#ভাগ্যবতী
#লাবিবা_তানহা_এলিজা
#পর্ব_৩
৫.
বিয়ে বাড়িতে পুলিশের পদধূলি। অভিযোগ — এখানে বাল্যবিবাহ দেওয়া হচ্ছে। কনের বয়স সতের বছর সাত মাস। আঠারো পূর্ণ না হওয়া অব্দি এটি বাল্যবিবাহ। আরেকটি অভিযোগ — এখানে হিন্দু মুসলিম বিবাহ হচ্ছে। একটি মুসলিম মেয়েকে জোর করে বিবাহ দেওয়া হচ্ছে। মেয়েটির আসল গার্ডিয়ান বাবা ,ভাই থাকতেও তাদের না জানিয়ে মামা মামী পনের লাখ টাকা পেয়ে মেয়েটিকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে । অভিযোগকারী মেয়ের বাবা আর ভাই। আসামী সাজু, জাহ্নবী, আশু। আশুর বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও কখনো ছোট খাটো প্রমান ও পাওয়া যায়নি। এবার প্রমান পাওয়া গেছে। সে বাল্য বিবাহের মতো একটা জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়েছে। অফিসারের মুখে বাকা হাসি ফুটে। চারিদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে যায়। মোল্লারা এ বাড়িতে পা রাখে। এবার বুঝি বিয়েটা আটকানো সম্ভব হলো। আশু পুলিশের সাথে আলাদা কথা বলতে চায়। কিন্তু এবার সাফ সাফ জানিয়ে দেওয়া হয় যে হাতে নাতে ধরেছে। সাংবাদিক ও সাথে আছে। মালকড়ি দিলেও কাজ হবেনা। এটা মিডিয়ার ব্যাপার। অবস্থা বেগতিক দেখে জাহ্নবী বকুলকে নিয়ে পালাতে চায়। সুযোগ বুঝে সাইড কেটে ঘরে আসে বকুলকে নিয়ে। টাকার ব্যাগটা খুঁজতে থাকে। কিন্তু যেখানে রেখেছিলো সেখানে আর খুঁজে পায়না। সাড়াঘর খুঁজতে থাকে। বকুল ও খোজার ভান ধরে কিন্তু পায়না। বকুল বলে, ” টাকাটা কোথায় গেলো মা? কোথায় রেখেছো? ”
” আরে এখানেই তো রেখেছি। পূরবী রেখে দেয়নি তো আবার? ”
বকুলকে নিয়ে পূরবীর রুমে আসে। পূরবী… পূরবী.. ঢেকেও পূরবীর সাড়া পায়না। বাইরে উকি দিয়ে দেখে পূরবী ভিড়ের মাঝে নেই। ” হায় হায় রে টাকা পয়সা নিয়ে পুরবী পালিয়ে গেলো রে ” চিৎকার করে বলে বসে বিলাপ শুরু করে দেয়। ” হায়রে আমার বান্ডিল বান্ডিল টাকা রে.. গয়না গাটি টাকা পয়সা সব নিয়ে পালিয়ে গেলো রে.. ”
পুলিশ স্টাফ পূরবীর রুমে চলে আসে। পুরো রুম সার্চ করে। জাহ্নবী বিলাপ করতেই থাকে। বকুল মনে মনে অফসোস করে ,” তোমার আর পালানো হলো না মা। আফসোস। ”
আশু ,জাহ্নবী ,সাজুকে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়। পুলিশের নিকট উল্টো আশু নালিশ করে , তার পনের লাখ টাকা আর বাইশ ভরি সোনার গহনা নিয়ে পূরবী পালিয়েছে। পূরবীর বাবা পলাশ খাঁ এমনিতেই মেয়েকে না পেয়ে হতাশ। ছোট মেয়েটা তার কোথায় না কোথায় গেলো কে জানে! চব্বিশ ঘন্টা হবার আগে পুলিশ ডায়রি লিখছে না। বলছে বাড়ি গিয়ে দেখুন মেয়ে বাড়ি গিয়েছে। মেয়ে যে বাড়ি যাবেনা সেটা সে কেনো সবাই জানে। এমন সময়ে কি কেউ ধরা ছোঁয়ার ভেতরে থাকতে চায়? তার মেয়েতো এমনিতেই ভয়ে আছে। তার মধ্যে এই আশু গুন্ডার উটকো কথাবার্তা। একটু আগে তার মেয়ে নাকি এই গুন্ডার বউ। সিঁদুর পড়িয়েছে। ঐসব হিন্দুজাতে। মুসলমানের আবার কিসের সিদুর পড়ানি? এখন আবার বলছে বাইশ ভরি সোনা আর পনের লাখ টাকা নিয়ে পালিয়েছে। মেনে নেওয়া যায় কি এসব? ভীষন চটে যায় সে। পলাশ খাঁর মেয়ের নাকি টাকা পয়সার অভাব পড়েছে তাই চুরি করে পালাবে। চাপা ধরেই ব্যাপারটা থেকে বেরিয়ে আসে। আপাতত সে মেয়েকে খুঁজে পেতে চায়। ডায়েরি লেখাতে চায়। পুলিশির হেল্প চায়। সাজু, জাহ্নবী ইঁদুর ছানার মতো হয়ে শুধু দেখে যাচ্ছে। বকুলের ভাবনা অন্য। পূরবী কতদূর? বাসে উঠেছে তো সে? আরেকটু আগে কেনো এলোনা ফুফা? সবাই যদি জেনে যায় পূরবীকে সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে তখন? আশুর জেল থেকে বের হওয়া তো ওয়ান টু ব্যপার। তারপর পূরবীর খোঁজ করলে? না পূরবীর কথা সে বলবেনা কাউকে। কিছুতেই বলবেনা।
৬.
গাছপালা ঘরবাড়ি গুলো পেছন দিকে ছুটছে। বড় রাস্তার উপরে ছুটে চলছে বাস, ট্রাক, টোটো, সিএনজি, মোটরবাইক। দিক থেকে দূরন্তে পাড়ি দিয়েছে তারা পূরবীর মতো। অশ্রুশিক্ত চোখে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে পূরবী। বাতাসে মুখের উপর ছোট চুলগুলো এলোমেলো ভাবে পড়ছে। হাত দিয়ে সরানোর প্রয়োজন বোধটুকুও করছে না সে। তার চিন্তা ভাবনা সব তার নিয়তিকে ঘিরে। জীবন তাকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে মা হারালো। তারপর বাপ-ভাইয়ের দ্বারা প্রতারিত হলো। তারপর ঘর হারালো। মামার বাড়ি আশ্রয় নিলো । মামা -মামীর দ্বারা প্রতারিত হয়ে এখন আশ্রয়টুকুও ছাড়লো। এক অজানা পথে ছুটছে সে। যেখানে নেই কোন আপনজন। নেই কোন ভরসার হাত, নেই কোন আশ্রয়। সব হারিয়ে আজ সে সর্বশান্ত। ভাগ্যের এই পরিহাস দেখে সে এবার ক্লান্ত। খুবই ক্লান্ত। ভাবতে ভাবতে চোখ বুঝে পূরবী।
বাস ছেড়েছে ঘন্টাখানেক হলো। বাসটির গন্তব্য চট্টগ্রাম । টিকেট কাটতে গিয়ে দেখে চট্টগ্ৰামের বাসটি ছাড়বে। শ্যামলী সেই বাসেই তুলে দেয় পূরবীকে। লাস্টের একটা সিট পেয়েছে সে। সীটে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে সে। ঘুম ভাঙল কয়েক ঘণ্টা পর বাস সুপারভাইজার এর ডাকে। মিটি মিটি চোখ খুলে তাকায় পূরবী। তার চারিদিকে অনেকেই হা করে উৎসুক চোখে তাকিয়ে তাকে দেখছে। যেনো পূরবী কোন সার্কাসের জন্তু। এবার তাকে নিয়ে খেলা দেখানো হবে। সুপারভাইজার বলে, ” এই যে দিদিমনি, আধাঘন্টার ব্রেক দিছে বাইরে গিয়া হোটেলে খাইয়া ফ্রেশ হয়ে নেন। এইভাবে মরার মতো ঘুমাইলে চলে? যান উঠেন। ”
পূরবী বাইরের দিকে তাকায়। সন্ধ্যা নেমেছে। কয়েকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোতলে মুখ দিয়ে পানি খাচ্ছে। কেউ কেউ হাতে বন রুটিও খাচ্ছে। কলাও আছে হাতে। এখানে নামাজের জন্য ব্যবস্থা করা থাকলে সে মাগরিবের নামাযটা পড়ে নিতে পারতো। একজন বলে উঠে,
” এইযে মেয়ে। নাম কি তোমার? পালিয়ে বিয়ে করেছো বুঝি? বর কোথায় তোমার? ”
আরেকজন বলে, ” বাপ মা বোধহয় কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলো তাইনা? তাই কৃষ্ণ পাগল হয়ে তোমাকে নিয়ে ভেগেছে। এমন রুপ যার পাগল তো হবেই। ”
পূরবী কি বলবে বোঝে উঠতে পারে না। চুপ করে লাগেজ হাতে নিয়ে নেমে পড়ে সে। হোটেলে ঢুকে একটা টেবিলে বসে। ওয়েইটার কে একটা লেমন জুস দিতে বলে।সাথে দুইটা কোক। দুদিনের না খাওয়া আর কান্নাকাটিতে অতিরিক্ত দূর্বল হয়ে পড়েছে সে। সকালে কয়েক টুকরো ফল পেটে পরেছিলো সেটা তখন ই শেষ। এখন কিছু খেলেই বাসে বমি করে ফেলে দিবে সাথে কেউ নেই যে একটু ধরবে। সে যদি অসুস্থ হয়ে যায় তখন কি হবে? এমনিতেই শরীরটা টেনে টেনে চলছে । বাসে ঘুমিয়ে একটু ভালো লাগছে।
আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সবাই তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নানান রকম মন্তব্য করছে। করবেই তো। সামনের টেবিলে বসা একজন মহিলা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। বয়স হবে হয়তো পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ। দেখতে দেখতে মহিলাটি উঠে এসে পূরবীর টেবিলে বসে। ওয়েটার লেমন জুস আর কোক দিয়ে যায়। মহিলাটি মুচকি হেসে বলে, ” বাহ চমৎকার বধূ। কি নাম গো তোমার? ”
” পূ… পূরবী। ”
” বাহ অনেক সুন্দর নাম। একা কেনো? কেউ সাথে নেই? ”
পূরবী মাথা নাড়িয়ে না করে। মহিলা জুসের দিকে ইশারা করে বলে, ” খাও। বাস ছেড়ে দিবে আবার। আমি তোমার পাশের সিটেই ছিলাম। ”
পূরবী গ্লাসে চুমুক দেয়। মহিলাটি জানায় সেও চট্টগ্রাম যাচ্ছে। চট্টগ্ৰামে পূরবীর থাকার জায়গা না থাকলে তার সাথে যেতে পারে। সে একটা মহিলা হোস্টেলের দায়িত্বে আছে। সেখানে ব্যবস্থা করে দিতে পারে। কাউন্টারে বিল দিতে গেলে মহিলাটিও বিল দিতে যায়। পূরবী বেনেটি ব্যাগ খুলে বান্ডিল থেকে টাকা নিয়ে মহিলাটির দিকে তাকাতেই মহিলাটি মিষ্টি হাসে।বলে, ” এসময় টাকা পয়সা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। টাকা না থাকলে নতুন সংসার শুরু করবে কিভাবে? “পূরবী লাগেজ নিয়ে বাসে চলে আসে। মহিলাটি এবার পূরবীর পাশে বসে। পুরো রাস্তা পূরবী মহিলাটির সাথে গল্প করে। তার ভাগ্যের এমন বর্ণনা শুনে মহিলাটি পূরবীকে শান্তনা দেয়। সাপোর্ট দিয়ে শক্ত হতে বলে। পুরোপুরি বিশস্ততা অর্জন করে নেয়। বাসট্যান্টে এসে মহিলাটির সাথেই নেমে যায়। রাস্তা ধরে মহিলাটির পিছু পিছু হাটতে থাকে। মহিলাটি বলে, ” পূরবী তুমি তো হাটতেই পারছো না। কষ্ট হচ্ছে মা? ”
” না আমি ঠিক আছি। ”
” আচ্ছা ব্যাগ গুলো আমাকে দিয়ে হাটো তাহলে কষ্ট কম হবে। ”
” না আন্টি আমি ঠিক আছি। ”
” আরে দাও। ছোট মানুষ তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। ”
মহিলাটি পূরবীর লাগেজ হাতে নেয়। তারপর বেনেটি ব্যাগের দিকে হাত দেয়। পূরবী আটকে দিয়ে বলে, ” আন্টি এইটা থাক আমার কাছে। আমি নিতে পারবো। ”
” ভারের জন্য তো তুমি হাটতেই পাচ্ছ না। একগাটি গহনার ভারে তো নুইয়ে পড়ছো মা। এগুলো খুলে ব্যাগে রাখো। তারপর ভার কমে গেলে হাটতে পারবে।
” এগুলো তেমন ভারী লাগছে না আন্টি। আমি পারবো। ”
” আরে মেয়ে তোমার ভালোর জন্যই তো বলছি। দাও ব্যাগটা দাও আমাকে। ”
“কিগো খালা আসছো তাহলে। ” দুটো লোক এসে জিজ্ঞাসা করে। সোডিয়ামের আলোয় তাদের দেখা যাচ্ছে। কালো শার্ট পড়া দুজন লোক। কেমন যেনো ভয় ঢুকে বসে মনে। পূরবী বুঝতে পারে সে একটা বড় ফাঁদে পড়েছে । তাকে পালাতে হবে ।
” এরা কারা? ”
” আমার ভাগিনা দুজন। ভয় পাচ্ছো কেনো মা? ”
” ওদের চলে যেতে বলুন আন্টি। ”
” আহা আমি আছিতো ভয় কিসের ? ওরা খুব ভালো। এইযে সামনেই আমাদের সেই হোস্টেল। ”
” না উনাদের সাথে যাবো না। উনাদের চলে যেতে বলুন। ”
মহিলাটি ইশারায় লোক দুটোকে চলে যেতে বললে ওরা আগে আগে চলে যায়। এতোক্ষনে লাগেজ নিজের হাতে কব্জা করে নিয়েছে পূরবী। মহিলাটি আবার বলে , ” ব্যাগ দুটো আমার হাতে দাও মা। ” বলেই ব্যানেটি ব্যাগ নেওয়ার চেষ্ট করে। পূরবী না করলেও আরো শক্ত করে টানতে থাকে। উপায় না পেয়ে পূরবী মহিলার পায়ে শক্ত করে একটা পারা দেয়। পেনসিল হিলের চৌখা অংশ মহিলাটির পায়ে ঢুকে পড়ে । চিৎকার করে পা ধরে বসে পরে। পূরবী ব্যাগ লাগেজ নিয়ে প্রাণপণ দৌড়াতে থাকে। পেছনে কালো পড়া লোক দুটোকে দেখতে পায়। জীবন মরন ত্যাগ দিয়ে দূর্বল শরীরটা টেনে দৌড়াতে থাকে সে।
৭.
ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে হেটে যাচ্ছে পূরবী। কাধে ব্যাগ হাতে ব্যাগ আর জুতা গা ভর্তি গহনা বেনারসী। নিজেকে নিয়েই নিজের বিরক্তি ধরে গেছে। ইচ্ছে করছে সব কিছু ফেলে চোখ বুজে থাকতে। রাত ঠিক কয়টা বাজে জানা নেই। হবে দশটা-এগারটা নাগাদ । মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। বাকি সব শুনশান । হিমেল হাওয়া বইছে শো শো করে। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। লাগেজের উপর ব্যাগটা রেখে রেলিং ধরে দাঁড়ায় পূরবী। শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দেয়। চোখের জল শুকিয়ে গেছে। এখন আর ধরা দিচ্ছে না। একা হয়ে গেছে পূরবী। একদম একা। লাইট গুলোর জন্য চারিদিক দেখা যাচ্ছে। এদিকটা কেউ নেই। আকাশ মেঘলা। মনে হয় বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি মাথায় কোথায় যাবে সে? মনে মনে আল্লাহ কে ডাকতে থাকে।
দু একটা লোক এ রাস্তায় হেটে যাচ্ছে। একটা লোক পূরবীর কাছে এসে বলে, ” ঐ যাবি? ”
পূরবী চমকে উঠে। কোথায় যাবে সে? তাকে তো এই লোক চিনেই না। ঐ মহিলার লোকগুলো নয়তো? না। ঐ লোকগুলো লম্বা ছিলো। এই লোকটা মিডিয়াম লম্বা। মুখটা খেয়াল করেনি পূরবি। মাথা নাড়িয়ে না বলে। লোকটা কিছু না বলেই চলে যায়। আবার একাকী দাঁড়িয়ে থাকে সে। কিছুক্ষন পর একটা লোক পেছন থেকে ডেকে উঠে ,
” ঐ ছেমড়ি এদিক আয়। রেট কতো নিবি? ”
চমকে উঠে পেছনে তাকায় পূরবী। মধ্যবয়স্ক একটা লোক হাতে মদের বোতল। হেলতে দুলতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। রেট মানে? তাকে কি খারাপ মেয়ে ভাবছে লোকটা? দাম দিয়ে কিনে নিবে? আশুর কথা মনে হয় পূরবীর। লোকটাকে যেনো ঠিক আশুর মতো লাগছে। পিছোতে পিছোতে ব্যাগের কাছে যায়। শক্ত করে মুঠি করে ধরে রাখে। গা ঘোলাতে থাকে পূরবীর। লোকটা কাছে এসে বলে, ” কিরে পরী চল। তোরে ভাল্লাগছে। পাচশ দিমু পাচশ। ”
” যাবোনা আমি। চলে যা তুই। সর দূরে সর বলছি। ” জোর গলায় বলে পূরবী। লোকটা কিছুক্ষন মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলে,
” যাবিনা? না গেলি। নিলাম না তোকে। হা হা হা..তুই যাবিনা আমি নিলাম না। ” পাগলের মতো হাসতে হাসতে চলে যায় লোকটি। লোকটি যখন তাকিয়ে ছিলো ভয়ে বার বার ঢুক গিলছিলো পূরবী। এবার যেনো নিঃশ্বাস নিতে পারছে সে। ফ্লাইওভারে যে রাতে এসব টুকটাক ব্যবসা চলে সে গল্প শুনেছে পূরবী। আজ সে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছে ব্যপারটা কতটা ভয়ানক। তাকে সবাই ঐরকম মেয়ে ভাবছে। সারারাত কি একের পর এক লোক আসবে? ক জনকে আটকাবে সে? কোথায় বা যাবে? হোটেল মোটেল কোন দিকে কিছুই জানেনা চিনেনা। রাতের বেলা নতুন শহর। তার উপর কোমড়টা যেনো ভেঙে যাচ্ছে। পেটে ক্ষুধায় চু চু করছে। খালি পায়ে হেঁটে কঙ্কর দিয়ে ব্যথাও পেয়েছে। শরীর অস্থির করছে পূরবীর। আর ভাবতে পারছেনা সে । কতোক্ষন নিজেকে পবিত্র রাখতে পারবে? সামনে হুট করে একটা সাদা গাড়ি এসে থামে। গ্লাস নামিয়ে পঞ্চাশ বছর বয়সী একটা লোক মাথা বের করে। পূরবীকে দেখে নিয়ে বলে,
” ঐ আয় গাড়িতে উঠ। ”
পূরবী বুঝে গেছে এই লোক তাদের দলের ই একজন। মাথা নাড়িয়ে না করে পূরবী। লোকটা আবার শীষ বাজায়। পূরবি একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। দু মিনিট যায় গাড়িটা দাড়িয়েই থাকে। পরক্ষনেই পূরবী দেখে লোকটা গাড়ি থেকে নেমে তার কাছে এসে দাঁড়ায়। শীষ বাজিয়ে বলে, ” দুই হাজার দিবো চল। আয়। ”
” না। ”
” পাচশ বাড়িয়ে দিলাম এবার চল। ”
” না। ”
” না? যাবি না? ব্যাশ্যা হয়ে পাওয়ার দেখাস? বউ সেজে বসে আছোছ। ঘরের বউ হবার শখ জাগছেনি? চল চল আড়াই দিমু। দেরি করিস না। পুলিশ টহল দিতে পারে। ”
” যাবো না আমি। দূরে সরেন আমার থেকে। ”
” বাহবা সতী সাবিত্রী পনা কোথা থেকে শিখলি? আয় চল। ”
” না। যাবো না। আমি ভালো মেয়ে। ”
” আমি তোকে আরো ভালো করে দিবো। চল। ”
বলেই পূরবির হাত ধরে। পূরবী ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলে,
” ছাড়েন। গায়ে হাত দিবেন না একদম । ছাড়েন। ”
লোকটা ছাড়ে না বরং আরেক হাত ধরে। পূরবী জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে যায় । লোকটা রাগ দেখিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে পূরবী। হাটু মুড়ে বসে পরে। এতোক্ষনের আটকে রাখা চোখের জল এবার বাধ ভাঙছে। নানান কথা মাথায় আসছে পূরবীর। এরা গেছে পরের গুলো যাবে এর সিউরিটি কে দিবে? একটার পর একটা আসতেই থাকবে। নিজের ইজ্জত বিলিয়ে দেবার থেকে মরা অনেক ভালো। কাঁদতে কাঁদতে হুট করে উঠে দাঁড়ায়। দু হাতে চোখ মুছে নেয়। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে শাড়ি উঁচিয়ে ধরে রেলিং এর উপরে উঠে দাঁড়ায়।চোখ দুটো বন্ধ করে লাফ দেয়।
চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা