গল্প:-মনের মহারাণী
লেখিকা:-Sohani Simu
পর্ব:-২৫

নানুর বাসায় আসতে আমাদের পাঁচমিনিট সময়ও লাগেনি।উমানদের বাসার দক্ষিণ দিকে বিশাল যেই পুকুর আছে সেই পুকুরের পাড়ে ছোট্ট একটা ইটের বাড়ি।ছাদের বদলে টিনের চাল।উঠান ভর্তি ফুলের গাছ।দরজার দুপাশে সিমেন্ট বাঁধানে বসার জায়গা।আশেপাশে শুকনো লালমাটির জন্য চারপাশ খটখটে হয়ে আছে।কোথাও একটুও ময়লা আবর্জনা নেই।এ যেন ছবির মতো সুন্দর বাড়ি।আমি তো খুবই আনন্দিত।এত সুন্দর একটা বাড়িতে দাদি আমাদের আসতে দিতে চাচ্ছিলেননা শুধু মাত্র নানু দাঁড়োয়ান বলে।উমান না থাকলে তো আসায় হত না।আমি উমানের দিকে তাকালাম।উনি একহাতে লাগেজ নিয়েছেন অন্যহাতে মিনিকে কোলে নিয়ে আছেন।উনি আমার দিকে তাকাতেই আমি অপ্রস্তুত হয়ে আম্মুর দিকে তাকালাম।আম্মু দরজার কাছে গিয়ে কড়া নাড়ছে।কিছুক্ষণ পর বয়স্ক একটা মহিলা এসে দরজা খুলে দিলেন।একরঙা সবুজ শাড়িটিতে বৃদ্ধা মহিলাকে দেখে আমার কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।আম্মু উনাকে দেখেই হাসি মুখ করে বলল,

‘মা!’

আমি বুঝলাম বৃদ্ধা আমার নানি।মুখের গড়ন অনেকটা আম্মুর মতোই কিন্তু আম্মুর মতো অত ফর্সা নয় একটু চাপা।এক কালে হয়তো আম্মুর মতোই ফর্সা ছিলেন এখন বয়স হয়ে চামড়া জড়ে গিয়ে শ্যামলা হয়ে গিয়েছেন।নানি আম্মুকে বুকে টেনে নিলেন।আমাদের দেখে উনি খুশিতে আত্মহারা।যদিও আম্মু আর মিনিকে উনি আগেই দেখেছেন কিন্তু আমাকে আজ প্রথম দেখলেন।উনার চোখে পানি।কাঁপা কাঁপা হাতে আমার গালে হাত বুলিয়ে সেই হাতে চুমু খাচ্ছেন।উনি আমাকে আরও কাছে থেকে আদর করতে চাইছেন কিন্তু কেন যেন ইতস্ততবোধ করছেন।আমি আর কিছু না ভেবে নানিকে জড়িয়ে ধরলাম।নানি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর বলছেন,

‘এ যে আমার ঘরে চাঁদ আসিলো।ও উমান বাবা,কারে নিয়ে আইলা তুমি?এযে রাজকুমারী।আমার ছোট্ট কুড়েঘরে এমন ফুটফুটে চাঁদের টুৃকরোরে আমি কোথায় বসতে দিমু? ‘

উমান মুচকি হেসে বললেন,

‘তুমি অকারনে চিন্তা করছো নানি।ওকে যেখানে বসতে দিবা সেখানেই বসবে।’

আমি মুচকি হেসে নানির দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘নানু কোথায়?’

নানি খুশি হয়ে আমার গালে হাত বুলিয়ে বললেন,

‘ওই মানুষ গেট খুলতে গেছে।’

মিনি উমানের কোল থেকে নানির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,

‘নানুর কাছে যাব।’

উমান বললেন,

‘নানু তোমাকে কোলে নিতে পারবেনা তো।নানু অনেক অসুস্থ, আগে সুস্থ হোক তারপর কোলে নিবে।’

মিনি তাও জোর করছিল দেখে উমান মিনিকে কোলে নিয়ে নানির কাছে আসলেন।নানির কোমড় ব্যথা তাই কিছুতেই মিনিকে কোলে নিতে পারবেননা।নানি এমনিই মিনিকে অনেক আদর করলেন।এরপর মিনি আমার কোলে চড়ার বাইনা ধরলো।মিনির ওজন চব্বিশ কেজি।ওকে আমি কোলে নিয়ে বেশিক্ষণ থাকতেই পারিনা।তাও উমানের কাছ থেকে আমার কোলে নিলাম।উমান আমার পেছনে গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছেন।উনার ধারনা মিনিকে নিয়ে আমি উল্টে পরে যাব।নানি আমাদের বাড়ির ভেতর আনলেন।দুটো রুম একটা বাথরুম আর কিচেন।রুমে তেমন কোন আসবাবপত্র নেই,যা আছে অতি সাধারন আর পুরাতন।মেঝে সিমেন্ট দিয়ে প্লাস্টার করা কিন্তু দেয়াল ইটেরই।আমাদের বিছানায় বসতে দিয়েই নানি আর আম্মু রুম থেকে বেরিয়ে গেল।মিনিকে বিছানায় নামিয়ে দিয়ে রুম দেখতে লাগলাম।উমান একটা কাঠের চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসতেই উনার ফোনে কল আসলো।উনি কল রিসিভ করে বললেন,

‘হুম আপু বল।’

…………।

‘আরে না পুকুরের দিকে একা যেতে দিব না।দাদিকে আদিক্ষেতা কম দেখাতে বল।এসব একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না?’

………….।

‘আচ্ছা রাখছি।’

আমি উমানের দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘উর্মি আপু?’

উনি ফোনে স্ক্রল করতে করতে বললেন,

‘হুম।’

মিনি বিছানার সাথে লাগানো জানালার শিকে উঠে বাদুরের মতো ঝুলতে ঝুলতে বলল,

‘আমাকে ধলতে পালে না।’

আমি মিনির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললাম,

‘এই নামো ওখান থেকে।পরে গেলে ব্যথা পাবা কিন্তু।’

মিনি তাও নামছেনা।আরও উপরে উঠছে।লোহার শিকগুলো অনেক পুরোনো তাই মরিচা ধরে নড়বড়ে হয়ে আছে।ওখান থেকে পরে গেলে বিছানায় পরবে তাও অনেক ব্যথা পাবে তাছাড়াও মরিচা লেগে মিনির নরম হাত কেঁটে যেতে পারে।আমি চিন্তিত হয়ে বিছানায় উঠে হাঁটু গেড়ে মিনির কাছে যেয়ে ওর পিঠে হাত দিয়ে বললাম,

‘দেখি নামো।’

মিনি চেঁচিয়ে বলল,

‘না নামবো না।’

আমি তাও ওকে জোর করে নামিয়ে দিলাম।মিনি রেগে আমাকে এলোপাথাড়ি খামচি দিতে লাগলো।একহাতে আমার চুল খামচে ধরলো অন্যহাতে আমার গালে খামচি দিল।আমি ওকে ছাড়াতে পারছিনা দেখে ফট করে ওকে মেরে দিলাম।মিনিও মারলো।ব্যস মারামারি শুরু।উমান এসেও মিনির হাত থেকে আমার চুল ছাড়িয়ে নিতে পারছেননা।আমিও মিনির চুল টানতেই ও আমার চুল ছেড়ে দিল।আমার কয়েকটা চুল ওর হাতের সাথে উঠে গেছে দেখে ঠাস করে একটা মাইর দিলাম ওকে।উমান আমাকে এক ধমক দিলেন।মিনিও কান্না করতে করতে আমার হাতে ওর পোকায় খাওয়া ধাড়ালো ফলার মতো দাঁত বসিয়ে দিল।ব্যথায় আমার চোখে পানি চলে এসেছে।ফুঁপিয়ে উঠতেই উমান মিনিকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওকে এক ধমক দিলেন।আমাদের কান্নাকাটির আওয়াজ পেয়ে আম্মু চলে এসেছে।মিনি কান্নার স্পীড বাড়িয়ে আম্মুর কাছে গিয়ে বলল,

‘আপু আবাল মেলেছে।’

আমি চেঁচিয়ে বললাম,

‘আমি মারিনি,মিথ্যে বলছে।ও আমাকে খামচি দিয়েছে আর কামড়ও দিয়েছে।এই দেখ রক্ত বের করে নিয়েছে আর ওর হাতে দেখ আমার চুলও আছে।’

মিনি এবার আম্মুর ভয়ে আরও জোরে চিৎকার করতে লাগলো।আম্মু আমাকে বকা দিয়ে মিনিকে নিয়ে রুম থেকে চলে গেল।বিনা দোষে আম্মুর বকা খেয়ে আমি রেগে বালিশ দুটো মেঝেতে ফেলে দিলাম।উমান ধপ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,

‘উফ্ আমার বউটা কি কিউট!!’

আমি তেজি কন্ঠে বললাম,

‘কিউট না ছাই,আমাকে মেরে মাংস তুলে নিল আর আপনি হা করে দেখলেন??’

উমান চট করে উঠে বসে আমার গালের খামচি দেওয়া জায়গায় হাত দিয়ে বললেন,

‘ইশ চামড়া ছিলে গিয়েছে।কষ্ট হচ্ছে?আয় একটু আদর করে দিই।’

উনি যে আমার সাথে ঠাট্টা করছেন বেশ বুঝতে পারছি।উনার হাত সরিয়ে বিছানা থেকে নামতেই উনি আমার হাত ধরে টান দিলেন।বিছানায় পরে চোখ মুখ খিচে বন্ধ করলাম।উমান সত্যি সত্যি আমার গালে ঠোঁট ছুয়ে দিলেন।কামড় দেওয়া হাতে ঠোঁট ছোয়াতেই বাইরে থেকে আম্মুর কথা শুনে উনি তাড়াহুড়ো করে আমাকে ছেড়ে দিয়ে মেঝে থেকে বালিশ তুলে বিছানায় রেখে চেয়ারে গিয়ে বসলেন।আমি ধীরে সুস্থে উঠে বসে দরজার দিকে তাকালাম।আম্মু মিনিকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো।আমি মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকালাম।মিনি বিছানায় উঠে আমার গালে চুমু দিয়ে বলল,

‘আপু সলি।’

এসব আম্মুর শিখিয়ে দেওয়া।তাই আমি রাগ করে আম্মুর দিকে তাকালাম।আম্মুর রাগী মুখ দেখেই আমি মিনির দিকে তাকিয়ে থমথমে মুখ করে বললাম,

‘ইট’স ওকে।’

আম্মু উমানের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘উম তুমি খেয়ে যেও।আমি খাবার নিয়ে আসছি।’

উমান আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘আজকে আমার কোন কাজ নেই,তোমাদের সাথে এখানেই থাকবো।আর নানির হাতের পিঠা খাব।পিঠা রান্না করতে বল নানিকে।’

আম্মু মুচকি হেসে বলল,

‘তুমি বাসায় যাও পিঠা আমি পাঠিয়ে দিব।এখানে কষ্ট করে থাকতে হবেনা।’

উমান কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন,

‘আমার এখানে কোন কষ্ট হচ্ছেনা,তোমার মেয়েকে দেখ গরমে সেদ্ধ হয়ে গিয়েছে।তাহলে ওকে নিয়ে বাসায় যাই?’

আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘বাসায় যাবা তুমি?’

আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম সাথে উমানের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিত রেগে বললাম,

‘আম্মু তোমাকে একটা কথা বলব।উম ভাইয়া…..।’

উমান মনে হয় বুঝতে পেরেছেন আমি বিয়ের কথা বলব তাই উনি আমার কথার মধ্যেই আম্মুকে বললেন,

‘সব কথা পরে হবে আগে তুমি খাবার নিয়ে আসো তো।নটা বেজে গিয়েছে এখনও ব্রেকফাস্ট করা হয়নি।’

আম্মু তাড়াহুড়ো করে উমানের জন্য খাবার আনতে গেল।আম্মু যেতেই উমান আমার দিকে রাগী চোখে তাকালেন।শার্টের ফোল্ড করা হাতা উপরে তুলতে তুলতে বললেন,

‘আর একবার মুখ খুললে থাপ্পড় দিয়ে বাপ দাদার নাম ভুলিয়ে দিব।’

আমি থমথমে মুখ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।মিনি আবার জানালায় উঠেছে।এবার আমি কিছু বলব না।পরে গিয়ে ব্যথা পেলে তারপর শিক্ষা হবে।জানালা দিয়ে বিশাল পুকুর দেখা যাচ্ছে।অনেক পুরোনো পুকুর।সবুজ ঘাস আর ফলের গাছে ভরপুর পুকুরের পাড়গুলো।জানালা দিয়ে আসা হালকা শীতল বাতাসে আমার কুচকানো ভ্রু স্বাভাবিক হল।মনের মধ্যে অদ্ভুত খেয়াল হচ্ছে।পুকুরে যেতে ইচ্ছে করছে।মনে হচ্ছে ওখানে গেলে গরম কম লাগবে,একটু স্বস্তি পাওয়া যাবে।ওখানে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই উমান বললেন,

‘কোথায় যাচ্ছিস?’

আমি রুম থেকে যেতে যেতে বললাম,

‘বাইরে।’

উমান বসা থেকে দাঁড়ালেন।আম্মুও খাবার নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বলল,

‘এখন বাইরে যাওয়া নয়,আগে নাস্তা কর তারপর।’

ক্ষুধা লেগেছে তাই নাস্তা করতে বসে গেলাম।আমি,মিনি আর উমান বিছানায় বসলাম।আম্মু আমাদের প্লেটে পরোটা আর ডিম ভাজি দিল।তাড়াহুড়ো করে খেয়ে বাইরে উঠোনে আসলাম।আমার পেছন পেছন উমানও মিনির হাত ধরে বাইরে আসলেন।পুকুরের দিকে যেতে যেতে বললাম,

‘এটা আপনাদের পুকুর?’

উমান মৃদু হেসে বললেন,

‘তোরও।’

আমি সামনে সামনে হাঁটছিলাম উনার কথা শুনে পেছন ফিরে ভ্রু কুচকে বললাম,

‘আমার কেন?’

উনি মুচকি হেসে বললেন,

‘কেন আবার বাবার অংশ পাবি,হাজব্যান্ডের অংশও পাবি।’

কিসের অংশ?অংশ টংশ কিছু বুঝিনা।আমি মুখ ভেংচিয়ে পুকুরের কাছে যেতে লাগলাম।পুকুর পাড়ে এসে দেখি নানুর বাসা থেকে যতটা সুন্দর লাগছিল জায়গাটা তারচেয়ে অনেক বেশি সুন্দর।শান বাঁধানা ঘাটের দিকে তাকাতেই দেখি দাদি আর দুটো কাজের মেয়ে বসে আছেন।দাদিকে দেখেই আমি উমানের দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘দাদি এখানে কি করছে?’

উমান দাদির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,

‘পুকুর পাহারা দিচ্ছে।’

মিনি দাদিকে দেখেই ডাক দিয়ে দৌঁড়ে দাদির কাছে গেল।দাদিকে দেখে মনে হচ্ছে আমাদের এখানে আসতে দেখে উনি ভয় পাচ্ছেন।মিনি উনার কাছে যেতেই উনি মিনির হাত ধরে থাকলেন।উমান আমার একহাত ধরে দাদির দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘দাদি তোমার বেলাকে দেখ আমি বেলিফুলকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি।’

বেলিফুল নাম শুনে রেগে উমানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁটা দিলাম।উমান পেছন থেকে খপ করে আমার হাত ধরে বললেন,

‘এই দাঁড়া,সাবধানে।এত লাফালাফি করছিস কেন?আজকে তোকে সব ঘুরে দেখাব।আজকের পর থেকে এখানে আসা তোর জন্য নিষিদ্ধ।’

আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘নিষিদ্ধ কেন?এটা আমার বাবারও পুকুর,যখন ইচ্ছে হবে তখনই আসবো।’

বলতে বলতে গাছের মরা ডালের সাথে পা বেঁধে পরে যেতে লাগলাম।উমান আমাকে ধরে রেগে বললেন,

‘দেখে হাঁটতে পারিসনা?এখনই তো পরে যেতি।বল আর কখনও এখানে আসবিনা,বল।’

আমিও কিঞ্চিত রেগে বললাম,

‘বলবব না।একশো বার আসবো।এখানেই থাকবো।’

উমান আমাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন,

‘আমি শুধু এটায় বলব এখানে অনেক ভয় আছে।বুড়িটা এমনি এমনি এখানে এসে বসে নেই।তুই যেন এখানে একা না আসিস সেজন্য বসে আছে।’

আমি হাঁটা থামিয়ে উমানের দিকে তাকালাম।গা টা কেমন যেন শিরশির করছে।উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘সত্যি এখানে ভয় আছে?’

উমান আমাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

‘হুম সত্যি।তুই একা এখানে কখনও আসবিনা ওকে?এখানে জ্বীন ভূত থাকে।’

উনাকে এমন সিরিয়াস হয়ে কথা বলতে দেখে একটু ভয় ভয় করছে।উনার একবাহু জড়িয়ে ধরে বললাম,

‘তাহলে চলুন এখানে থাকবনা।’

উনি মুচকি হেসে বললেন,

‘তোর নানুর বাসায়ও ভুত আছে।রাত হলেই অত্যাচার করে অনেক।আমার ব্যালকনি থেকে দেখা যায় নানুর বাসার ছাদে সাদা শাড়ি পরে কুচকুচে কালো একটা মেয়ে ঘুরে বেরায়।আজকে রাতে থাকলে তুই ও দেখতে পাবি।উঠোনের ওই মোটা আম গাছেও জ্বীন থাকে,ওরা রাতের বেলা ঘুরাফিরা করে।’

এসব শুনে ভয়ে উমানকে টানতে টানতে নানুর বাসায় নিয়ে আসলাম।মিনি দাদির কাছেই থাকলো।আমি আম্মুকে বলতে এসেছিলাম রাতে এখানে থাকবোনা।আম্মু আর নানি মাটির চুলোয় দুপুরের খাবার রান্না করছে দেখে ওসব কথা ভুলে আমিও কিচেনে ঢুকে গেলাম।কৌতূহলি হয়ে আম্মুকে বললাম,

‘আম্মু আমিও রান্না করব।’

আম্মু কিছু বলার আগেই উমান বললেন,

‘তোকে রান্না করতে হবে না,চল তোকে ফিজিক্স শিখায়।পড়াশুনা তো একদম ছেড়েই দিয়েছিস।এভাবে চললে ফেইল করবি।’

আম্মু উমানের কথায় সায় দিয়ে বলল,

‘হ্যাঁ যাও,ভাইয়ার সাথে প্রবলেম নিয়ে ডিসকাস কর।উম,তুমি ওকে মোশনের চ্যাপটারটা একটু বুঝিয়ে দিও তো।নিউটনের সূত্র ভাল বুঝতে পারেনা।আমার ব্যাগে ছোট একটা খাতা আর কলম আছে দেখ।’

উমান মুচকি হেসে বললেন,

‘আচ্ছা আমি দেখছি।’

আম্মু তরকারিতে ঝোল দিয়ে বলল,

‘মিতি যাও,ভাইয়াকে খাতা কলম বের করে দাও।’

রাগ করে রুমে আসলাম।আম্মুর ব্যাগ খুলে খাতা কলম নিয়ে বিছানায় ছুড়ে মারলাম।উমান আমার মাথায় চাটি মেরে বিছানায় গিয়ে বসে বললেন,

‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।এটা নিউটনের থার্ড ল,আয় তোকে বুঝিয়ে দিই।’

টেবিলের উপর কাচের গ্লাস ছিল মেঝেতে ছুড়ে তেজি গলায় বললাম,

‘আপনাকে আমার অসহ্য লাগছে।’

উমান ভ্রু কুচকে বললেন,

‘কেন?’

উল্টো দিকে ঘুরে বুকে হাত গুজে দাঁড়ালাম।কেন সঠিক জানিনা তবে আন্দাজ করতে পারছি।আম্মু বার বার বলছে ভাইয়ার কাছে শিখতে,ভাইয়াকে খাতা কলম খুঁজে দিতে।এসব শুনতে ভাল লাগছেনা।উমান কাউকে কিছু বলছেন না তাই রাগ হচ্ছে।উমান বিছানা থেকে উঠে এসে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

‘এত ভাঙলে সবাই যে তোকে মিসেস ভাঙ্গা বলে ডাকবে।’

মেজাজ আরও তিরিক্ষি হয়ে গেল।চেঁচিয়ে বললাম,

‘চলে যান এখান থেকে।আমার নানুর বাসায় আপনি এসেছেন কেন?’

আমার চেঁচামেচির আওয়াজ কিচেন পর্যন্ত চলে গিয়েছে।আম্মু কিচেন থেকে চেঁচিয়ে বলল,

‘এই কি হয়েছে?আসছি আমি।’

উমান আমাকে ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রেগে বললেন,

‘এত খারাপ হয়েছিস কেন তুই?’

আমিও রেগে বললাম,

‘আমি খারাপ?আপনিই খারাপ।’

আম্মু শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রুমে ঢুকে রেগে বলল,

‘মিতি!কি বলছো?বড় ভাইয়ার সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?কি হয়েছে উম?’

উমান আম্মুর পাশে এগিয়ে গিয়ে বললেন,

‘গ্লাস ভেঙ্গে বলছে,আমাকে নাকি অসহ্য লাগছে।পড়া বুঝিয়ে নিবে না।’

আমি উনার দিকে দুধাপ এগিয়ে গিয়ে বললাম,

‘মিথ্যে কথা।আমি একবারও বলিনি পড়া বুঝিয়ে নিব না।আপনি আমাকে মিসেস ভাঙ্গা বললেন সেটা?চলে যান এখান থেকে,আমার নানুর বাসায় আপনাকে থাকতে দিব না।’

আম্মু আমার গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিয়ে বলল,

‘তুই চলে যা এখান থেকে।আমার বাবার বাসায় তোকে থাকতে দিব না।’

গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।মিনি দাদির একটা কাজের লোকের সাথে চলে এসেছে।আম্মুর আঁচল টেনে বলছে,

‘আম্মু চকি খাব।’

আমি উল্টো দিকে ঘুরে আমার ছোট ব্যাগ কাঁধে নিয়ে গট গট করে হাঁটা দিলাম।আমার ব্যাগে চকলেট আছে।একটা চকলেটও দিব না হু।আম্মু উমানকে বলল,

‘দুপুরে খাওয়ার সময় নিয়ে এসো ওকে।এখানে থাকতে অসুবিধে হচ্ছে,ফ্যান নেই তাই গরমে রেগে যাচ্ছে।তুমি কিছু মনে কর না।’

উমানের কথা কিছু শুনতে পেলাম না।আসার সময় নানিকে না বলেই দৌঁড়ে বেরিয়ে আসলাম।এত কিছুর পর উমানদের বাসায় যাওয়ার কোন মানেই হয়না তাই এক দৌঁড়ে পুকুর পাড়ে চলে আসলাম।দাদি যেই ঘাটে বসে ছিল সেটা এখন ফাঁকা।আমি দৌঁড়ে এসে দাদির বসার জায়গায় বসলাম।সকাল সাড়ে এগারোটার মতো বেজে গিয়েছে।রোদে পুকুরের পানি চিকচিক করছে।শেষ সিঁড়িটায় দুটো ছোট মাছ এসে শ্যাওলা খাচ্ছে।এমন অদ্ভুত সুন্দর মাছ আমি আগে কখনও দেখিনি।মাছ দুটো এত স্বচ্ছ যে ওদের শরীরের ভেতরে নাড়িভূরিও দেখা যাচ্ছে।ওদের ধরার প্রবল ইচ্ছা হচ্ছে।ব্যাগ রেখে শেষ সিঁড়িটায় নেমে এলাম।মাছ দুটো আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে আরও দুটো সিঁড়ি নিচে নেমে গেল।পানি স্বচ্ছ হওয়ায় এখনও ওদের দেখা যাচ্ছে।আমি পানিতে পা ভিজালাম।আর এক সিঁড়ি নিচে নেমে পায়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।সবুজ শ্যাওলার উপর আমার পা দেখতে ভালই সুন্দর লাগছে।শ্যাওলাগুলো পায়ের নিচে সুরসুরি দিচ্ছে।কিছুক্ষণ পরই ছোট ছোট মাছ এসে আমার পা ঠোকরাতে লাগলো।আমি সুরসুরি পেয়ে পায়ের আঙুল গুলো নড়াতে লাগলাম।হঠাৎ একটা পাখির কর্কশ ডাক শুনে মাথার উপর গাছের ডালে তাকালাম।আশেপাশে কোন পাখি নেই।গা ছমছম করে উঠলো।উমানের কথা মনে পরলো।এখানে অনেক ভয় আছে,একা আশা নিষেধ।ভয়ে পেয়ে তাড়াহুড়ো করে উঠে আসবো তখনই শ্যাওলাতে পা স্লিপ করে পানিতে পরে গেলাম।

সাঁতার জানিনা,আতংকে হাত পা অবশ হয়ে আসতে লাগলো।নিচের দিকের পানি বরফের মতো ঠান্ডা উপরের পানি গরম।পুকুরটা মনে হয় অনেক গভীর।আমার নাক মুখ দিয়ে পানি ঢুকছে।আমি ধীরে ধীরে গরম অঞ্চল থেকে ঠান্ডা অঞ্চলে চলে যাচ্ছি।হাত দিয়ে পানি ঝাপটাচ্ছি কোন লাভ হচ্ছেনা,ডুবে যাচ্ছি।পানির মধ্যে সবুজ আর হলুদ আলো দেখতে পাচ্ছি।পানি খেয়ে খেয়ে পেট ঢোল।বাঁচার কোন আশা নেই।বাবাকে মনে পরছে।ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে হাঁটা শিখছি,বাবা আমাকে টাওয়ালে মুড়িয়ে কোলে নিয়ে ঘুরছে আমি ঘুমোচ্ছি এসব চোখের সামনে ভাসছে।বুঝতে পারছি এসব আমার ভ্রম।অত ছোট বেলার কথা কারও মনে থাকেনা।আমি চোখ খিচে বন্ধ করে আরও কয়েক ঢোক পানি খেলাম।পেটে আর পানি ধরছেনা,একদম গলায় এসে ঠেকেছে।হাত-পা নড়ানোরও আর শক্তি পাচ্ছিনা।নিস্তেজ হয়ে তলিয়ে গেলাম।

চলবে………………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here