মেঘের_আড়ালে_মেঘ”২৫”
#জেরিন_আক্তার_নিপা

ইরফান হুমায়রাকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো। হুমায়রা এখনও হাঁপাচ্ছে। ইরফান ওকে পানির বোতল কিনে দিয়ে বলল,

“তোমার এই রূপ সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। আমি জাস্ট স্পিচলেস। তোমার রাগ হামনার থেকেও বেশি। ভাগ্য ভালো আমি হামনার জায়গায় তোমাকে বিয়ে করিনি। তাহলে তো এতদিনে আমার জীবন পুরোই তেজপাতা বানিয়ে ফেলতে।”

ইরফান ঠিকই হুমায়রার মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। তার উপর দিয়ে কোন ঝড় বয়ে যাচ্ছে এটা ইরফানের থেকে ভালো এখন কেউ বলতে পারবে না। তবুও সে হুমায়রাকে হাসানোর জন্য এসব কথা বলে যাচ্ছে। ওর মনটা যদি একটু হালকা করা যায়।

“মনের সব জ্বাল মিটিয়ে এসেছি দুলাভাই। মুখে ড্রিঙ্কস ছুঁড়ে মেরেছি। মাথায় নুডলস ঢেলেছি। হাত থেকে আংটি খুলে নিয়ে সবার সামনে অপমান করেছি। তবুও মন ভরছে না। একটা চড় মারতে পারলে দিল খুশ হতো। মুখে বলতে বলতে হাতের কামাল দেখাতে পারলাম না। ঠাটিয়ে একটা চড় মারা উচিত ছিল। কী বলুন?”

“হুম। সবকিছুই ঠিক ছিল। শুধু মাঝ থেকে চড়টা বাদ পড়ে গেছে। জোরে ঠাস শব্দে একটা চড় হলে সিনটা জমে ক্ষীর হয়ে যেত।”

“এখন যাব? চড়টা তোলা থাকবে কেন? এখনই দিয়ে আসি? পরে যদি আর সুযোগ না পাই।”

“ওই পাগল! পাবে, পাবে। পরেও আরো অনেক সময় পাবে। এখন আর গুণ্ডিগিরি করতে হবে না।”

“গুণ্ডিগিরি আপনি করতে দিলেন কই? হাত ধরে রেখেছেন। ডায়লগ গুলোও পুরোপুরি বলতে দেননি। তার আগেই টেনে নিয়ে এসেছেন।”

“চলো তোমাকে বাসায় নামিয়ে দেই।”

“না। আমি একা যেতে পারব। আপনি আয়ামকে স্কুল থেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান।”

“তর্ক বা জেদ কোনোটাই করবে না। এখন আমি তোমার কোন কথা শুনব না। গাড়িতে উঠো।”

হুমায়রার হাত কাঁপছে। সে বুঝতে পারছে অসুস্থ হয়ে পড়ছে সে। দুলাভাইকে কোন ভাবে বাড়ি পাঠাতে পারলে সে রাস্তায় বসেই কতক্ষণ কাঁদত। এভাবে কান্না চেপে রেখে দম বন্ধ হয়ে আসছে। ক্রমশ শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। গাড়িতে বসে হুমায়রা পানির পুরো বোতল শেষ করল। ইরফান তা লক্ষ করলেও কিছু বলল না। হুমায়রাই নিজ থেকে বলল,

“তাহলে আপনাদের বিয়েটা নাটক ছিল? আপনারা তিন জন মিলে আমাদের চোখে ধোঁকা দিয়েছেন! ”

“আমার হাতে তখন অন্য কোন উপায় ছিল না। এই একটা রাস্তাই খোলা ছিল আমার কাছে।”

“তবুও দুলাভাই আপনার এই কাজে আমি মোটেও সমর্থন করতে পারছি না। শেষে কিনা আপনিও ওই বাটপার ফ্রড লোকের সাথে চুক্তিতে গেছেন!”

“পুরো ব্যাপারটাই যে এতটা ঘোলাটে হয়ে যাবে তা আমি তখন কল্পনাও করতে পারিনি।”

“মেহরীনকে অন্ধকারে রাখা আমাদের ঠিক হচ্ছে না। চলুন ওকে এক্ষুনি অনন্তর ব্যাপারে সব সত্য বলে দেই।”

“সেটা এখন আর সম্ভব না। তুমি আমার স্ত্রীর বোন। আমাকে অনেক বছর ধরে চেনো। আমাদের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক আছে। তাই তুমি আমার মুখের কথাতেই বিশ্বাস করে নিয়েছ। মেহরীন আমাকে ভালো করে চিনেই না বলতে গেলে। আমার সম্পর্কে তাকে কী ধারণা সেটা আমি জানি না। আমাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। সে কেন আমার মুখের কথা বিশ্বাস করতে যাবে?”

“তাহলে ওকে সামনে রেখে অমানুষটার মুখোশ খোলা উচিত ছিল।”

“তাতেও বিশেষ একটা লাভ হতো না। এতদিনে আমি মেহরীনকে যতটা চিনেছি, সে অনন্তর প্রতিটা কথা চোখ কান বুজে বিশ্বাস করে। ওর সামনে অনন্তকে তুমি অপমান করলে বরং সে কষ্ট পেত। অনন্তর সাইড নিত। উল্টো তোমাদের সম্পর্ক খারাপ হতো।”

“অনন্ত আমার সাথে এনগেজমেন্ট করেছে। এটা জানার পরও মেহরীন অনন্তকে বিশ্বাস করত!”

“অনন্তকে তুমি এখনও চেনো না। সে তোমাদের এনগেজমেন্টের ব্যাপারটাকেও কোন না কোন বাহানা দিয়ে মেহরীনকে মানিয়ে নিত।”

“তাহলে আমরা মেহরীনকে ওই লোকের আসল চেহারা কীভাবে দেখাব। মেহরীন ভুল করে যাবে আর আমরা তা চুপচাপ দেখব!”

“না। তার জন্য হাতেনাতে অনন্তকে ধরতে হবে। তবেই মেহরীন বিশ্বাস করবে।”

“আমি আগে শুধু মেহরীনকে ভালো মনের মেয়ে ভাবতাম। এখন দেখছি মেহরীনের মত বোকা মেয়ে দু’টা নেই। কেউ কাউকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে কীভাবে?”

” এক্ষেত্রে মেহরীনকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বাবা মা হারা মেয়েকে ভাই যখন বাড়ি থেকে বের করে দেয়। যখন তার পাশে আপন বলতে কেউ নেই। এই পৃথিবীতে পুরোপুরি একা সে, তখন যদি কেউ তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তার হাত ধরে। তাকে ভালোবাসে বলে দাবি করে, তখন যে কোন মেয়ে সেই মানুষটাকে অন্য সবার থেকে বেশি গুরুত্ব দিবে। মেহরীনের খারাপ সময়ে অনন্ত তার পাশে থেকে তার বিশ্বাস অর্জন করেছে। আর সেই বিশ্বাসের জোর নিয়েই দিনের পর দিন মেয়েটাকে ঠকিয়ে যাচ্ছে।”

ইরফান হুমায়রাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। হুমায়রা আজ তাকে একবারও ভেতরে যেতে বলল না। ইরফান চলে গেলে হুমায়রা ক্লান্ত পায়ে লিফটে করে ওদের ফ্লোরে চলে এলো। এখান থেকে হেঁটে রুমে যাওয়ার মত শক্তি হুমায়রার শরীরে নেই। পা দু’টো যেন অবশ হয়ে আসছে। চোখ জ্বালা করছে। চোখের সামনে সব ঘোলাটে আর অন্ধকার লাগছে। কোনোভাবে নিজের শরীরটাকে বয়ে নিয়ে হুমায়রা রুমে চলে এলো। ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে হুমায়রা দরজার সামনেই হেলান দিয়ে বসে পড়লো। চিৎকার করে সে কখনো কাঁদতে পারে না। আজও পারছে না। দুই হাতে মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।

“আমার সাথেই কেন এমন হয়? আমি যা চাই তা কেন কখনও পাই না। অনন্ত… অনন্ত আমাকে ব্যবহার করেছে! সে আমাকে ভালোবাসে না।”

ফ্লোরে শুয়ে পড়ে হুমায়রা কাঁদছে। ইরফানের মুখ থেকে অনন্তর সত্য শোনার পর ভেতর থেকে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে সে। তবুও দুলাভাইয়ের সামনে নিজেকে শক্ত প্রমাণ করেছে। ভেঙে পড়েনি সে। অনন্তর সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস তার ছিল না। ওর সামনে দাঁড়িয়ে এতগুলো কথা বলার সময় তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ওদের শুধু বিয়েটাই তো বাকি ছিল। সে অনন্তকে মন থেকে স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছিল। ভালোবেসে ছিল ওকে। বিয়ে পরে একসাথে ওদের ছোট্ট একটা সুখের সংসার হবে। বাচ্চাকাচ্চা হবে। কত স্বপ্নই না দেখে ফেলেছিল হুমায়রা। আজ তার সব স্বপ্ন মিথ্যা হয়ে গেল। যাকে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখেছে, সেই মানুষটাই যে মিথ্যা।

“আপু আমি কেন তোর মত ভাগ্য নিয়ে দুনিয়ায় এলাম না? তুই এই পৃথিবীতে নেই। আর কখনো ফিরে আসবি না। তবুও দুলাভাই এখনও শুধু তোকেই ভালোবাসে। মেহরীন তোর মত দেখতে হলেও দুলাভাই ওকে তোর জায়গা দিতে পারে না। আর আমার ভাগ্যটা দেখ। এই জীবনে কখনো কাউকে ভালোবাসিনি আমি। আর এখন যাকে ভালোবাসলাম, সে আমাকে ভালোবাসে না। আমাকে ঠকিয়েছে সে। আমার ভাগ্যটা কেন এত খারাপ। বাবাকে আমি কী বলব? বাবা যখন জানতে পারবে তখন আমি বাবাকে কীভাবে সামলাবো? তুই তো আমাদের ছেড়ে গিয়ে দিব্যি আছিস।”

হুমায়রার বুকে কষ্ট হচ্ছে। কান্না আটকে আসছে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে দম নিতেও কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে এখন সে মরে গেলেই ভালো হতো।
.
ইরফান বাড়ি ফিরে এলে মেহরীন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে ওর কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,

“সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট না করে কোথায় বেরিয়েছিলেন আপনি? কাউকে কিছু বলে যাননি। ফোন ধরছেন না। বাবা আপনার জন্য চিন্তা করছে। মানুষকে টেনশন দিতে আপনার ভালো লাগে, না?”

ইরফান মেহরীনের সাথে কোন কথা বলল না। সে রুমের দিকে এগোতে লাগল। মেহরীনও ফোলা পা নিয়ে ওর পেছন পেছন যাচ্ছে।

“কী হলো? কথা বলছেন না কেন? আচ্ছা আপনি এমন কেন বলুন তো। মাঝে মাঝে আপনার কী হয়? এখন আবার কথা বন্ধ করে দিয়েছেন কেন?”

ইরফানের রাগ লাগছে। অনন্তর উপরের সব রাগ মেহরীনের উপর এসে পড়েছে। মেহরীনের জন্যই এতসব। অনন্ত তো ওকে ভালো রাখার জন্যই এসব করছে। মেহরীন না থাকলে অনন্ত হুমায়রাকে ধোঁকা দিতো না। তার সাথে যদি মেহরীনের দেখাটাই না হতো।
ইরফানকে শার্ট বের করতে দেখে মেহরীন বলল,

“এখন অফিসে যাবেন নাকি? আজ তো অনেক দেরি হয়ে গেল। আপনি খাবেন না? না খেয়ে অফিসে যাবেন। কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?”

ইরফান মেহরীনের বকবক আর নিতে পারছে না। সে রেগে গিয়ে শার্ট ফ্লোরে ছুড়ে মারল। চেঁচিয়ে বলল,

“আমি কোথায় যাব না যাব তা আপনাকে বলে যেতে হবে? আপনি আমার কে হোন? আমার সব কথা আপনাকে কেন বলতে হবে? ভুলে যাবেন না, আপনি আমার বউয়ের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। সত্যি সত্যি আপনি আমার বউ না। আপনি আয়ামের মা না। বাবার ছেলের বউ না। এই বাড়ির সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই। অভিনয় করছেন আপনি। আপনার কাজ শেষ হলে চলে যাবেন। তাই আমার ব্যাপারে নাক গলাতে আসবেন না। আমার বউ হওয়ারও চেষ্টা করবেন না।”

ইরফান কথাগুলো বলে এক মুহূর্ত এখানে দাঁড়াল না। মেহরীন ওর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ছলছল করছে তার। হঠাৎ করে সে কী এমন করলো যার কারণে ইরফান তাকে এভাবে কথা শুনিয়ে গেল। সে জানে এই বাড়ির কারো সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। তাকে একদিন সবাইকে ছেড়ে এই বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে। সে যাবেও।

“আমি আপনার বউ হওয়ার চেষ্টা করছি! আপনি কোথায় গিয়েছিলেন এটা জানতে চাওয়া আমার অপরাধ! আমি জানি আমি আয়ামের মা না। আপনার বাড়ি থেকে তো চলেই যাব আমি। তবুও আপনি আমার মুখের উপর এই কথাগুলো বলতে পারলেন! আমার খারাপ লাগার দিকটা একবারও ভাবলেন না।”

টুপ করে মেহরীনের চোখ বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। মেহরীন চোখ মুছতে মুছতে বলল,

“আপনার মন পাথর। আপনার কাছে মানুষের অনুভূতির এক পয়সাও দাম নেই। নিজের দিকটাই ভাবেন শুধু। আসলে আপনি একটা স্বার্থপর। আপনার উপকার করার জন্যই তো আমি এই বাড়িতে আছি। নিজের দরকারে আপনি আমাকে এখানে রেখেছেন। আমি এখানে থাকার পেছনে আমার নিজস্ব কোন স্বার্থ নেই। আপনি পৃথিবীতে একজনকেই ভালোবাসতে শিখেছেন। অন্য কারো মন বোঝার ক্ষমতা আল্লাহ আপনাকে দেয়নি। চলেই যাব। এবাড়িতে সারাজীবনের জন্য থাকতে এসেছি নাকি আমি? কাল চলে যাওয়ার থেকে ভালো আজই চলে যাব। এখানে থেকে নিজের আত্মসম্মানে কাউকে আঘাত করতে দেব না। যারা আমার কথা ভাবে না আমি কেন তাদের কথা ভাববো? আয়ামের মা আমি কখনও হয়ে উঠতে পারব না। আপনি এটা আজ আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।”

চলবে___

পর্ব ছোট হয়েছে বলবেন না। কারণ আপনারাই বলেছিলেন, রোজ ছোট পর্ব হলেও চলবে। একদিন পরপর দিলে বড় পর্ব দিতে পারব। কারণ লিখতে সময় লাগে। এমনিতেই চোখে সমস্যা। মাথা ব্যথার জন্য চশমা নিতে হয়েছে। অনেক সময় ধরে ফোন হাতে রাখলে আম্মুর বকা ফ্রি 🌚
সবার গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। আর হ্যাঁ, গল্পটা যেহেতু আমি লিখছি তাই কাহিনীও আমার উপরই ছেড়ে দিন। মেহরীন ঠিক সময়েই সত্য জানতে পারবে।

গল্প সম্পর্কিত সকল ধরনের পোস্ট, আলোচনা, সমালোচনা, আড্ডা গ্রুপে করতে পারেন।
গ্রুপ লিংক
https://www.facebook.com/groups/928548141001685/?ref=share

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here