#মেঘের_পালক
পর্ব-৯

এক বছর পর…

বিয়েবাড়িতে এসে খাওয়ার সময়ে অরিনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। জায়গার তুলনায় অতিথি অনেক। এক ব্যাচ খেয়ে ওঠার আগেই অন্যরা সেই টেবিলের চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ বসার বৃথা চেষ্টা করে সে চলে গেল সেখান থেকে। ভিড় কমলে নাহয় খাবে।

হাঁটতে হাঁটতে করিডোরে এসে দাঁড়াল সে। মা জোর করে এসব অপরিচিত লোকের বিয়েতে নিয়ে আসে। মায়ের বান্ধবীর মেয়ের বিয়ে। দাওয়াত সবাইকে করলেও বাবা আর ভাই সুযোগ পায়নি আসার। তাকে বাগে পেয়ে ধরে এনেছে। মা আবার কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। খাবারের লাইনে সুবিধা করতে না পেরে বান্ধবীর সাথে গল্প জুড়ে দিয়ে হেঁটে কোনদিকে গেল ঠিক বুঝতে পারেনি অরিন। সে একাই ঘুরে বেড়াতে শুরু করল।

বিয়ের কনে ভারি সুন্দর দেখতে! লাল টুকটুকে বউ একেই বলে। তার ওপর ভীষণ লাজুক। চোখই তুলছে না। আজকালকার বউ আবার এমন হয়?

করিডোরে দাঁড়িয়ে সে আজকের মেঘলা আকাশ দেখল। তার জীবনটা এত দ্রুত বদলে যাচ্ছে! সবকিছু অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। সে ফাইনাল ইয়ারে উঠে গেছে। বাসা থেকে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলের সাথে কথাও হয়৷ কিন্তু কেন যেন কিছুই ভালো লাগে না!

সেই যে প্লাবনের সাথে তীব্র ঝগড়া আর প্রেম মিলে তিনদিনের ছোট্ট সম্পর্ক হয়েছিল, সেটার রেশ এতদিন রয়ে যাবে কে জানত! এখনও সে সেই মানুষটাকে মিস করে যার সাথে তার কখনো কথা বলার অভ্যাসটাও গড়ে ওঠেনি!

ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে উঠেছিল সে৷ ফোনের শব্দে ঘোর ভাঙল। সাজ্জাদের ফোন। ধরল না অরিন। কেন যেন লোকটাকে উটকো ঝামেলা মনে হয়। অথচ ভালো লোক। অরিনের মনে এখনো সেই বড় বড় চোখের লম্বা ছেলেটার অবয়ব ভাসে যাকে দেখলে এক অপূর্ব আনন্দে মন পূর্ণ হয়ে যেত! আহা!

আবারও সেই স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে যেতে থাকল অরিন৷ দেখল পাগড়ি মাথায় দাঁড়িয়ে প্লাবন। হাসিমুখে বিয়ে করতে আসছে! এমন স্বপ্ন বহুবার দেখেছে অরিন।

হঠাৎ মনে হলো স্বপ্ন কোথায়? সে যা দেখছে তা তো সত্যি! এটা কি প্লাবন? হ্যাঁ প্লাবনই তো! কিন্তু কী করে সম্ভব? এই বিয়ের বর সে? অরিনের কেমন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে বরের গাড়ি থেকে পাগড়ি মাথায় শেরওয়ানি পরা মানুষটাকে। প্লাবন!

অরিনের মনটা টুপ করে বিষন্নতার আঁধারে ডুবে গেল। কি হাসিমুখ মানুষটার! অবশ্য যা হয়েছে ভালো হয়েছে। ফ্রড দুই নাম্বার লোকের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে।

কিন্তু প্লাবনের বিয়ের কথা অর্নব কিছু বলল না কেন? সম্ভবত কপি করা চিঠিটা ধরা পড়ার পর অর্নবের সাথে যে বিশাল ঝগড়া হয়েছিল তার আর মৌটুসীর, সেজন্য সেই ব্যাপারে আর কথা বলতে আগ্রহ পায়নি অর্নব নিজেই। যাক, ভালো হয়েছে। আশা করা যেতে পারে প্লাবন তার স্ত্রীকে ভালো রাখবে।

অরিন নিজের নামে ডাক শুনে পেছন ফিরল। মা এসেছেন।

“কখন থেকে ডাকছি! শুনিস না কানে? খাবি না?বরপক্ষ চলে এলো যে!”

“খাব না মা।”

“সেকি!”

“হুম। খিদে চলে গেছে খাবারের গন্ধে।”

“তুই না খেলে চলে যা। আমাকে যেতে দেবে না এখনই।”

“থাকো তুমি। আমি চলে যাব।”

“আচ্ছা।”

মাকে দেখা গেল রীতিমতো ব্যস্ত৷ চলে গেল সেখান থেকে।

অরিন চলে যাবে ভেবেও যেতে পারছে না৷ কেন যেন ইচ্ছে করছে বর বউকে একসাথে দেখতে। সে দাঁড়িয়ে রইল।

মিনিট কয়েক পর কোথা থেকে খুব সুন্দর দেখতে এক স্বাস্থ্যবান এক মহিলা এসে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি শাহিদার মেয়ে না?”

“জি।”

“শাহিদা এসেছে?”

“জি।”

“আমার সাথে চলো তো, তাড়াতাড়ি!”

“কেন?”

“গেট ধরতে হবে। শালির সংখ্যা যত বেশি হবে টাকা তত বেশি উঠবে।” বলতে বলতে মহিলা তাকে একেবারে টেনে নিয়ে গেলেন৷ দাঁড় করিয়ে দিলেন সামনে৷

অরিন জমে শক্ত হয়ে গেল। প্লাবনের একেবারে সামনে এসে পড়েছে সে! প্লাবন দেখলে কী করবে? কিছু বলে বসবে না তো?

কিন্তু অরিনকে অবাক করে দিয়ে প্লাবন তাকে দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না৷ কয়েক পলক নির্বিকারভাবে তাকিয়ে থেকে এত ঝগড়াঝাঁটির মধ্যেও একবার হাই তুলল। তারপর টাকাপয়সার ঝামেলা মিটিয়ে বিয়ে করতে ঢুকে পড়ল।

একটা বড় সোফায় একগাদা বন্ধুর সাথে বসে আছে প্লাবন। অরিন নিজের মনেই কেন যেন বউয়ের সাথে নিজেকে তুলনা করতে শুরু করল৷ মেয়েটা কিভাবে প্লাবনের সাথে মানায়? প্লাবনের এমন মেয়েই পছন্দ ছিল? সে কি শুধরে গেছে? কে জানে!

অরিন আর গেল না। দাঁড়িয়েই রইল। বিয়ে পড়ানোর সময়ও সে আশেপাশেই ঘুরঘুর করতে থাকল।

কাবিন নামায় সই করার জন্য যখন কাজি এলো, অরিনের হঠাৎ চোখে পানি চলে এলো। মনে পড়ে গেল তার হাত কেটে যাওয়া আর প্লাবনেই খাইয়ে দেবার দিনটা। আজ সেই মানুষটার বিয়ে দেখতে হচ্ছে চোখের সামনে। কি অদ্ভুত জীবন! প্লাবনকে কি তার প্রাক্তন বলা যায়? নাকি সেটা একতরফা ভালোবাসা ছিল? প্লাবনের দিক থেকে তো কিছু ছিলই না৷

কাজি যখন বিয়ে পড়ানো শুরু করবে, তখন প্লাবন হঠাৎ একটানে পাগড়ি খুলে ফেলল। সেটা নিয়ে পাশের জনের মাথায় পরিয়ে দিয়ে জোরে জোরেই বলল, “তোর জিনিস তুই পর ভাই। অনেকে আবার ভাবছে আমারই বোধহয় বিয়ে।”

বলে অরিনের দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিল। অরিনের গা জ্বলে গেল। তবে মনটা বোধহয় জ্বলা অবস্থা থেকে ফের ঠান্ডা পানিতে এসে পড়ল!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here