#বিবর্ণ_বসন্ত (পর্ব ৪) [ রি-পোস্ট ]
নুসরাত জাহান লিজা
আট.
অদ্ভুত সুন্দর আলোকের ঝর্ণাধারায় অবগাহনে মেতেছে যেন দুজন! এতটা বুঁদ হয়ে আছে ওরা যে ভুলেই গেছে এখানে বসার কারণ। আবিদই প্রথম মুখ খুলে,
“তোমার বন্ধু কোথায় ? ওকে দেখছি না যে?”
ঘোর থেকে বেরিয়ে অন্বেষা বলল,
“খাবার পর দেখলাম গার্লফ্রেন্ড ফোন দিয়েছে, কথা বলতে বলতে ঘুমাতে গেল।”
“তুমি শুধু বাসায়ই কথা বললে যে, তোমার বিশেষ কেউ নেই? ”
“প্রশ্নটা ব্যক্তিগত হয়ে গেলো না? ”
“আমার যতদূর মনে হচ্ছে, একটু পরে আমাকে ব্যক্তিগত প্রশ্নের মুখোমুখিই হতে হবে! তাই কিছুটা শোধ বোধের চেষ্টা। ”
“নাহ্! বিশেষ কেউ নেই।” হেসে উত্তর দিল অন্বেষা।
“সে কী! এরকম অস্থির জেনারেশনের হয়েও বয়ফ্রেন্ড নেই এটা ঠিক হজম হচ্ছে না! ” অবিশ্বাসের সুর আবিদের গলায়।
“কেন? এই জেনারেশনের কী সমস্যা? আর বয়ফ্রেন্ড না থাকা দোষের কিছু নয় নিশ্চয়ই। নাকি এই প্রজন্ম থেকে নির্বাসনে যেতে হবে?” কিছুটা বিরক্তি নিয়ে অন্বেষা বলল।
“না, তা নেই। তুমি রেগে যাচ্ছো কেন? কিছু ইতিবাচকতাও আছে অবশ্য। তবে তোমাদের এই প্রজন্মটা বড্ড বেশিই এলোমেলো। কারও কোনো স্থিরতা নেই। কেমন যেন! কী করবে আর কী করবে না সেটাই বুঝে উঠতে শেখেনি। শুধু সামনে যাবার তাড়া।” আবিদের গলাটা রূঢ় শোনালো!
“সামনে ছুটে চলায় খারাপের কিছু তো নেই। আর প্রত্যেক প্রজন্মের কাছেই তার নিজের প্রজন্মই সেরা হবে। আমি নিশ্চিত, আপনি যখন আমার বয়সী ছিলেন, তখন অগ্রজের কাছ থেকে আপনার বলা কথাটাই শুনে এসেছেন যে আগেই ভালো ছিলাম, তোমাদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আবার আমিও হয়তো কয়েক বছর পর আমার পরবর্তী প্রজন্মকে এই কথাগুলোই বলব।”
ঝাঁঝালো গলায় একদমে কথাগুলো বলে থামল অন্বেষা।
আবিদ মুগ্ধ গলায় বলল, “ভালো বলেছ তো। তোমাদের জেনারেশনের কনফিডেন্সটা আমার ভালো লাগে খুব। এই যে হুট করে আমার পিছু নিয়ে চলে এলে, আমরা হলে হয়তো এতটা সাহসী হতে পারতাম না।”
প্রসঙ্গ বদলালো অন্বেষা, “আপনি জানতে চেয়েছিলেন বয়ফ্রেন্ড নেই কেন, আসলে ছিল একজন, ভার্সিটি লাইফের শুরুতে। রিলেশনশীপটা ওয়ার্ক করেনি। প্রথম দিকে ভালো চললেও মানিয়ে নিতে পারিনি দুজনেই। কিছুদিন পরেই যে যার আলাদা পথ বেছে নেই। পরে আর ইচ্ছে হয়নি কেন জানি! সাড়া পাইনি মন থেকে।”
“হুম, এটাও এই জেনারেশনের একটা সমস্যা, সবকিছুতেই বড্ড তাড়াহুড়া, সামনে কী আছে বা পরিনতি কী হবে সেসব ভাবনা কম আসে মাথায়। ভালো লাগলো সম্পর্কে জড়ালাম, ভালো লাগছে না তো ব্রেক-আপ!”
“কেন, আপনাদের সময় ব্রেকআপ হয়নি কারো?” গলায় স্পষ্ট রাগের আভাস।
“হয়েছে, তবে এখন সেটার মাত্রাটা বেড়ে গেছে!”
“সবশেষে তালগাছ আপনারই, তাইতো?”
অণ্বেষার বলার ধরনে হেসে ফেলল আবিদ, “আমরা কি প্রসঙ্গে ফিরতে পারি? রাত বাড়ছে! ”
অন্বেষাও হালকা আলাপ থেকে বেরিয়ে মুহূর্তেই নিজেকে আবৃত করে নিল তুখোড় সাংবাদিকের খোলসে।
“আপনাকে নিয়ে লোকের কৌতুহলের শেষ নেই! এই যে এতগুলো বছরে এতটা নাম, খ্যাতি, যাদের জন্য লিখেন তাদের জন্যও নিজেকে কখনো সামনে আনেননি, শুধু কিছু সেমিনারে মোটিভেশানাল স্পিচ দেয়া ছাড়া। নিজেকে এতটা রহস্যে মোড়ে রেখেছেন কেন?”
আবিদ অতি সন্তর্পণে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে অত্যন্ত নীরস গলায় বলল,
“আমার উপর স্পটলাইট থাকুক এটা আমার ঠিক পছন্দ নয়। তুমি আমাকে নিয়ে যেই বিশেষণগুলো যোগ করলে, রহস্যাবৃত আরও কী কী, আমি এরকম কিছুই নই, অতি সাধারণ এক নিভৃতচারী মানুষ।”
ভেতরে ভেতরে চটে গেলেও পরের প্রশ্নে চলে গেল, “আমি যতদূর জানি, আপনি ফটোগ্রাফি করতেন, আপনার তোলা সেসব ফটো বিশ্বের বড় বড় কিছু ম্যাগাজিনেও আছে। সেগুলো দেখলেই আন্দাজ করা যায় আপনি কতটা প্যাশনেট ছিলেন! যখন মাত্রই ক্যারিয়ার এগুতে শুরু করেছিলো, তখন সব ছেড়ে ছুড়ে চলে এসেছিলেন কেন?”
“এক জিনিসে বেশিদিন আগ্রহ পাইনা তাই। হঠাৎ লেখালেখিতে আগ্রহী হলাম, আর দেশে চলে এলাম।”
“মিথ্যা কথা বলছেন আপনি। এটা কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা হতে পারে না। লেখালেখির জন্য ফিরলে মাঝে লম্বা সময় আপনি কোথায় ছিলেন? ফিরে এসে প্রায় চার বছরের বিরতি দিয়ে তারপরে বেরিয়েছে আপনার প্রথম বই।”
“তোমার নামের মতই তোমার মধ্যে অন্বেষণে মত্ত থাকার একটা ব্যাপার আছে। একেবারে পারফেক্ট নাম তোমার, অন্বেষা! ” তিক্ততা ঝরল কণ্ঠে।
“প্লিজ, সত্যিটা বলুন না! ” কিছুটা অনুনয় ফুটল।
“প্রত্যেক মানুষের কিছু না কিছু দূর্বল জায়গা থাকে, তুমি যেটা জিজ্ঞেস করছো সেটা আমার গভীরতম আবেগ আর অনুভূতির জায়গা। সেটা সামনে এলে লোকে ভাববে এটা আমার স্ট্যান্ডবাজি, হয়তো লোকের সিম্প্যাথি পাবার জন্য এসব গালগল্প করেছি! সেটা আমি সহ্য করতে পারব না। ” বিষাদ ঢালা স্বরে বলল আবিদ।
“এই যে রেকর্ডার বন্ধ করলাম, আমাকে বলুন না, আমি কথা দিচ্ছি আপনি না চাইলে আমি ফিচার করবো না। প্লিজ!” রেকর্ডার বন্ধ করতে করতে বলল অন্বেষা।
তাচ্ছিল্যের সুরে আবিদ বলল, “তোমরা মনগড়া খবর লিখতে পারো, আর এই ঘটনা এড়িয়ে যাবে! এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়!”
“আপনিও তো চুপ করেই ছিলেন সেসময়। তাদেরকে সেই সুযোগেটা আপনিই করে দিয়েছিলেন। যদি স্টেপ নিতেন সেসবের বিরুদ্ধে তবে ওটা হতো না।”
কিছুটা সময় গড়ালো সুনসান নীরবতায়, রাত বেড়ে চলছে। এত প্রগাঢ় জোছনা খুব বেশি দেখেনি অন্বেষা। একই সাথে স্পষ্ট আবার কিছুটা অস্পষ্ট, ঘোলাটে! এই অদ্ভুত আলো আঁধারীতে আবিদের মুখটা দেখছে ও। কী এক গভীর বিষাদে ছেয়ে আছে চেহারাটা! কেন যেন মায়া অনুভব করল, গভীর মায়া।
কী লুকোনো আছে ভেতরটায় জানতে তীব্র কৌতূহল বোধ করলো।
অবশেষে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ, মুহুর্তকাল নীরব থেকে ক্ষীণ অথচ দৃঢ় গলায় আবিদের ঘোষণা,
“আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি, অন্বেষা। শুনেছিলাম শেয়ার করলে নাকি বোঝা কমে যায়। আমার তো সেরকম কেউ নেই বলবার! কাউকে না কাউকে তো বিশ্বাস করতেই হয়, তোমাকেই করলাম নাহয়! কেন যেন মনে হচ্ছে তোমাকে বিশ্বাস করাই যায়।”
“আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করি বিশ্বাস রাখার।” অভয় দিল অন্বেষা।
আবিদ খুলে দিল ওর হৃদয়ের বন্ধ প্রকোষ্ঠ, প্রকাশ করতে চলল চেপে রাখা সত্যটা। যা এতদিন সযত্নে সংরক্ষিত ছিল ওর একেবারেই হৃদয়ের গহীন অরন্যে!
নয়.
তারুণ্য দীপ্ত, প্রাণোচ্ছল আবিদ তখন সদ্য পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য চেষ্টারত, সাথে শখের ফটোগ্রাফি। সারা দেশ প্রায় চষে বেড়িয়েছে, দৃষ্টিনন্দন কিছু ক্যামেরায় ধারণ করতে। ও বুঝতে পেরেছে ন’টা পাঁচটা চাকরিতে ওর পোষাবে না, যেখানে মনের খোরাক যোগাবে না সেটা ওকে দিয়ে হবে না। প্রথাগত জিনিসে যেন বরাবরই বড্ড অনীহা চির দুর্বিনীত এই তরুণের! ফটোগ্রাফার হিসেবেই নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চায় ও। কিন্তু সেসময় এটা প্রফেশনাল পর্যায়ে যায়নি সেভাবে, কিংবা গেলেও সুযোগ সীমিতই ছিল। তাই দেশের বাইরেও চেষ্টা করছিল।
সারা দেশ ঘুরতে ঘুরতে বরাবরের মতোই মনোরম আর নির্জন একটা পাড়াগাঁয়ে খুঁটি গেড়ে বসে কিছুদিনের জন্য। তখন কে জানতো এটাই ঘুরিয়ে দেবে ওর জীবনের মোড়!
গ্রামের মোহময় সৌন্দর্য উপভোগ করছিল আর ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করে নামছিল ক্যামেরার শাটার। সহসা আশেপাশে কোনো জায়গা থেকে উৎসারিত মিলিত কণ্ঠের উল্লাস ধ্বনি বেজে উঠলো কানে, উৎস খুঁজে সেদিকে পা বাড়ালো। আর তারপরই দেখা পেল এক অদ্ভুত সুন্দরের!
কয়েকজন বারো তেরো বছরের বাচ্চা যেন মেতেছে ঘুড়ি উড্ডয়ন উৎসবে। সেখানকার মধ্যমনি ছিল সতেরো আঠারো বছরের একজন মেয়ে। মেয়েটার চোখেমুখে যেন খেলা করছিলো প্রাণের স্পন্দন, এতটা উচ্ছ্বসিত, উদ্ভাসিত মুখ কখনো দেখেনি আবিদ। মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে ছিল সে। চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না কোনোভাবেই।
“লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট” কথাটা ওর কাছে সবসময় ফালতু কনসেপ্ট মনে হয়েছে, কারো সম্পর্কে না জেনে ভালোবাসা হয় নাকি! কিন্তু এত উচ্ছল, প্রাণবন্ত একজন ভালো মানুষ না হয়ে যায়ই না! ভালোলাগায় ছেয়ে গেলো মন। কারো অনুমতি ছাড়া ছবি তোলা যে শিষ্টাচার বহির্ভূত, এই সত্যটাও মাথায় নেই ওর। ঘুড়িতে মগ্ন উচ্ছ্বসিত ওই মেয়ের মধ্যে তখন সম্মোহনী শক্তি। ওকে কী এক অমোঘ আকর্ষণে হাতছানি দিচ্ছে যেন! একের পর এক ফ্রেমবন্দী করে চলছে অপূর্ব সৌন্দর্যের প্রতীককে। ওর মনে হচ্ছিলো এই সৌন্দর্যের জন্ম অন্য কোনো ভুবনে, এই পৃথিবীতে হতেই পারে না! ভালোবাসা হয়তো জন্মায়নি, তবে তীব্র ভালোলাগা ছুঁয়েছিল।
মেয়েটা আচমকা ওর দিকে তাকাতেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল সেই অতল চোখে। মেয়েটি এগিয়ে এসে প্রশ্ন করেছিল,
“আপনি কে? আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না? এভাবে ছবি কেন তুলতেছেন?”
বন্ধুদের আড্ডা মাতানো বাকপটু আবিদ যেন ভাষা বিস্মৃত হয়েছে। কোনো শব্দ ওর মাথায় আসছিল না, একদমই না।
চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে মেয়েটি বলে উঠল,
“কি সমস্যা আপনার, কথা বলতে পারেন না নাকি?”
আবিদ মোহ ভেঙে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলে,
“আপনি কি এই পৃথিবীরই, নাকি অন্য কোন গ্যালাক্সির কেউ!” চোখে তখনও ঘোরলাগা দৃষ্টি।
শ্যামলা রঙের মায়াময় মুখাবয়বের মেয়েটিকে তার অভিব্যক্তির জন্যই অনন্য লাগছিল।
অসন্তোষ খেলে গিয়েছিল ওর চোখে মুখে,
“ফাজলামো করেন? ছবি কেন তুলেছেন সেটার উত্তর দেন? অনুমতি নিছেন আমার?” কড়া গলায় বলে ও।
চোখের দৃষ্টিতে যেন অগ্নি গোলক নিক্ষিপ্ত হচ্ছে ওর দিকে, যে আগুনে ভস্ম হয়ে যাবে আবিদ। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে আবিদ বলে,
“আসলে আমি ফটোগ্রাফার, এখানে কিছুদিন আছি। ছবি তোলার জন্য ঘুরছিলাম, হঠাৎ আপনাকে আর বাচ্চাদের ঘুড়ি উড়াতে দেখলাম, কম্পোজিশনটা দারুণ ছিল, অনুমতি নিতে গেলে ন্যাচারাল জিনিসটা হারাতো। তাই এভাবেই….”
জীবনে কখনো এতটা অপ্রতিভ হয়নি ও।
“তাই এভাবেই ছবি তুলে ফেলবেন? সামান্য কার্টেসি দেখাবেন না? যত্তসব! দেখি, ক্যামেরাটা দিনতো?” স্পষ্ট ঝাঁঝ।
জীবনে কিছু ঠিক কাজের মধ্যে এটা একটা মনে হচ্ছিল ওর। কিন্তু মুখে বলার সাহস পেল না। যা রেগে আছে, যদি ভেঙে ফেলে ক্যামেরা!
“দেখুন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আমি শুধুই ভালোলাগা থেকে তুলেছি ছবিগুলো। আমার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই, বিশ্বাস করুন।” কাতর গলায় বলল আবিদ।
সন্দিগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর আবিদকে বিশ্বাস করাই স্থির করল মেয়েটি।
“আমার নাম অতসী। এখানকার চেয়ারম্যান আমার বাবা। উল্টাপাল্টা উদ্দেশ্য থাকলে ভুলে যান সেটা। নতুন এসেছেন এই এলাকায় তাই এবারের মতো মাফ করলাম, পরেরবার কিন্তু আর কোনো ভুল করবেন না, পরিণতি ভালো হবে না, না আপনার আর না আমার।”
কথা শেষ করেই হনহনিয়ে চলে গেলো অতসী, পেছনে রেখে গেলো এক মোহাবিষ্ট তরুণকে।
……….
(ক্রমশ)