“মায়ার_বাধঁন”পর্ব ৫

৫..★★★★
-কীরে কখন এলি?
ভাবির ডাক শুনে চোখ মুছে পেছন ফিরে কিছু বলতে যাবো এমন সময় ভাইয়াও রুমে প্রবেশ করে।
ভাইয়াকে দেখে আর চোখের পানি লুকাতে পারলাম না।ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে নিরবে কান্না করতে লাগলাম।ভাইয়াও বাধা দিলো না।
কিছুক্ষন পর ভাইয়া আমার চোখ মুছে দিয়ে ভাবিকে বাবার পাশে বসতে বলে আমাকে নিয়ে বাইরে চলে এলেন।
-কীরে কখন এলি !আর তোর শরীরের এই অবস্থা কেনো।
ভাইয়ার কথা শুনে বললাম,
-এই একটু আগেই এসেছি।আর শরীরের অবস্থা…বাদ দাও তো!আগে বলো বাবার শরীর এখন কেমন?
-চিন্তা করিস না!আগের থেকে এখন একটু ভালো আছেন।
আচ্ছা বলতো তোর বাসাতে কী হয়েছে!তোর শশুর বাবাকে ফোন করে কী জানি বললেন আর বাবার সাথে সাথে হার্টের প্রবলেম শুরু হলো।বাবার এমনিতেই হার্টের
প্রবলেম তার উপর তোর শশুর না জানি কী এমন কথা বলেছেন!সাথে সাথেই বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন!আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে আমি দেশে ছিলাম নয়তো বাবার সাথে খারাপ কিছু ঘটে যেতো।
ডাক্তারও বার বার বলেছে,বাবাকে সঠিক সময়ে হসপিটালে নিয়ে আসায় উনি এ যাত্রায় বেঁচে গেছেন!নয়তো…..
ভাইয়া দ্রীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
আমি ভাইয়ার কথা শুনে একেবারে থ হয়ে দাড়িঁয়ে আছি।আমার কারনে বাবা আজ হসপিটালে।
-আচ্ছা তোর বাসাতে কী কিছু হয়েছে!
ভাইয়ার কথা শুনে আমি ভাইয়াকে সায়ান আর সানার ব্যাপারে সবকিছু খুলে বললাম।
হঠাৎ ভাবি বলে উঠলেন,
-তোর কারনেই সব কিছু হচ্ছে!কে বলেছিলো তোকে গেঁয়ো ভূত সাজতে।পর্দা করে চলিস ভাল কথা তাই বলে উনার বন্দুরা আসলে সামনে বের হবি না, একটু বাইরে যাবি না,পার্টিতে যাবি না!ও গড!তার উপর তো আজ চার বছর হলো একটা সন্তানের মুখও দেখাতে পারিস নি!সায়ান ভাই বলে তো এত দিন সহ্য করে ছিলেন!অন্য কেউ হলে কখনোই তোর সাথে সংসার করতো না!
এজন্যই তো মনে মনে চিন্তা করতাম সায়ান ভাইয়ের মত ছেলে শালিকার দিকে এত নজর দেয় কেনো?উনারই বা দোষ কোথায়!ঘরের বউই যদি মন মতো না হয় তাহলে স্বামীরা তো বাইরের দিকে নজর দিবেই!
আচমকা ভাবির কথাগুলো শুনে খুব কষ্ট লাগলো!
ভাইয়াও ভাবির কথার কোনো প্রতিবাদ করলেন না।নিরবে সব শুনে গেলেন।
আসলেই সব ভাইয়ারা সমান হয় না।লোকে বলে ভাইরা বিয়ের পর বদলে যায় আর আমার ভাইয়া তো বিয়ের আগেও অন্যরকম ছিলেন এখন তো আরও বদলে গেছন!আমার ভাইয়া নিজে বিয়ে করার জন্য এরকম দ্বীনহীন এক ছেলের কাছে আমাক কোন রকম গছিয়ে দিয়ে ঘর খালি করলেন।আমি তো সব কিছু আমার ভাগ্য হিসেবে মেনে নিয়েছি।
তারপরও চোখের অশ্রু তো আর বাধা মানে না।
বাবার পাশে বসে নিরবে কেঁদে চলছি। কিছুক্ষণ কান্না করার পর মনটা অনেক শান্ত হয়।
হঠাৎ বাবা চোখ খুলে আমার দিকে তাকিঁয়ে বলে উঠলেন,
-কীরে মা!এভাবে কান্নাকাটি করে চোখ -মুখ ফুলিয়ে রেখেছিস কেনো?দেখ আমি তো এখন ভাল আছি।
বাবার মুখে “মা”ডাক শুনলে মনে হয় নিমিষেই সব দুঃখ-কষ্ট উধাও হয়ে যায়।
বাবাকে দেখে শত কষ্টে থাকা সত্বেও মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,-বাবা এখন কেমন লাগছে!
-এখন বেটার ফিল করছি রে মা!
বাবার কথা শুনে চেয়ারে বসেও বাবার কাঁধে মাথা রাখলাম!বাবা শুয়ে শুয়েই আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন!
আমি কিছুটা আহ্লাদি স্বরে বললাম,
-আচ্ছা বাবা ডাক্তার তোমাকে বার বার বলে চিন্তামুক্ত থাকতে!অযথা আমাকে নিয়ে কেনো চিন্তা করো!আজ যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারতাম না।
-তোর পরিবারে এতকিছু হচ্ছে আর আমাকে তুই কিছুই জানাস নি!
বাবার কথা শুনে বললাম,-বাবা তুমি এমনিতেই হার্টের রোগী!তোমাকে এসব জানিয়ে চিন্তায় ফেলতে চাই নি!আর ভাইয়া তো উনার বউ-বাচ্চাকে নিয়েই বিজি!আমার সুখ-দুঃখ শুনার জন্য উনার সময় কই!যখনই ফোন দেই ভাবি ফোন ধরে এটা-ওটা বলে রেখে দেন।
যাক সেসব কথা!বাবা তুমি চিন্তা করো না।আল্লাহ যা করেন বান্দার ভালোর জন্যই করেন।এতেও নিশ্চই ভালো কোনো দিক আছে।
বাবা আমার কথা শুনে দ্রীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,আমারই ভুল রে মা! আমার ছেলেকে তো মানুষ করতে পারি নি সাথে করে আমি আমার মা-বাপ মরা এতিম ভাতিজিটাকেও সঠিক শিক্ষা দিতে পারি নি।তুই তো প্রায়ই আমাকে বলেছিস দাইয়ুস সম্পর্কে কিন্ত আমি সেসব কথা কানে নেই নি!ভেবেছি আমার এতিম ভাতিজিটা কোনভাবে না বুঝুক যে আমরা ওকে আপন না ভেবে ওর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছি।আগে যদি ওকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করতাম তাহলে সে বড় বোনের জামাইর সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হতো না!
আমি বাবার কাঁধ থেকে মাথা তুলে বললাম,বাবা দাইউস কাকে বলে জানো এবং দাইউস ব্যক্তির পরিণতি কি?
বাবা বললেন,- না রে মা!তুই তো প্রায়ই বলতি আমি সেসব কথা কানে দিতাম না!
আমি বললাম,
দাইউস হলো সে ব্যক্তি যে তার পরিবার পরিজনকে সঠিক রাস্তায় পরিচালনা করেন না এবং পরিবার পরিজন সঠিক ভাবে না চললেও ভালো মনে করে বা প্রতিবাদ করে না।
অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি তার স্ত্রী-সন্তানদের বেপর্দা বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার সুযোগ দেয় তাকেও দাইউস বলা হয়।
♻ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন যে, “আল্লাহ তিন ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম করেছেন। মাদকাসক্ত, পিতা-মাতার অবাধ্য এবং দাইউস, যে তার পরিবারের মধ্যে ব্যভিচারকে প্রশ্রয় দেয়” (মুসনাদে আহমাদ: ২/৬৯)
♻ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন : ‘দাইউস ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহ্‌র রাসূল (সাঃ)! দাইউস কে? উত্তরে রাসুলূল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘যে ব্যক্তি তার পরিবারে আল্লাহ্‌র আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোন তৎপরতা অবলম্বন করে না বরং উপেক্ষা করে চলে।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, ‘দাইউস হল সে, যে তার পরিবারে বেহায়পনার বাস্তবায়নে সন্তষ্ট ও পরিতুষ্ট।’ (আহমদ)
♻ কোরআনে আল্লাহ বলেন, “তোমরা নিজেরা জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা কর এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর। যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর; যার উপর নিয়োজিত রয়েছেন কঠোর হৃদয় সম্পন্ন ফিরিশতাগণ, তারা আল্লাহ যা নির্দেশ করেন তা বাস্তবায়নে অবাধ্য হোন না, আর তাদের যা নির্দেশ প্রদান করা হয়, তা-ই তামিল করে’’।
( সূরা আত-তাহরীম: ৬)
♻ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্বাধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, রাষ্ট্রনেতা তার প্রজাদের সম্পর্কে দায়িত্বশীল আর তাকে তাদের পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন পুরুষ লোক তার পরিবারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, তাকে তাদের পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন মহিলা তার স্বামীর ঘরের সার্বিক ব্যাপারে দায়িত্বশীলা, তাকে সেটার পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন পরিচারক তার মালিকের সম্পদের সংরক্ষক, আর তাকে সেটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এক কথায় তোমরা সবাই দায়িত্বশীল আর সবাই জিজ্ঞাসিত হবে সে দায়িত্ব সম্পর্কে”। (বুখারী : ৭১৩৮; মুসলিম: ১৭০৫)
♻ আমি যদি নিজেকে মুসলমান হিসাবে দাবী করি তাহলে অবশ্যই কোরআন হাদীস মেনে চলবো। উপরের কোরআন ও হাদীস গুলো যদি নিজের সাথে মিলিয়ে নেই তাহলে কি দেখতে পাবো ? আমি কি সঠিক ভাবে আমার দায়িত্ব পালন করছি ? আমার পরিবার কে সঠিক নিয়মে পরিচালনা করছি ? আমি জোর গলায় বলতে পারি, বর্তমানে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া কেউ আমরা নিজেরাতো সঠিক নিয়মে চলছি না বরং পরিবারকেও আমরা ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছি।
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব,
.
-বাবা আল্লাহ দয়ার সাগর।আল্লাহর কাছে একাগ্রচিত্রে ক্ষমা চাও আর ভাইয়া-ভাবি,সানার হেদায়েতের জন্য দোয়া করো ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তোমাকে নিরাশ করবেন না।
বাবা বললেন,হ্যা রে মা।চেষ্টা করবো!আল্লাহ কী আমার মতো গুনাহগার বান্দার দোয়া কবুল করবেন।
-বাবা আমাদের অতীত নিয়ে বিষণ্ণ হওয়া উচিত নয়।আর ভবিষ্যৎ নিয়েও দুশ্চিন্তা করা ঠিক না।
তবে এই দুইটি কাজ অবশ্যই করা উচিত,
১. অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া ভুলের জন্য অনবরত ইস্তিগফার করা।আর
২. ভবিষ্যৎ এর জন্য আল্লাহর কাছে আন্তরিক ভাবে দু’আ চাওয়া।
দেখবে ইনশাআল্লাহ আল্লাহ আমাদেরকে নিরাশ করবেন না।

চলবে ইনশাআল্লাহ,,
লেখনিতে-জান্নাত_রুবি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here