মনের কোণে🥀
#পর্ব_৯
আফনান লারা
.
‘আধ ঘন্টা ধরে হেঁটেই চলেছি অথচ তোমার সুমন ভাইয়ার দোকানের হদিস পাচ্ছিনা।অাদৌ আছে নাকি গোল খাওয়াচ্ছো আমায়?’
‘এতদূর এসে আমার কি লাভ হলো?আবার আপনাকে গোল খাওয়াতে যাবো কোন দুঃখে?’
নাবিল আর কিছু বলেনি,চুপচাপ হাঁটছে।গভীর রাত।প্রায় বারোটা সাড়ে বারোটার কাছাকাছি সময়।কালো ঘুটঘুটে অন্ধকার পথ ফেটে মাঝে মাঝে মানুষের বাড়ির আলো পথে এসে নামছে, তখনই হাঁটতে সুবিধা হয়।বাড়ি শেষ তো আলো শেষ,এরপর আবার অসুবিধা।চাঁদের আলো আছে তবে এত এত গাছগাছালিতে সে আলো হারিয়ে গেছে।
ফোনে চার্জ নেই যে টর্চ চালিয়ে পথ চলা যাবে।একটা একটা করে কঙ্কর লাগছে পায়ে।নাবিল একটা সময়ে বসেই গেলো একটা গাছের গুড়ির উপর।লিখি ওকে থামতে দেখে নিজেও বসলো, সে নিজেও ক্লান্ত।
পথে একটা মানুষ নেই।শুধু তারা দুজন।গন্তব্য বহুদূর।এমন সময়ে বাস ছেড়ে নেমেছে তারা যে কোথাও রিকশা নেই,গাড়ী নেই।পথটাই এমন।
নাবিল বোতলে থাকা শেষ ঢোক পানি খেয়ে নিয়েছে
এদিকে লিখি বারবার বলছে তার গলা শুকিয়ে গেছে।কথাটা আরও আগে বললে হয়ত এই পানিটুকু নাবিল খেতোনা।দুজনে এতই ক্লান্ত যে বসা থেকে উঠার শক্তিটুকু পাচ্ছেনা।
‘কাঁধ থেকে মাথা সরাও লিখি।অচেনা একটা মেয়ে হয়ে কি করে এত ফ্রি হলে তুমি?’
লিখি গাছে হেলান দিয়ে শুয়েছিল।নাবিলের কথা শুনে অবাক হয়ে পেছনে ফিরে বললো,’কে আপনার কাঁধে মাথা রেখেছে?আমি তো এখানে’
নাবিল পাশে ফিরে দেখলো একটা পাগল লোক ওর কাঁধে মাথা রেখেছিল, এখন আবার উঠে দাঁড়িয়ে লাফ দিয়ে বললো,’কিরে প্রেমকাহিনী কেমন আছিস তোরা?’
লিখি চোখ বড় করে উঠে দাঁড়িয়ে গেছে।নাবিল ও উঠে বললো,’আপনি কে?’
‘প্রেমকাহিনী তোরা আমায় চিনস না?আমি তোদের বাপ রে।বাপ’
লিখি নাবিলের কানে ফিসফিস করে বললো,’মনে হয় পাগল’
‘এই আমায় পাগল বলবিনা।আমি হলাম তোদের চেয়ে ভাল মানুষ।আমায় পাগল বললে আমার মাথার তার ছিঁড়ে যায়।বলবিনা খবরদার আমায় পাগল বলবিনা।খাবার আছে তোদের কাছে?’
‘না।কিছু নেই’
‘এই রাতে এখানে কি করিস তোরা?বাড়ি কোথায় তোদের?’
লিখি নাবিলের হাত টানতে টানতে দূরে নিয়ে আসলো।ওমা লোকটা যে জায়গায় ছিল ওখানেই দাঁড়িয়ে বকবক করে যাচ্ছে এখনও।
নাবিল আর লিখি পুনরায় হাঁটা ধরে।
অনেকক্ষণ পর তাদের সামনে একটা বাড়ি আসলো।ছনের ঘর।এটা সুমনের দোকান না।তবে হয়ত অন্য কারোর।
লিখি বললো সামনে আরও পথ বাকি আছে।কিন্তু নাবিল বললো সে এখানে কিছুক্ষণ থাকবে।
‘আরে বোঝার চেষ্টা করুন।গ্রামের মানুষদের চিন্তাধারা কেমন জানেন তো।ধরে বিয়ে পড়িয়ে দিবে।তখন কি করবেন?’
‘বলবো আমরা স্বামী- স্ত্রী। ‘
‘যদি প্রমাণ চায়?’
‘বোকাদের মতন কথা বলছো কেন?স্বামী স্ত্রীর আবার কিসের প্রমাণ? ‘
লিখির গাল এবার লাল হয়ে গেছে।অন্ধকারে ঝাপসা আলোয় নাবিল দেখলোনা।লিখির মানা করার সত্ত্বেও সে দরজায় কড়া নেড়েছে।একটা যুবতী মেয়ে দরজা খুললো তখন, গায়ে তার সুতির শাড়ি জড়ানো।নাবিলকে দেখে হা করে তাকিয়ে রইলো সে।
লিখি মেয়েটাকে দেখে ঘরের ভেতরে দেখার চেষ্টা করছে।
‘আপনারা কারা?’
‘আমাদের একটু পানি দিতে পারবেন?হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেছি’
‘আসুন বসুন এখানে’
নাবিল লিখিকে জোর করে ভেতরে এনে বসতে বসলো।বসার জায়গা বলতে নিচে বেতের পাটি বিছানো।বেতরে আলাদা রুম নেই।একটাই রুম মিলে একটা ঘর।মাঝে এনার্জি বাতি জ্বলে।বাহিরের বাতাস জানালা দিয়ে ঢুকে বাতিটা দোলনার মতন দুলছে।ঐ যুবতী মেয়েটা স্টিলের গ্লাসে করে পানি এনে নাবিলের হাতে দিলো। নাবিল এক চুমুক দিয়ে বললো আরেক গ্লাস ওর জন্য আনতে।
‘আর তো পানি নেই।কলসি ফাঁকা।এই টুকুই ছিল।ভোরে আবার যাব পানি আনতে’
নাবিল তাই নিজের গ্লাস্টা লিখির দিকে ধরলো
‘ইশ!আমি আপনার ঠোঁট লাগানো গ্লাসে খাবো?আমার বয়ে গেছে’
‘ভেবে নাও।পানি কিন্তু আর নেই,অনেকটা পথ হাঁটতে হবে’
লিখি কি আর করবে বাধ্য হয়ে গ্লাস হাতে নিয়ে বাকি পানিটুকু খেয়ে ফেরত দিলো গ্লাসটা।যুবতী সেই মেয়েটা এক দৃষ্টিতে শুধু নাবিলকেই দেখছে।নাবিল সেটা বুঝতে পেরে বারবার লিখির দিকে তাকাচ্ছিল।কিন্তু লিখির তো দুনিয়াদারির খবর নেই, সে গোটা ঘরটা পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত।
‘শুনছো?’
‘কি?’
‘মেয়েটা আমাকে কেমন নজরে দেখছে খেয়াল করেছো?’
‘আচ্ছা আপনারা কি জামাই বউ?’
নাবিল মাথা ঘুরিয়ে বললো,’হ্যাঁ।আচ্ছা এই ঘরে আর কেউ থাকেনা?’
‘আমার স্বামী থাকেন,উনি মাছ ধরতে নদীতে গেছেন’
‘আর কেউ নেই?’
‘না।আপনারা মুড়ি খাবেন?’
“না না,আজ আসি।ধন্যবাদ’
মেয়েটা তাও নাবিলের মুখের দিকে চেয়ে রইলো।নাবিলের কেমন অস্বস্তি লাগছে।সে লিখির হাত টেনে বেরিয়ে পড়লো ঘর থেকে।
‘একটু জিরোতে পারতাম,এত টানাটানি করতেছেন কেন?’
‘ঐ মেয়েটা কেমন করে তাকাচ্ছিল।যে পানি খাইছি গলা আবার শুকিয়ে গেছে আমার ‘
‘ভাল হয়েছে।আপনারই তো বেশি আগ্রহ ছিল এই বাড়িতে ঢোকা নিয়ে।হলো শান্তি?’
নাবিল আবারও চুপ করে থেকে হেঁটে চললো।লিখি হঠাৎ করে বললো,’এসে গেছি।ঐ তো সুমন ভাইয়ার দোকান’
ছুটতে ছুটতে এসে সে হাজির সেখানে।কিন্তু ভুল ধারনা ছিল, এটা দোকান না, একটা বাড়ি।তবে সুমনেরই বাড়ি।তাও অন্তত ওর নাগাল পেলো ভেবে কলিজা ঠাণ্ডা হলো লিখির।দরজা ধাক্কানোর পর সুমনের বোন এসে দরজা খুলে বললো,’আপনি লিখি আপু?’
‘হ্যাঁ’
‘আসেন ভেতরে আসেন’
লিখি তাড়াহুড়ো করে ঢুকে বললো,’আমায় একটা ডিম ভেজে এনে দাও।আমার অনেক খিধে পেয়েছে’
সুমনের বোন ফিক করে হেসে বললো,’ঘরে কিছু না থাকলে মানুষ ডিম ভেজে খায়,কিন্তু মায়ে তো আপনাদের জন্য পোলাও,কোর্মা বানিয়েছে আজ’
‘তাহলে সেটাই আনো।আমি তো বুঝাইতে চাইলাম আমার খিধে পেয়েছে’
নাবিল ব্যাগ রেখে ওর পাশে বসে বললো ‘আমার ফোন যে ফেরত নিতে এসেছি এটা কি জানে ওরা?এমন খাতির তো গড়বড়ের লক্ষণ। ‘
‘এখন অবধি জানেনা।পরে জানাবো।হ্যালো ভাইয়া’
কথা বলতে বলতে লিখি একটু দূরে চলে গেলো।
‘আমাকে বললেনা এতদূর তুমি কেন আসলে?তোমার সাথে নাকি আরেকজন ও এসেছে?কে সে?নতুন নাকি?’
‘ভাইয়া আসলে ঐ যে কদিন আগে একটা ফোন পাঠিয়েছিলাম না?’
‘ঐ ফোন তো আমি রেখে দিয়েছি,বেশ ভাল ক্যামেরা।কেন?কি হয়েছে?’
‘ফরমেট করেছো?’
‘সমস্যা হলো লক খুলছেনা।তবে লক না খুলেও ক্যামেরা চেক করতে পেরে বুঝতে পারলাম ক্যামেরা ভাল।কাল আমার বন্ধু রিয়াদের কাছে নিয়ে যাব।ও লক খুলতে এক্সপার্ট। আচ্ছা তোমরা বিশ্রাম করো কাল কথা হবে।আমি এখন অনেক ব্যস্ত ‘
লিখি ফোন রেখে পিছনে তাকাতেই নাবিলের সাথে এক ধাক্কা খেলো।নাবিল ওর মুখ চেয়ে আছে ফোনের খবর জানার জন্য’
‘চুপচাপ বসে পেট পুরে খাবার খান তারপর যা হবার হবে’
‘তুমি? ‘
‘ফ্রেশ হতে যাচ্ছি।আপাতত মুখে ফোনের নাম নিবেননা।ভাল ছেলের মতন আপ্যায়ন উপভোগ করুন’
লিখি চলে গেলো,আর নাবিল দাঁড়িয়ে ভাবছে তার ফোনের কি হবে সেটা নিয়ে।লিখি কখনও পুরো কথা বলেনা।এটাই হলো সমস্যা। ফোন হাতে না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি মতন খাওয়া দাওয়াও করা হবেনা।
‘ওমা সুমনের বোন ডাইনিংয়ে এসে ওমন করে চেয়ে আছে কেন?আজ আমার মুখে কি হলো?’
নাবিল সোজা গিয়ে ভেসিনের সামনের আয়নায় চেক করতে গিয়ে দেখলো তার ঠোঁট জোড়া লাল টুকটুকে হয়ে আছে।
মানে লিপস্টিক লাগিয়ে লাল করা।এই কাজ লিখি ছাড়া আর কারোর হতে পারেনা।বাসে যখন সে ঘুমাচ্ছিল তখন মনে হয় দুষ্টামি করে লিপস্টিক লাগিয়ে দিয়েছে!
লিখির বাচ্চা!!!!’
লিখি ওয়াশরুমের দরজা ভাল করে লাগিয়ে চুপ করে আছে।সে জানে নাবিল বুঝে গেছে তার ঠোঁটে লিপস্টিক লেপটানো।
‘তার মানে এই কারণে ঐ মেয়েটা এমন করে তাকাচ্ছিল?সাথে এখন সুমনের বোনও তাকিয়ে আছে! আজ লিখি বের হোক ওয়াশরুম থেকে!’
চলবে♥