#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ১৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
_____________________________
আভার অভিমান মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। অভিমানে ক্রমশ ক্ষয় হতে লাগল ভালোবাসার আনন্দ। এতদিন পর আহনাফের মনে পড়ল আভা বলেও এক পাগল প্রেমিকা তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে? আভা চোখের কার্নিশের জলটুকু মুছে জানালার জানালার পর্দা আটকে দিল। আভার অভিমানী চেহারা ঢাকা পড়ল ফিনফিনে কাপড়ের আড়ালে। আহনাফের ভ্রু কুচকে এল। হঠাৎ আভার মতিগতি পরিবর্তন হওয়ায় সে বেশ বিরক্ত। সে দেরি করে এসেছে। কিন্তু দেরি করার কারণ কি আভা নয়? অবশ্যই। আভা যদি আহনাফকে ঠিকানা দিত, তাহলে নিশ্চয়ই আভাকে খুঁজে পেতে আহনাফের এত কসরত করতে হত না। আহনাফ ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বিরক্তি আড়াল করল। নারীরা বড্ড রহস্যময়ী, উক্তিটি মাথায় রেখে ফোন হাতে নিল। আভার নাম্বার ডায়াল করে কল দিল তাকে। দুবার রিং বাজল। আভা কল ধরল না। আহনাফের বিরক্তি আকাশ ছুঁলো। আহনাফ মেসেজ করল,
‘ কল রিসিভ করবে। নাহলে দুতলা বেয়ে উপরে উঠে আমার হবু শাশুড়িকে সালাম করে আসব। সেটা কি চাও? ‘

আভা বার্তা পড়ে চোখ গোলাকৃতি করল। ইশ, কেমন কথা। হবু শাশুড়ি? বউয়ের খোঁজ নেই। আসছে শাশুড়িকে সালাম করতে। খারাপ লোক। আভা উত্তর দিল না মেসেজের। অথচ একটি বার্তা বারংবার পড়তে লাগল। আহনাফের একটা বার্তা তার হৃদয়ের ঘণ্টা নাড়িয়ে দিচ্ছে। যতবার আহনাফের এই ক্ষুদে বার্তা পড়ছে, আভার বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে। মানুষটা আগাগোড়া কেমন প্রেমময়। তার কথা ভাবলে প্রেম পায়, তার স্মৃতি মাথা চাড়া দিলে প্রেম পায়, তার কন্ঠ শুনলেই প্রেম পায়। তার সবকিছুতেই আভার কেমন যেন প্রেম প্রেম পায়। যতক্ষণ সে সামনে থাকে আভার ইচ্ছে হয়, সারাক্ষণ তার দিকে অপলক চেয়ে থাকতে। তাকে আগাগোড়া জরিপ করতে ইচ্ছে করে। তার ঘন ভ্রু, ঘোলাটে দৃষ্টি, বলিষ্ট পেটানো দেহ সব আভাকে ভীষন টানে। কিন্তু সে সামনে থাকলে লজ্জার কারণে আভা চেয়ে থাকতে পারে না। অথচ সে চেয়ে থাকে। পুরুষ মানুষ হলে ভীষন সুবিধা। প্রিয় মানুষকে মন খুলে চেয়ে দেখা যায়। যখন তখন স্বইচ্ছায় ছুঁয়ে দেখা যায়। অথচ মেয়ে মানুষ পারে না। আভা পারে না। লজ্জায় ভেঙে পড়ে। আল্লাহ তায়ালা মেয়েদের এত লজ্জা কেন দিয়েছেন?

পুনরায় মুঠো বার্তার শব্দে আভা সম্বিত ফিরে পায়। মুঠোফোনের দিকে চায়। আহনাফের মেসেজ,
‘ আমি তোমাদের বাসায় দরজার সামনে। কলিং বেল বাজাতে হবে নাকি তুমি আসবে? ‘

আভা চমকে উঠল। সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে? কলিং বেল বাজালে আভার মা তাকে দেখে নিশ্চয়ই বিশাল ঝটকা খাবেন। মা আভাকে নানা প্রশ্ন করবেন। আহনাফের সামনে সেসব প্রশ্ন শুনলে আভার লজ্জায় আক্কেলগুডুম হবে। ইশ, না, না। আভা আর দেরি করল না। ফিরতি বার্তা পাঠাল,
‘ খবরদার! বিল্ডিংয়ের নিচে গিয়ে দাড়ান। আমি নিচে আসছি। ‘

আহনাফের ঠোঁটের কোণায় কুটিল হাস। বোকা মেয়ে!

কয়েক প্রহর কেটে যাওয়ার পর দেখা গেল আভা চাদরের আড়ালে মুখ লুকিয়ে নিচে নেমে আসছে। লম্বা চাদরে শরীর থেকে মুখ অব্দি ঢেকে। চোখ দুখানা দেখা যাচ্ছে। আভা আহনাফের পাশে এসে দাঁড়াল। চারপাশ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পরখ করে আহনাফের দিকে চাইল। রাগান্বিত কণ্ঠস্বরে বলল,
– ‘ আপনি জানেন আপনি খুব খারাপ। একদম বাসায় চলে গেলেন? জানেন মা আপনাকে দেখলে কি করবে? মেরেই ফেলবে আমাকে। ‘
আহনাফ ভ্রু বাঁকাল। বুকে আড়াআড়ি হাত ভাঁজ করে বুক টানটান করে দাঁড়াল। অতঃপর বলল,
–’ কে বলল, আমি তোমার বাসায় গিয়েছি? আমি তো নিচেই ছিলাম এতক্ষণ। ‘
–’ মানে? আপনিই তো বললেন আপনি বাসার দরজার সামনে। আমি না এলে কলিং বেল বাজাবেন। ‘
–’ এটা তো তোমাকে নিচে নামানোর ছোট্ট এক প্রয়াস। ‘
আহনাফের নির্লিপ্ত উত্তর। অতি স্বাভাবিক কণ্ঠ। ভয়ডর নেই। কেমন যেন গা ছাড়া উত্তর শুনে আভা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। মুখ কুঁচকে বলল,
–’ মিথ্যা বলেছেন? ‘
–’ হ্যাঁ। ‘
আভা হাল ছেড়ে দিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–’ আপনি আসলেই খুব খারাপ। ‘
–’ আমি কি একবারও বলেছি, আমি ভালো। ‘
আভা বাঁকা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আহনাফের পানে। আহনাফ মৃদু হাসল। আভার দিকে ঠোঁট ঝুঁকে এনে কানেকানে সুধাল,
–’ খারাপের এখন তো সবে শুরু মিস. বউফ্রেন্ড! সামনে তোমার জন্যে আরো ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে। বি রেডি। ‘

আহনাফের কানেকানে বলা বুলি আভার সারা গায়ে কম্পন সৃষ্টি করল। আভা ওপর পাশের মানুষকে নিজের অনুভূতির জোয়ারে ভেসে বেড়ানো দেখাতে চাইল না। কিন্তু নিজের অনুভূতি দল ছুটে পালিয়েছে। আভার কথা অমান্য করে কেমন বেহেয়ার ন্যায় আহনাফের প্রেম প্রেম বানি শুনে কেমন জমে গেছে। আহনাফ আভার কানের কাছে থেকে চাদর সরাল। কানের লতিতে আলতো করে ঠোঁট বসাতেই আভার সারা অঙ্গ শিরশির করতে লাগল। পায়ের আঙ্গুল বেকে যেতে চাইল। আভা পায়ের নখ দ্বারা স্যান্ডেল আকড়ে ধরল। মিনমিন করে বলল,
–’ এ-এটা র-রাস্তা। ‘
রাস্তা কথাটা কানে প্রবেশ করলে আহনাফের ঘোর ভেঙে যায়। আহনাফ তড়িৎ ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ইতি অতি চেয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে আঙ্গুল কর্তৃক ঘাড় ঘষে। আভা লজ্জায় ইতি ওতি চায়। আহনাফ প্রশ্ন করে,
–’ হেঁটে হেঁটে কথা বলা যাক? ‘

আভা উত্তর দেয় না। কথা বলতে পারছে না সে। গলার কাছে সমস্ত অনুভূতি জট পাকাচ্ছে। কথা আটকে আটকে যাচ্ছে। আহনাফের প্রথম স্পর্শ সহ্য করা যাচ্ছে না। এখনো সবকিছু কেমন ঘোর-ঘোর লাগছে। আভা গায়ের চাদর খামচে ধরে সামনে হাটতে লাগল। আভাকে এগিয়ে যেতে দেখে আহনাফ আভার পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।

পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে আভা এবং আহনাফ। মনে পড়ে যাচ্ছে পুরনো সব স্মৃতি। সাজেকের রাতের আকাশের নিচে এভাবেই দুজন একসাথে হেঁটেছিল। তবে সেদিনের চিত্র একরকম আর আজকের চিত্র অন্য। আভা প্রশ্ন করল,
–’ আজ কি মনে করে আমার কথা মনে পড়ল? ‘
আভার প্রশ্ন স্পষ্ট ব্যঙ্গাত্মক ছিল। তবে তা আহনাফকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারল না। আহনাফ জিন্সের পকেটে দু হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সুধাল,
–’ আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। ‘

আভা থমকে গেল। পায়ের পাতা আটকে গেল চকিতেই। আভাকে থামতে দেখে আহনাফ পা থামাল। আভার দিকে চেয়ে বলল,
–’ জানতে চাইবে না উত্তরটা কি ছিল? ‘

আভা উত্তর দিল না। হেঁটে এগিয়ে গেল সামনে। তবে উত্তরের প্রয়োজনবোধ করল না আহনাফ। আভার অভিমানের পাহাড় বড্ড উচু হয়েছে। অভিমানের পাহাড় ধ্বসে পড়ার জন্যে আহনাফের প্রশ্নের উত্তরটা জানা জরুরী। তাই সে নিজ তাগিদেই উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করল। আভার হাত ধরল। আভা থেমে গেল। আভার নরম হাত আহনাফের শক্ত হাতের ভাঁজে বন্দী। আভা সামনে তাকিয়ে আছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চিপে ধরে আছে। চোখ খিঁচে রাখা। আহনাফের উত্তর শোনার সাহস আভার নেই। উত্তরে যদি বিচ্ছেদ লেখা থাকে, তবে আভার বেচে থাকার কোনো কারণ থাকবে না। আভা মৃদু স্বরে বলল,
–’ হ-হাত ছাড়ুন। ‘
–’ উত্তর শুনবে না? ‘
আহনাফের নেশাল কণ্ঠ আভাযে মুহূর্তেই নাড়িয়ে দিল। আভা ঠোঁট কামড়ে ধরল। সদ্য জন্মানো অনুভূতির যন্ত্রণা আভার আর সহ্য হচ্ছে না। বুকের ভেতর শক্ত লোহা যেন ঘা পেটাচ্ছে। উত্তেজনা রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে বেড়াচ্ছে। রক্তের তাপমাত্রা উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে। হৃদপিন্ড চঞ্চল ব্যাঙের ন্যায় লাফাচ্ছে। উত্তর কি হবে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here