#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব -০৯]
#আফরোজা-আনজুম

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে আম্মুর রুমে গেলাম। আব্বু ডেকেছিল। আমি যেতেই আব্বু আমাকে বসিয়ে দিল হিসাব-নিকাশের খাতা দিয়ে। চোখের সমস্যার জন্য প্রায় সময় হিসাব আমাকে দেখান। মাঝে আব্বুর ফোন বেজে উঠে। আমাকে নিতে বললে দেখি রেবা আন্টির কল। আব্বুকে দিয়ে আবারও হিসাবে মনযোগ দিলাম। মনযোগ সরে গেলো আব্বুর কথা শুনে। আব্বু বললো, ” আপা, সেদিন তো বললাম মেয়ে বিয়ে দিবো না এখন।”

আন্টির আগের কথা খেয়াল করি নি। তবে এখন শুনতে পেলাম,
” হ্যা। সেটাই তো বলেছি। কিন্তু তারা মানতে নারাজ। সরাসরি আপনাদের বাড়ি গিয়ে প্রস্তাব দেবে বলছে। নিলয়ের আব্বাকে ফোন করে বললো সেও যেন সাথে গিয়ে বলে। আপনি বরং ফোন করে তাদের সরাসরি জানিয়ে দিন যে প্রবাসী ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দিবেন না। এটাই ভালো হবে। এর আগে অন্য কথা বলায় তারা হালকা ভাবে নিয়েছে।”

” হ্যা সেটাই করবো।”

প্রবাসী বলায় বুঝে গেলাম কার কথা বলছে। হঠাৎ নিঠুল ভাইয়ের আওয়াজ পেলাম। আন্টির পাশেই ছিল বোধহয়। সে বললো,

” আঙ্কেল, তুমি এখন ফোন করে জানিয়ে দাও।”

আব্বু বললো, ” এখন কেন? রাত এগারোটা বাজছে। কাল সকালে বলবো।”

” কাল সকালে না। এখন বলো। তারা জেগে আছে।”

তার গম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেলো। আব্বু আচ্ছা বলে কল কেটে দিলো। তারপর মনে পড়লো নিলু আপুর শ্বশুর বা শাশুড়ি কারো নাম্বার নেই। ফোন করবে কীভাবে? আব্বু আমাকে বললে নাম্বারটা নিতে। আন্টির কাছে কল করে নাম্বার দিতে বললাম। নিঠুল ভাই আমাকে শুনিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, ” সব দোষ ওর। সেদিন দেখলে না সিয়ামের সাথে কেমন লেগে থেকেছে! তার মধুর মধুর কথা শুনেই তো সে মনে করেছে এও পছন্দ করে হয়তো তাকে। এই বেয়াদবটাই পাগল করেছে সিয়াম ভাইকে। নয়তো প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পর এখন আবার উতলা হচ্ছে কেন? বেয়াদব মেয়ে! কাজই হচ্ছে ছেলেদের পাগল করা।”

আরো কিছু বলতো; আন্টি ধমক দেওয়ায় চুপ হয়ে যায়। এদিকে অপমানে আমার কান্না চলে আসে। আন্টির সামনে কীভাবে বলতে পারলো এটা! সিয়াম ভাইয়ার সাথে সেদিন কথা বললেও এমন কিছু করি নি যাতে মনে হয় আমার তাকে পছন্দ। এখানে আমার দোষটা কী!
.
.
.
পিউ ফোন করে লাইব্রেরিতে যেতে। ক্লাস অফ থাকায় এমনিতেই বসে ছিলাম বিরক্ত হয়ে। পিউ বলার পর আর দেরি করি নি। একটা ছেলেকে দিয়ে নিঠুল ভাই খবর পাঠালো দেখা করতে। সে ভবনের সামনে আছে। ইচ্ছে করেই যাই নি আমি। লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি পিউ কোণার একটা বেঞ্চে বসে মেবাইল টিপছে। খানিকটা ঝুঁকে দেখলাম ছবি দেখছে রুপম ভাইয়ের। আমাকে দেখে মোবাইল রেখে অস্থির গলায় বললো, ” আমি মরে যাবো, রোজ। আমি মরে যাবো। ”

“কত সুন্দর হাসিমুখে রুপম ভাইয়ের ছবি দেখছিলি এইমাত্র। আর এখন আমাকে দেখেই মরে যাচ্ছিস!”

” রুপমের ছবি দেখলে শত দুঃখের মাঝেও হাসি ফোটে। কী করবো বল! ”

” রু..প..ম! ভাইয়াটা কেটে দিলি! তো মরে যাবি বলেছিস। কারণ কী? ”

পিউ এমন প্রশ্নে আহত হলো মনে হচ্ছে। বললো, ” আমি মরে যাবো শোনার পরও তুই এতো স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করছিস কারণ কী! তোর একটুও টেনশন হচ্ছে না?”

দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বললো পিউ। আমি বললাম, ” নিজের দুঃখ প্রকাশ করতে বলেছিস। সত্যিই যে মরে যাবি না সেটা জানি আমি। এখন বল তো কী নিয়ে দুঃখ! ”

” রুপমকে নিয়ে। সারাক্ষণ তার পিছু ঘুরি, তাকে নিয়ে ভাবি কিন্তু সে একদম দুধের বাচ্চার মতো থাকে। যেন কিছুই বুঝে না। আর আমাকে ডাকে বোন। আমি নাকি তার ছোট বোন। এইতো একটু আগেও বোন ডেকে গেলো।”

আমি হাসলাম। বললাম, ” তার হয়তো ছোট বোন নেই। তাই তোকে ছোট বোন হিসেবে দেখে।”

পিউ রেগে উঠে বললো, ” ভার্সিটিতে মেয়ের অভাব আছে নাকি! আমাকে কেন বোন ডাকে! আজকেই বুঝিয়ে দিবো আমি তার বোন নাকি অন্য কিছু। ”

সে চলে যাচ্ছে। আমিও তার পিছু নিলাম। সিড়ি দিয়ে নামতে নিঠুল ভাই, রুপম ভাইকে দেখলাম। রুপম ভাই জিজ্ঞেস করলো পিউ এমন করে কোথায় গেলো৷ আমি না লুকিয়ে সরাসরি বললাম, ” ভাইয়া, পিউ আপনাকে ভালোবাসে। আপনি তাকে বোন বলে ডাকেন তাই সে রেগে আছে। এখন সে নাকি মরে যাবে।”

রুপম ভাইয়া নিঠুল ভাইয়ের দিকে তাকালো। তাকে চুপ থাকতে দেখে আমি পাশ কাটিয়ে নেমে গেলাম। ক্লাস জলদি শেষ হওয়ায় গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিলাম। সবাই আসলে গাড়ি ছাড়বে। বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম বলে নিঠুল ভাই, রুপম ভাইয়াকে দেখতে পেলাম। সেও দেখলো। মুহূর্তেই আবার আড়াল হয়ে গেলো। হঠাৎ পাশে কেউ গা ঘেঁষে বসায় চমকে উঠলাম আমি। নিঠুল ভাই আমার ব্যাগ টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো পানি আছে কি না! বলার সাথে সাথে ব্যাগের চেইন খুলে নিয়েও ফেললো বোতল। ঢকঢক করে পানি খেয়ে বোতলটা বাইরে ছুড়ে মারলো। আমি রেগে গেলাম তা দেখে। বললাম, ” বোতলটা ফেলেছো কেন?”

সে আমার ওড়নার কোণা টেনে হাত মুছে বললো, ” বোতলে পানি খাওয়া সেইফ না। একটা ওয়াটার পট কিনতে পারিস না! নাকি তোর কন্জুস বাপ এখানেও বলে যে বোতল থাকতে ওয়াটার পট কেন কিনতে হবে টাকা খরচ করে! শুধু শুধু খরচ! ”

” আমার আব্বুর কাছে টাকার পাহাড় নেই আমাদের। বলাটাই স্বাভাবিক। ”

” নেই! তোর বাপের কতো টাকা আছে সব জানা আমার। এতো টাকা কেন জমাচ্ছে রে না খেয়েদেয়ে! তোর বাপের যা বুদ্ধি… ”

আমি উঠে চলে আসতে চাইলাম। সে আমাকে বসিয়ে দিয়ে ধমকে উঠলো। বললো, ” আমি প্রচুর রেগে আছি তোর উপর। মাথা ঠান্ডা রাখতে চাইছি। তুই আবার আমাকে রাগ দেখাচ্ছিস! সকালে আধঘন্টা মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম ভবনের সামনে। কয়বার ডেকে পাঠিয়েছি? আসিস নি কেন? ”

” কেন! বেয়াদব, খারাপ মেয়েটাকে কেন প্রয়োজন তোমার যে ছেলেদের পাগল করে দেয়! ”

” কারণ মেয়েটা আমাকেও পাগল করে দিয়েছে। তাকে অন্য কেউ চাইলে আমার ইচ্ছে করে তাকে খুন করতে। আমার তাকে অন্য কেউ কেন চাইবে! কেন ভাববে তাকে নিয়ে! এতো বছর ধরে তাকে ভালোবেসে আসছি, আগলে রেখেছি। হুট করে অন্য কেউ কেন তার জীবনে আসতে চাইবে! সে শুধু আমার। একান্ত আমার। তাকে নিয়ে ভাববোও আমি।”

কেঁপে উঠলাম আমি। পাশাপাশি সিটে বসায় খুব কাছে দুজনে। আমার চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলেছে নিঠুল ভাই। তার কণ্ঠে কী যেন ছিলো! চোখ নামিয়ে নিলাম আমি লজ্জায়। নিঠুল ভাই একহাতে আমার মুখ তুললো। তার মুখটা কাছাকাছি আনছে। সে কী চুমু খাবে এখন! আমি কাঁপছি, বুকে ধুকপুক আওয়াজ হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
” যেটা ভেবে আন্ডা চোখগুলো বন্ধ করে ফেলেছিস সেটা একদমই করবো না এখন। তার জন্য স্পেশাল প্লেস, স্পেশাল মোমেন্ট চাই।”

তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার কানের কাছে অনুভব করছি। চোখ খুললেই লজ্জায় পড়তে হবে তাই চোখ বন্ধই রাখলাম। অন্যদের আওয়াজ শুনে চোখ খুলে ঠিক হয়ে বসলাম। নিঠুল ভাই পাশের সারির সোজাসুজি সিটে বসে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি এপাশ ফিরে হাসলাম আমিও।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here