#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব -১৫]
#আফরোজা_আনজুম

সন্ধ্যা থেকে একনাগাড়ে বৃষ্টি ঝরছে। থামার কোনো নাম নেই। রেবা আন্টি কয়েকবার এসে ড্রয়িংরুমে হেঁটে গেলো। মুখে এক কথা,’ নিঠুল কোথায় আছে কে জানে! ফোনও তুলছে না। এই ঝড়ের ভেতর না বলে বের হয়ে চলে গেছে।আসলেই একটা চড় মারবো বেয়াদবকে।’

রিনি আপু বললো, ” আম্মা, আমাকে বলেছে তো! রুপম ফোন করে যেতে বললো।”

” তুই আমাকে বলিস নি কেন তখন?”

আঙ্কেল এসে বসলো সোফায়। আন্টিকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” এতো অস্থির হচ্ছো কেন তুমি? ও তো ছোট নয় যে তোমার এতো চিন্তা করতে হবে! চিন্তা বাদ দিয়ে কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে দাও তো রেবা!”

” সারাদিন কাজকর্ম নিয়ে পড়ে থাকে। আমার খবর নেয় না, মনে পড়ে না। চায়ের নেশা উঠলে রেবার কথা মনে পড়ে।” আন্টি রাগে গজগজ করে বললো।

আঙ্কেল হাসলো। ঠাট্টা করে বললো, ” তোমার কথা মনে থাকে বলেই তো চা খেতে আসি তোমার কাছে। নয়তো পাশের বাসার ভাবীর কাছে যেতাম। ”

” মেয়েরা আছে এখানে। আজেবাজে বলিও না। ” আন্টি কপট রাগ দেখিয়ে কথাটা বলে কিচেনে চলে গেলো।

রিনি আপু আর আমি ফিক করে হেসে উঠলাম। রিনি আপু হেসে বললো, ” তুমি কীভাবে কীভাবে যেন আম্মাকে থামিয়ে দাও।”

” থামাতে আর পারলাম কই! সারাজীবন তো সে-ই আমাকে থামিয়ে দিয়ে এসেছে। এখন ছেলের বউ আছে তাই একটু ছাড় দিচ্ছে।” কথাটা জোরেই বললো যাতে আন্টি শুনতে পায়।

রিনি আপু উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বললো, ” তোমার চা আর আসবে না। আমিই যাই।”

কলিং বেল বাজলো এর মাঝে। আমি উঠে দরজা খুলে দেখলাম নিঠুল ভাই এসেছে। ভিজে একাকার হয়ে গেছে। ভেজা শার্ক গায়ের সাথে সেঁটে আছে, কপালে থাকা এলোমেলো চুল বেয়ে পানি পড়ছে। সে আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে দরজা থেকে আমার হাত সরিয়ে ঢুকে পড়লো। একটু আগে তাকে দেখে যে ভালো লাগাটা অনুভব হলো নিমিষেই তা খারাপে পরিণত হলো। সে বোধহয় আমাকে আশা করে নি। নিঠুল ভাই এসেছে শুনে আন্টি কথা শুনিয়ে দিলো একগাদা। সে চুপ ই থেকেছে। বিপরীতে একটা কথাও না শুনে আন্টি আরও রেগে গেলো। আমি নিঠুল ভাইয়ের রুমে গেলাম। সে বোধহয় ওয়াশরুমে। জিনিসের ছড়াছড়ি তার রুমে। বিভিন্ন রকমের কাগজ, ব্যানার, তার, লাইট আরো কী কী সবে ঠাঁসা রুমটা। তাই বড় রুমটা গোছানো থাকলেও কেমন এলোমেলো মনে হয়। বিছানা থেকে তার মোবাইলটা নিলাম। পাওয়ার অফ। চার্জে দিচ্ছিলাম তখনই সে বের হলো। খালি গায়ে দেখে লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। মিনিটেই সে তেড়ে এসে উঁচু গলায় বললো, ” আমার রুমে কী করছিস তুই? আমার সামনে আসতে বারণ করেছি না!”

সে এগিয়ে আসাতে আমি পিছিয়ে গেলাম। ফিকে গলায় বললাম, ” তুমিই তো এসেছো আমার সামনে।”

সে কিছু না বলে আমার হাত ধরে বের করে দিলো রুম থেকে। খেতে বসেও আমাকে এড়িয়ে চললো যা আমাকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। নিজ থেকে বুঝিয়ে না বললে সে হয়তো আর কথাই বলবে না আমার সাথে। রাতে আপুর রুমে গেলাম ঘুমাতে। আপু ফোনে কথা বলছে নিলয় ভাইয়ার সাথে। কথা বলছে না; কথা কাটাকাটি করছে। লাউড স্পিকারে ছিলো বিধায় আমিও শুনতে পেলাম নিলয় ভাইয়ার কথা। আপুকে থামিয়ে দিয়ে নিলয় ভাইয়া বললো, ” এই রাত বিরাতে রিনা খানের রোল প্লে করছো কেন রিনি?”

রিনি আপু রাগে ফোসফাস করে বললো, ” হ্যা। এখন তো আমি রিনি থেকে রিনা খান হয়ে গেছি। যখন প্রেম করতে তখন বলতে রিনি,তুমি আমার চিনি, মিনি। আর বিয়ের পর! বিয়ের পর কথায় কথায় বলে রিনা খান। ”

” আচ্ছা আমি আসলে নিয়ে যাবো বললাম তো! সবসময় বাপের বাড়ি, বাপের বাড়ি করে। ঐসব কথা বাদ দাও। একটু মিষ্টি কথা বলো তো! তোমাকে আজ সুন্দর লেগেছিল শাড়িটাতে। আমি যেদিন বাসায় যাবো সেদিন পরবে সেটা, ঠিক আছে! সারাদিন তোমাকে সামনে বসিয়ে রেখে দেখবো আমি। ”

রিনি আপুর রাগ উবে গিয়ে মুখে লজ্জিত ভাব এলো। লজ্জা পেয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি ফিক করে হেসে উঠলাম। বললাম, ” ভাইয়া, সারাদিন শুধু আপুকেই দেখবেন? অন্যদেরও একটু দেইখেন।”

নিলয় ভাইয়া থেমে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আপুকে বললো, ” ও আছে আমাকে বলবে না? আবার স্পিকারেও দিয়ে রেখেছে।”

কথাটা বলে ফোন রেখে দিলো। আমি হেসে আপুকে বললাম, ” এই যা!ফোন রেখে দিলো! এতো লাজুক ভাইয়া! এতো লজ্জা নিয়ে ভাইয়া তোমাকে প্রপোজ করেছে কীভাবে? তোমাদের যে সম্পর্ক ছিল তা তো কেউ বিশ্বাসই করে নি। ”

” বিশ্বাস না করারই কথা। দেখতি না সামনাসামনি থাকলে চোখ তুলেও তাকাতো না লজ্জায়! কথা তো দূর। সবার সামনে ভদ্র সেজে থাকতো ; এদিকে ফোনে আমার কান ফাটাতো। আর প্রপোজ করেছে বিয়ের রাতে। তাও আমি জোর করেছি বলে।”

” তো তোমাদের প্রেম হলো কীভাবে? ভাইয়া বলেছে নাকি তুমি?” উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

” নিঠুল বলেছে।”

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম, ” মানে?”

” মানে নিঠুল জানিয়েছে আমাকে যে তার ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে। পরে আমি তাকে ম্যাসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে কী করেছে জানিস! পুরোপুরি অস্বীকার করেছে। নিঠুল নাকি আমার সাথে মজা করেছে, তেমন কিছু নয়। পরে নিঠুলকে ফোন করে অনেক কথা শুনালো। নিঠুলও কথার প্যাঁচে বের করে নিয়েছে তার মনের কথা। আমি নিঠুলের সাথেই ছিলাম। নিলয় যখন জেনে গেছে আমি সব শুনেছি তখন আর লুকায় নি। তারপরও আমিই এগিয়েছি। এখন কী বলে জানিস! নিঠুল না বললে নাকি আমি কোনোদিনও জানতাম না তার মনের কথা।”

মনটা ভালো হয়ে গেলো মুহূর্তে। রিনি আপুর হঠাৎ করে অন্য জায়গায় বিয়ের কথাবার্তা শুরু হয়। কাবিন করে রাখবে এমন কথাও হয়েছে। আগের দিন নিলয় ভাইয়া এসে সবাইকে জানায় সে আপুকে ভালোবাসে। আপুও তাদের সম্পর্কের বিষয়ে জানায়। যে ছেলে লজ্জায় মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকায় না, কথা বলে না, পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো সেই ছেলের সাথে মেয়ের সম্পর্ক চলছে তা অবিশ্বাসের ছিল সবার কাছে।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে আপুকে বললাম, ” আমি আসছি একটু পর। তোমাদের কথা বলার সুযোগ করে দিলাম। ”

” শুয়ে পড় তুই। ও আর ফোন করবে না। ”

আপুর কথা কানে না নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। আন্টিকে দেখলাম নিঠুল ভাইয়ের রুম থেকে আসছে। আমাকে দেখে বললো, ” দেখেছিস সন্ধ্যায় ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছে! ”

” সন্ধ্যায় কোথায় গিয়েছিল আন্টি? ”

“হসপিটালে গিয়েছিল নাকি কোন রোগীকে রক্ত দিতে।”

থেমে আবার বললো, ” উঠে এসেছিস কেন? কিছু খাবি?”

” না। এমনি এসেছি।”

” আচ্ছা। শুয়ে পড় তাহলে। তোর আঙ্কেলকে ঔষধ দিতে হবে। যাই। ”

গুটিগুটি পায়ে হেঁটে নিঠুল ভাইয়ের রুমে পা রাখলাম। কাঁথা গায়ে দিয়ে ডান হাত মাথার নিচে রেখে লম্বালম্বি হয়ে ঘুমিয়ে আছে সে। তার পাশে বসে কপালে হাত রাখতেই উষ্ণতা অনুভব করলাম। চোখ মুখ শুকনো লাগছে। হঠাৎ করে তার ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিতে ইচ্ছে করলো। সে তো এখন ঘুমিয়ে আছে। একটা চুমু তো খাওয়া যায়। তার জাগ্রত অবস্থায় এই কাজটা করার সাহস নেই আমার। ভাবতে ভাবতে ঝুঁকে গেলাম তার দিকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলাম তাকে। এতো কাছ থেকে এতো সময় নিয়ে দেখার সুযোগ হয় নি কখনো। মুখটা আরেকটু এগিয়ে নিতেই চট করে চোখ খুলে ফেললো সে। চমকে উঠে পিছিয়ে গেলাম আমি। ভয়ে, লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ঘুমিয়েই তো ছিল ; টের পেলো কীভাবে! সে আমার কোমর জড়িয়ে তার কাছে টেনে নিয়ে বললো, ” সামনে আসতে বারণ করেছিলাম। তুই তো একেবারে আমার গায়ের উপর চলে এসেছিস। ”

এতো কাছ থেকে তার পুরুষালি কণ্ঠে কেঁপে উঠলাম আমি। বুক ধুকপুক করছে। মাথা নিচু করেই ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম নিজেকে। সে আরো জোরে চেপে ধরে। জ্বরের মাঝেও এতো শক্তি পায় কোথায়!

” এতো রাতে আমার ঘরে এসে আমার ঘুমের সুযোগ নিচ্ছিস!”

” আমি তো… আমি তো এমনিই এসেছি। উল্টাপাল্টা কী সব বলছো তুমি! ”

” আমি উল্টাপাল্টা বলছি, না! চুরের মায়ের বড়ো গলা। কোন মতলবে এসেছিস আমি জানি না!”

” কোন..কোন মতলবে এসেছি?”

কথাটা বলার সাথে সাথেই সে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দিল। হঠাৎ আক্রমণে হকচকিয়ে গেলাম। পাঁচ ছয় সেকেন্ড পর সে ছাড়িয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো এবং বললো, ” এই মতলবে।”

তার হাত সরিয়ে উঠতে চাইলাম আমি। সে ছাড়লো না। দুষ্টু হেসে বললো, ” ঠোঁটটা এখনো শুকিয়ে আছে। দাঁড়া আরেকটু ভিজিয়ে নেই।”

লজ্জায় কান লাল হয়ে গেলো আমার। তার হাতে জোরে চিমটি কাটলাম। মৃদু চিৎকার করে ছেড়ে দিলো সে। ততক্ষণে আমি উঠে দরজার দিকে চলে গেলাম। পেছনে ফিরে বললাম, ” এই মতলবে এসেছিলাম আমি।”
.
.
.
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সুখবর পেলাম। রিনি আপু কনসিভ করেছে। রিনি আপু লাজুক মুখে আন্টিকে তা জানাতেই আন্টি খুশিতে চিল্লিয়ে উঠে আপুকে জড়িয়ে ধরে। খুশি হবেই না বা কেন! তিনবছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই খুশির সংবাদটা শোনার জন্য। নিঠুল ভাই দৌড়ে চলে যায় মিষ্টি আনতে। আন্টি বড় চাচীকে ফোন করে জানিয়ে দেয়। রিনি আপুকে পারে না কোলে নিয়ে বসে থাকে। রিনি আপু নিলয় ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলো তখন নিঠুল ভাই ফোনটা টেনে নিয়ে কংগ্রাচুলেশন জানায়। শাশুড়ী-দেবরের কাণ্ডে লজ্জায় রুমে বসে আছে রিনি আপু। এতো কিছুর মাঝেও নিঠুল ভাই আমাকে এড়িয়ে চলছে। কাল রাতের কথাও মনে নেই হয়তো। বিকেলে আন্টিকে বললাম আমি চলে যাবো। আন্টি না করলেও বুঝিয়ে বললাম। আন্টি নিঠুল ভাইকে দিয়ে আসতে বললে সে সোজা বলে দেয়, ” আমার কাজ আছে। আজকে পারবো না। থাকতে বলো ওকে।”

” কতো করে বললাম শুনছে না ও। তুই দিয়ে আয়।”

” বাইকে যাবো তাহলে। আসতে বলো।”

” কার বাইক? বাইক চালাতে বারণ করেছি তোকে।” আন্টি রাগী গলায় বললো।

” আমি বাইক চালাতে জানি, আম্মা। সমস্যা হবে না। এবার ভাইয়া আসলে একটা নিয়ে নিবো দেখো।”

” কথা শুনিস না তুই! মেয়েটাকে আমি তোর সাথে দিবো বাইকে! গাড়িতে করে যা।”

” গাড়িতে গেলে টাকা খরচ হবে শুধু শুধু। আব্বুর, ভাইয়ার কত কষ্টে কামানো টাকা! তার চেয়ে বাইক চালিয়ে যাই!”

” এক চড় মারবো, ফাজিল। এখন বাবা, ভাইয়ের কষ্ট বুঝছে সে! গাড়িতেই যা।”

সে আন্টির কথা শুনছে না। বাইকে হলে নিয়ে যাবে নয়তো না। বন্ধুর কাছ থেকে নাকি শিখেছে বাইক চালানো। তার জন্য নিতে চাইলেও আন্টির ঘোর আপত্তির কারণে নিতে পারছে না। আন্টিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমাকে উঠতে বলে বাইকে। একটু একটু ভয় লাগছে তাই তার দিকে ঝুঁকে বসলাম। সে বুঝতে পেরে তাকে ধরে বসতে বলে। আমি পেছন থেকে হাত এগিয়ে তাকে হালকা জড়িয়ে ধরি। কিছু বলে নি সে। সাহস করে হাতের বাঁধন শক্ত করে তার পিঠে মাথা রাখলাম। অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে। তার শার্ট থেকে পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ আসছে। চোখ বন্ধ করে নিলাম আমি। একটু যেতে কিছুর সাথে ধাক্কা লাগলো বাইক। কিছু বুঝে উঠার আগেই বাইক ছিটকে রাস্তার পাশে পড়লো। চারপাশে মানুষ জড়ো হলো। পাশে নিঠুল ভাইয়ের অর্ধেক শরীর বাইকের নিচে পড়ে আছে। সে উঠতে চায়ছে। সামনে দেখতে পেলাম অারেকটা বাইকের পাশে একটা লোক পড়ে আছে। লাল রক্তে রাস্তা ভেসে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। নিঠুল ভাইকে কাতর কণ্ঠে বলতে শুনলাম, ” ওর কাছে যান দয়া করে। ওকে তুলুন আগে।”

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here