মাতোয়ারা
পর্ব_১৯
ইরিনদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় আমাদের সাথে এক নতুন ঝামেলা যোগ হলো। মিলি ইরিনের পিছু নিলো। সেও আমাদের বাড়ি আসতে চায়।
ইরিন কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। আমি বললাম,
—আসুক। সমস্যা কি?
—ও বলছে দিন কয়েক থাকবে। একবার গিয়ে যদি আসতে না চায়?
—আশ্চর্য! তুমি এত বিরক্ত কেন হচ্ছো? বাচ্চা মানুষ। বেচারির হয়তো বেড়াতে ইচ্ছে করছে।
—আমি তো গিয়েই কলেজ এসকারশানে চলে যাবো! তখন? একা মিলি থাকবে কোথায়?
—মা তো আছে। মায়ের সাথে থাকবে।
ইরিন মুখ কালো করে মিলিকেও আমাদের সাথে নিয়ে এলো। মিলি আমাদের বাড়ি এসে বেশ মিশে গেলো। ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াতে থাকলো। মা’কে চা বানিয়ে দেয়, সকালের নাশতায় সবাইকে ডেকে তুলছে।আমারও বেশ ভালো লাগছিল। আমার নিজের বোন নেই। মিলিকে পেয়ে মনে হলো, এবার ছোটবোন হলো একটা। একটা ছোটবোন একটা বাড়ির সৌন্দর্য্য যে হাজারগুণ বাড়িয়ে দেয় তা মিলি’ই বুঝিয়ে দিলো।
ইরিন শুধু ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছিলো না। আমাকে বারবার বলতো,
—মিলি’কে এত প্রশ্রয় দেবার কোনো দরকার নেই। বাচ্চা মানুষ। আবেগের বশে কিছু করে ফেলে কিনা। ও আপনার প্রতি খুব উইক। খুব…
আমি মনে মনে বলতাম, তুমি নিজে তো আমার উপর উইক না। তাই কেউ একটু কনসার্ন দেখালেই ভাবো উইক।
ইরিন কলেজ এসকারশানে যাবার দিন আমি আর মিলি ওকে এগিয়ে দিতে গেলাম। বাসে উঠবার সময় ইরিন হঠাৎ করে আমায় জড়িয়ে ধরলো।
কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
—খুব মন খারাপ লাগছে। খুব। ভালো থাকবেন। সাবধানে থাকবেন। আপনি রাজনীতি করেন কিন্তু মানুষের ভেতরের নীতি তো জানেন না।
ইরিনের এসকারশনে যাওয়া আমার জন্য অগ্নিপরীক্ষা হয়ে দাঁড়ালো। আমি দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো পরিমাণ কষ্ট নিয়ে ও’কে বিদায় দিলাম।
রাতে ঘুমিয়েছি হঠাৎ দেখি দরজায় নক।
দরজা খুলে দেখি মিলি দাঁড়িয়ে আছে।
—কি ব্যাপার?
মিলি শক্ত করে আমায় জড়িয়ে ধরলো। ইরিনের সন্দেহ তাহলে ঠিক। মেয়েটা বাচ্চা বয়েসি আবেগে আটকে গেছে। চিৎকার চেঁচামেচি করলে, উল্টো আমার দোষ হবে কিনা। আমি বুঝিয়ে টুঝিয়ে ও’কে ঘরে দিয়ে এলাম।
ইরিনকে ফোন করলে তাঁর ট্যূর খারাপ হবে ভেবে ফোন করলাম না।
পরদিন অনেকটা রাগারাগি করেই আমি মিলিকে বাড়ি চলে যেতে বললাম।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি ইরিনের মা-বাবা এসেছেন। মা বলতে নতুন মা। মিলি তাদের মাঝখানে বসে বসে কাঁদছে। আমার মা’ও মুখ গম্ভীর করে তাদের সাথে বসে আছেন।
ব্যাপার কি জিজ্ঞেস করতেই আমার মা সোজা উঠে এসে আমায় চড় মারলেন।
আমি তো আচমকা চড়ে বিস্মিত।
—তুই মিলিকে রাতে তোর ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলি কেন?
—আমি কখন ডেকে পাঠালাম?
—মিলি বলছে, ডেকে পাঠিয়ে তুই অসভ্যতা করেছিস ও’র সাথে।
ইরিনের বাবা মাথা নিচু করে বললেন,
—বাবা আগেও তোমার ঘটনা ছিলো, ইউনিভার্সিটিতে কেলেঙ্কারির ঘটনা। আমার মেয়ের সাথেও তুমিও ঘটনা ঘটালে। এখন আমার এই ছোট মেয়েটারেও….
ইরিনের বাবা কাঁদতে লাগলেন। ইরিনের নতুন মা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
—আমি এর শেষ দেখে নেবো। হয় ইরিন এই সংসারে থাকবে নয় আমার মেয়ে। আসুক ইরিন।
আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
—ইরিন আসছে নাকি? কে খবর দিলো।
মা বললেন,
—ইরিনকে ও’র বাবা’ই ফোন করেছে। রাতের ট্রেনে ও আসছে।
ইরিনের নতুন মা আমার চরিত্র নিয়ে ভয়ংকর কুৎসিত সব কথা বলতে লাগলেন। আমার ভেতরে তখন শরীরের প্রতিটা শিরা ফেটে যাওয়া ব্যথা। আমার এই লজ্জা, এই কুৎসা, এই নিচুতা ইরিন কি করে সহ্য করবে কি করে? আমি কি ইরিনকে একবার ফোন করবো?
ইরিনকে ফোন করতে হলোনা।
ইরিন নিজেই ফোন করলো।
—হ্যালো…
আমি হ্যালো বলতেও পারছিলাম না। নিঃশ্বাস আটকে আসছিলো আমার। ইরিন মোলায়েম স্বরে বললো,
—আমি আসছি। ফ্লাইটে। সাড়ে পাঁচহাজার টাকা নিলো টিকেটে। দু’ঘন্টা পর একটু এয়ারপোর্টে চলে আসতে পারবেন?
আমি কোনোরকমে বললাম,
—আমি এক্ষুণি আসছি।
—আসছেন তো! ফোন রাখবেন না। আমার ফ্লাইটের আরো চল্লিশ মিনিট বাকি। একটা গল্প শোনাই দাঁড়ান।
আমি অসহায় কণ্ঠে বললাম,
—ইরিন.. তুমি কেমন আছো?
—গল্পটা আগে বলি? তারপর বলবো কেমন আছি!
—আচ্ছা বলো..
—এক চোর ছিলো। ভীষণ দরিদ্র চোর। চুরিচামারি করে স্বামী-স্ত্রীর কোনোরকমে দু-মুঠো ভাতও জুটে না। একদিন সে খেয়াল করলো, তাঁর বউয়ের পরনের শাড়িটি অত্যন্ত মলিন। সে মনে মনে ঠিক করলো, আজ রাতে সে একটি শাড়ি চুরি করবে। সে শাড়ি চুরি করে বাড়ি ফিরে আসার পথে একদল লোক তাঁকে ধাওয়া করতে শুরু করলো। ধাওয়ায় পালাবার সময় সে একটা পতিতাপল্লীর পাশ দিয়ে দৌঁড়াচ্ছিল। হঠাৎ করে সে শুনলো, পতিতাপল্লীতে কে যেন কাঁদছে। সে কৌতুহলবশত কাছে গিয়ে দেখলো, একদমই জরাজীর্ণ শাড়ি পরনে একজন পতিতা কাঁদছে। তাঁর শাড়িটা এত মলিন আর ছেঁড়া ছিলো যে, শরীরের বেশিরভাগ লজ্জাস্থানই দৃশ্যমান ছিলো।
চোর জিজ্ঞেস করলো,
—কাঁদছো কেন?
পতিতা জবাবে আমার শাড়ি নেই বলে কাঁদতেই থাকলো।
চোরটার তখন মনে হলো, তাঁর চুরি করা শাড়িটা তাঁর বউয়ের থেকে এই পতিতার খুব দরকার। বউয়ের জন্য তো সে পরেও শাড়ি চুরি করতে পারবে। চোরটা শাড়িটা পতিতা’কে দিয়ে দিলো। ধাওয়া করা লোকগুলো এসে ততক্ষণে চোরটাকে ধরে ফেলেছে।
লোকগুলো তাঁকে ভীষণভাবে মারতো লাগলো। ওরা বলতে লাগলো,
—তুই একে তো চোর, তার উপরে শাড়ি নিয়ে এসেছিস পতিতালয়ে ফুর্তি করতে। সে যতই বলতে লাগলো, শাড়িটা সে এমনি দিয়েছে, কেউ তাঁকে বিশ্বাস করলো না। বেধরক মার খেয়ে সে যখন বাড়ি ফিরলো তখন তাঁর বউ জিজ্ঞেস করলো,
—কি হয়েছে?
চোর তখন বউকে পুরো ঘটনাটা খুলে বললো। বউ তখন কি বললো জানেন?
—কি বললো?
—বললো সবাই তোমাকে অবিশ্বাস করলেও আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছি। তুমি যে শাড়িটা শুধু লজ্জা নিবারণের জন্যই পতিতা’কে দিয়েছো আমি সেটা জানি৷ তোমার মনে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিলো না।
চোর জিজ্ঞেস করলো,
—কেন তুমি আমাকে বিশ্বাস করছো? কেউ তো আমাকে বিশ্বাস করেনি।
বউ তখন জবাব দিলো,
—আমি তো তোমাকে ভালোবাসার মানুষ হিসেবে চিনি। আর বাইরের লোকেরা তোমাকে চেনে চোর হিসেবে।
চোরটা ঠিক সেই মুহূর্তে ঠিক করলো এই জীবনে এই মুহূর্তে সে চুরি করা ছেড়ে দেবে এবং পরবর্তীতে সে একজন মানুষ হিসেবে সৎ জীবন-যাপন শুরু করলো।
আমি সাথে সাথেই বললাম,
—ইরিন, তুমি তাহলে আমাকে বিশ্বাস করছো?
—শুনুন… গল্প শেষ হয়নি, রোমান মিথে এই গল্পটা অন্যভাবেও শেষ করা হয়েছে। যেমন চোরটা মার খেয়ে বাড়ি ফিরে বউকে ঘটনাটা বলতেই বউ তাঁকে অবিশ্বাস করলো। চোরটা তখন মনে মনে এত কষ্ট পেলো যে, সে সিদ্ধান্ত নিল সে আত্মহত্যা করবে। সে আত্মহত্যা করলো। এতে করে পৃথিবীতে বউটা তাঁকে ভালোবাসবার মত সবথেকে আপন লোকটাকে পৃথিবী থেকে হারালো। চোরের মৃত্যুর পর বউটা এত অভাবী হয়ে গেলো যে, জীবিকার দায়ে বউটার স্থান হলো সেই পতিতাপল্লীতে। দেখা হলো সেই পতিতা’র সাথে যাকে তাঁর চোর স্বামী শাড়ি একবার দিয়েছিলো। সে বুঝতে পারলো স্বামীকে তাঁর বিশ্বাস করা উচিত ছিলো। তবে তাঁর এই দূর্দিন আসতো না।
আমি ফোনের এ পাশে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
আমার মনে হলো, রিয়া নয় ইরিনই আমার জীবনের একমাত্র গন্তব্য ছিলো। যেটা করুণাময় রিয়া নামক ছায়ার মধ্য দিয়ে পাঠিয়েছিলেন।
এয়ারপোর্টে ফিরে ইরিন আমাকে আরো চমকে দেয়া গল্প শোনালো। বললো,
—বাস্তবে এই গল্পটার শেষটা কেমন হয়েছিলো জানেন?
—এই চোরটা বাস্তবেও ছিলো নাকি?
—হুম.. বাস্তবে চোরটার ঘটনা শুনে বউটা আত্মহত্যা করেছিলো। বহুবছর পর সেই চোর আবার বিয়ে করলো, কাকে জানেন? ওই শাড়ি দেওয়া পতিতাপল্লীর মহিলাটিকে।
আমি চমকে উঠে বললাম ,
—তোমার মা কি সুইসাইড করেছিলো ইরিন?
—ধুর আমি মায়ের গল্প কেন বলবো? আমি তো চোরের গল্পের বললাম।
চলুন বাড়ি চলুন….
বাড়ি এসে ইরিন তাঁর বোন মিলিকে প্রথম যে কথাটা বললো, তা হলো…
—আমি তোর সবধরনের ডাক্তারি পরীক্ষা করবো। তোকে তোর দুলাভাই কিছু করে থাকলে ডাক্তারি রিপোর্টে চলে আসবে। চল…
মিলি আরো কাঁদতে লাগলো। সে কিছুতেই ডাক্তারি পরীক্ষা করাবে না বললো।
—পরীক্ষা না করালে তো বিচার পাবি না।
মিলি বললো, সে কোনো বিচার চায় না।
ইরিন তাঁর পরিবারের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে এলো৷
আর আমি ঠিক সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি এমন একটা কিছু করার চেষ্টা করবো যাতে আমিও ইরিনের জীবনের গল্প হতে পারি৷ যে গল্পটা বহু বছর পর ইরিন হয়তো আমাদের সন্তানকে শোনাতে পারবে!
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা