“কি সৌভাগ্য আমার যে আজ দু দু’টো চাঁদের দেখা পেলাম। জীবনে এমন চাঁদ রাত পাবো কখনো ভাবিনি।”
তুষার আলগোছে কখন এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। ঘোমটা তুলে তাকাতেই তার চোখের তারায় জ্বলজ্বল করা খুশির ছটা দৃষ্টি গোচর হলো। সংকোচ আমায় ঘিরে ধরলো, কিঞ্চিৎ ভয়ও লাগছে। ভাবছি তুষার কি এবার স্বামী অধিকার ফলাবে? এতো তাড়াহুড়ো চাইনা আমি। আমি চাই যখন ও আমার কাছে আসবে তখন যেন আমার মাঝে দ্বিধা না আসে। খুব ইচ্ছে দু’জনার চেনাজানা হোক ভালোভাবে তারপর একে অপরের মাঝে বিলীন হবো। তুষার আমায় বুঝবে কিনা জানি না। গতকাল ওর মধ্যে অস্থিরতা দেখেছি। বাকী পুরুষদের মতো ও হয়তো নিজের অধিকার আদায়ে তটস্থ হবে। আমার এলোমেলো ভাবনায় ভুলে গেছি কোথায় আছি। তুষার চুটকী মেরে আমায় ঘোর থেকে বের করলো-
“ম্যাডাম, সামনে জলজ্যান্ত একজন হ্যান্ডসাম হাল্ক দাঁড়িয়ে থাকার পরও কোন ভাবনায় বিভোর হলেন? আমাকে কি যথেষ্ট আকর্ষনীয় দেখাচ্ছে না? আমি কি আর একটু মেকওভার করে আসবো?”
আমি ঘোমটার আড়ালে থেকেও হেসে দিলাম, একেবারে প্রানখোলা হাসি যাকে বলে। মানুষটা এমন করে কথা বলে যে না হেসে পারা যায় না। আমি হাসি থামাতে পারছি না, চোখে পানি চলে এসেছে হাসতে হাসতে। সচেতনভাবে দু’চোখের কোল মুছে নিয়ে ঘোমটা তুলে তুষারকে দেখলাম। আসলেই তাকে অনেক হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে। তার উজ্জ্বল শ্যাম বর্নের চেহারা আজকে আরো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। আজ মনেহলো তুষারের চেহারায় একটা দুষ্ট বালক মার্কা ভাব আছে।
“ঈদের চাঁদ দেখেছেন?”
“হ্যা, এইতো দেখছি।”
আমার প্রশ্নে তুষারের তরিৎ জবাব। আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে বলি-
“আকাশের চাঁদ দেখেছেন?”
“ঘরে চাঁদ থাকতে কষ্ট করে আকাশে তাকাবো কেন?”
বুঝতে পারছি আমার লাজে রক্তিম মুখায়বর খুব উপভোগ করছে তুষার। আমি বারকয়েক কামড়ার এদিক সেদিক তাকালাম। কি বলবো কিছুই মাথায় আসছে না। আবার টুপ করে ঘোমটা টেনে নিলাম। ঘোমটার আড়ালেও টের পেলাম তুষার মিটিমিটি হাসছে। অনেকটা সময় আমার অবস্থা দেখে হয়তো তার মনে দয়া হলো। কাছে এগিয়ে এসে আমার পাশে বসলো। ঘোমটা সরিয়ে আমার মুখটা উঁচু করে। আমি সাথে সাথে চোখ বুজে ফেললাম। তুষার ফিসফিস করলো-
“এভাবে চোখ বুঁজে থাকলে তো আমি আজ নিজেকে সামলে রাখতে পারবোনা। কি করছেন বলুন তো?”
আমি সাথে সাথে চোখ খুলতেই তার চোখে চোখ পড়লো। তার ঘোর লাগা দৃষ্টির সামনে টিকতে না পেরে চোখ নামাই। তুষার বলে-
“কাপড় পাল্টে চট করে ওযু করে আসুন তো। দু’রাকাত নামাজ পড়ে আপনাকে নিয়ে ছাঁদে যাবো। আজ একসাথে দু’টো চাঁদ দেখবো আর চা খাবো।”
আমি যেন পালিয়ে বাঁচলাম। এই লোক কথার জালে মারবে আমায় এটা আমি বেশ বুঝতে পারছি।

তুষারদের বাড়ির ছাদটা সুন্দর। নানারকম ফুল আর ফলের গাছ আছে ছাদে। ছাউনি দেওয়া একটা দোলনাও রাখা। লাইটের হালকা আলোয় আমি মুগ্ধ চোখে সব দেখছিলাম। তুষার দোলনায় বসে ডাকলো আমাকে-
“এখানে আসুন।”
আমি এগিয়ে যেতেই নজরে এলো চায়ের পট আর দু’টো কাপ। তুষারের পাশে বসলাম। তুষার যত্ন নিয়ে চা ঢাললো কাপে। চায়ে চুমুক দিয়ে মন ভালো হয়ে গেলো আমার। এতো মজার চা খুব কমই খেয়েছি। চা নিয়ে আমার খুব ফ্যাসিনেশন আছে। খুব ছোট থেকেই আমি চা খাই। মা অনেকবার মানা করেছে। দুধ চা খেলে নাকি মানুষ কালো হয়ে যায় এই কারনে। এমন হয়েছে মায়ের ভয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে চা খেয়েছি তবুও বন্ধ করতে পারিনি চা পান। সেই আমি আজ স্বামীর সাথে বসে চা খাচ্ছি।
“চা টা বেশ মজা। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এতো তৃপ্তিদায়ক চা খাওয়ানোর জন্য।”
তুষার মাথা নেড়ে হাসি মুখে আমায় দেখলো বেশ খানিকটা সময়। তারপর পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট একটা বক্স বের করে হাতে নিলো। আমার ডান হাতটা তুলে নিলো নিজের হাতে। অনামিকায় পড়িয়ে দিলো একটা আংটি। আংটির মাথায় জ্বলজ্বল করা লাল পাথর জানান দিচ্ছে ওটা বিশেষ না হয়ে যায় না। আমি বিস্মিত হয়ে তুষারের দিকে তাকিয়ে কিছু বলবো তার আগেই সে বলে-
“সম্পর্কটা আরেকটু এগিয়ে নিতে একটা অনুমতি চাইছি। তুমি করে ডাকার অনুমতি। আসলে আপনি ডাকলে কেমন দূরের কেউ মনেহচ্ছে। কিন্তু আপনি তো আমার সবচেয়ে আপন মানুষ, তাই না?”
আমি অবাক হয়ে মাথা নাড়ি। এতো সুন্দর করে সবকথা বুঝিয়ে বলে তুষার যে অবাক না হয়ে পারা যায় না। সে গাঢ় স্বরে আমায় কথা বলতে শুরু করে-
“আংটিটার একটা বিশেষত্ব কি জানো? এটা রুপার তৈরি কিন্তু পাথরটা অরিজিনাল রুবি। এটা স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানিয়েছি শুধু তোমার জন্য। সাধারণ রুপার সাথে অসাধারণ রুবির কম্বিনেশন কেন করলাম জানো?”
তুষারের কথা যত শুনছি তত মুগ্ধ হচ্ছি। ওর কথাবার্তা আচরণ আমাকে মুগ্ধতার আবেশে মুড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত। আমি বোকা চাহুনি দিয়ে না বোধক মাথা নারি। সে হাসলো-
“রুপার বিশেষ গুন হলো যত দিন যায় এটার উজ্জ্বলতা কমে। কিন্তু যত্ন করে পরিস্কার করলে আবার পুরনো রুপে পাবে যেন একদম নতুন গয়না। আর রুবির উজ্জ্বলতা সারাজীবন একই রকম থাকবে। কোরআনে সুরা আর রহমানে রুবির কথা বলা আছে। রুবিকে নেয়ামত হিসেবে উল্লেখ করা আছে। তোমাকে আমি আমার জীবনের রুবি পাথর মনে করি। আমি নরমাল রুপা যার জীবনে তুমি দামি রুবি একদম পারফেক্ট কম্বিনেশন।”
তুষারের কথা শুনে আমি কেঁদে দিলাম। এই জীবনে এতো ভালোবাসা আর সন্মান পাবো কখনো কল্পনা করিনি। এখন হুট করে পেয়ে কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগছে। তুষার আমায় চোখের জল মুছে দিলো-
“আমার জীবন অতি সাধারণ ভাবে কেটেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর পুরো সংসারের দায় কাঁধে। তিনবোনকে মানুষ করা তাদের বিয়ে দেওয়া এসব করতে যেয়ে নিজের দিকে তাকানো হয়নি। অনেক কিছু করা হয়নি জীবনে। কোনো ইচ্ছে বা আকাঙ্খা পূরণ করতে পারিনি। এখন টাকা হয়েছে কিন্তু সেই বয়স আর নেই। ব্যংকে চাকরির সুবাদে আধুনিক দু’একজন মেয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আমার মনমানসিকতার সাথে তারা বেমানান। এমন কাউকে বিয়ে করতে চাইনি যাকে বুঝতে যেয়ে আমার জীবনের বাকি সময় চলে যাক। বরং এমন কাউকে চেয়েছি যাকে সহজে বুঝতে পারবো, নিজের মনের হাল তার কাছে প্রকাশ করতে পারবো কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়াই। ছোটখাটো শখ পূরণ করতে পারবো তাকে সাথে নিয়ে। এমন কাউকে চেয়েছি যার কাছে সম্পর্কের গুরুত্ব আছে, যে নিজের জীবনে কিছু অর্জন করেছে। আর এজন্য তোমার চাইতে যোগ্য কে আছে? তুমিও তো আমার মতোই কষ্ট করে বড় হয়েছো। নিজে কিছু হয়েছো আপন যোগ্যতায়। আমি জানি পড়ালেখা করতে গিয়ে আমারই মতো নিজের দিকে তাকানোর সময় হয়নি তোমার। নিজের শখ আহলাদ জলাঞ্জলী দিয়ে এই পর্যায়ে এসেছো। আর এই কারনেই জীবনসঙ্গী হিসেবে তোমাকে পচ্ছন্দ করেছি। দু’জন স্ট্রাগলিং মানুষ যারা এতোদূর পথ পাড়ি দিয়েছে কোন আশাভরসা ছাড়াই তারা একসাথে হলে জগৎ জয় করতে পারবে।”
তুষার একটু থামলো। বোতলে রাখা পানি পান করলো। আর আমার চোখ থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। তবে এটা সুখের বৃষ্টি দুঃখের নয়। তুষার ওর দু’হাতের মুঠোয় আমার হাত নিয়ে চোখে চোখ রাখে-
“তুমি আমি মিলে একটা পরিপূর্ণ জগৎ গড়বো। আমি চাই আমরা দু’জনে মিলে নিজেদের সব অপূর্ণতা পূর্ণ করি। না পাওয়াকে পাওয়ায় বদলে দেবো, একে অপরের পরিপূরক হবো, এমন উদাহরণ হবো যাতে বেশি বয়সে বিয়ের আফসোস মিটে যায়। মোটকথা জীবনটাকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করবো। প্রতিটা মুহূর্ত কাজে লাগাবো। তুমি কি আমার এসব চাওয়া পূরণের সাথী হবে?”
আমি তখন আবেগে বাকরুদ্ধ। স্ববেগে মাথা ঝাকিয়ে কম্পিত কণ্ঠে উত্তর দেই-
“হবো।”
আমার জবাবে তুষার মধুর হাসলো-
“কলেজে প্রথমদিন দেখে তোমাকে ভালো লেগে গেছিলো। এরপর যতদিন গেছে সেই ভালোলাগা বেড়েছে। তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি মনেহয়।”
আমি নতমস্তকে বসে থাকি ঠায়। ভালোলাগায় অন্তর থইথই করছে। আবেগগুলো তন্বী তরুণীর মতো শরীর মনে তিরতির করে কাঁপন তুলছে। তুষার কি বুঝতে পারছে আমিও একটু একটু করে তার প্রতি আকর্ষিত হচ্ছি? যে মানুষটা আমার সব ভালোলাগা মন্দলাগার খেয়াল রাখছে তার প্রতি আকর্ষিত না হয়ে কি পারা যায়?
“ওই যে দেখো ঈদের চাঁদ।”
“কোথায়?”
আমি তাড়াহুড়ো করে আকাশে তাকাই চাঁদকে খুঁজি। তুষার কাছে এসে আমার হাত ধরে থামিয়ে তর্জনি তুলে দিক নির্দেশ করে-
“ওই যে দেখো।”
বড় হওয়ার পর এভাবে শেষ কবে চাঁদ দেখেছি জানি না। মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ মাথা উঁচু করে দাড়াতে গিয়ে জীবন থেকে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলে। ঈদের চাঁদ দেখার এই রেওয়াজও আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছিলো। আমি মুগ্ধ হয়ে চাঁদ দেখি। এই চাঁদ আমার জীবনে আশির্বাদ স্বরুপ। তুষার আমায় কাঁধে চিবুক রেখে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর নিশ্বাসে আছড়ে পড়ছে আমার কাঁধে। তুষার এবার কানে ফিসফিস করলো-
“আরেকটা অনুমতি কি পেতে পারি তিথী?”
নিজের নামটা অন্য কারো মুখে শুনতে এতোটা মধুর লাগবে জানা ছিলোনা। তুষার আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমায় হাতদুটো ওর হাতের মুঠোয় নিয়ে আমার চোখে চোখ রাখে। আমি বুঝে গেলাম সে কিসের অনুমতি চাইছে। আমি দু’বার চোখের পলক ফেলতেই প্রথমবারের মতো তার ওষ্ঠাদয় আমার কপোল ছুঁয়ে দিলো। কোথায় যেন পড়েছিলাম সত্যিকার প্রেমিকের প্রথম চুম্বন হয় নারীর কপালে। সে কথা মনে আসতেই তুষারের আকর্ষনে আমি আরো একধাপ এগিয়ে গেলাম।

#বাম_পাঁজরের_হাড়
#পর্ব-৫
© Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here