গল্প:-মনের মহারাণী
লেখিকা:-Sohani_Simu
পর্ব:-০৫
প্রেশার কুকারের সিটির আওয়াজ পেয়ে ঘুম থেকে উঠলাম।সকাল হয়ে গিয়েছে।জানালার পর্দা গুলো সব খুলে দেওয়া তাই সূর্যের কিরণ এসে মেঝেতে পরে পুরো রুম ঝকঝক করছে।দেয়ালের শৌখিন ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি দশটা দশ বাজে।এতক্ষণ ঘুমোলাম!তাড়াহুরো করে বিছানা থেকে নেমে বিছানা গুছিয়ে নিলাম।ওয়াশরুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে মাথায় চিরুনি করতে শুরু করেছি তখনই উমান ভাইয়া রুমে আসলেন।আমি আয়নাতে উনাকে দেখতে পেয়ে হকচকিয়ে লাফিয়ে উঠেছি কারন উনার মুখে ময়দা লেগে আছে।আমি পেছনে ঘুরে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘আপনি এখানে কেন?মুখে কি যেন লেগে আছে।’
উনি আমার দিকে এগিয়ে আসলেন।আয়নার দিকে উকি দিয়ে গালের ময়দা গুলো টিশার্টের হাতায় মুছতে লাগলেন।আমি দুই হাতে চিরুনি ধরে রেখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।উনি সাদা কালার একটা ঢোলা টিশার্ট আর নিচে বাবার লুঙ্গি পরে আছেন।উনাকে দেখে আমার হাসি পাচ্ছে কিন্তু হাসলে যদি উনি রিয়্যাক্ট করেন সেজন্য চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।উনি মুখের ময়দা মুছে ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকালেন।আমার খোলা চুলে হাত দিয়ে সন্দেহী চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘গোসল করিসনি?এগুলো শুকনো কেন?’
আমি চুল থেকে উনার হাত সরিয়ে দিয়ে বললাম,
‘এত সকালে গোসল করিনা আমি।’
উনি আমার হাত ধরে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বললেন,
‘ছিঃ মিতি!তুই খুব অপরিচ্ছন্ন।সারারাত বরের সাথে শুয়ে থাকলি তাও গোসল দিলি না?যা ঢোক,একদম ফরজ গোসল দিবি।’
উনি আমাকে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন।লজ্জায় আমি আর একটা কথাও বলতে পারিনি।এত লজ্জা লাগছে যে দুই হাতে মুখ ঢেকে ওয়াশরুমের দেয়ালে হেলান দিয়ে পায়ের নখ খুটলাচ্ছি।প্রায় দশমিনিট এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আরও কুঁড়ি মিনিট ধরে গোসল করার পর খেয়াল হল আমি কোনো ড্রেস নিয়ে আসিনি।ভেজা কাপড়ে রুমে যেতে হবে,ধূর ভাল্লাগেনা!
শাওয়ার অফ করে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসলাম।রুমে উমান ভাইয়া নেই।সট সট করে হেঁটে আলমারি সামনে আসলাম।আলমারি খুলে হলুূদ কুর্তি আর কালো জিন্স নিয়ে উল্টোদিক ঘুরতেই উমান ভাইয়ার সাথে ধাক্কা খেলাম।উনি আমার হাত থেকে ড্রেস গুলো নিয়ে বিছানায় ছুড়ে ফেলে আমার হাতে আম্মুর একটা লাল কালার শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘এটা পরে আয়।’
শাড়ি আমার অসহ্য।আমি কিছুতেই এটা পরবো না কিন্তু উনাকে ডিরেক্ট না বললে হয়তো জোর করবেন তাই ইনিয়ে বিনিয়ে বললাম,
‘আমি তো এটা পরতে পারিনা।’
উনি মুচকি হেসে বললেন,
‘নো প্রবলেম আমি পরিয়ে দিব।’
আমি গোল গোল চোখ করে উনার দিকে তাকালাম।এখন কি বলবো?ভাব মিতি ভাব।ভাবতে ভাবতেই ফট করে উনাকে বললাম,
‘আমার তো ব্লাউজ পেটিকোট নেই।ওসব না থাকলে শাড়ি পরা যায়না।’
উনি নিচের ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে তাকালেন।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ওসব ছাড়াই পরে দিব।যা চেন্জ করে আয় আগে।’
উনার কথা শুনে মাথার মধ্যে ভো ভো করতে লাগলো।উনাকে বেশি ঘাটালে আরও বেফাস কথা উনি বলবেন।উনার মুখে কিছুই আটকায়না খুব ভাল করে বুঝতে পারছি।আমি আর কথা না বারিয়ে আলমারি খুলে আমার ব্লাউজ পেটিকোট বের করে উনার হাত থেকে শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বললাম,
‘আমি শাড়ি পরতে জানি।আপনি নিজের কাজ করুন।’
উনি পেছন থেকে আমার ভেজা চুলগুলো মুঠো করে ধরলেন।আমি ব্যথা পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম।উনি আমার হাত থেকে শাড়ি নিয়ে বিছানায় ছুড়ে ফেললেন।পেছন থেকে আমার গালে গাল ঠেকিয়ে বললেন,
‘ওকে আমি তাহলে এখন নিজের কাজই করি।বউয়ের ভেজা ঠোঁটে কিস করতে হবে।’
আমি নিজের চুল ছাড়াতে ছাড়াতে রেগে বললাম,
‘ছাড়ুন!এসব কি ধরনের অসভ্যতামি উম ভাইয়া?’
উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।আমি তো চরম অবাক হয়েছি।এত সহজে ছেড়ে দিলেন!অদ্ভুত!আমিও আর দাঁড়িয়ে না থেকে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে চেন্জ করে নিলাম।
সাড়ে এগারোটার দিকে রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে আসলাম।খুব ক্ষুধা পেয়েছে,কিছু খাওয়া দরকার।উমান ভাইয়া ড্রইং রুমের মেঝেতে বসে খুব মন দিয়ে মিনির শিশু শিক্ষা বইগুলো পড়ছেন।আমি ফিক করে হেসে দিলাম কিন্তু সেই হাসি উনার কান পর্যন্ত পৌঁছালেও মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছালো না।আমি মুখ ভেঙচিয়ে কিচেনে গেলাম।ফ্রিজে কিছু নেই।বাসায় কোন খাবারই নেই।রাজশাহী যাবার আগে সবকিছু ফেলে দিয়েছিলাম কিন্তু স্টোভের উপর প্রেশার কুকার রাখা আছে।খুলে দেখি মাংশের ভূনা।আমার ঠোঁট প্রসারিত হল কিন্তু পরক্ষণেই মন খারাপ হয়ে গেল কারন আমি খাসির মাংশ খেতে পারিনা,গন্ধ লাগে।প্রেশার কুকারের ঢাকনা লাগিয়ে থমথমে মুখ করে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলাম।টেবিলের উপর কিছু খাবার ঢেকে রাখা আছে।খুশি হয়ে সেগুলোর ঢাকনা সরিয়ে দেখি ওই একই খাবার।মাংশ আর রুটি।অন্য একটা বাটিতে বিরিয়ানি রাখা আছে কিন্তু সেটার মধ্যেও মাংশ দেওয়া।ক্ষুধাই পেট চো চো করছে।ফোনটাও নেই যে বাহিরে থেকে খাবার অর্ডার করব।আমি মন খারাপ করে উমান ভাইয়ার দিকে তাকালাম।উনি ভ্রু কুচকে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছেন।আমি যে জ্যান্ত একটা মানুষ এখানে বসে আছি সেদিকে উনার কোন নজর নেই।আমি মুখ ফুলিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘এসব খাই না আমি।’
উনি একবার আমার দিকে তাকালেন তারপর আবার বইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ওভেনে আছে তোর খাবার।’
আমি মুচকি হেসে দ্রুত কিচেনে আসলাম।ওভেন খুলে দেখি গরম গরম মোগলাই পরোটা।একদম ফুলে ফেপে আছে।গন্ধেই আমার পেট অর্ধেক ভরে গিয়েছে।মোগলাই একটা প্লেটে নিয়ে চাকু দিয়ে পিস করে কাটলাম।তারপর ডাইনিংয়ে এসে মজা করে খেতে লাগলাম।খুব ভাল হয়েছে খেতে।ভেতরে অনেক ডিম দেওয়া আছে।এত ডিম দেওয়া মোগলাই কোন দোকানে পাওয়া যায়?ভেবেই আমি উমান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘এগুলো কোন দোকান থেকে এনেছেন?খুব ভাল হয়েছে খেতে।’
উনি বই গুলো সব বন্ধ করে সোফার উপর রাখলেন।মেঝে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে লুঙ্গি ঠিক করতে করতে বললেন,
‘ওগুলো আমি বানিয়েছি।’
আমি খাওয়া থামিয়ে একবার পরোটার দিকে তাকালাম তারপর আবার উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘আপনি এসব বানাতে পারেন?এত ভাল তো আম্মুও বানাতে পারেনা।’
আমি অবাক হয়ে উনাকে দেখছি।এই ছেলে নাকি মোগলাই বানিয়েছে।অবিশ্বাস্য!উনি আমার কাছে এগিয়ে আসলেন।আমার পাশে চেয়ার টেনে বসে নিজের প্লেটে খাবার নিতে নিতে বললেন,
‘কি হল?খাওয়া বন্ধ করে এমন হা করে তাকিয়ে আছিস কেন?খাইয়ে দিতে হবে?’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘আপনি রান্না করতে পারেন?’
উনি খেতে খেতে বললেন,
‘তুই কি আমাকেও তোর মতো আমড়া কাঠের ঢেকি মনে করেছিস?’
আমি ভ্রু কুচকে রাগী কন্ঠে বললাম,
‘আমি আমড়া কাঠের ঢেকি?’
উনি গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন,
‘ধীরে কথা বল।দেয়ালেরও কান আছে।ওরা যদি শুনে আমার বউ একটা অপদার্থ তাহলে আমার প্রেস্টিজ থাকবে?’
আমি দ্বিগুণ রেগে বললাম,
‘আমি আপনার বউ নই।আমি আপনাকে বিয়ে করিনি আর কোনদিন করবও না।’
উনি কয়েক ঢোক পানি খেয়ে গ্লাস রেখে মুচকি হেসে বললেন,
‘তুই জানিস,আমার বউ হওয়ার জন্য কত মেয়ে আমার পেছনে ঘুর ঘুর করে?আমি যদি একবার ইয়েস বলি একঘন্টার মধ্যে ওরা এখানে চলে আসবে।তোর এই কুড়েঘরে সবাইকে জায়গায় দিতে পারবিনা।’
আমি চেঁচিয়ে বললাম,
‘আপনিও জানেননা আমি একবার ইয়েস বললে একঘন্টার মধ্যে কতগুলো ছেলে এখানে চলে আসবে।’
উনি মৃদু হেসে বললেন,
‘হুহ্ তোর মতো ইলিটারেট,আনস্মার্ট,আগলি অ্যান্ড ম্যারিড অলছো মেয়েকে কেউ পাত্তায় দিবেনা।’
আমি তিরিক্ষি হয়ে খাবারের প্লেট ঠেলে সরিয়ে কাঁটা চামচ হাতে নিয়ে বললাম,
‘আমি অশিক্ষিত?আপনি জানেন আমি ক্লাস টেনে পরি?আপনিই অশিক্ষিত।শিক্ষিত হলে ওভাবে মিনির ওই নার্সারির বই গুলো পরতেন না।আর আপনি শুধু অশিক্ষিতও নয় আপনি একটা কানা সেজন্য আপনি আমাকে কালো দেখছেন।আপনি একটা গুন্ডা,আমার বাসার কাজের লোক আপনি সেজন্য আমার খাবার রান্না করেছেন আর………আর আপনি একটা চোরও। আমার বাবার দরকারি জিনিসপত্র চুরি করছেন।’
উনাকে এতগুলো কথা শুনাতে পেরে শান্তি লাগছে।উনি এতক্ষণ আমার কথা শুনছিলেন আর মজা করে খাচ্ছিলেন।আমার কথা শেষ হতেই উনি খাওয়া থামিয়ে বিদ্রূপ হেসে বললেন,
‘তোতলার মুখে দেখি খই ফুটছে।অ্যানাদার পয়েন্ট ইজ,ইউ আর আ স্টেমারার।’
উনার কথা শুনে আমার শরীর জ্বলে গেল।পানির গ্লাস মেঝেতে ছুড়ে মেরেছি।উঠে চলে আসবো তখনই উনি আমার একহাত ধরলেন।মুচকি হেসে বললেন,
‘তো আমার চাকরানী সাহেবা দুপুরে কি খাবেন বলুন?’
আমি চেঁচিয়ে বললাম,
‘আমি চাকরানী?? ‘
উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।খাবার খাওয়া হাতেই আমার গাল টিপে ধরে চোখমুখ শক্ত করে বললেন,
‘আওয়াজ কম হবে।আমি চাকর হলে তুইও চাকরের বউ আর চাকরের বউ চাকরানী হয়।পুরো বাসা মুছে দিবি।অনেক নোংরা হয়েছে।এখানে আমরা কয়েকদিন থাকবো সো কথা না বলে কাজে লেগে পর,গো।’
উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে আবার খেতে বসলেন।আমি গাল মুছতে মুছতে রেগে ধপধপ করে হাঁটতে হাঁটতে নিজের রুমে এসে সজোরে দরজা লাগিয়ে দিলাম।ওয়াশরুমে যেয়ে মুখ ধুয়ে সোজা ব্যালকনিতে আসলাম।এখানে আসার উদ্দেশ্য পাশের বিল্ডিংয়ের ছেলেদের হাত করে একটা ফোনের ব্যবস্থা করতে হবে তারপর ইমরুল আঙ্কেলকে সব জানাতে হবে।উমান ভাইয়ার মতিগতি আমার একদম ঠিক লাগছেনা।
ব্যালকনিতে এসে উমান ভাইয়ার ভেজা শার্ট-প্যান্ট দড়িতে ঝুলতে দেখে আমি আমার মোটিভটা ভুলেই গেলাম।মাথার মধ্যে শয়তানি বুদ্ধি এসে নাচানাচি করতে লাগলো।ড্রেস গুলো নিয়ে রুমে এসে টেবিল চেয়ারে বসে কাচি দিয়ে কাঁটতে লাগলাম।
প্রায় একঘণ্টা বসে থেকে ড্রেসগুলো কুচি কুচি করে কেঁটে শয়তানি হেসে বললাম,
‘উমের বাচ্চা উমান,কুত্তা,এখন কি পরে তুই বাইরে যাস সেটায় দেখবো।’
ছেড়া ড্রেস গুলো মেঝেতে ফেলে রুমের দরজা খুলে বাইরে আসলাম।কাচি ফোচাতে ফোচাতে হাত ব্যাথা হয়ে গিয়েছে।কাগজ কাটা কাচি দিয়ে জিন্সের প্যান্ট কাটা চারটি খানি কথা নয়।এত খাটুনি করে আমার তো খুব ক্ষুধা পেয়েছে।যাই মোগলাই গুলো খেয়ে আসি।
ড্রইং রুমে এসে উমান ভাইয়াকে নতুন প্যান্ট শার্ট পরে থাকতে দেখেই আমি ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসলাম।আমার এত খাটুনি সব বৃথা গেল।কিন্তু উনাকে কে ড্রেস এনে দিল!ভাবতেই উমান ভাইয়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বললেন,
‘চল রেডি হয়ে নে,শপিংয়ে যাব।’
আমি থমথমে মুখ করে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।উনি ভ্রু কুচকে বললেন,
‘হোয়াট?মুখ এমন করে আছিস কেন?’
আমি কাঁদবো কাঁদবো করতে করতে কেঁদেই দিলাম।উনি একটু ঘাবড়ে গিয়ে আমার পাশে বসে আমার গাল ধরে বললেন,
‘কি হয়েছে?কাঁদছিস কেন?বলবি তো কি হয়েছে।বাবার কথা মনে পরছে?’
আমি গাল থেকে উনার হাত সরিয়ে দিয়ে চোখ মুছে নাক টেনে বললাম,
‘বাবাকে সব বলে দিব।একবার আসুক শুধু।আপনাকে আমি পুলিশে দিব।’
উনি আমার গালে শব্দ করে কিস করে বললেন,
‘বাবাকে কি বলবি?যা বলার বলিস কিন্তু খবরদার ভাইয়া বলবিনা আমাকে।’
‘একশোবার বলবো,হাজার বার বলবো।ভাইয়া,ভাইয়া,ভাইয়া,উমান ভা..’
আর কিছু বলার আগেই উনি উনার ঠোঁট দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করে দিলেন।আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছি।
চলবে…………….