#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ১১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
____________________________
আহনাফের রাগ যেন আকাশ ছুঁলো। মস্তিষ্কের ভেতর ভোঁতা এক যন্ত্রণা ভেতরকার সবকিছু কেমন যেন তছনছ করে দিতে লাগল। আহনাফ আভার হাত নিজের আঙ্গুলের ভাঁজে চেপে ধরলো। আহনাফের শক্ত হাতের স্পর্শে নরম দেহী আভার হাতের রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম। দাগ পড়ে গেছে হাতের কব্জিতে। আভা চোখ খিচে নিল। আহনাফ গভীর তথা রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
–’ আমাকে আর ভালো লাগছে না? ‘
আভা চমকে উঠল। কিভাবে বলবে সে, মা বাবার পরে আহনাফ আভার জীবনের সর্বশ্রেষ্ট ভালো লাগা। আভা দুনিয়া ভুলে যাবে তবুও এই মানুষটাকে কখনো ভুলে যেতে পারবে না। মৃত্যু আপন করবে অথচ ওপরপাশের মানুষকে ভালো না বেসে থাকতে পারবে না।
আভা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। মৃদু স্বরে বলল,
–’ বোধহয় না। ‘
আহনাফের অবিশ্বাস্য দৃষ্টি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে আহনাফ ঠিক চিনে উঠতে পারছে না। এ তো আভা নয়। কোনো অন্য বটে। আহনাফ হাতের বাঁধন হালকা করল। আভা হাত বটে নিল। লাল হয়ে আসা কব্জির ঘষে কাতর চোখে আহনাফের দিকে চাইল। আহনাফ শান্ত কণ্ঠে সুধাল,
–’ তাহলে এতদিন এসব কি ছিল? মোহ? ‘
আভা চুপ থাকল। উত্তর দিল না। বরং এড়িয়ে গেল। বলল,
–’ যেতে হবে আমার। বাবা অপেক্ষা করছেন। ‘
–’ করুক। যার যা ইচ্ছে করুক। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। কি চলছে এসব? ‘
আভা এবার আহনাফের দিকে চাইল। আহনাফের ওই দু চোখে আভার চেয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। আহনাফের দু চোখ তো চোখ নয়। আস্ত এক সাগর। আভা সেই সাগরের নীল জলে অতলে ডুবে যাচ্ছে। আভা চোখ নামাল। হার মানল। মৃদু স্বরে বলল,
–’ নিজের মনে প্রশ্ন করুন। আমি আপনার কাছে কি ছিলাম। যেদিন এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন। আমার কাছে আসবেন। আমার উত্তর জানিয়ে দিব। শুভ বিদায়। ‘
আভা লাগেজ হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছে। আহনাফ পেছনে স্থির পায়ে দাঁড়িয়ে রইল। আভার এই নতুন পরিবর্তন বড্ড ভাবাচ্ছে তাকে। কি বলে গেল আভা? প্রশ্ন এবং উত্তর?
আহনাফের ধ্যান ভাঙল। ফোনের কর্কশ শব্দে মেজাজ তিড়িং করে তুঙ্গে লাফাল। আহনাফ ফোন তুলল। দিহানের কল।
–’ আহনাফ, কই তুই? গাড়ি সেই কখন থেকে এসে বসে আছে। দ্রুত আয়। ‘
–’ আসছি। ‘
আহনাফ ফোন কেটে পা চালাল পেছনে। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে হাজার প্রশ্ন। অনুভূতিরা উকিঝুকি দিচ্ছে মনের কোণে। আভা আহনাফের কাছে কি? আহনাফ জানে না। কেমন যেন চেনা অজানা প্রশ্নের কাছে হার মানছে সে।
আভার বাবা জুনায়েদ অপেক্ষা করছেন। আভা বাবার দিকে এগিয়ে আসে। আভা বাবাকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
–’ কেমন আছো, বাবা? মিস করেছি খুব। ‘
–’ আমিও করেছি। কেমন কাটল সাজেক ট্রিপ? ‘
আভার ভাবনারা হামলে পড়ল মস্তিষ্কের আনাচে-কানাচে। মনে পড়তে লাগল, সাজেকে আহনাফের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত। আভা মৃদু স্বরে বলল,
–’ অনেক ভালো কেটেছে। নতুন কিছুর সাথে পরিচিত হয়েছি। এমন নতুন অনুভূতি যা আগে কখনো অনুভব করি নি। ‘
–’ ভালো করেছ। সর্বদা নতুন কিছু জানতে হবে। নতুন বিষয় আমাদের সবসময় আনন্দ দেয়। ‘
আভা বাবার দিকে চেয়ে হাসে। জুনায়েদ মেয়ের লাগেজ নিজের হাতে নিয়ে বলেন,
–’ এবার যাওয়া যাক। ‘
আভার মনে পড়ে একটা বিষয়। আভা তাড়া দেখায়। বাবার থেকে চেয়ে ইশারা করে বলে,
–’ বাবা, পাঁচ মিনিট। একটা ফোন কল আছে। ‘
–’ যাও। দ্রুত আসবে। তোমার মা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। ‘
–’ আসছি। জাস্ট ফাইভ মিনিটস। ‘
আভা বাবার থেকে একটু দূরে এসে দাড়ায়। কল দেয় কামরুলকে। দুবার রিং বাজতেই কামরুল কল রিসিভ করে। আভা বলে,
–’ কামরুল ভাই, কোথায় তোমরা? ‘
– ‘ বাইকে আমি। বাসায় যাচ্ছি। ‘
–’ আর সে? ‘
–’ কে সে? ‘
কামরুল টিপ্পনী কেটে উঠে। আভা লজ্জা পায়। তবু নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,
–’ তোমাদের অ্যাটিটিউড কিং। গুমড়া মুখো। ‘
–’ আহনাফ? ‘
–’ হ্যাঁ। কই সে? ‘
–’ ও গাড়িতে। বাঁধনদের সাথে আসছে। আমি বাইকে একা।’
–’ আচ্ছা, আমার কিছু কথা বলার ছিল। মন দিয়ে শুনবে। ‘
–’ মন আছে। বলো। ‘
–’ তোমার কাছে আমার ফোন নাম্বার আছে। এই নাম্বার তাকে দিবে না। সে অনুরোধ করলেও না। এটা আমার অনুরোধ। ‘
–’ কিন্তু কেন? তোমাদের ঝগড়া হয়েছে? ‘
–’ আমাদের বলতে এখনো কিছু হয় নি, কামরুল ভাই। শুধু আমি আর সে হবে। আর না, আমাদের ঝগড়া হয় নি। এমনি বললাম। সে চাইতে পারে আমার নাম্বার। তার কাছে নাম্বার নেই। যদি চায়, দিবে না। ‘
–’ আচ্ছা দিলাম না। কিন্তু কেন দিব না সেটা তো বলো। ‘
–’ তার দরকার পড়লে সে কষ্ট করে খুঁজে নিবে। কিছু পেতে হলে কষ্ট করতে হয়। পরিশ্রম ছাড়া কিছু পেয়ে গেলে তার মূল্য ফিকে হয়ে যায়। কষ্ট করে যা পাওয়া যায়, তা অমূল্য হয়ে থাকে। ‘
–’ বাহ। অনেক জ্ঞ্যান দিচ্ছ তো। তা নাম্বার না দিলে আমি কি পাব? ‘
–’ দেখা হলে নিজের হাতে চা খাওয়াব। চলবে? ‘
–’ চলবে, চলবে। আচ্ছা রাখছি এখন। বাইকে আছি। ‘
–’ আচ্ছা, বাই। ‘
আভা ফোন ব্যাগে রেখে বাবার দিকে এগিয়ে আসে।
– ‘ কথা বলা শেষ? ‘
–’ হ্যাঁ। চলো। ‘
আভারা বাসায় পৌঁছে। আভার মা তিনদিন পর মেয়েকে দেখে আহ্লাদে আটখানা। শেষ বয়সে হাজার দোয়ার পর পেয়েছেন এই মেয়ে। মিনহাজ হওয়ার পর তারা ছেলে মেয়ের মুখ দেখেনি নি প্রায় দশ বছর। এই দশ বছরে অনেক ডাক্তার, কবিরাজ দেখান হয়েছে। কিছুতেই কাজ হয় নি। বরাবরই মেয়ের শখ ছিল আভার মায়ের। মেয়ে হয় নি দেখে ভেঙে পড়েছিলেন একদম। কত ইচ্ছে ছিল, নিজের হাতে মেয়েকে পুতুল সাজাবেন। অথচ এত বছরেও আল্লাহ তায়ালা তাদের ঘরে জান্নাত দেন নি। দশ বছর পর যখন আভার মুখ দেখেন, তাদের সকল কষ্ট ছুটে পালায়। আভার বাচ্চা মুখ দেখে এতদিনের অপেক্ষার কষ্ট সব ভুলে চেয়েছিলেন হাতে থাকা বাচ্চা পুতুলের দিকে। ভেবেছিলেন, আল্লাহ এতদিন তাদের অপেক্ষা করিয়ে ভুল করেন নি। অপেক্ষার ফলস্বরূপ এই ফুটফুটে মেয়ে পেয়েছেন। এই বা কম কিসের? আল্লাহ তাদের কোল ভরিয়ে দিয়েছেন। শুকরিয়া তাকে।
বাবা মায়ের আহ্লাদে আভা হয়েছে ননীর পুতুল। এটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারে না। কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে যায়। যখন যা চেয়েছি, তাই পেয়েছে। আভার বাবা মা মেয়েকে সত্যিকারের পুতুলের ন্যায় বড় করেছেন।
খাবার দাবারের পর্ব শেষ করে আভা গোসলে যায়। লম্বা এক গোসল সেরে মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে বেরিয়ে আসে।
আভার মা চা দিয়ে গেছেন। আভা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে জানালার কাছে আসে। জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকায়। আহনাফকে এতগুলো কথা শুনানোর পর মনটা ভালো নেই তার। কেমন যেন করছে ভেতরে। অসহ্য লাগছে সব। আহনাফের অস্থিরতা দেখে নিজেকে সেসময় ঠিক রাখতে পারেনি। ইচ্ছে করছিল, ছুটে তার বুকে ঝাপটে পড়তে। অথচ পারে নি আভা। পরিকল্পনা মোতাবেক আগাতে হবে। আহনাফের মুখে ভালোবাসা স্বীকার করাতে চাইলে এটুকু ধৈর্য্য ধরতে হবে। শক্ত মনের অধিকারী হতে হবে। নাহলে আহনাফ যা মানুষ। বুক ফাটবে তবু মুখ ফুটবে না। এত সহজে প্রেম স্বীকার করবে না এই ছেলে। কসরত করতে হবে।
আভার অপেক্ষার প্রহর শুরু হল। আজ থেকে আভা প্রতিটা ক্ষণ অপেক্ষা করবে। জানালার কাছে মাথা ঠেকিয়ে চেয়ে থাকবে অদূরের পিচড়ালা সড়কের পানে। আহনাফ কবে আসবে?
#চলবে