মনের কোণে🥀
#পর্ব_১৩
আফনান লারা
.
নাবিল লোকটার জামার কলার টেনে ধরে বললো,’কি বললেন?আপনি কি আমাদের সাথে মশকরা করছেন?যদি তাই হয় তবে আগেই স্বীকার করে নেন নাহলে আমার রাগ ঝাড়তে বেশি সময় নষ্ট করবোনা ‘
লোকটা হেসে নিজের কলার থেকে নাবিলের হাত সরিয়ে বললেন,’মশকরা তো তোমরা করো,বিয়ে নিয়ে।বিয়ের মতন একটা পবিত্র বন্ধনকে তোমরা নকল রেজিস্ট্রি পেপার দ্বারা আটকে রাখতে চাও।আমি তো তোমাদের সম্পর্কটাকে বৈধ করে দিয়েছি মাত্র’
নাবিলের প্রচণ্ড রাগ হলো।এই মূহুর্তে নিজের উপর বেশি রাগ হচ্ছে তার।এখানে লিখির দোষ নেই।তার নিজের জোরাজুরিতেই তো সে এখানে আসতে বাধ্য হয়েছে।লোকটা যে এমন ঘোল খাওয়াবে এটা কে বা জানতো!
লিখি মাথায় হাত রেখে চুপ করে আছে তখন থেকে।বাস্তবের এই কড়া সত্যটাকে তার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।হাত পা থরথর করে কাঁপছে।
সে এটা চায়নি।যাকে চেনে না, জানেনা তাকে বিয়ে করার ভয়ে বাসা থেকে পালিয়েছিল অথচ আজ এমন একজনের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো যাকে সে ভালমতন চেনেই না এখনও।নিয়তিতে তবে এটাই লেখা ছিল?
নাবিল ওকে চুপ থাকতে দেখে নিজেও পাশে চেয়ার টেনে বসে গেছে।ঐ লোকটা দু কাপ চা পাঠিয়েছে তাদের দুজনের জন্য।নাবিল রেগেমেগে চায়ের কাপ উল্টে ফেলে দিয়েছে।কিন্তু লিখি ফালায়নি,সে কাপ নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়েছে বরং।এত বেশি প্রেশারের কারণে তার মাথা ব্যাথা বেড়ে গিয়েছিল,আসলেই এখন চায়ের প্রয়োজন ছিল ভীষণ।
দুজনে ঐ অফিস থেকে বেরিয়ে শূন্য রাস্তায় মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে ।নাবিল অসহায়ের মতন চেয়ে রইলো লিখির দিকে।ও তখন থেকে কোনো সাড়া দিচ্ছেনা বলে নাবিল বললো,’লিখি আই এম সরি।এটার জন্য আমি নিজেও প্রস্তুত ছিলাম না, তুমি আমায় অন্তত বোঝো।আমি জানলে কখনওই এটা হতে দিতাম না।সম্পূর্ণ আমাদের অজান্তে ঘটে গেলো বিষয়টা। আমায় ক্ষমা করে দাও লিখি।আমার জন্য তোমার লাইফটা….’
লিখি গাল ফুলিয়ে চিৎকার করে বললো,’হয়েছে এবার শান্তি?চলুন এখন।এবার তো বাড়িওয়ালা নেচে নেচে আপনাকে ভাঁড়া দিয়ে দিবে।সামান্য বাসা ভাড়ার জন্য দুইজনের লাইফ চেঞ্জ করে দিয়েছেন।এই বিয়ের ভয়ে আমি এতদূর অবধি আসলাম অথচ এখানেই আমার বিয়েটা হয়ে গেলো তাও কাগজে-কাগজে। অস্বীকার যে করবো তারও উপায় নেই কোথাও।একেই বলে-“আকাশ থেকে পড়ে খেজুর গাছে আটকানো”
‘লিখি তুমি তো সব নিজের চোখেই দেখেছো।আমি কি আগে থেকে জানতাম?তোমার কি ধারণা আমি ওদের সাথে যুক্ত?’
‘এখন এসব বলে কি লাভ?তাতে বিয়েটা বাতিল হয়ে যাবে?যাবে না তো!তবে সাফাই দিয়ে কি লাভ হচ্ছে?’
নাবিল চুপ করে গেলো।লিখিকে এখন কোনো কথা ছোঁয়ানো যাচ্ছেনা।প্রচণ্ড রেগে আছে তা বোঝা যাচ্ছে।আপাতত চুপ থাকাই শ্রেয়।
স্টেশন থেকে চুপচাপ বাসে উঠলো দুজন।এখান থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে এক ঘন্টার বেশি সময় লাগবে।নরসিংদীর কাছাকাছি জায়গা।নাবিল ঠিক করেছে অন্য এরিয়াতে বাসা ভাঁড়া নেবে।
এত বড় কথা মাকে জানানো জরুরি বলে ফোন নিলো নাবিল।তখনই লিখি আঙ্গুল তুলে বললো,’খবরদার যদি কাউকে বিয়ের কথা জানিয়েছেন তো!কাউকে জানাবেননা,এই বিয়ে মানার মতন না।আমি মানিনা এবং আমি চাইনা এটা তৃতীয় কেউ জানুক।আগে আমার ক্যারিয়ার তারপর সব যা হবার হবে’
‘রেজিস্ট্রি করা বিয়ে তোমার কাছে না মানার মতন??’
লিখি ঘুরে বসে বললো ‘তো কি চান বৌভাতের জন্য সেজে তৈরি হয়ে নিব?’
‘না,তা বলিনি’
‘সেটাই তো বুঝাচ্ছেন কথা দিয়ে।আপনার কি ধারণা?আপনার মাকে যখন বলবেন- মা আমি তো বিয়ে করে নিয়েছি তখন আপনার মা চুপচাপ বলবে- ও তাই!!বলবে এখন মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসো।আমরা অনুষ্ঠান করে আত্নীয় স্বজন খাওয়াবো’
‘সেটাও কথা,বাবা জানলে তো সর্বনাশের মাথায় বাড়ি পড়বে’
‘তো?এগুলা কমন সেন্স।আপনি কোন সাহসে এই খবর আপনার মাকে দিতে যাচ্ছিলেন?বিয়ে হয়েছে নাকি হয়নাই এখনও ঐ ঘোর থেকে বের হতে পারিনি আমি আর উনি মাঝ দিয়ে বিবিসির খবর জানাতে কল করতে যাচ্ছিলেন’
‘ওকে সরি’
—–
হাতিরঝিলে এসে নেমেছে তারা দুজন।এখানে বাসা ভাড়া করে থাকবে।নাবিল কল করে তার মামাকে ডেকে এনেছে।মামার বাসা হাতিরঝিলেই।মামাকে প্রথমে লিখির ব্যাপারে সবটা বলে শেষে বলে দিয়েছে কথাটা যেন গোপন রাখে।ইভেন মা ও যেন না জানে।মামা প্রথমে রাগারাগি করেছেন এভাবে কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করায়,পরে মেনে নিয়েছেন।ওদের দুজনকে তিনি তার বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বললেন কিন্তু নাবিল রাজি হয়নি।বাবা যদি আন্দাজ করে মামার বাড়িতে খুঁজতে এসে ওকে পেয়ে যান তবে মহাবিপদ। তাই মামাকে সাথে নিয়ে আশেপাশের একটা খালি ফ্ল্যাট আছে এমন বাসায় এসে উপস্থিত হলো তারা।
তবে ভাড়া বেশি।গুনে গুনে চৌদ্দ হাজার।বেড তিনটে,ডাইনিং,সোফার রুম, রান্নাঘর,বেলকনি ২টা।
আপাতত এটাই সোনায় সোহাগা মনে করে নাবিল রাজি হয়ে গেছে।মামা দস্তখত করে ওদের সব ওকে করে দিয়েছেন,শুধু তাই নয় আজকের রাতটা ওদের মামার বাসায় থাকার কথাও বলে গেছেন।কিন্তু নাবিল রাজি হলোনা।তার মতে বাবা যেকোনো সময় এসে যেতে পারে।
শেষমেষ অন্তত ডিনারটা খেয়ে যাওয়ার জন্য রাজি করালেন তিনি।
—–
মামা চলে যাবার পর খালি বাসায় পা রেখেছে দুজনে।লিখির শুরু থেকেই মন খারাপ ছিল।এখনও মন খারাপের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে সে একটা রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।নাবিল জুনায়েদকে ফোন করে ছাত্রাবাসের অবস্থা জানতে চাইলো।জুনায়েদ বললো বাবা নাকি যাবার সময় লোক রেখে গেছেন।কড়া পাহারা দিচ্ছে তারা।ফোন রেখে নাবিল এবার ফ্রেশ হতে গেলো।
গায়ে ঝর্নার পানি ঝরে ভিজে একাকার হয়ে যাবার পর তার মনে পড়লো তোয়ালে,নতুন জামা কিছুই নেই সাথে।সঙ্গে সঙ্গে ঝর্না বন্ধ করে দূরে সরে গেছে সে।কি ঝামেলা!এখন কি হবে!
বাধ্য হয়ে ভেজা গায়ে বের হলো সে।লিখির কাছেও তো তোয়ালে থাকার কথানা।এই ভেজা শরীর নিয়ে কতকাল থাকতে হবে?
কলিংবেল বাজছে,শোনা গেলো।গায়ের শার্টটা খুলে ফ্লোরে রেখে নাবিল গেলো দরজা খুলতে।বাড়িওয়ালার মেয়ে ইমু এসেছে হাতে নাস্তা নিয়ে।নাবিলকে এমন হালে দেখে সে হাত থেকে ট্রে টাই ফেলে দিলো।আওয়াজ শুনে লিখি দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দেখলো নাবিল উদম গায়ে দাঁড়িয়ে আছে আর ঐ মেয়েটা হা করে ওকে দেখছে শুধু।লিখি এগিয়ে এসে বললো,’কি হচ্ছে এখানে?’
‘আসলে আমার জামাকাপড় তো নেই,ভুলে শাওয়ারের নিচে চলে গেছি তাই এমন হাল হলো আমার’
লিখি যেন নাবিলের কথাই শোনেনি।মেয়েটার দিকে চেয়ে বললো,’আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি’
‘আমি তো নাস্তা দিতে এলাম।হঠাৎ ওনাকে এই অবস্থায় দেখে বেসামাল হয়ে ট্রে পড়ে গেছে হাত থেকে’
লিখি ঠাস করে মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো।
নাবিল ব্রু গুটিয়ে বললো,’এটা কেমন ব্যবহার!মেয়েটা কি ভাববে?’
‘ ক্রাশ খেলে হাত থেকে ট্রে পড়ে,ভয় পেলে পড়েনা।আমি বাবুসোনা না যে সোজা কথা বুঝিনা’
নাবিল নিজের বুক থেকে পানি মুছে বললো,’তো তুমি কি জেলাস হচ্ছো?’
‘মোটেও না,আপনার ইচ্ছা জাগে তো ভেগে যান বাড়িওয়ালার মেয়ের সাথে,আমি মানা করেছি নাকি?’
কথাটা বলে লিখি হনহনিয়ে চলে গেলো রুমের ভেতর।নাবিল দরজা ফাঁক করে বললো,’বইনা ট্রে-টা নিচেই রেখে যাও,আমি নিব পরে’
‘বইনা ডাকবেননা,আমি আপনার বোন না’
‘ওকে আপু”
‘আপু ডাকবেননা আমি আপনার আপু ও না’
‘ওকে খালা’
নাবিল এবার নিজেও দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।লিখি ঠিক বলেছিল।এই মেয়েটা তো দেখি দিবানা হয়ে গেছে আমার উপর।’
—-
‘লিখি আসো খাবে,চা ফ্লাক্সে পাঠিয়েছে ওরা।খাবে আসো,তুমি তো চা পছন্দ করো।
উফ কি জ্বালা!বিয়ে করে মনে হয় বিপদে পড়েছি আমি।সবাই আমাকে দোষ দিচ্ছে।’
‘আপনার চা আপনি খান।আমাকে একা থাকতে দিন প্লিজ’
নাবিল দরজায় হাত রেখে বললো,’তোমার এই রাগ কেন দেখাইতেছো?তুমি তো বললে বিয়েটা মানোনা,তবে রাগ দেখিয়ে কি লাভ হচ্ছে?’
‘ক্ষোভ বলতেও একটা জিনিস আছে,আমি কি রাগ ও করতে পারবোনা?এখন থেকে আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চাইছেন?’
‘জাহা….’
‘হ্যাঁ!!আমাকে তো জাহান্নামেই যেতে বলবেন,জানতাম তো।বিয়ে করেছেন অধিকার ফলাতে’
‘তুমি ডিভোর্স পেপার আনো আমি সই করে দিই।তাও এমন বাচ্চাদের মতন বিহেভ করবানা।তোমার দেখি সংসার বলতে কোনো জ্ঞানই নাই,যেখানে আমিও তোমার মতন ডোজ খেয়েছি সই করে সেখানে তুমি রাগ দেখাচ্ছো কিসের ভিত্তিতে?রাগ তো এখন আমিও দেখাইতে পারি’
‘কারণ আপনি উড়া-উড়ি করছিলেন নকল রেজিস্ট্রি নিয়ে’
‘উড়া-উড়ি না করে তোমায় একা রাস্তায় এত রাতে ফেলে চলে গেলে ভাল হতো তবে?’
লিখি এবার চুপ করলো।আর কিছু বললোনা।তার উত্তর সে পেয়ে গেছে।
চলবে♥