#ভেজাগোলাপ❤️
#লেখিকা-মালিহা খান❤️
#পর্ব-৬

চারদিকে স্নিগ্ধ পরিবেশ।পশ্চিম আকাশে হেলে পরেছে সূর্য।পরন্ত বিকেলবেলা।
পার্কের এককোণে দাড়িয়ে আছে নীরাদ।পরণে তার সাদা রংয়ের টি-শার্ট।সাথে কালো ট্রাওজার।
একহাত পকেটে ঢুকিয়ে আরেকহাতে ফোন স্ক্রোল করছে সে।মাঝেমধ্য চোখ উঠিয়ে মার দিকে নজর রাখছে।

একটু দুরেই মনিরা আহমেদ অলস ভঙ্গিতে হাটাহাটি করছেন।নীরাদকে একপ্রকার জোর করেই নিয়ে এসেছেন তিনি।তার অবচেতন মন বারবার রোদ্রিকে খুঁজছে।সেদিনের পর মেয়েটাকে আর দেখেনি পার্কে।
একা একা হাঁটতে ভালোলাগেনা আর নীরাদ আজকে দুপুরেই বাড়ি ফিরেছে অফিস থেকে তাই তাকে সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছে সে।হঠাৎই সামনে তাকিয়ে একটা দৃশ্য চোখে পড়তেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠল।দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে।

কাঁধে কারো সপর্শ পেয়ে চমকিয়ে পিছনে ফিরল রোদ্রি। রাস্তার কিছু বাচ্চাদের ঝালমুড়ি কিনে দিচ্ছিল ও।ভার্সিটির পর আজ আর বাসায় যায়নি ও।সোজা এখানে চলে এসেছে।
পিছনে তাকিয়ে মনিরাকে দেখে হাসিমুখে সালাম দিল সে।

-কেমন আছেন আন্টি?আপনার ব্যাথা কমেছে?

রোদ্রির ব্যবহারের আজও মুগ্ধ মনিরা আহমেদ।মেয়েটার মধ্যে বিরক্তি নামক শব্দটার অস্তিত্ব নেই।

-আমি ভালো আছি মা।তুমি কেমন আছো?

-আলহামদুলিললাহ ভালো আছি।আপনি আজকেও একা এসেছেন আন্টি?আবার ব্যাথা হলে?

-আজ আর একা আসিনি মা।আমার ছেলে এসেছে সাথে।

-ওহ্,আচ্ছা।

এরই মধ্যে ঝালমুড়িওয়ালা টাকা চেলে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দেয় রোদ্রি।

-বাহ্।তুমিতো বেশ ভালো মা।কজন ই বা ওদের সাথে এমন ব্যাবহার করে?

জবাবে মুচকি হাসল রোদ্রি।কিছু বললোনা।নিজের প্রশংসা শুনলে ওর কেমন জানো অসস্তি লাগে।
পরিচিত পুরুষালি কন্ঠে ধ্যান ভাঙে ওর।সামনে নীরাদকে দেখে বেশ অবাক হয়।

নীরাদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোদ্রির দিকে।আজকে দুইদিন পর রোদ্রিকে সামনাসামনি দেখলো ও।
এতক্ষনের বিরক্তিকর মেজাজটাও কেমন ফুরফুরে হয়ে গেছে।

-মিস রোদ্রি?আপনি এখানে?

রোদ্রি কিছু বলবে তার আগেই মনিরা আহমেদ বলল,

-তুই ওকে চিনিস নীরাদ?ওইতো সেদিন আমাকে বাসায় পৌছে দিয়েছিল।

-উনি আপনার মা?

ব্যাপারটা বুঝতে কয়েকসেকেনড লাগলে নীরাদের।মা সেদিন তাকে একটা মেয়ের কথা বলছিল কিন্তু সেটা যে রোদ্রি তাতো আর সে জানতোনা।

-জি,অনেক ধন্যবাদ আপনাকে সেদিন মাকে সাহায্য করার জন্য।

-না,ঠিকাছে।আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও এমনটাই করত।

-তোমরা কিভাবে একে অপরকে চিনো সেটা নাহয় পরে জানব।রোদ্রি মা,তুমি কিনতু আজকে আমার সাথে বাসায় যাবে।সেদিন কিছু না খেয়েই চলে গিয়েছিলে।

মনিরার কথা শুনে চিনতায় পরে গেল রোদ্রি।আজকে গাড়ি না নিয়েই বেরিয়েছে সে।এখন উনাদের বাসায় গেলে দেরি হয়ে যাবে।আর সন্ধ্যা হয়ে গেলে একা একা বাড়ি ফেরার সাহস ওর মধ্যে নেই।আবার সামনে দাড়ানো মনিরাকেও না করতে পারছেনা।

না পেরে কিছুটা কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,

-আন্টি আমি অন্যদিন যাবোনে।বাসায় ভাইয়া ভাবি জানেনাতো।দেরি হলে চিন্তা করবে।এমনেও আজ একা এসেছি।

রোদ্রির কথার মাঝেই নীরাদ কিছুটা হন্তদন্ত গলায় বলল,

-আপনার ভাইয়াকে আমি জানিয়ে দিব সমস্যা নেই।আর আপনাকে বাসায়ও আমিই পৌছে দিব।

এবার আর কিছু বলতে পারেনা রোদ্রি।অগত্যা রাজি হতে হয় তাকে।

নীরাদ দের বাসার সামনের বাগানে ঘুরে ঘুরে দেখছে রোদ্রি।বাসার একপাশের এতবড় বাগানটা সেদিন তাড়াহুড়োয় খেয়ালই করেনি সে।ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি নিয়ে বিস্মিত নয়নে ফুলগুলো দেখছে সে।বড় বড় রক্তলাল রংয়ের গোলাপ ফুটে রয়েছে একপাশে।আরো অনেক রকম ফুলের গাছও আছে তবে লালগোলাপের প্রতি তার একটা আলাদা আকর্ষন কাজ করে।সে নিজেও একটা গাছ লাগিয়েছিল তবে পরিচর্যার অভাবে কোনো ফুলই ফুটেনি।

-এগুলো কে দেখাশোনা করে মি.নীরাদ?

এতক্ষন রোদ্রির দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে ছিল নীরাদ।তার ঠোঁটের প্রশস্ত হাসিটায় গভীরভাবে মশগুল ছিল সে।রোদ্রি আশেপাশে থাকলে অন্যদিকে তাকানোর ইচ্ছা বা ধ্যাণ কোনোটাই থাকেনা নীরাদের।

-মালীচাচা আছে।বাগানের দেখাশোনার জন্য।আর ছুটির দিনে সময়পেলে আমিও একটু আগাছা কেটে দেই।

জবাবে”ওহ্”বলে আনমনেই একটা গোলাপ ধরতে গেলে আঙুলের ডগায় কাঁটা বিধে যায় রোদ্রির।”আহ্” বলে মৃদু আর্তনাদ করে উঠে সে।
তড়িঘড়ি করে এসে রোদ্রির হাত চেপে ধরে নীরাদ।অস্থির কন্ঠে বলে,

-মিস.রোদ্রি কি করলেন?এটা ধরলেন কেন?জানেননা,গোলাপে কাঁটা থাকে।বলে খুব সন্তর্পণে কাঁটাটা
বের করে ফেলে।সাথে সাথেই রক্ত বেরিয়ে আসে।
ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে রোদ্রি।ছোট থেকেই রক্ত দেখতে পারেনা সে।

রোদ্রির রক্ত দেখে বিচলিত হয়ে উঠে নীরাদের মন।নিজেকে বারবার কথা শোনায়,ও একটু খেয়াল রাখলেই ব্যাথাটা পেতোনা রোদ্রি।

সোফায় চুপ করে বসে আছে রোদ্রি।খুবই যত্ন করে তার হাতে স্যাভলন লাগিয়ে দিচ্ছে নীরাদ।নীরাদের চেহারা দেখে ব্যাথার মধ্যেও হাসি পাচ্ছে তার।মনে হচ্ছে হাত হাতে নয় নীরাদের হাতেই কাঁটা ফুটেছে।আর ব্যাথাটাও তারই হচ্ছে।একবার স্যাভলন লাগাচ্ছে আর আরেকবার মুখ দিয়ে ফুঁ দিচ্ছে নীরাদ।রোদ্রিকে হাসতে দেখে শাসনের সুরে বলল,

-আপনি হাসছেন?কতটা রক্ত বের হলো দেখেছেন?বলে পাশে থাকা তুলাটা উঁচু করে দেখাল।

-আঙুলে কাটলে রক্ত একটু বেশিই বের হয় মি.নীরাদ।

-আর ব্যাথা?ব্যাথা পাচ্ছেন না?এরকম বাচ্চামো কাজ করলেতো ব্যাথাই পাবেন।কথায় কথায় তো কান্না করে দেন,আর আজ খুব হাসি পাচ্ছে না?

কথায় কথায় কান্না বলতে যে নীরাদ সেদিন হসপিটালের কথা বলেছে ব্যাপারটা বেশ বুঝতে পেরেছে রোদ্রি।রাগে গাল ফুলিয়ে সে বলল,

-ছাড়ুনতো,হাত ছাড়ুন আপনি।লাগবেনা আপনার কিছু করা।আপনি একটা..

আর কিছু বলার আগেই রোদ্রির ঠোঁটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিল নীরাদ।শাসন ভরা গলায় বলল,

-একদম চুপ করে বসে থাকেন।কোন কথা বলবেন না।

লোকটার শাসনে কেমন যেন একটা মায়া আছে।উনার
শাসন শুনে খারাপ লাগছেনা রোদ্রির।বরং একরকম ভালোলাগা কাজ করছে।

সুন্দর করে ব্যান্ডেড নাগিয়ে যখনই উঠতে যাবে নীরাদ,তখনই আকাশের মেঘ ডাকার শব্দ হয়।জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে ঠান্ডা বাতাস হচ্ছে।হয়তো বৃষ্টি নামবে খুব জোরে।

-মি.নীরাদ।আমার এখন বাসায় যাওয়া উচিত।দেখুন বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।

-আচ্ছা,ঠিকাছে।আপনি আসুন।আমি গাড়ি বের করছি।
______________
মাঝপথেই বৃষ্টি নেমে গেছে।বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা।এতক্ষন গাড়ির জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে ছিল রোদ্রি।শীতল বাতাসে কেঁপে উঠছিলো মাঝে মাঝে।নীরাদ জানালা বন্ধ করতে বললেও সে করেনি।বৃষ্টি শুরু হওয়ার পরও জানালা খোলা রাখায় পানির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে রোদ্রিকে।

-মিস রোদ্রি এবার জানালাটা বন্ধ করেন।ভিজে যাচ্ছেনতো।
নীরাদের কথায় রোদ্রির কোনো হেলদোল নেই।বাধ্য হয়ে নীরাদ নিজেই কিছুটা ঝুকে যায় রোদ্রির দিকে,একহাতে সুইচ চেপে জানালাটা লাগিয়ে দেয়।বিরক্তি নিয়ে মুখ ঘুরাতেই নীরাদকে এতটা কাছে পেয়ে হচকচিয়ে যায় রোদ্রি।সাথেসাথেই সরে নিজের সিটে বসে পরে নীরাদ।

কিছু না বুঝেই ফট করে বলে রোদ্রি,

-আপনি এত আনরোমান্টিক কেন?কই বৃষ্টি উপভোগ করবেন,তা না করে জানালাটা বন্ধ করে দিলেন।

প্রশ্নটা করে নিজেই বেকুব হয়ে যায় রোদ্রি।ছিহ্,এটা কি বলল সে?বেশ লজ্জা পায় সে।

রোদ্রির প্রশ্নে হেসে দেয় নীরাদ।ব্যাপারটা সহজ করে দেয় রোদ্রির জন্য।হাসতে হাসতেই রোদ্রিকে বলে,

-আপনার কি এখন রোমান্স করতে ইচ্ছে করছে?হাউ ফানি।

সারাটা রাস্তা আর একটাও কথা বলেনি রোদ্রি।।চুপ করে বসে ছিল।নীরাদও কিছু বলেনি।
দুজনের মাঝেই কেমন একটা জড়তা।অসস্তির দেয়াল।যতবারই এ দেয়াল ভাঙতে চায় নীরাদ,ততবারই রোদ্রির হাতের জলজল করা আংটিটা তার “অন্যকারো”হওয়ার জানান দেয়।

বৃষ্টির বেগ বাড়ছে।ভিজিয়ে দিচ্ছে পুরো শহর।ধুয়ে মুছে সতেজ হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি।এভাবেই যদি তাদের মধ্যেকার জড়তাটাও মুছে ফেলতো পারতো এই বৃষ্টি।

চলবে???

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here