#ভাগ্যবতী
#লাবিবা_তানহা_এলিজা
#পর্ব_৮
রাতে পূরবীর ডাক পড়ে মমতার রুমে। জমিলা খবর দিয়েই কিচেনে চলে যায়। চুলোয় তরকারি বসিয়েছে সে। জমিলার দেখানো দিকে পূরবী আস্তে আস্তে খোঁজে মমতার রুম পেয়ে যায়। মমতা পূরবীকে বসতে বলে। পূরবী সোফায় গিয়ে বসে। মমতা পূরবীর দিকে ঘুরে বসে বলে,
” তোমার দিকটা ভেবে দেখলাম আমি। তুমি অপরিচিত। তবুও তোমাকে বিশ্বাস করলাম। তুমি এখানেই থাকো। নূরার সাথে কথা বলে নিবো আমি। ”
” শুকরিয়া মেডাম। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।আমি এমনকিছু করবোনা যাতে আপনাদের ক্ষতি হয়। ”
” আমাকে বড়মা বলে ডাকতে পারো।আমি তোমার মায়ের মতো। ”
পূরবীর চোখ দুটো ছল ছল করে উঠে।
” শোনো পূরবী। আমি তোমাকে এমনি এমনি রাখছি না। স্বার্থ ছাড়া এ পৃথিবীতে কেউ কিছু করেনা। তোমাকে আশ্রয় দেওয়ার পেছনে আমারো কিছু স্বার্থ আছে। তবে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো তোমার ক্ষতি হবে এমন কিছুই তোমাকে করতে বলবোনা। তবে আমার সব কথা তোমাকে শুনতে হবে। ”
” কি কথা? ”
” আমি যখন যা কিছু করতে বলবো তাই করবে। বিনিময়ে তোমার ভরনপোষনের দায়িত্ব আমাদের। তুমি রাজী তো? ”
” আ.. আমার কি কাজ? ”
” সময় হলে বলবো। এখন তুমি আসতে পারো। ”
পূরবী মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। নিজেকে খুব হালকা লাগছে। মাথার উপর থেকে একবোঝা দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেছে। অবশেষে সে আশ্রয় পেয়েছে। বকুল যদি না সাহায্য করতো তাহলে কি হতো!ভেবেই বুক কেপে উঠে। বকুলের নাম্বারে ফোন দিয়ে জানিয়ে দেওয়ার কথা ছিলো তার। কয়েক সেকেন্ড ভেবেই পেছন ঘুরে আবার মমতার সামনে আসে। বুক ভরে সাহস নিয়ে বলতে যাবে তখনই মমতা জিজ্ঞাসা করে, ” কিছু বলবে? ”
” আমি একটা ফোন করতে পারি? ”
মমতা নিজের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলে, ” আমার সামনে কথা বলো। ” পূরবী মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।
” তোমার ফোন আনোনি বুঝি? ”
” আমার ফোন মামীর কাছে ছিলো। ”
” ওহ”
পূরবী বকুল কে ফোন দেয়। বকুলের নাম্বার মুখস্ত ছিলো। বকুল পূরবীর গলা শুনেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
” পূরবী ঠিক আছিস তুই? কোথায় আছিস? এতোক্ষনে ফোন দিলি তুই। আমি তো টেনশনে মরেই যাচ্ছিলাম। ভালো আছিস তুই? কিছু হয়নিতো? ”
” আমি ঠিক আছি আপু। ”
” আল্লাহ রক্ষা করুক। ”
” আমি ঢাকা আপু। ”
” তোকে না চট্টগ্রামের বাসে তুলেদিয়ে আসছে শ্যামলী ? তাহলে ঢাকা কিভাবে গেলি? ”
পূরবী বকুলকে সবটা খুলে বলে। বকুল বুকে হাত রেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
” তুই চলে যাবার অনেকক্ষণ পর ফুফা আর ভাইয়া এসেছে। পুলিশি ডাইরি করা হয়েছে। মা বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল।আবার ছেড়েও দিয়েছে। আশুকে আটক করা হয়েছে। হয়তো ছাড়া পেয়ে যাবে দু একদিনে। তুই আর বাড়ি মূখো হবি না পূরবী। আশু এবার তোকে খুঁজে বের করতে উঠে পড়ে লাগবে। তোর জীবনটা নষ্ট করে দিবে। ফুফা তোকে খুঁজতে থানায় ডাইরি করেছে । ভীষন কষ্ট পাচ্ছে ফুফা ভাইয়া। ”
” কষ্ট পাক। অনেক কষ্ট পাক। আমাকে কষ্ট দিতে তো একপাও পিছোয়নি। শুনবোনা আমি ওদের কথা। ওদের কথা বলবেনা আমাকে। ”
” শুনে তো ঠিকই কাঁদছিস। ”
” আমি কাঁদবো আরো কাঁদবো। কেউ আটকাতে পারবে না। ”
” বাদ দে। তুই আশ্রয় পেয়েছিস পূরবী।নিশ্চয় উনারা ভালো মনের মানুষ। তুই ভালো থাক সুখে থাক বোন।”
” তোমার সুখে যে ভাটি পড়লো তার কি হবে আপু?তোমার বিয়ে যে আটকে যাবে। এতো কিছু শোনার পর তারা কি আর তোমাকে ঘরে তুলে নিবে? ভালো ফ্যামিলির কেউই এসব শোনার পর আর আত্মীয়তা করতে চাইবেনা। ”
“পূরবী তুই কি জানিস তোর সি এনজি ড্রাইভার তোর হবু ভাইয়াই ছিলো? ”
” মানে? ”
” তুই হয়তো খেয়াল করিসনি। আমি যখন কি করবো ভেবে না পাচ্ছিলাম তোর ভাইয়াই আমাকে সমস্তটা সাহায্য করেছে। আর আশু কেমন তা সবাই জানে। তাই পুরো দোষটা আশুর উপর গড়িয়েছে।আমাকে নিয়ে চিন্তা করিসনা বোন। সামনের মাসেই হয়তো বিয়েটা হয়ে যাবে। আমি ভালো থাকবো। ”
” তাই যেনো হয়। ”
” এটা কার নাম্বার? ”
” এবাড়ির মালকিং এর। ”
” ওহ। দরকারে তোকে এই নাম্বারে ফোন দিলে পাবো তো? ”
” হ্যাঁ পাবে। বড়মা অনেক ভালো। রাখছি। ”
” ভালো থাকিস। ”
ফোন কেটে পূরবী ফোনটা মমতাকে দেয়। মমতা বলে, ” ডিনারের টাইম হয়ে গেছে। এসো আমার সাথে। ঠিক দশটায় ডিনার টাইম। আটটায় ব্রেকফাস্ট টাইম, দুটোয় লাঞ্চ টাইম। কাজের চাপ থাকলে অন্য কথা। তোমার তো কোন কাজ নেই। ”
মমতার পিছু পিছু পূরবী ডাইনিং এ আসে। সাদ অলরেডি এসে বসে আছে। মাথা নিচু করে ফোনে স্কলিং করছে। পূরবীর দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। পুরো সময় একটা কথাও বলেনা। খাওয়া শেষ করে উঠে চলে যায় মমতা। পূরবী এখনো খেয়ে যাচ্ছে। খেতে একটু টাইম লাগে পূরবীর। সাদের খাওয়া শেষ। টাওয়ালে হাত মুছতে মুছতে কয়েকবার পূরবীর দিকে তাকায়। চোখ মুখ ফুলে আছে পূরবীর। মাথায় উড়না দিয়ে চুপচাপ ধীরে ধীরে খেয়ে যাচ্ছে। সাদ দু পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। পূরবীকে সন্ধিহান চোখে দেখতে থাকে। পূরবী টের ও পায় না। খাওয়া শেষে হাত ধুতে বেসিনে যেতেই সাদকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। চটপট বুকে থু থু দিয়ে সাদের দিকে তাকায়। মুখটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষন ভয় পেয়েছে। সাদ এগিয়ে এসে পূরবীর সামনে দাঁড়ায়। পূরবী কয়েকবার চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে থাকে।
” সুবিধাবাদী ব্যক্তিত্ব অথবা তেজস্বীয় লাভা
স্বচক্ষে অবলোকিত হয় অনবরত যেথা
আখি জলে বুক ভাসায় সেই নারী
হলেও হতে পারে সে মোহমায়া ছলনাময়ী ।”
সাদের বলা এই চারটি লাইন বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে থাকে পূরবী। তাচ্ছিল্য হাসিতে ঠোঁট বাকায় সাদ। দুই পকেটে হাত রেখেই সিড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে চলে যায়।
১৩.
ভোরে ফজর নামাজ আদায় করে রুমেই বসেছিলো পূরবী। রাতে একদমি ঘুম হয়নি। নতুন জায়গায় সহজে ঘুম আসতে চায় না। কিছু সময় থ হয়ে বসে থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। মাথা ধরে আছে। এককাপ চা হলে ভালো হয়। কিচেনে ঢু মারতেই দেখে জমিলা চা বানাচ্ছে। পূরবী জমিলার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। জমিলা পূরবীকে দেখে মুচকি হেসে বলে ,” চা খাবা? বসো চা দেই । তুমি বলে ডাকলাম। কিছু মনে করো না । আমার অনেক ছোট তুমি। ”
সকালে ঘুম থেকে উঠে চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস পূরবীর। একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে সে। জমিলা চা দেয় টেবিলে। পূরবী জিজ্ঞাসা করে,
” বিস্কুট হবে খালা? ”
” দাঁড়াও দেই। ”
জমিলা বিস্কুট দিলে গরম ধোয়া উঠা চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে ডুবিয়ে খায় পূরবী। বাহির থেকে বাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করে মমতা। ফজরের নামাজের পর গার্ডেনে একঘন্টা হাটাহাটি করে সে। কিচেনে পূরবীকে দেখে বলে,
” গুড মর্নিং। ”
” গু..গুড মর্নিং বড়মা। ”
” জমিলা আমার চা টা দাও। ”
” পানি খেয়েছেন মেডাম? আমি রাতেই হরতকি, বহেরা ভিজিয়ে পানি রেখে এসেছিলাম আপনার রুমে। ”
” হুম খেয়েছি। এখন চা দাও। ”
মমতা চায়ে চুমুক দেয়। পূরবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
” খালি পেটে চা খাওয়ার অভ্যাস? ”
” পূরবী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। ”
” মানুষ অভ্যাসের দাস। এখন থেকে চা খাওয়ার আগে অন্তত একগ্লাস পানি খেয়ে নিবে। আজকালকার মেয়েরা খালিপেটে অনেক কিছুই খায় ফিট থাকার জন্য। তোমাকে দেখে মনে হয়না তোমাকে খেতে হবে। ডক্টর বাড়ি এটা। এখানে সঠিক নিয়ম ই চলবে। তোমার বড়বাবাও ডক্টর ছিলেন। তার সপ্ন ছিলো তার ছেলে মেয়েরাও ডাক্টর হবে। সে মারা যাবার পর দুজনেই বাবার সপ্ন পূরন করে। আমার বড় মেয়েটা সিডনিতে থাকে। ”
পূরবী মাথা নাড়ায়। জমিলা কফি হাতে সিড়ির দিকে যেতে নিলেই মমতার ডাকে থেমে যায়। মমতা বলে,
” মগটা পূরবীর হাতে দাও। আজ থেকে পূরবী সাদকে কফি দিয়ে আসবে। ”
পূরবী চোখ বড় বড় করে ফেলে। ” আমি কেনো? ” মমতা বলে, ” চোখ ছোট করো। প্রত্যেক দিন সকালে এটা তোমার কাজ। ঠিক সাড়ে ছয়টায় সাদকে কফি দিয়ে আসবে। ” জমিলা পূরবীর হাতে মগ দিয়ে বলে ,”উপরে বা দিকের তিন নাম্বার রুমটা ছোট সাহেবের। যাও। ”
পূরবী মগ নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভয় হচ্ছে তার। যদি প্রশ্ন করে বসে আমি কেনো? তখন? সত্যি কথা বলে দিবো বড়মা পাঠিয়েছে। আল্লাহর নাম নিয়ে দরজায় টুকা দিতেই খানিকটা খুলে যায়। তার মানে দরজা খুলা? পূরবী আরেকটু দরজাটা খুলে দেখে কেউ নেই। পুরোপুরি দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে। খলা খাঁকারি দিয়ে মি. ডাক্তার… মি. ডাক্তার বলে কয়েকবার ডাক দেয়। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। বেশ বড়ো সড় রুমটা। চোখ ধাঁধানো সব ফার্নিচার। বা দিকে রাজকীয় খাট পাতানো। তার উপর দেয়ালে বড়ো একটা ছবি। ছবিতে খুব এটিটিউট নিয়ে পকেটে দু হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে সাদ। পূরবীর চোখ ওতেই আটকে যায়। সামনে এগিয়ে নিখুঁত ভাবে ছবিটা দেখতে থাকে। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে অপলক চোখে তাকিয়ে দেখতে থাকে। বাস্তবের থেকে ছবিতে মনে হয় একটু কম ই হ্যান্ডসাম লাগছে। হতে পারে ছবিটি দুই এক বছর আগের। ছেলেদের যত বেশী বয়স হয় ততো তাদের চেহারায় পরিপক্কতা আসে। ইডিটের ছড়াছড়িও চোখে ধরা পড়ছে। ডিএসএলআর দিয়ে তোলা ছবি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। যেটাতে বেশী চোখ যাচ্ছে পূরবীর সেটা ঠোঁটের কোনে বাকা হাসিতে। সেই পরশু রাত থেকে দেখে যাচ্ছে সাদকে। লোকটা একটুও হাসে না। তবে একবার বিদ্রুপূর্ণ হাসতে দেখেছে। সব সময় গম্ভীর ভাব নিয়ে থাকে। একটুতেই রাগ করে বসে সাথে চিল্লাচিল্লি ফ্রি। একটু হাসলে কি হয়?
খট করে দরজা খোলার শব্দ হয়। পূরবী পেছন দিকে তাকাতেই দেখে সাদ বাথরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছে। কোমরে পেঁচানো পিংক কালারের একটা টাওয়েল। বুক পিঠ বেয়ে বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ছে। পূরবী ঢুক গিলে ওরে.. মা..মা..মা.. বড়মা.. বলে চিৎকার দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। সাদ তাড়াহুড়ো করে বেডের উপর থেকে শার্ট নিয়ে পরে নেয় । ঘটনা আকষ্মিকে দুজনেই ঘাবড়ে যায়। পূরবী চোখ বন্ধ করে যথারীতি কাপছে। এটা সে কি দেখলো? এরকম দৃশ্য তো সে মুভিতে দেখেছে। হিরো সদ্য সুইমিং পুল থেকে সুইমিং করে উঠেছে। ভেজা শরীর বেয়ে টুপ টুপ করে গড়িয়ে পড়ছে পানি। শর্টসের উপর দিয়ে কোমড়ে টাওয়েল জড়িয়ে ক্যামেরার দিকে ঘুরে তাকায়। সে কি বডি! কি চমৎকার মাসল ! চুল থেকে মুখ বেয়ে বুক বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ার দৃশ্যটা না হলেও হাজার বার টেনে টেনে দেখেছে পূরবী। আজ সামনাসামনি এমন দৃশ্য দেখে হাত পা কাপা শুরু করে দিয়েছে তার।
চলবে,