গল্প:-মনের মহারাণী
লেখিকা:-Sohani Simu
পর্ব:-১৯
আমার শরীর মোটেই ভাল লাগছেনা।নিঃশ্বাস নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে।শুয়ে থেকে স্বস্তি পাচ্ছি না কিন্তু উঠে বসলেই উমান দুই বাহু ধরে শক্ত করে বিছানায় চেপে ধরে রাখছেন।উনার এক কথা ইউ নিড সাউন্ড স্লিপ।তাই অসহ্য লাগলেও শুয়ে আছি।চোখে ঘুম নেই।আতংকে হাত-পা এখনও কাঁপছে।আঘাতের পরিমাণ কম হলেও বেশি লোক দেখে আজকে প্রচুর ভয় পেয়েছি।এখন মধ্যরাত তাই ভয়ের পরিমাণ আরও তীব্র হয়েছে।রুমে আলো জ্বলছে।আলো চোখে লাগছে,ভাল লাগছে না এই আলো কিন্তু ভয়ের জন্য বন্ধ করতেও ইচ্ছে করছে না।উমান আমার পাশেই আধশোয়া হয়ে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।কত কথা বলতে ইচ্ছে করছে উনাকে কিন্তু কিছু বলতে পারছিনা।হাজার অস্বস্তি নিয়েই চোখ বন্ধ করে থাকলাম।
সকালে ঘুম ভাঙলে নিজেকে উমানের বুকের মধ্যে আবিষ্কার করলাম।দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছি উনাকে।উনিও একহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছেন।বন্ধ চোখ আর এলোমেলো চুলে উনাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই উনি নড়ে চড়ে উঠে আমাকে আরও কাছে টেনে নিলেন।আমার গালে গাল ঠেকিয়ে ঘুমঘুৃম কন্ঠে বললেন,
‘গুড মর্নিং মহারাণী।’
দুদিন আগেই ক্লিন শেভ নিয়েছিলেন তাই আজকে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো কাঁটার মতো লাগছে।উনাকে ঠেলে মুখ কুচকে গাল সরিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে বললাম,
‘সরুন,ঘুমোতে দিন।’
উনি আমার পায়ের উপর উনার একশো মণ ওজনের পা আর পেটের উপর ৫০ মণ ওজনের হাত তুলে দিলেন।উন্মুক্ত পেটে হাতের ছোঁয়া পেতেই ফট করে চোখ খুললাম।দুজন এক চাদর গায়ে দিয়ে আছি।চাদরের ভেতরে উঁকি দিতেই চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হল।এ আমি কেমন অদ্ভুত পোষাক পড়ে আছি!!শাড়ি কোথায় গেল আমার!উনাকে ঠেলে সরিয়ে উঠে বসে চাদর গায়ে জড়িয়ে নিয়ে দেখি শাড়ি সোফার উপর পরে আছে।উমানের টিশার্ট ধরে টানতে টানতে বললাম,
‘উম আমার শাড়ি ওখানে কেন?এনে দিন।’
উমান কপালের উপার হাত দিয়ে ঘুমঘুম কন্ঠে বললেন,
‘হুম আনছি।’
পাঁচমিনিট পরও উনি শাড়ি এনে দিলেন না।আমি উনাকে ঘুম থেকে টেনে তুললাম।উনি শুয়ে থেকেই চোখ ডলতে ডলতে বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘শাড়ি পড়তে হবেনা অন্য ড্রেস পর।’
আমি ভীত চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ওয়াশরুমে যাব।’
উনি আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললেন,
‘তো যা না,কে ধরে আছে?’
‘আপনিও চলুন।’
উনি ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে উঠে বসলেন।আমার গলা থেকে চাদর সরিয়ে কাটা জায়গায় হাত দিয়ে দেখে বললেন,
‘ব্যথা করছে?’
আমি মুখ মলিন করে বললাম,
‘একটু একটু।’
তারপর উনি কিছু বলার আগেই চোখ বড় বড় করে বললাম,
‘ওই লোকগুলোর কি হয়েছিল?আপনি দুটো হয়ে গিয়েছিলেন কিভাবে?ওরা কে ছিল?ভয় লাগছে আমার।’
উনি বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে নেমে জানালার কাচ খুলতে খুলতে বললেন,
‘কিসের এত ভয় তোর?আমি আছি তো।ওরা আর আসবেনা,ওদের বেঁধে রেখেছি।’
আমি বিছানার উপর হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম,
‘কোথায় বেঁধে রেখেছেন?বলুন না কারা ওরা?আপনার পেছনে কেন পরে আছে?’
উনি জানালা খুলে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।আমার দুই গালে হাত রেখে বললেন,
‘পরে বলব আগে ফ্রেশ হয়ে খাবি তারপর মেডিসিন আছে।’
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে উমানের হাত ধরে পুরো বাসা আমি নিজে সার্চ করে দেখলাম।কোথাও কাউকে লুকিয়ে থাকতে না দেখে ভয়টা একটু কমলো।এখন উমানকে নিয়ে ড্রইংরুমের সোফায় বসেছি সব ঘটনা শোনার জন্য।উমান কিছুতেই মুখ খুলছেন না।উল্টো রেগে গিয়ে আমাকে ধমক দিচ্ছেন।আমি উনার হাত ঝাকিয়ে জেদ ধরে বললাম,
‘বলুন না,কাউকে বলব না আমি।’
উনি ঝারা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে বললেন,
‘এই সর তো এখান থেকে,খেলা দেখতে দে।’
টিভিতে নিউজিল্যান্ড বনাম সাউথ আফ্রিকার ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে।পাঁচ বলে দুই রান করলেই সাউথ আফ্রিকা জিতে যাবে।খেলায় টান টান উত্তেজনা।সবার ধারণা আর এক বলেই খেলা শেষ হয়ে যাবে।উমান আগ্রহ নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে আছেন।বোলার বল করতে দৌঁড় দিয়েছেন আর আমি টিভির স্ক্রিনে রিমোট ছুড়ে মেরেছি।টিভি যে ভেঙ্গে যাবে আমি বুঝতে পারিনি।ভীত চোখে উমানের দিকে তাকালাম।উনি রাগ কন্ট্রোল করার জন্য বড় বড় দুটো নিঃশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
‘আর কি কি ভাঙবি বল তো তুই?তোর হাত টায় ভেঙে দেওয়া উচিত।’
বলেই উনি আমার হাত চেপে ধরলেন।আমি ভয়ে কান্না মুখ করে বললাম,
‘না।আমার হাত ভাঙবেন না।আমি আর কিছু ভাঙবো না।ওই লোকগুলোর কথা বললে আর কোন কিছু ভাঙবোনা।’
উমান আমার হাত মোচার দিলেন।আমি একটুও ব্যথা পাইনি কিন্তু ভয়ে এক চিৎকারে বাসা কাঁপিয়ে ফেলেছি।উমান চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করেছেন আর আমি এখন খুক খুক করে কাশছি।তখনই পেছন থেকে কেউ বললেন,
‘এই কি হয়েছে তোদের?উম?কি করেছিস ওকে?’
বাসায় তো আমি আর উমান ছাড়া কেউ নেই তাহলে কে কথা বলল?ওই লোকগুলো আবার আসলো নাকি!!ভয় পেয়ে উমানকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার দিয়ে বললাম,
‘উম!!!””ওরা আবার এসেছে!!!’
এবারের চিৎকারে মনে হয় গলা ফেঁটে গিয়েছে।উমান আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন,
‘উফ্ কান মনে হয় নষ্টই হয়ে গেল।তুই ও আসার আর টাইম পেলিনা।’
আমি উমানকে জড়িয়ে ধরেই কাশতে লাগলাম।উমান বললেন,
‘দাঁড়িয়ে দেখছিস কি পানি নিয়ে আয় একটু।’
তারপর উমান আমার মাথার পেছনে হাত রেখে বললেন,
‘কাম ডাউন।সাদ এসেছে।ভাই হয় তোর।কিছু বলবেনা।’
উনার কথা শুনে পেছনে তাকালাম।ডাইনিংয়ে উল্টোদিক ঘুরে একটা ছেলে গ্লাসে পানি ঢালছে।পেছন থেকে ছেলেটাকে উমানের মতোই দেখাচ্ছে।উমানের মতোই কালো টিশার্ট আর প্যান্ট পরে আছেন।এটাই তাহলে সাদ ভাইয়া?উনি কোথায় থেকে আসলেন?ভাবতেই সাদ ভাইয়া পানির গ্লাস নিয়ে আমার দিকে ঘুরলেন।অহ মাই গড!এ আমি কি দেখছি।সাদ ভাইয়াকে দেখে মনে হচ্ছে উমানের যমজ ভাই।মুখের গড়ন অনেকটা একই রকম।দুজনারই লম্বাটে মুখ,তরতরে নাক,চুলের স্টাইলও এক শুধু উনি একটু উমানের থেকে কম ফর্সা আর মুখে একটু কাটা ছেড়ার দাগ।আমি মনে হয় কাল রাতে দুটো উমান নয়,একটা উমান আর একটা সাদ দেখেছি।এখন প্রশ্ন হল উমান আর সাদ ভাইয়া তো মামাতো ফুফাতো ভাই তাহলে চেহারায় এত মিল কিভাবে?উমানকে ছেড়ে দিয়ে উনার একবাহু জড়িয়ে ধরে বললাম,
‘এই উম,সাদ ভাইয়া আপনার মতো দেখতে কি করে হল?’
উমান মৃদু হেসে বললেন,
‘আমি হয়েছি বাবার মতো দেখতে আর ও হয়েছে ফুপির মতো দেখতে।বাবা,চাচ্চু আর ফুপি যে একই রকম দেখতে।কিন্তু তুই চাচ্চুর মতো না হয়ে ডাইনি বুড়ি আনারকলির মতো দেখতে হয়েছিস।মিনিটা আমাদের মতো হয়েছে,অনেক সুন্দর।’
উনি বলতে বলতে সাদ ভাইয়া আমার পাশে বসে আমার দিকে গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘মামা যখন বলেছিল তুই ওই ডাইনিটার মতো হয়েছিস উম আমাকে এক কেজি মিষ্টি ট্রিট দিয়েছিল।’
উমান চোখ রাঙিয়ে বললেন,
‘ওই শাট আপ।’
সাদ ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,
‘কিসের শাট আপ?তুই বলিসনি ডাইনিটাকে তোর ভাল লাগে।ওটার সেম কপি চাই।’
আমি পানি খাচ্ছি আর সাদ ভাইয়াকে দেখছি।ফুপিকে আমি দেখেছি আর বড়াব্বুকেও দেখেছি।এরা সবাই প্রায় একরকম!এত মিল!আমি যে কেন বাবার মত সুন্দর হলাম না!!মিনিটা বাবার মতো সুন্দর হয়েছে।কিন্তু আমি ওই ডাইনি আর খচ্চরনি বুড়ির মত কোনদিন হইনি হু।আমি আম্মুর মতো হয়েছি।আমার আম্মু সবার থেকে সুন্দর।কিন্তু সাদ ভাইয়ার মুখে এত কাটা ছেড়া দাগ কেন?ভেবেই আমি সাদ ভাইয়াকে বললাম,
‘ভাইয়া আপনার মুখে এসব কিসের দাগ?’
উনি মুখে হাত দিয়ে বললেন,
‘কিছুদিন আগে এক্সিডেন্ট হয়েছিল সেজন্য।’
কিসের এক্সিডেন্ট!ওয়ান মিনিট,উমান তো বলেছিলেন সাদ ভাইয়া মারা গেছে তাহলে ফিরে আসলো কিভাবে!আমার ভাবনার মাঝেই সাদ ভাইয়া উমানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘মামা জানে তুই ওকে বিয়ে করেছিস?’
উমান ভাব নিয়ে বললেন,
‘না।’
আমি সাদ ভাইয়ার মারা যাওয়ার প্রসঙ্গটা তুলবো কিন্তু দুজনার কথার ভিরে কথা ঢুকাতে পারছিনা।উনার কথা শুনে সাদ ভাইয়া অবাক হয়ে বললেন,
‘না?এখন কি হবে?’
উমান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন,
‘যা হওয়ার হবে।চাচ্চু কিছু বলবেনা।’
সাদ ভাইয়া অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন,
‘এটা তুই ঠিক করিসনি।মিতির তো বিয়ের বয়সই হয়নি।এখনই এসব,মামা একদম ভালভাবে নিবে না।তুই কি আর মিতি কি।দশ-বারো বছরের ডিফারেন্স না?’
আমি অবাক হয়ে মনে মনে বললাম দশ-বারো বছর!!আমার তো মাত্র ষোল।শেষে কিনা সাতাস-আঠাশ বছরের বুড়োর সাথে বিয়ে হল?উমান কিঞ্চিত বিরক্ত হয়ে সাদ ভাইয়াকে বললেন,
‘ওর বয়স হয়নি সেটা ওকে বল।আমার বিয়ের বয়স হয়েছে আমি বিয়ে করে নিয়েছি।’
উমানের কথা শুনে আমি গলা ঝেরে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললাম,
‘সাদ ভাইয়া জানেন?উম আমাকে জোর করে বিয়ে করেছে।দড়ি দিয়ে হাত পা বেঁধে মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে বলেছিল বিয়ে না করলে মাথা ফুটো করে দিবে।’
উমান ধপ করে আমার পিঠে থাবা দিয়ে বললেন,
‘ওই ডাইনি আনারকলিটাও আমার নামে এভাবেই নালিশ করে আর তুইও করছিস?তোকে তো আমি ফু দিয়ে উড়িয়ে দিব।’
সাদ ভাইয়া ভ্রু কুচকে বললেন,
‘মামা শুনলে কিছু বলবেনা?’
উমান পায়ের উপর পা তুলে বললেন,
‘কি বলবে?এই পেত্নীর জন্য আমার চেয়ে ভাল জামাই পাবে কোথাও?আমি বিয়ে না করলে তো এর বিয়েই হবেনা।মুুখের যা শ্রী তার নাম আবার দ্যা প্রিন্সেস।’
আমি নাক মুখ ফুলিয়ে বললাম,
‘আপনি একবারও নিজের মুখ আয়নাতে দেখেছেন?এই কালো টিশার্টে আপনাকে একদম ভাল্লুকের মতো দেখাচ্ছে।এই যে দেখুন এখানে লিখাও আছে ‘বিয়ার আ হ্যান্ড’।আপনি জানেন বিয়ার মানে ভাল্লুক।আপনি একটা ভাল্লুক সেজন্য আপনার টিশার্টেও ভাল্লুক লিখা আছে।’
উমান আমার গাল টিপে ধরে বললেন,
‘ইদানীং খুব বেশি কথা বলছিস।তুই জানিস বিয়ার আ হ্যান্ড মানে সাহায্য করা?অশিক্ষিত একটা!!’
সাদ ভাইয়া উমানকে ঝারি দিয়ে বললেন,
‘উম!কি করছিস,ছাড় ওকে।’
উমান আমার গাল ছেড়ে দিতেই আমি সাদ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘আপনি খুব ভাল সাদ ভাইয়া।আর উনি খুব খারাপ।আমাকে অনেক মারেন।সেদিনই চড় মেরেছিলেন,
এখনও গাল ব্যথা করে।’
সাদ ভাইয়া উমানের কাছে এমনটা আশা করেননি সেটা উনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।সাদ ভাইয়া রেগে উমানকে বকা দিতেই উমান বললেন,
‘আর ও কি করেছে সেটাও শোন।সারাদিন আমার সাথে কথা বলেনি,খায়ওনি কিছু।স্বপ্নের মধ্যে কি বলে জানিস?নিষাদের সাথে পালিয়ে যাবে।থাপ্পড় দিব নাতো কি করব?একে তো খুন করা উচিত।’
নিষাদ ভাইয়ার কথা সাদ ভাইয়াকে কেন বলতে হবে?আমি কিঞ্চিত রেগে উনার হাতে খামচি দিলাম।উমান আমার গাল টেনে ধরলেন।আমি উনার চুল ধরতেই উনি আমার গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন।
চলবে………………….