পর্ব ১৪

রাত এগারো টা।

অম্লান এখনো বাসায় ফেরে নি। সে গেছে টিকেট কাটতে। আগামীকাল বেরিয়ে পড়তে হবে। কোথায় যাবে সে ব্যাপারে নীলাক্ষীকে কিছুই জানায় নি। নীলাক্ষী বারবার কল দিয়েও পাচ্ছে না ওকে। ঘরে বসে থাকলে হু হু করে টেনশন বাড়ছে বলে দাদীর ঘরে চলে এলো নীলাক্ষী।
দাদী জেগে আছেন। গ্রামোফোনে গান বাজছে, ‘তুমি যে আমার কবিতা, আমারও বাঁশির রাগিণী…’ দাদী শান্ত হয়ে শুয়ে গান শুনছিলেন। নীলাক্ষী দরজা ঠেলে ভেতরে আসার অনুমতি চাইলে দাদী নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, ‘আয় দাদু ভাই ভেতরে আয়।’

নীলাক্ষী দাদীর পাশে এসে বসলো। দাদীর চেহারা এখনো বেশ টকটকে। গায়ের রং ফর্সা, সাদা চুল, পান খেলে ঠোঁট দুটো লাল হয়ে থাকে। কি যে মিষ্টি লাগে দেখতে! নীলাক্ষী বললো, ‘দাদী তুমি একা থাকো তোমার খারাপ লাগে না?’
দাদী হেসে বললেন, ‘একা কই রে? তোর দাদুর স্মৃতি আছে না? তারা আমাকে একা থাকতে দেয় নাকি?’

এই বয়সের একজনের কাছে তার স্বামীর স্মৃতিকে আগলে ধরে বেঁচে থাকার কথাটা শুনে নীলাক্ষী অবাক না হয়ে পারলো না। ভালোবাসার স্বপ্নীল মুহুর্তের স্মৃতি গুলোই বোধহয় মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করে। নয়তো একা একটা মানুষ কেমন করেই বা এত হাসিখুশি থাকে!

নীলাক্ষী বললো, ‘দাদী তুমি কি দাদাকে অনেক ভালোবাসতে?’
– ‘তা তো বাসতাম। তবে লোকটা আছিলো পাগল রে। আমাকে এত আদর যত্ন করতো! মাঝেমাঝে মনে হইতো একদিন সুখেই মরে যাবো। চুলে তেল দিয়ে দিতো, মাঝেমাঝে রান্নাও করতো আমার জন্য। রাতে গল্প শোনাইতো আর আমি ঘুমাই পড়তাম।’

বাদামী সংসার
লেখক- মিশু মনি

দাদীর সুখের কথা শুনতে শুনতে নীলাক্ষী কোথায় যেন হারিয়ে যেতে শুরু করে। জীবন মানুষকে কতটা দিতে পারে নীলাক্ষীর জানা নেই। কিন্তু কাউকে কাউকে বোধহয় একটা হৃদয় ভরে ভালোবাসা দিয়ে দেয়। যাতে একজীবনে আর কিছুই প্রয়োজন না হয়।

দাদী একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘হুট করে আমাকে ফেলে চলে গেলো রে। অথচ বলেছিলো আমাকে ছেড়ে কখনো কোথাও যাবে না। মানুষ যে কেন মরে যায়!’
নীলাক্ষী দাদীকে স্বান্তনা দেয়ার চেষ্টা করে বললো, ‘দাদী গো, মন খারাপ কোরো না। দাদু তোমাকে অনেক সুখের স্মৃতি দিয়ে গেছেন না? যেগুলো নিয়েই এখনো তোমাদের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রেখেছো? এটাও দরকার জীবনে।’
– ‘হু। একদিন আমিও চলে যাবো তার কাছে। আল্লাহ চাইলে জান্নাতে যদি তারে আবার পাই!’

নীলাক্ষীর যেন চোখ ছলছল করে ওঠে। কি ভয়ংকর সুখের কথা! একটা মানুষ শেষ বয়সে এসেও তার স্বামীকে জান্নাতে চেয়ে প্রতীক্ষায় বুক বাঁধছেন। ওর বড় ভালো লাগে। নিজেকেও দাদীর মতো করে গড়ে তোলার অভিপ্রায় জাগে। একটা পরিবার, একটা ভালোবাসা, এগুলো না থাকলে তো জীবনটাকে জীবন বলাই যায় না।

দাদী হেসে বললেন, ‘তা বোনটি, দাদুভাই কেমন যত্ন নিচ্ছে তোর? কোনো অনাদর হচ্ছে না তো?’

নীলাক্ষী লজ্জা পেয়ে হেসে উত্তরে বললো, ‘না গো। মানুষটা বড় ভালো। আমার অনেক কেয়ার করে।’

এমন সময় ঘরে প্রবেশ করলো দোয়েল। বললো, ‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি রে। তোর কপাল অনেক ভালো। কত ভালোবাসা পাচ্ছিস। বর আমাকে পর্যন্ত গাড়িতে নেয়নি, বলে কিনা আমি একাই গাড়ি তে বউকে নিয়ে যাবো। মা’র মুখের উপর আমরা কেউই কথা বলার সাহস করিনা অথচ সে রীতিমতো তর্ক যুদ্ধ করে হানিমুনে যাওয়ার ব্যবস্থা করলো। কয়জন করবে এমন?’

নীলাক্ষী লজ্জায় মাথা নিচু করে হাসলো। দোয়েল নীলাক্ষীর পাশে এসে বসলো। নীলার হাতটা ধরে বললো, ‘তুইও তাকে আগলে রাখিস। পুরুষ মানুষ হচ্ছে একটা আজব চরিত্র। এই দেখবি তোকে খুব ভালোবাসছে, আবার দেখবি তোর ভালোবাসা না পেলে বিগড়ে গেছে।’

নীলাক্ষী দুষ্টুমি করে বললো, ‘কেন গো? ভাইয়া বুঝি বিগড়ে গিয়ে উল্টা পাল্টা কিছু করেছে?’
– ‘ছি ছি। ও কেন এসব করবে? তবে ও অম্লানের মতো এত রোমান্টিক না। বোঝে খালি ব্যবসা বাণিজ্য।’

নীলাক্ষীর মনের আকাশের শুকতারাটা উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে লাগলো। নিজেকে ওর মনে হতে লাগলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েদের একজন। মানুষটা ওকে কি অদ্ভুত ভাবেই না ভালোবাসছে! আচ্ছা, এখনো বাসায় ফিরছে না কেন? দুশ্চিন্তা হচ্ছে তো।

ভাবনা না ফুরোতেই দরজায় বেল বেজে উঠলো। দোয়েল হেসে বললো, ‘তোর রাজকুমার এসেছে। যা, জড়িয়ে ধর গিয়ে।’

নীলাক্ষী লজ্জায় লাল হয়ে ভাবীকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘ভাবী, তুমি না..’

অম্লানকে দেখে নীলাক্ষীর মনে শত প্রশ্ন জাগছিলো। কেন দেরি হলো, রোজ দেরি করে বাসায় ফেরে কি না, কোথায় ছিলো, এতক্ষণ কি কি করলো, এরকম অসংখ্য প্রশ্ন। কিন্তু মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলার সাহস হলো না। এতগুলো দিনেও ওর লজ্জার আবরণ একটুও হালকা হয় নি। কিছু বলতেও লজ্জা করে আবার কিছু শুনলেও একেবারে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। অম্লান টেবিলের ওপর একটা ব্যাগ রেখে বাথরুমে গেলো। নীলাক্ষীর খুব কৌতুহল জাগছিলো ব্যাগের ভেতর কি আছে সেটা দেখার জন্য। কৌতুহল দমন করে রাখতে হলো। কারো অনুমতি ছাড়া কিছু দেখাটা অন্যায়, সেটা নিজের স্বামী হোক না কেন। দেখানোর মতো হলে সে নিজেই তো দেখতে বলবে।

অম্লান হাতমুখ ধুয়ে এসে বললো, ‘ তুমি খাইছো?’
– ‘না। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’

অম্লান বললো, ‘শোনো, আমার মাঝেমাঝে এরকম দেরি হতেই পারে। এর থেকে বেশিও হতে পারে। বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা দেই, এখানে সেখানে যাই। তুমি সময়মত খেয়ে নিবা। পুরনো আমলের বউদের মতো অত লক্ষী হওয়া লাগবে না। নিজের পেট আগে।’

নীলাক্ষীর হাসি পেলো। ফিক করে হেসে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি ভাত দিচ্ছি, আসুন।’

রাত বেড়ে যাওয়ায় বাড়িটা একেবারে নিস্তব্ধ। খাবার টেবিলে নীলাক্ষীর চামচ নাড়ানো আর অম্লানের গ্লাসে পানি ঢালার শব্দ ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিলো। খাবারেরও একটা শব্দ আছে। দুজনে নিরবে খাওয়ার সেই শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোনো শব্দ নেই। খাবার অর্ধেকের বেশি ফুরিয়ে যাচ্ছে। নীলাক্ষী মাঝেমাঝে কৌতুহলী হয়ে তাকাচ্ছে অম্লানের দিকে। লোকটা সবসময় কত কথা বলে অথচ আজ কি শান্ত! একটা কথাও বলছে না। টিকেট কোথাকার কাটলো তাও বলছে না। টেবিলের নিচে পা নাচাতে নাচাতে কথাগুলো ভাবছিলো নীলাক্ষী।

অম্লান নিরবতা ভেঙে বললো, ‘তোমার পাসপোর্ট থাকলে মেঘালয় নিয়ে যেতাম। কিন্তু তোমার তো পাসপোর্ট নেই।’
নীলাক্ষী কিছু বলতে পারলো না। চুপচাপ খাবার গিলছিলো। অম্লান জিজ্ঞেস করলো, ‘অফিস কবে থেকে তোমার?’
– ‘আমার অনেকদিনের ছুটি। আরো আটদিন সময় পাবো।’
– ‘আমার অবশ্য দুদিন পরেই অফিস খুলবে।’
– ‘তাহলে কিভাবে হবে?’
– ‘কি?’
– ‘মানে বেড়াতে যাবো না?’

অম্লান গম্ভীর মুখে বললো, ‘না। যাবো না।’
নীলাক্ষী চমকে উঠলো। গত দুইটা দিন মায়ের সাথে এত তর্ক করার পর বেড়াতে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছে। অথচ আজ বলছে কি না যাবে না!

নীলাক্ষীর বিষন্ন ও উদ্বিগ্ন চেহারা দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো অম্লান। হাসতে হাসতে বললো, ‘ভয় দেখাচ্ছিলাম। দেখছিলাম যে তুমি বেড়াতে না গেলে আসলেই আপসেট হও কি না। আমরা আগামীকাল রাতের বাসে রাঙামাটি যাচ্ছি।’
– ‘রাঙামাটি! উফফ!’

অজান্তেই এক বিস্ময়সূচক শব্দ অস্ফুটে বেরিয়ে এলো নীলাক্ষীর মুখ থেকে। বাকিটুকু খাবার খেতে খেতে উত্তেজিত হয়ে উঠছিলো। আগে মাত্র দুই একবার ঢাকার বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলো ও। কোথাও বেড়াতে যাওয়া নিয়ে ওর খুব একটা আগ্রহ নেই। কতবার বন্ধু বান্ধবরা জোর করেছিলো বেড়াতে যেতে। অনেকেই দল বেঁধে ট্যুরে চলে যায়। নীলাক্ষীর কেন যেন যেতে ইচ্ছে করে নি। তবুও আজ ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা বোধ করছিলো।

অম্লান খাওয়া শেষ করে বসে রইলো। মোবাইল বের করে কিছু একটা দেখছিলো। নীলাক্ষীর খাওয়া শেষ হয়ে গেলে হাত ধুতে চলে গেলো।

নীলাক্ষী বিছানায় উঠে বসামাত্র অম্লান সেই ব্যাগটা নিয়ে এসে বসলো। নীলাক্ষীকে বললো খুলে দেখতে। ভীষণ কৌতুহল নিয়ে নীলাক্ষী ব্যাগ খুলে দেখলো একটা ছবির এলবাম। ওর বিস্মিত হয়ে বললো, ‘সুন্দর তো!’

প্রথম পাতাটা বের করেই একটা বড়সড় ধাক্কা খেয়ে গেলো নীলাক্ষী। প্রথম পাতায় যে ছবিটা রাখা আছে সেটা দেখে ওর বুক ধুকপুক করে উঠলো। ওর হারিয়ে যাওয়া বন্ধু অবনীর বর্তমান ছবি! অম্লান কি করে তার খোঁজ পেলো!
নীলাক্ষী আশ্চর্যান্বিত চোখে অম্লানের দিকে তাকালো। অম্লান বললো ‘সারপ্রাইজ!’
নীলাক্ষী বিস্মিত গলায় বললো, ‘আমি সারপ্রাইজের ফিলিংসটা পেতে চেয়েছিলাম। এত এক্সাইটেড একটা ফিলিংস আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। প্লিজ বলুন না এই ছবি আপনি কোথায় পেলেন?’

অম্লান ওর মোবাইল বের করে এগিয়ে দিলো নীলাক্ষীর দিকে। একটা নাম্বার দেখিয়ে বললো, ‘এটা অবনীর নাম্বার। এখন সম্ভবত হায়দ্রাবাদে আছে। আমি ফেসবুকে ওর বাংলা ইংরেজি দুটো নাম লিখেই ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। এক বান্ধবীকে দিয়ে বিভিন্ন ফিমেল গ্রুপে পোস্ট করেছি। অনেক চেষ্টার পর তোমার সেই বান্ধবীকে খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছি। নাও, ফোন দিয়ে কথা বলো।’

নীলাক্ষী বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলতে গেছে। অম্লান মিটমিট করে হাসছে। এই না হলে সারপ্রাইজ! কাউকে ভীষণভাবে চমকে দিতে খুব মজা লাগে। নীলাক্ষী কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন নিয়ে সেই নাম্বারে ডায়াল করলো। অম্লান বললো, ‘আমি একটা সিগারেট খেয়ে আসি?’

নীলাক্ষী মাথা দুলিয়ে বললো, ‘আচ্ছা।’

অম্লান সিগারেট বের করে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। নীলাক্ষী অবনীর কণ্ঠস্বর শুনে অনেক্ষণ বিমূঢ় হয়ে রইলো। কি বলবে, কিভাবে বলবে বুঝতেই পারছিলো না। অবনীকে ও কলিজা বলে ডাকতো। এত বছর পর তার সাথে কথা হচ্ছে! অবনী ভিডিও কল দিতে বললে কল দিয়ে কেঁদে ফেললো নীলাক্ষী। কথা বলতে বলতে দুজনেই ফিরে গেলো শৈশবে। জলভেজা চক্ষে কত কথার ফুলঝুরি মেলে দিলো কেউই জানেনা। কত আনন্দ, কত উল্লাস আর উত্তেজনা।

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে অম্লান সিগারেটের ধোঁয়ায় অশান্ত মনটাকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করছে। ফাইরুজ আজকে প্রফুল্লকে নিয়ে অনেক কথা বললো। প্রফুল্ল’র অবস্থা নাকি ভীষণ খারাপ। ভালোবাসাটা হয়তো এখনো আছে কিংবা নেই, কিন্তু আপন একজন মানুষের জন্য দুশ্চিন্তাটা ঠিকই মস্তিষ্কের এক কোণে জায়গা দখল করে রেখেছে। দীর্ঘশ্বাসে যন্ত্রণাগুলোকে বিদায় জানাতে চেয়েও পারছে না অম্লান। ঘর থেকে ভেসে আসছে নীলাক্ষীর বিশ্বজয়ী হাসির শব্দ। হাসছে আর বলছে, ‘আর বলিস না। ও দুষ্টু হতে পারে কিন্তু আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসছে রে, এত্ত কেয়ারিং। আমি অনেক ভাগ্যবতী।’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here