মধুচন্দ্রিমা
পর্ব ২০
তানিয়া রহমান

গম্ভীর মুখে ব্যালকনিতে বসে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে মেহবুব, মনিরের চাপ,ইরিনকে বুঝতে না পারা সবকিছু কাঁটা হয়ে বিঁধছে মেহবুবের জীবনে।
স্লাইড ডোর সরিয়ে ইরিন ব্যালকনিতে এল,নিকোটিনের ধোঁয়ায় কাশতে কাশতে বলল- স্মোকিং করছেন? আগেতো কখনো দেখিনি
মেহবুব এ্যাসট্রেতে সিগারেট গুঁজে দিল- স্যরি, সবসময় করি না, মাঝে মাঝে যখন টেন্স থাকি
ইরিনকে টেনে নিজের কোলের উপর বসিয়ে আবার বলল – আর করব না তবুও মুখটা ওমন পেঁচার মতো করে রেখ না
ইরিন হেসে বলল – ঘুমাবেন না,কটা বাজে জানেন
হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মেহবুব দেখলো রাত একটা
ইরিন বলল- অনিয়ম করলে অসুখ করবে
– আমিতো চাই অসুখ হোক
– বাজে চিন্তা কেন করছেন
– বৌর ভালবাসা পাবার জন্য
তারপর আনমনে বলে উঠলো
ভালবাসার দুটি মন
বসেছে শূন্য ঘরে
একজনের চোখে জল
আরেকজনের মুখ শীতল
তারপর ভালবাসা বিরহের পথে
-এটা কার লিখা বলতে পার ইরা
– উঁহু
– আমারো মনে পরছে না কিন্তু আজকাল বড় পোড়ায় এই কয়েকটি লাইন
– কি হয়েছে আপনার
– ইরা!আমি আর পারছি না, এই যে তোমার আমার সুরহীন সম্পর্ক, মনিরের ঝামেলা সবকিছু আমাকে ক্লান্ত করে দিচ্ছে
-চলুন কোথাও ঘুরে আশি
মেহবুব বিস্ময় নিয়ে বলল – সত্যি তুমি যাবে আমার সঙ্গে
– যাব
– কোথায় যাবে বল পাহাড় না সমুদ্র
-পাহাড়
– ওকে ডান

পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট সুন্দর একটা কটেজে উঠেছে মেহবুব আর ইরিন, কটেজের নামটাও সুন্দর “নীলিমায় ঋতু “নাম দেখে ইরিন বলল- এটা আপনার কটেজ
– হুম
– আগে কখনো বলেননি কেন
– কখনো জানতে চাওনি তাই
ইরিন কটেজের ভিতর ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে চলে এল বারান্দায়
পড়ন্ত বিকেলে একটু একটু করে সূর্যটা ক্ষয়ে যাচ্ছে লাল হলুদ কমলা রঙ ছড়িয়ে
সাদা মেঘের উপর রঙের বিচ্ছুরণ এ যেন এক ভূস্বর্গ, ইরিনের মনে হল ও জেন এক মেঘের নদীতে ভাসছে,মেহবুব পিছন থেকে জরিয়ে ধরে বলল- কেমন লাগছে
– ভীষণ ভালো
মেহবুব পশ্চিমে আঙ্গুল তুলে বলল- ঐ দিকে দেখ
ইরিন মেহবুবের আঙ্গুল বরাবর তাকিয়ে দেখল একঝাঁক বলাকা ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে ক্ষয়ে যাওয়া কমলা রঙের সূর্যকে ক্রস করছে, কি যে অদ্ভুত সুন্দর! ইরিন নিজের অজান্তেই বলে উঠলো -ওয়াও!
মেহবুব ইরিনের মুখ দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল – পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য তোমার পায়ের কাছে এনে দিব শুধু আমাকে ছেড়ে যেও না ইরা
কাঁপা কন্ঠে বলল ইরিন – এত ভয় কেন আপনার
– দূরে সরে আছযে
ইরিন চোখ নামিয়ে নিল
আকাশের রক্তিম সূর্য পাঠ চুকিয়ে তার লাল রেশ ছড়িয়ে দিয়েছে মেঘের পাতায় পাতায়
মেহবুব বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়ে ইরিনের দিকে তাকিয়ে আবৃত্তি করে উঠলো
মেঘের দেশে নিয়ে এলাম
মেঘের জলে ভাসাতে,
চোখ খুললে ভালবাসা
বন্ধ করলে প্রেম,
হাওয়ার ভেলায় ভাসাব বলে
কড়ির টাকায় কিনে নিলাম
অপাঙ্কতেয় এক প্রেম।
– খুব সুন্দর, কার লিখা, ইরিন বলল
– সেদিন ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে পেলাম অখ্যাত এক কবি কি জেন নাম তানিয়া হবে হয়তো ভাল লাগলো তাই মেমোরিতে ঢুকিয়ে নিয়েছি

আজ পূর্নিমা,
মেহবুব ডিভানে হেলান দিয়ে এক পা মেলে আরেক পায়ের হাঁটু উঁচু করে মেঝেতে বসে আছে, আর ইরিন মেহবুবকে পিছনে ফেলে দু’হাতে মেহবুবের হাঁটু জরিয়ে তার উপর থুতনি রেখে বারান্দার দরজার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে আছে দূরের পাহাড়ে
চাঁদের আলো দরজার ফাঁক গলে ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পরেছে,ঝিরিঝিরি বাতাসে দু একটা চুল উড়ছে ইরিনের
মেহবুব জানালার কাঁচ ভেদ করে দৃষ্টি দিয়েছে আকাশের শেষ কোনটায় যেখানে লুব্ধক জ্বলছে সবটুকু আলো ছড়িয়ে।
ভাবলেশহীন ভাবে বলল মেহবুব – ইরা!
– হুঁ
– আজ আমাদের জীবনের শেষ রাত
ইরিন দ্রুত মেহবুবের দিকে তাকালো, মেহবুব আবার বলল – আজকের পর থেকে আমরা আর কখনো একসাথে থাকব না
ইরিন ধরা গলায় বলল – কেন
– তোমাকে না জানিয়ে আমি একটা কাজ করে ফেলেছি
– কি
– মনিরকে আসতে বলেছি তোমায় নিতে
– কেন, গাঢ় কন্ঠে বলল ইরিন
– তোমাদের কথা বলা প্রয়োজন,তাছাড়া এভাবেতো চলতে পারে না তাই না
ইরিন মেহবুবের কাছে চলে এল, চোখে চোখ রেখে বলল- নিজের বৌকে লম্পট বন্ধুর হাতে তুলে দিতে লজ্জা করছে না আপনার
মেহবুব ম্লান হেসে বলল – বৌটা নিজের কিন্তু বৌ কি কখনো বরকে নিজের করে পেতে চেয়েছে
– আমার সময় দরকার
– আর কত ইরা!আমাদের বিয়ের কতদিন হল বলতো, থেমে আবার বলল এগারো মাস, কতবার তোমার কাছে আসতে চেয়েছি,কতভাবে তোমাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি তুমি বোঝনি,ঐ লম্পটটা আজও তোমার মনে স্বপ্ন বুনে, তোমার জীবনের এই এগারো মাস অতি নগন্য ঐ উনত্রিশ বছরের কাছে। আমি বেরিয়ে আসতে চাই এই সাপলুডু খেলা থেকে
ইরিনের চোখ জলে ভিজে এল
মেহবুব বলল- আমার মনে হয় তোমার রিভেঞ্জ নেয়া শেষ হয়েছে,আর মনিরও বুঝতে পেরেছে ও কি হারিয়েছিল,আমাকে আর তোমাদের কারো প্রয়োজন নেই
ইরিনের গাল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো, অস্ফুট ভাবে বলল – এতবড় একটা ডিসিশন একাই নিয়ে নিলেন
– এরকমইতো হবার কথা ছিল, মাঝে থেকে আমিই সব গুবলেট করে ফেলেছি
ইরিন উঠে চলে যেতে চাইলে মেহবুব ইরিনের হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে এল
– কোথায় যাচ্ছ
ইরিন অভিমানের সুরে বলল- ছাড়ুন
মেহবুব মুচকি হেসে ইরিনের কপালে চুমু খেল
– আজকের রাতটা আমায় দিবে ইরা,এই রাত হয়ে থাক আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত
ইরিন মেহবুবের বুকে আছড়ে পরে ঢুকরে কেঁদে উঠলো
– কাঁদছো কেন বোকা মেয়ে, ঠিক আছে তোমাকে কিছু দিতে হবে না, দু’হাতে আগলে উঁচু করে ধরলো ইরিনের মুখ, তারপর বলল- দেখি আমার দিকে তাকাও
ইরিন চোখ তুলে তাকালো মেহবুবের দিকে, কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বলল- আমি মনিরকে ছেড়ে থাকতে শিখে গিয়েছি কিন্তু তোমাকে ছাড়া পারব না মেহবুব
মেহবুবের মনে হল আকাশের চাঁদটা টুপ করে খসে পরেছে তার হাতের মুঠোয়, দিক বিদিক হারিয়ে পাগলের মতো চুমু খেল ইরিনকে।

চাঁদের আলোয় লেপ্টে আছে ওদের শরীর, বহু প্রতিক্ষার পর দুটি মন ভিজে যাচ্ছে নিপাট ভালবাসায়
ইরিন বলল- পর্দা টেনে দাও
– না,কেন
– আলো আসছে
– এটাতো জোৎস্না
– আমার লজ্জা লাগছে, প্লিজ!
ইরিনের কানের কাছে ফিসফিস করে মেহবুব বলল- চাঁদের আলো ছাড়া মধুচন্দ্রিমা হয় নাকি! ওকে আসতে দাও আমাদের ভিজিয়ে দিতে।

ফুরফুরে মেজাজে মনির যখন বান্দরবান পৌঁছালো তখন ভোরের সূর্য ঈশান কোন ছুঁয়েছে,আজ তার কাছে সবকিছু অন্যরকম সুন্দর, বাস থেকে নেমে মনির যখন কটেজের পথে তখন টুংটাং করে ম্যাসেজের শব্দে ফোনের দিকে তাকালো মনির, ওপেন করে দেখলো ইরিনের ম্যাসেজ “খুব করে ভেবে এটাই পেয়েছি ফিরে এসে আবার যদি কখনো হারিয়ে যাই তবে তোমার জীবন অন্ধকারে ডুবে যাবে, তার চেয়ে এই ভাল নয় কি একটা ছোট্ট মনির সবসময় একটা ভালবাসার হাত তোমার দিকে বারিয়ে থাকবে ”

আলো নিভিয়ে দিলেই যে অর্জন করা যায় না,তা জেন অজানাই রয়ে গেল মেহবুবের জীবনে, ইরিনের মনের গহীনে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা যে প্রদিপের শিখা দূর থেকে দিশেহারা নাবিককে পাইয়ে দেয় এক নতুন পথের সূচনা, দূরে থেকেও অর্জন করা যায় এ কথা জেনেছে মনির,
সেদিন ফিরে এসেও মনির বুঝেছিল তাকে সে পেয়েছে।
সমাপ্ত
কপি করা যাবে না
বিঃদ্রঃ আমার সম্মানিত পাঠকদের অনেক ধন্যবাদ যারা ধৈর্য্য ধরে গল্পটি পড়ে আমায় উৎসাহ দিয়েছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here