#মন_নিয়ে_খেলা(১৮)
************************
পূনম কেনাকাটা শেষ করে রুমে ফিরে এলেন। ফাহাদ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। খুটখাট শব্দে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় উঠে বসে ফাহাদ বললেন, কেনাকাটা হল?
হুম। ভালোই তো একটা ঘুম দিলে। স্যরি, আমি তোমার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলাম।
সমস্যা নেই। ঘন্টাখানেকের বেশিই ঘুমিয়েছি। ঘুমানোর আগে কেমন অস্থির লাগছিল। ঘুমিয়ে একটু ফ্রেশ লাগছে। কী কিনলে?
এই তো, চোখে যা ভালো লাগল, কিনে নিলাম। পূনম শপিং ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটা তোমার।
কী এটা?
হাতে নাও তো আগে। খুলে দেখো কী আছে। তুমি না কেমন যেন নির্লিপ্ত হয়ে গেছ! আগের তুমি আর নেই।
“এই তুমিই তো আমাকে নির্লিপ্ত বানিয়েছ পূনম। আবেগ, ভালোবাসার অনুভূতিগুলো দলে-মুচড়ে, তুমিই তো আমাকে আবেগহীন জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছ।” বলার ইচ্ছা থাকলেও কথাটা বলতে পারলেন না ফাহাদ। অকারণ ঝগড়াবিবাদ করার বা পূনমের কঠিন কথা সয়ে যাওয়ার মতো শক্তি তাঁর হৃদয়ের এখন নেই। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খুলতেই ভেতর থেকে টকটকে লাল রঙের একটা শার্ট বেরিয়ে এল। ফাহাদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, লাল শার্ট! কার শার্ট এটা?
কার আবার? তোমার শার্ট।
আমি লাল শার্ট পরব!
এটা মোটেও লাল না। এটা হচ্ছে টোম্যাটো রেড। ঠিকমতো কালারও চেনো না তুমি।
ঠিক আছে, বুঝলাম এটা টমেটো কালার; কিন্তু আমি এই টমোটো কালারের শার্ট কেন পরব?
পরবে কারণ, এটা আমি পছন্দ করে এনেছি। তুমি সেদিন এই রঙের কাতান আনলে আমার জন্য, মনে নেই?
কবে আনলাম?
কেন, হিমির মেয়ের বিয়েতে পরার জন্য যেটা এনে দিলে।
ও আচ্ছা। তোমার তো বিয়েতে যাওয়াই হল না। আমার সঙ্গে এখানে এসে তোমার অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। তুমি বিয়ের জন্য থেকে গেলে পারতে পূনম। আমার অফিসের যে কেউ আমার সঙ্গে আসতে পারত।
তুমি এভাবে কথাটা বললে? আমি কী এতটাই দায়িত্বজ্ঞানহীন? তোমার প্রতি কী আমার কোনও দায়িত্ব বা ভালোবাসা নেই? তোমার চেয়ে হিমির মেয়ের বিয়ে বড়ো হল আমার কাছে?
পূনম আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ায় ফাহাদ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বললেন, আমি ওভাবে বলিনি। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। এখানে এসো। আমার পাশে একটু বসো।
পূনম, ফাহাদের মুখোমুখি বসে বললেন, তুমি আমাকে যতটা হৃদয়হীন মনে করো, আমি কী সত্যি এতটা খারাপ? তোমাকে এই অবস্থায় এখানে পাঠিয়ে, আমি ঢাকায় ভালো ঢাকতে পারতাম, বলো?
ফাহাদ, পূনমের হাত ধরে বললেন, বহুদিন পর তুমি আমার সঙ্গে এত ভালোভাবে কথা বলছ পূনম। মনে হচ্ছে আমি সে-ই আগের পূনমের সঙ্গে কথা বলছি।
শার্টটা তোমার পছন্দ হয়নি?
শার্টটা অনেক সুন্দর; কিন্তু আমি বহুদিন এমন লাল শার্ট পরিনি।
আবারও লাল বলছ?
ও স্যরি, চেরি রেড।
চেরি রেড! বাদ দাও, তোমাকে রঙ চিনিয়ে লাভ নেই। শার্টটা আমি পছন্দ করে এনেছি, এটা তোমার পরতেই হবে।
আচ্ছা পরব। অবশ্যই পরব।
তোমাকে একটা কথা বলব।
বলো। কথা বলার জন্য এভাবে বলতে হচ্ছে কেন? এতক্ষণ ধরে তো কথাই বলছ।
অরণী ফোন করেছিল?
অরণী? কী জানি? আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মোবাইলটা আবার কোথায় রাখলাম? এদিক-ওদিক হাতড়ে, ব্ল্যাঙ্কেটের তলা থেকে মোবাইলটা বের করলেন ফাহাদ। মোবাইলে চেক করে বললেন, না তো। কারও ফোন আসেনি এরমধ্যে। কেন, কী হয়েছে?
কিছুই হয়নি৷ অরণীর সঙ্গে একটু আগে কথা বললাম। আমি ওদের আসতে বলেছিলাম। ওদের দু’জনেরই পরীক্ষা, তাই বোধহয় আসতে পারবে না।
ওদের আসার কী দরকার? ক্লাস মিস দিয়ে খামোখা এখানে আসার কোনও প্রয়োজন নেই।
আমি মেয়েটাকে নিয়ে ভীষণ টেনশনে আছি।
কিসের টেনশন? অখিল আছে। বাড়িতে এতগুলো বিশ্বস্ত লোক আছে। তাছাড়া আত্মীয়স্বজন সবাই তো ওদের খোঁজ নিচ্ছে। আমাদের সঙ্গেও সারাক্ষণ কথা হচ্ছে। তারপর তোমার আবার কিসের এত টেনশন?
তুমি কী আসলেই সবকিছু একটু দেরিতে বেঝো, নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করো, বলো তো?
খোলা চোখে আমি যা বুঝলাম, তা-ই তোমাকে বললাম। কেন, আমি কী ভুল কিছু বলেছি?
অবশ্যই ভুল বলেছ। ওদের একা থাকা নিয়ে আমি কোনও টেনশন করছি না। আমি টেনশন করছি, অরণী ঐ ছেলের সঙ্গে যদি কিছু করে ফেলে?
কী করে ফেলবে!
আমি জানি না। ঐ ছেলের কথা মনে হলে, আমি পাগল হয়ে যাই। আমার মাথা গরম হয়ে যায়।
ওহ, পূনম! তোমাকে কী করে বোঝাই? কীভাবে বুঝালে তুমি বিষয়টাকে সহজভাবে নিতে পারবে, বলো তো?
আমাকে যেভাবেই বোঝাও না কেন, এটা আমি কখনোই সহজভাবে নিতে পারব না। আমার সোজা কথা, আমি আমার মেয়েকে যেখানে-সেখানে বিয়ে দিয়ে, তার জীবনের বারোটা বাজাবো না।
তোমাকে আর কতোবার বলব, অরণী ছেলেটাকে পছন্দ করে।
তুমি আমাকে যতোবারই বলো, কোনও লাভ হবে না। মেয়ে তো নিজের ভালো বোঝেই না। তুমিও কী ওর সঙ্গে ছোটো হয়ে গেলে? কোনটা ভালো আর কোনটাতে তার ক্ষতি হবে, এটা কী তুমি বুঝতে পারছ না?
ভালো-মন্দ বিচার করার আমরা কে, পূনম? আর ভালো-মন্দের কথা যদি বলো, আমরা কী অনেক ভালো আছি? সত্যি করে বলো তো, তুমি ভালো আছ?
আমি অবশ্যই ভালো আছি। আমার যখন যা মন চায়, আমি করতে পারি। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। আমি আমার নিজের ইচ্ছায় বাঁচি। আমি খারাপ থাকব কেন?
সত্যি তুমি ভালো আছ? ভালো থাকা মানে কী যথেচ্ছ টাকা খরচ করা? ভালো থাকার মানে কী যখন-তখন কিটি পার্টি আর ইচ্ছে হলেই বিদেশ যাওয়া? আমরা চারজন মিলে কী ভালো আছি পূনম? অরণী, নীলোর্মি তোমার ভয়ে নিজেদের আলাদা একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছে। নিজের সন্তানের সঙ্গে এই যে এতটা মানসিক দুরত্ব, এটাকে তুমি ভালো থাকা বলতে চাও?
পূনমের মেজাজটা খারাপ হতে শুরু করল। স্বামীর এমনতর কথা শোনার মতো ধৈর্য তাঁর এখন নেই। তিনি বললেন, আমি অরণীকে তোমার কথা বলেছি।
কী কথা?
আমি বলেছি, ওর টেনশনে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছ। ওর কারণেই তোমার আজকে এই অবস্থা।
তুমি এটা কেন বলেছ? আমার নামে মিথ্যা কেন বললে পূনম?
মেয়েকে বাঁচানোর জন্যেই মিথ্যা বলেছি। তোমার মেয়ে প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছে। কার সঙ্গে মিশতে হবে, চলতে হবে, সেটাও ভুলে গেছে৷ ওকে ওখান থেকে ফেরাতে আমাকে এটুকু মিথ্যা বলতেই হল। স্যরি।
তোমার এই কাজটা আমার পছন্দ হল না। মিথ্যা বলে, ভয় দেখিয়ে, তুমি অরণীকে ফেরাতে পারবে?
চেষ্টা করে দেখি। আমি আমার মতো চেষ্টা করবই। অরণী ফোন করলে তুমি আবার যেন বলে দিয়ো না।
কী বলব না?
আমি যে মিথ্যা বলেছি। মেয়ে দিন দিন যেরকম বেপরোয়া হচ্ছে, সে নিজেই তোমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করবে, কথাগুলো তুমি বলেছ কি না।
মোবাইল ফোন বেজে উঠলে পূনম জিজ্ঞেস করলেন, কার ফোন?
অরণীর।
দেখেছ! আমি তাকে নিষেধ করলাম, সে যেন এখন কিছুতেই তোমার কাছে এই বিষয়ে জানতে না চায়। অথচ সে ঠিকই ফোন করে ফেলল!
ফাহাদ ফোন রিসিভ করলে অরণী বলল, বাবা তুমি কেমন আছ?
ভালো। তোমরা কেমন আছ, আম্মা?
আমরা ভালো আছি। বাবা, একটু আগে আম্মু ফোন করেছিল।
ফাহাদ, পূনমের দিকে তাকালেন। পূনম তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে। ফাহাদ বললেন, হ্যাঁ তোমার আম্মু বলেছেন।
বাবা, আম্মু আমাদের দু’জনকে আসতে বলেছেন। আমরা বৃহস্পতিবারের ক্লাস শেষ করে তারপর আসি? আমরা রবিবার পর্যন্ত থাকতে পারব তোমাদের কাছে।
পরীক্ষার মধ্যে আসার দরকার নেই। পরীক্ষার ক্ষতি হবে।
সমস্যা হবে না, বাবা। তিনদিনই তো। ম্যানেজ করে নিতে পারব। আমরা আসি বাবা। তুমি অখিল কাকুকে বলে দিয়ো বৃহস্পতিবারের টিকিট করে দিতে।
আচ্ছা ঠিক আছে। নীলোর্মি কোথায়?
নীলোর্মি ওর বন্ধুর পার্টিতে গেছে। কাইনাদের বার্থডে পার্টি আছে আজকে।
ঠিক আছে। আমি অখিলকে বলে দিচ্ছি।
তুমি ভালো থেকো বাবা। একদম টেনশন করো না।
মেয়ের কথা শুনে ফাহাদের মন ভালো হয়ে গেল। মেয়েটা একদমই পূনমের মতো হয়নি। দুই মেয়ের একজনও তাদের মা’র কিছুই পায়নি। না ভোগবিলাসী মানসিকতা, না পূনমের মতো বদমেজাজ। ওরা অনেক বেশি মানবিক হয়েছে। অরণী ইচ্ছা করলেই তাঁকে পূনমের কথাগুলো জিজ্ঞেস করতে পারত; কিন্তু এই কথাগুলো এই মুহূর্তে বলা উচিত না, এটা অরণী ঠিকই বুঝেছে।
কথা শেষ করে ফোন রাখা মাত্রই পূনম বললেন, দেখেছ অবস্থা! আমি নিষেধ করলাম; কিন্তু সে আমার কথা শুনলই না। কী বলল অরণী?
ওরা বৃহস্পতিবার আসবে।
আমি যখন আসতে বললাম, তখন না করল কেন?
তুমি তো পুরো সময়ের জন্য চলে আসতে বলেছিলে। ওরা তো আসছে তিনদিনের জন্য।
অরণী কী বলল, সেটা বলো।
আর কী বলবে? কেমন আছি জিজ্ঞেস করল।
কেন, ঐ কথা তোলেনি? তুমি ঐ কথা বলেছ কি না, তা জানতে চায়নি।
ফাহাদ হেসে বললেন, অরণী ঐ কথা জানতে চাইবে, এটা তুমি একদম নিশ্চিত ছিলে, তাই না?
হাসছ কেন?
আমি, আমার মেয়েদেরকে চিনি। তারা তাদের বাবার দুঃখকষ্টগুলো বুঝতে পারে। এখন যে এইসমস্ত বিষয় নিয়ে কথা বলা উচিত না, এটা বোঝার মতো এতটুকু বুদ্ধি অরণীর আছে।
তুমি বলতে চাও, আমি কিছু বুঝি না? আমি স্বেচ্ছাচারিতা করি?
আমি এখন আর কিছু বলতে চাই না। আমি শুধু একটা অনুরোধ করতে চাই, তুমি যা শুরু করেছ, এটা এখানেই থামিয়ে দাও। কোনোকিছুর বাড়াবাড়ি ভালো ফল বয়ে আনে না। কথাটা মনে রেখো পূনম।
পূনমের মেজাজ এবার সত্যি ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। তিনি শপিংব্যাগগুলো তুলে নিয়ে পাশের রুমে চলে গেলেন। আগামী কয়েক ঘন্টা এই বিগড়ে যাওয়া মেজাজ কিছুতেই ঠিক হবে না। ততক্ষণ তিনি একা থাকবেন, একদম একা।……………………….