#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ২৮
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
________________________
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত হিসেবে সমধিক পরিচিত। L পাথারিয়া পাহাড় (পূর্বনাম: আদম আইল পাহাড়) কঠিন পাথরে গঠিত; এই পাহাড়ের উপর দিয়ে গঙ্গামারা ছড়া বহমান। এই ছড়া মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত হয়ে নিচে পড়ে হয়েছে মাধবছড়া। আভা এবং আহনাফরা সবাই যাচ্ছে মাধবকুন্ডের দিকে। তবে গাড়িতে নয়। রিকশা করে। গাড়ি থেমে যায় কাঠালতলী বাজারে। এরপরের পথটা সিএনজি নাহয় রিকশা করে যেতে হয়। আহনাফ চেয়েছিল সিএনজি ভাড়া করতে। কিন্তু আভা মানা করেছে। সে রিকশা চড়তে চায়। আহনাফ বোঝানোর চেষ্টা করেছে অনেকটা পথ যেতে হবে। সিএনজি ভালো। তবে আভা নাছোড়বান্দার ন্যায় রিক্সার নাম মুখে নিয়ে কুলুপ এটে বসেছিল। আহনাফ তবুও শুনছে না। কামরুল এগিয়ে এল। আহনাফের কাধে হাত রেখে টিপ্পনী কেটে বলল,
‘ দোস্ত,প্রেমিক ও প্রেমিকার মধ্যে হরহামেশা প্রেমিকাই জিতে এসেছে। এবারেও তাই হবে। তুই খামোকা নিজের শক্তি অপচয় করছিস। তোরা রিক্সা করে আয়, আমরা সিএনজি নিচ্ছি। এনজয়।’
কামরুল হেসে চলে গেল। আহনাফ চোখ উল্টে মৃদু নিঃশ্বাস ছাড়ে। আভার দিকে কিছুক্ষন থমথমে দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে রিকশা নেয়। আভার দিকে চেয়ে বলে,
‘ উঠো এবার। ‘
আভা খিলখিল করে হেসে উঠে। হেলেদুলে রিক্সায় চড়ে বসে। আহনাফ আভার পাশে বসে। তবে বেশ খানিক দূরত্ব রেখে। আভা চেপে বসেছে রিক্সার কিনারায়। আহনাফ বলল,
‘ এদিকে এসে বসো। রিক্সার ঝাঁকুনি লাগলে পড়ে যাবে। ‘
‘ না, পড়ব না। অভ্যাস আছে আমার। ‘
আহনাফ আর কথা বাড়াল না। চুপ করে সেলফোন বের করে মগ্ন হয়ে পড়ল। বিপত্তি ঘটল খানিক পর। রিকশা কিছুক্ষন পরপর ঝাঁকুনি খাচ্ছে। আভার বোধ হচ্ছে তার পেটের নাড়িভুড়ি সব বের হয়ে যাচ্ছে। যা খেয়েছিল সব বমি হয়ে যাবে এখন। এত বন্ধুর রাস্তা! আবারও বিশাল এক ঝাঁকুনি খেয়ে আভা আহনাফের উরু চেপে ধরল। আহনাফ মনেমনে বেশ শান্তি পেল। তার কথার খেলাপ করে এবার বুঝবে। সেলফোন পকেটে পুড়ে আহনাফ আভার কাধে হাত গলিয়ে দিল। একহাতে আভাকে শক্ত করে চেপে ধরল। বলল,
‘ একটু পথ সহ্য করে নাও। পৌঁছে গেছি প্রায়। ”
আভা আড়চোখে আহনাফের দিকে চাইল। মানুষটা এত দারুন কেন? তার ভয়ংকর ভালোবাসা দেখলে আভার হাউমাউ করে কান্না পায়। কাদতে কাদতে আহনাফের বুক ভেজাতে ইচ্ছে করে। ইশ! এত ভয়ংকর ভালোবাসা তার কপালে ছিল বুঝি?
মাধবকুন্ড পৌঁছে গেছে সবাই। কামরুল এবং বাকিরা আভাদের অপেক্ষা করেছিল। আভা এবং আহনাফ আসার পর তারা পা বাড়াল সামনে। কিছুটা পথ হাঁটতে হবে এবার। তবে হাঁটার জায়গা বেশ সুন্দর, পাকা করা। তবে উচুঁ ভীষন। গ্রাভিটির কারণে কষ্ট হয় বেশ। আভা সুন্দর করে সবার আগে আগে হেঁটে চলে যাচ্ছে। বোধ হচ্ছে এই জায়গার মত ভয়ানক সুন্দর জায়গা সে আর দুটো দেখেনি। কিছু দূর যাওয়ার পর একটা ছোট দোকান চোখে পড়ে। আহনাফ সেখান থেকে সবার জন্যে ড্রিংকস ও আইস্ক্রিম কিনে। আভা মালাই কিনেছে। খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত সবাই পৌঁছে গেছে জলপ্রপাতের সামনে।
জলপ্রপাতের সৌন্দর্য্য দেখে সবার ঠোঁট ফাঁক হয়ে হা আকার ধারণ করেছে। আভা মুখে দুহাত চেপে ধরে বড়বড় চোখে উপর থেকে বেয়ে নিচে নেমে আশা জলের দিকে চেয়ে আছে। আভা দৌঁড়ে গেল সামনে। থামল অতঃপর আরো একটু দৌঁড়ে আরো সামনে গেল।
পা ভেজাল জলপ্রপাতের পানিতে। ইশ, কি ঠান্ডা। আভা তাৎক্ষণিক পা বটে নিল। পেছন ফেরে সবার দিকে চেয়ে দেখল সবাই ইতিমধ্যে জিন্স বটে পাথরে বসে পানিতে পা ভিজিয়ে রেখেছে। একে অন্যের গায়ে পানি ছেটাচ্ছে। আভা ওদের দেখাদেখি আবার পানিতে পা ভেজানোর চেষ্টা করল। ইশ, অনেক ঠান্ডা পানি। মনে হচ্ছে ফ্রিজের পানি কেউ রেখে দিয়েছে। পা রাখা যাচ্ছে না পানিতে। আভা আবার পা বটে নিল। মুখ ফুলিয়ে সবার দিকে চেয়ে বলল,
‘ তোমরা কিভাবে পা ভিজিয়েছ? আমি পা রাখতে পারছি না। অনেক ঠান্ডা পানি। ‘
দিহান ছবি তুলছে। কথা বলতে বলতে ব্লগ করছে। দিহান নতুন ট্যুর ব্লগ চ্যানেল খুলেছে। সেই চ্যানেলের জন্যেই ব্লগ বানাচ্ছে। আহনাফ এগিয়ে এল। তার জিন্স পায়ের বেশ খানিক উপরে বটে রাখা। যার ফলে পায়ের ঘন লোম দেখা যাচ্ছে। আভা আহনাফের পা দেখে শিউরে উঠল। এত আকর্ষণীয় কারো পা হয় বুঝি? লোমগুলো দেখে আভার গায়ে কাঁপন দিচ্ছে। আহনাফের ভেজা পা দেখে আভার লোভ লাগছে। ইশ, কি লজ্জার ব্যাপার। আভা নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করল। আহনাফ আভার পায়ের কাছে হাঁটু গেরে বসল। আভার লেগিংস একটু উপরে বটে দিল। বলল,
‘ কবে নিজের খেয়াল রাখতে শিখবে? এক্ষুনি ভিজে যাচ্ছিল কাপড়। ‘
আভা মিনমিন করে বলল,
‘ আমি সারাজীবন এমন বেখেয়ালি থাকব, রাগিনাফ। তুমি আছ তো আমার খেয়াল রাখার জন্যে। ‘
আহনাফ শুনতে পেল। ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘ আমি যখন থাকবনা তখন….’
আভা কেঁপে উঠল। কেউ যেন কানে বি’ষ ঢেলে দিয়েছে তার। এমন ফালতু কথা আহনাফ কি করে বলল? বুক কাঁপল না তার? আভা আহনাফের থেকে সরে হনহন করে চলে গেল সামনে। পাথরে বসে অসহ্য ঠান্ডা পানিতে জেদ করে পা চেপে রাখল। পাথরের ঘষা লেগে পা খানিক কেটে গেল। তবুও ঠায় বসে রইল নিজ স্থানে।
আহনাফ দূর থেকে কিছুক্ষণ আভার কাজ দেখল। আভা রেগে আছে, কিসের জন্যে? সে তো সত্য কথা বলেছে। মৃত্যু সত্য জানার পর সেটা থেকে পালানো বোকামি। মৃত্যুকে উপভোগ করতে শেখা উচিৎ। মেয়েটা বড্ড আবেগি। আহনাফকে ঘিরে তার যত অসম্ভব আবেগ। আহনাফ আভার পাশের এক পাথরে বসল। আভার পায়ের রক্ত ভেসে উঠেছে পানিতে। আহনাফ চমকে উঠল রক্ত দেখে। দ্রুত আভার পা পানি থেকে তুলে নিজের উরুর উপর রাখল।
‘ কোথাও কেটেছ? হ্যাঁ? এই মেয়ে কথা বলছ না কেন? ‘
আভা চুপ। অন্যদিকে চেয়ে আছে। ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল। আহনাফ আবার বলল,
‘ থাপ্পড় চেনো? এরপর অযথা সব কথায় নিজের শরীরের উপর রাগ দেখাবা তো তোমার সাথে কথা বন্ধ। বুঝেছ? ‘
আহনাফ খুঁজে পেল আঘাতপ্রাপ্ত স্থান। পানির নিচে ছিল বলে রক্ত পড়া কমে গেছে। আহনাফের ব্যাগে সবসময় ফার্স্ট এইড বক্স থাকে। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিল। আভা এখন ফুপাচ্ছে। আহনাফ বলল,
‘ আর কিছুক্ষণ থাকলে ইনফেকশন হয়ে যেত জায়গাটা। মাথায় ঘিলু বলে কিছু আছে? নাকি সব হাঁটুর নিচে? ‘
‘ তোমার মত মহা বুদ্ধিমান হওয়ার কোনো দরকার নেই আমার। ‘
আভা এতক্ষণে মুখ খুলল। আহনাফ নত মুখে ঠোঁট টিপে হাসল। সোজা হয়ে বসে বলল,
‘ আমি বুদ্ধিমান?
‘ হ্যাঁ। মরার কথা যে বুক ফুলিয়ে বলতে পারে সে তো বুদ্ধিমানই। ‘
‘ আচ্ছা?
‘ খবরদার ওভাবে তাকাবে না। ওভাবে তাকালে আমি রাগ করে থাকতে পারি না তোমার উপর। আমি এখন রাগ ভাঙতে চাইছি না। বুঝেছ? ‘
‘ আচ্ছা? ‘
‘ উফ! অসহ্য! ‘
আভা হাল ছেড়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বসে রইল। আহনাফ শব্দ করে হেসে ফেলল। আভার নরম গাল টেনে ধরে বলল,
‘ হুয়াই সো কিউট? ‘
আভা গাল ঘষে বোকা বোকা চোখে আহনাফের দিকে চেয়ে থাকল।
‘ আহনাফ, আমি চলে যাচ্ছি ঢাকা। ‘
বাঁধনের হঠাৎ আগমন আভা এবং আহনাফকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিল। আহনাফ গলা কেশে আভার থেকে সরে দাঁড়াল। আভা লজ্জায় উঠে চলে গেল সেখান থেকে। বাঁধনের কথা শুনে আহনাফের ভ্রু কুঁচকে গেল। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ কেন? মাত্র আজ এলাম আমরা। ‘
‘ আমার এখানে ভালো লাগছে না। দম বন্ধ লাগছে। বাসায় গিয়ে একা থাকতে চাই কদিন। ওদের বলে দিয়েছি। এবার তোকে বললাম। আসছি আমি। ‘
আহনাফ আরো দু কথা বলতে চাইল। পারল না। তার আগেই বাঁধন ব্যাগ কাধে তুলে হনহন করে চলে গেল।
আহনাফ হতাশ চোখে বাকি বন্ধুদের দিকে তাকাল। ওরা নিজেরাও হতবম্ব। বাঁধনের এরূপ অস্বাভাবিক আচরণের কারণ কামরুল ধরতে পেরেছে। বাকিরা এখনো অবাক, নির্বাক, হতবম্ব!
#চলবে