বাসন্তী
পর্ব- ৩৭
#লেখা-লিমু

-” রাগে কলির মাথাটা গিজগিজ করছে সকাল থেকে। কারন পুষ্পর বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়ে গেছে,এবং বিয়ের কেনাকাটা করতেই ঐ ডিকবাল(ইকবাল কে ডিকবাল নাম দিয়েছে কলি) এর সাথে ঢাকা গিয়েছে শপিং করতে। কলিকেও সাথে নিয়ে যায় নি। কলির কেন যেন এই লোককে সুবিধার মনে হচ্ছে না। কেমন যেন একরোখা স্বভাবের,নিজে যেটা বলবে সেটাই। ভুল হলেও, সেটাই সঠিক।
হঠাৎ কলির ফোনটা বেজে উঠলো।
-” হ্যা বলুন।”
-” ওপাশ থেকে,কি অবস্থা এখন? কোন আপডেট?”
-” খুব বাজে আপডেট। কলি করুণ স্বরে বললো।”
-” কি হয়েছে বলো। ”
-” বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়ে গেছে।”
-” হোয়াট!”
-” হুম,এ মাসেই। ১২ ফেব্রয়ারি। ”
-” আর ইউ ম্যাড?”
-” আমি না, আমার বু ম্যাড। আমি নিশ্চিত, ও পাগল হয়ে গেছে। ও কি করছে না করছে, কিছু জানেনা। একদম অস্বাভাবিক আচরণ করছে। তবে আমি নিশ্চিত ও নিজের সাথে রাগ দেখিয়ে, এমন একটা ডিশিসান নিয়েছে হুট করে। আর কিছুটা আমার সাথে জিদ করে,যেন আমি কোনকিছু না বলতে পারি অতীত নিয়ে। কিন্তু গাধীটা এটা বুঝতে পারছেনা,নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছে। রাগের মধ্যে নেয়া কোন ডিশিসান কখনোই ভালো কোন ফল বয়ে আনতে পারেনা। এ বিষয়গুলো ও নিজে আমাকে বুঝিয়েছে,আর এখন ওর কি হলো। এমনতো ছিলো না ও। ওর কথা ভেবে কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ও কেন বুঝতে পারছেনা , ওর জীবনটা ও নিজের হাতে ধরে নষ্ট করে দিচ্ছে।

-” এখন আমাদের কি করণীয়?

-” আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা,আপনি কোন একটা উপায় বের করুন। আমার মাথা সত্যি কাজ করছেনা। ঐ গাধী ঐ ডিকবালকে নিয়ে… কলি কথাটা শেষ করতে পারলনা ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে গেল। কলি হ্যালো হ্যালো করতে লাগলো, কিন্তু ওপাশ থেকে সাড়া না পেয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখে কেটে গেছে। যাহ…কেটে দিলো কেন হুট করে!
-” সবার মাথায়ই প্রবলেম হয়ে গেছে,সব কটাকে পাবনা পাঠিয়ে দেয়া দরকার। ভালো লাগেনা আর আমার। আবার ফোন দিলো কলি,কিন্তু ফোন রিসিভ হচ্ছে না। রাগে ফোনটাকে বিছানায় আছাড় মারলো কলি। প্রয়োজনের সময় সবাই বিজি থাকে,এটাই সত্য। মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো কলি। কোনকিছু ভেবে কোন কূলকিনারা করতে পারছেনা সে।

রিকশায় বসে হঠাৎ নাফিসের মনে হলো ফোন মার্কেটের ভেতর ফেলে এসেছে। পুষ্পকে রিকশায় বসতে বলে চলে গেল। রিকশা একসাইডে রেখে পুষ্প নেমে দাঁড়ালো একটু।
আচমকা পেছন থেকে পুষ্পর হাত টেনে ধরলো কেউ। পুষ্প কিছু বলার আগেই গাড়িতে তুলে নিলো ওকে। কিন্তু কে, সেটা চিনতে পারছেনা পুষ্প। কারন মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা,আর মাথা হুডির ক্যাপ দিয়ে ঢাকা। চোখেও কালো সানগ্লাস পরা। সবমিলিয়ে অদ্ভুত লাগছে লোকটাকে। পুষ্প চিৎকার করতে চাইলে মুখ চেপে ধরে সে। ভয়ে পুষ্প একেবারে চুপসে যায়। লোকটা পুষ্পকে আঙুলের ইশারায় চুপ থাকতে বলে,না হলে বিপদ আছে এমনটা বুঝায়। পুষ্প ভয়ে আর টেনশনে সম্পূর্ণ জমে গেল। কোন কথা বলা তো দূরে থাক,নড়াচড়াও পর্যন্ত করছেনা। লোকটা হাই স্পিডে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে একটু খক খক করে কাশছে। পুষ্প রাগে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইলো,আর আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলো।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর,পুষ্প নিজেকে নিজে একটু সাহস যোগালো। চোখমুখ শক্ত করে বললো,

—” কে আপনি? কি চাই আপনার? দেখে তো ভদ্র ঘরের সন্তানই মনে হয়,তাহলে আচরণ এমন অসভ্য কেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে,বলুন…
পুষ্প মোটামুটি চিৎকার করেই কথাটা বললো।সাথে সাথেই গাড়ির ব্রেক কষলো লোকটা। আর পুষ্পকে টেনে গাড়ি থেকে নামালো। একটা খোলা জায়গায় নিয়ে দাঁড় করালো পুষ্পকে। পুষ্পকে পেছনে রেখে লোকটা একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো। পুষ্প যখন মনে মনে পালানোর ফন্দি আটছিলো,যে দৌড় দিবে। ঠিক সেই মুহুর্তেই কেউ বলে উঠলো,

-” পালানো টা তো তোমার স্বভাব হয়ে গেছে তাই না? ”

-” কন্ঠস্বরটা পুষ্পর কান ভেদ করে অন্তরাত্বায় গিয়ে ধাক্কা লাগলো। পুষ্পর শরীর কাঁপছে অনবরত। কাঁপতে কাঁপতেই পুষ্প এক পা দু পা করে এগুতো লাগলো। এতটুতু দূরত্ব,তবুও যেন পা ফেলে যেতে অসীম সময় লাগছে।

-” এমন স্বভাব হয়েছে যে,এখন একেবারেই পালিয়ে গেছো। এটা কেমন স্বভাব তোমার? ”

-” পুষ্প কাছে গিয়ে লোকটার কাঁধে হাত রাখবে,তার আগেই সে ঘুরে দাঁড়ালো। পুষ্প পিছনে সরতে গিয়ে শাড়িতে পা লেগে পড়ে যেতে নিলো। খপ করে পুষ্পর হাতটা ধরে সেই চিরচেনা কন্ঠ বলে উঠলো,

-” কেমন আছে আমার বাসন্তী, তার প্রণয়বাঁধন থেকে মুক্তি পেয়ে?
-” পুষ্প কোন কথা বলতে পারছেনা,ওর ঠোঁট কাঁপছে তরতর করে। অনেক কষ্টে শুধু একটা শব্দ বললো,
-” তুমি!”
-” খুব বেশিই শকড খেয়ে গেছো মনে হচ্ছে। পৃথিবীটা গোল,আমরা না চাইলেও আমাদের দেখা হতেই পারে। এতে এত বেশি অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর তোমার সাথে তো দেখা হওয়ার কথায় ছিলো,হিসেব বাকী আছে না পুরোনো। পুরোনো হিসেব না চুকিয়ে, নতুন হিসেব খোলা যায় না, এটা জানোনা বোধহয়।
-” প্রণয়ের কথা শুনে আর চোখমুখ দেখে পুষ্পর ভয়ে আত্না কাঁপছে। সেই তিন বছর আগের প্রণয় আর এখনের প্রণয়ের মাঝে অনেক পার্থক্য। চেহারা কেমন জানি বিবর্ণ হয়ে গেছে। চোখদুটো টকটকা লাল,অসুস্থ মনে হচ্ছে। হঠাৎ পুষ্পর ভীষণ মায়া হতে লাগলো প্রণয়কে দেখে।মনের অজান্তেই প্রশ্ন করে বসলো,

-” চেহারার কি হাল করেছো?

-” এটা শুনে প্রণয় একটা বিদ্রুপের হাসি হাসলো। তারপর বুকে আঙুল দেখিয়ে বললো,

—” চেহারার হাল দেখে তোমার খারাপ লাগছে? তাহলে এ বুকটা চিরে যদি দেখাতে পারতাম,তাহলে তোমার দেওয়া ব্যাথা নিয়ে প্রতিনিয়ত বেঁচে থেকেও মরছি,সেটা সহ্য করতে পারতে তো?
-” টুপ করে একফোটা মুক্তোদানার মতো জল গড়িয়ে পড়লো পুষ্পর চোখ বেয়ে। সেই জল মাটিতে পরতে দিলো না প্রণয়। আঙুল দিয়ে মুছে বললো,
-” আমি বলেছিলাম তোমার চোখে আর কোনদিন জল আসতে দিবো না। কিন্তু দেখো আজ তুমিই আমার চোখে জল উপহার দিয়ে নতুন জীবন শুরু করে ফেলেছো। আচ্ছা আমার ভুলটা কি ছিলো, সেটা তো বলতে পারতে অন্তত।
ফাঁসির আসামীকেও তো তার দোষ প্রমাণ করে, তারপর ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো হয়। আমাকে তো তুমি জীবন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলে,তাও অপরাধ না জানিয়ে।
এটা কি তোমাকে ভালোবাসার পুরষ্কার?

-” পুষ্প নিশ্চুপ।

-” কিছুতো বলো। তোমার উপর তো আমার আর কোন অধিকারও রইলোনা। তাই তোমার উপর জোরও কাটাতে পারবোনা আর। তোমার বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই,তুমি ভালো থাকলে,সুখে থাকলেই আমি দূর থেকে হাসবো। শুধু আমার অপরাধটা বলে চলে যাও।
আমি আর কোন প্রশ্ন করবোনা তোমাকে। কোনদিনও তোমাকে বিরক্ত করতে যাবোনা।
-” পুষ্প কাঁদতে কাঁদতে বললো, যা জিজ্ঞেস করার আপনার ডাক্তার কাজিনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন,সব উত্তর পেয়ে যাবেন। এটা বলে পুষ্প একসেকেন্ডও সেখানে দাঁড়ালো না। আর প্রণয় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ডাক্তার কাজিন মানে মেহের,কিন্তু ওকে কি জিজ্ঞেস করবে? আর কেনইবা করবে,ও আবার কি করেছে। প্রণয়ের মাথা চরকির মতো ঘুরতে লাগলো। পুষ্পর কথার মানে কিছুই বুঝতে পারলনা।
সাথে সাথে গাড়ি নিয়ে ওদের বাসার দিকে চললো। পুষ্প সিএনজি নিয়ে একাই নাফিসের বোনের বাসায় চলে গেল। ফোন হাতে নিয়ে দেখে নাফিস অনেকগুলো ফোন দিয়েছে। তাই কলব্যাক করে বললো যে, বাসায় চলে এসেছে। নাফিস ধমকে বললো,
-” তাহলে ফোন ধরছিলে না কেন?”
-” সাইলেন্ট ছিলো। ”
-” দিনের বেলায়ও ফোন সাইলেন্ট রাখতে হয় কেন? ”
-” সেটা আমার ইচ্ছে। আপনি এতো ধমকাচ্ছেন কেন? বলেছি তো বাসায় এসে গেছি,তাহলে এতো চিৎকার করার কি আছে। এখনি স্বামীগিরি দেখাতে আসবেন না,বিয়ে হয়নি এখনো। এটা বলে পুষ্প ফোনটা কেটে আছাড় মারলো ফ্লোরে। চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে ওর। কেন যখনি নিজেকে ঠিক করতে চায়,তখনি আরো বেশি বিগড়ে যায় সব। কেন সামনে এলো সে,আমিতো বেশ আছি। সেও তার মতো নিজেকে গুছিয়ে কেন নিচ্ছেনা। জরুরি নয়,সবাই সবার ভালোবাসে পাবে। কিছু ভালোবাসা অপূর্ণই থাকে। হয়তো এটাই নিয়তি।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here