবে ইমরুল চৌধুরীর খুন হওয়া লাশ দেখে মোনা ভয় পেয়েছিল, সেই ভয় নতুন করে নাড়া দিয়েছে। ভার্সিটি, জব ওসব কিছুই যেন মনে নেই মোনার। মোনা নিস্তেজ অবস্থায় বিছানায় পড়ে থাকে। লিলি বেগম চোখের আড়াল হলেই মোনা চিৎকার দিয়ে উঠে শুধু। মোনা উদভ্রান্তের মত হয়ে গেছে। পৃথিবীর কোন খেয়াল নেই ওঁর।
কয়েকদিন হয়ে গেলো মোনার অবস্থার তেমন উন্নতি হলো না। প্রিয়ম রাতে বাসায় থাকলেও, দিনে কয়েকবার আসে মোনার বাসায়। মোনার পাশে বসে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। স্থির দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে মোনার দিকে। কোন রাগ,জিদ, তেজ কিছুই নেই মোনার। মোনার এই অবস্থা প্রিয়ম’কে পীড়া দিচ্ছে ভীষণ ভাবে। হঠাৎ মোনার এই অবস্থা প্রিয়ম মানতে পারছে না। প্রিয়মের বুকের ভিতর ভারী হয়ে আসে বার বার। বুকে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভূত হয়, বুক চিঁড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসে।
লিলি বেগম ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লো। কিছু সময়ের ব্যবধানে কেমন হয়ে গেলো মোনা। প্রিয়ম বলল,
-“আম্মু মোনার চিকিৎসার জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট দরকার, মোনা মানসিক ভাবে বিপর্যয়গ্রস্থ হয়ে পড়েছে।”
প্রিয়ম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-“আচ্ছা খালু খুন হয়েছিল কিভাবে?”
(চলবে)