বাদামী সংসার
পর্ব ৩৭
মিশু মনি
সকালের সোনালী রোদ্দুর লেগে চিকমিক করছে গাছের পাতা। নীলাক্ষী বড় লাগেজ টানতে টানতে অম্লানের অফিসের সামনে এসে দাঁড়ালো। চারপাশের পরিবেশ ভীষণ অচেনা। মনে হচ্ছে এই জায়গাটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। সে আগে কখনো শহরের বাইরের কোনো মফস্বল শহর দেখেনি। অজানা পরিবেশ বিস্ময়ের ডালি নিয়ে চোখে ধরা দিচ্ছে।
রাতটা কেটেছে ব্যকুলতায়। শ্বশুরবাড়ির কেউ জানে না এটা নীলাক্ষীর প্রথম একলা ভ্রমণ। জানলে নিশ্চয় একা ছাড়তেন না। নীলাক্ষী সাহস করেই বেরিয়ে পড়েছে। প্রয়োজনের সময় বোধহয় মানুষ দুঃসাহসী হয়ে ওঠে।
অম্লানের অফিস থেকে দুই মিনিটের পথ হাঁটলে সামনে যে দোতলা বাড়িটা চোখে পড়বে, সেই বাসাতেই অম্লান থাকে। একদিন কথায় কথায় সেটা বলেছিলো অম্লান। বাড়িটাতে আর কোনো ভাড়াটিয়া নেই। বাড়ির মালিক পরিবার আর অম্লানের এক রুম, এই যা। নীলাক্ষী সেই অনুযায়ী এগোতে লাগলো ইট দিয়ে বাঁধানো রাস্তাটি ধরে। রাস্তাটি সরু, কিছুদূর এগিয়ে গিয়েই শেষ হয়ে গিয়েছে। তারপর সবুজ মাঠের মতো কিছু একটা চোখে পড়ছে। নীলাক্ষী হাঁটছে, বুক কাঁপছে দুরুদুরু করে। অম্লানের সাথে রাতে কথা হয়নি। সে জানেও না নীলা এত বড় একটা কাণ্ড ঘটাতে যাচ্ছে।
রাস্তার মাথায় এসে থমকে দাঁড়ালো নীলাক্ষী। সামনে বিস্তৃত সবুজ ধানের ক্ষেত। পাশে দাঁড়ানো মাত্রই একরাশ স্নিগ্ধ হাওয়া এসে শরীরে দোলা গিয়ে গেলো। দেহের ক্লান্তি দূর করতে এমন একটা সমীরণের খুব প্রয়োজন ছিলো বোধহয়। নীলাক্ষী খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নেয়। সে জানে না অম্লান তার উপস্থিতিকে কীভাবে নেবে কিন্তু একটা নতুন পদক্ষেপের সূচনা ঘটিয়ে ফেলেছে সে।
বামদিকে তাকালেই চোখে পড়ে একটা একতলা বাড়ি, তার ঠিক পেছনেই মাথা বাড়িয়ে তাকিয়ে আছে দোতলা বাড়িটি। বাইরে থেকে হালকা গোলাপী রঙের সাথে আকাশী রঙের মিল রেখে রং করা বাড়িটি দেখেই মন ভালো হয়ে গেলো। ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা টের পেলো নীলাক্ষী। সে এই বাড়িতে নতুন করে গড়ে তুলবে জীবন!
বাড়ির দিকে যতই এগোচ্ছে, প্রতি মুহুর্তে হৃদস্পন্দন বাড়ছিলো। নীলাক্ষীর মনের ভেতর মুহুর্তের জন্য উঁকি দিচ্ছে একটা ভয়, ভেতরে হয়তো প্রফুল্ল আছে। বাড়ির যত কাছে এগিয়ে আসছে, ততই ভয়টা বাড়তে লাগলো। প্রধান ফটকের কাছাকাছি এসে মনে হলো দম বন্ধ হয়ে আসবে। নিশ্চয় অম্লান প্রফুল্লকে নিয়ে বিছানায় জড়াজড়ি করে ঘুমাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখলে নির্ঘাত মরে যাবে নীলাক্ষী। কিছুতেই তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হবে না।
ভয়ের মাত্রা ক্রমশ বাড়ছেই, একইসাথে বাড়ছে ধুকপুকানি। নীলাক্ষীর হাত পা যেন ধীরেধীরে অসাড় হয়ে
আসছে। সে কোন দুর্ঘটনার সাক্ষী হতে চলেছে কে জানে! হার্টবিট হচ্ছে দ্রুত। নীলাক্ষী ত্রস্তপদে এগিয়ে এলো বাড়ির ভেতরে। ভেতরে খানিকটা ফাঁকা জুরে সবজির বাগান। একজন মহিলা বসে ঘাস সাফ করছিলেন। নীলাক্ষীকে দেখে ডাক দিতেই চমকে উঠলো নীলাক্ষী। মহিলাটি জানতে চাইলেন, ‘কার কাছে এসেছেন?’
নীলাক্ষী কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলো, ‘অম্লান আছে? আমি ওর স্ত্রী।’
‘স্ত্রী’ শব্দটা উচ্চারণ করার সময় শরীর কেঁপে উঠলো। কী জানি আজ থেকে সেই অধিকার হয়তো হারিয়ে ফেলতে হবে তাকে। বুকের দুরুদুরু কাঁপুনি নিয়ে নীলাক্ষী তাকিয়ে রইলো, মহিলা কী বলবেন সেই আশায়।
কিন্তু মহিলা নীলাক্ষী আসায় বিন্দুমাত্র খুশি হোন নি মনে হচ্ছে। তিনি মুখটা রীতিমতো কালো করে ফেললেন। যেখানে এগিয়ে এসে হাসিমুখে শুভেচ্ছা জানানোর কথা, সেখানে তিনি কঠিন পায়ে এগিয়ে এসে দোতলার একটা ঘর দেখিয়ে বললেন, ‘ওইযে ওইখানে সিঁড়ি। সোজা উইঠা যান।’
নীলাক্ষীর ভয়ে এবার আরও মাত্রা যোগ হলো। মহিলার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে নীলাক্ষী বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। তবে কী ভেতরে প্রফুল্ল! না, আর ভাবতে পারছে না নীলাক্ষী। রীতিমতো দম বন্ধ করা অবস্থায় ধীরপায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো।
অম্লানের ঘরটা এক কোণায়। দরজায় শব্দ করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো নীলাক্ষী। পুরো দেহ শিরশির করে ভয়ে। মাথার ভেতর কী একটা দ্রুত ছোটাছুটি করছে। আরেকবার শব্দ করার আগেই দরজা খুলে গেলো।
নীলাক্ষীর বুকটা ধক করে উঠলো। অম্লান ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে। প্রথমটায় সে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। চোখ কচলে মাথা ঝাড়া দিয়ে অম্লান বললো, “নীলু! হেই, তুমি! মানে নীলু তুমি কীভাবে..”
অম্লান আরো একবার মাথা ঝাঁকুনি দিলো। নাহ, সে ভুল দেখছে না। নীলাক্ষী নিরুত্তর দ্রুতপদে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো। তার হৃদস্পন্দন তখন ভয়াবহ উর্ধ্বে।
ঘরে প্রবেশ করেই নীলাক্ষী থমকে দাঁড়ালো। খা খা করছে চারদিক। ঘরের মেঝেতে একটা ম্যাট্রেস বিছানো, তার পাশেই ছোট টুলের ওপর ল্যাপটপ। একদিকে একটা টেবিলের ওপর রান্নার সরঞ্জাম, গ্যাসের চুলা ও ছড়ানো ছিটানো জিনিসপত্র। দুই দেয়ালে পেরেকে আটকানো দড়িতে ঝুলছে অম্লানের শার্ট, প্যান্ট, একগাদা কাপড়চোপড়। প্রফুল্ল তো দূরের কথা, একটা নারীর স্পর্শের ছিটেফোঁটাও কোথাও নেই। দুইহাতে মুখ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো নীলাক্ষী। ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে তার।
অম্লান কাছে এগিয়ে এলো। মৃদুস্বরে বললো, “নীলু, তোমাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন?”
নীলাক্ষী মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিষ্পলক চোখে স্থির চেয়ে রইলো। যেন নিষ্পাপ একটা পদ্মফুল। যার পা দুটো শেকড়ের মতো মাটির ভেতরে প্রোথিত। নড়াচড়াও করার শক্তিটুকুন নেই। অম্লান আলতো করে নীলাক্ষীর মাথাটা বুকের ভেতর টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। একটা স্নিগ্ধ উষ্ণতায় জড়ানো আদরে চোখ বুজে আসলো নীলাক্ষীর।
পৃথিবীর সমস্ত সুখ এখানেই!
অম্লান বললো, “আমাকে না জানিয়ে হুট করে চলে আসলা যে? কী হয়েছে?”
নীলাক্ষী নিরুত্তর ভঙ্গীতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অম্লান বললো, “আচ্ছা। এসে ভালো করেছো। আমার একা এক থাকতে ভালো লাগছিলো না। ওভাবে কী দেখছো বলোতো?”
নীলাক্ষীর চোখে পানি চলে এলো। অম্লান দরজার বাইরে থেকে বিশাল লাগেজ ঘরের ভেতরে নিয়ে এসে রাখলো। নীলাক্ষীকে আরেকবার জড়িয়ে ধরে কপালে আলতো চুমু খেয়ে বললো, “বাথরুমে যাবা?”
“না।”
“আমার খুব চাপ লেগেছে। তুমি বসো, আমি এক্ষুণি আসছি।”
অম্লান বাথরুমে চলে গেলো। রুমের সাথে এটাস্ট বাথরুম। নীলাক্ষী চুপচাপ বসে পড়লো মেঝেতে বিছানো ম্যাট্রেসের ওপর। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ফিক করে হাসিও এসে গেলো তার। কত কী উল্টাপাল্টা না ভেবে ফেলেছিলো সে! উফফ একটা রাত, একটা দিন, কত বিচ্ছিরিভাবে কেটে গেছে।
বিছানার ওপর থেকে অম্লানের মোবাইল তুলে নিয়ে কল লিস্টে প্রবেশ করে দেখলো সেখানে নীলু, আব্বু, কৌশিক ছাড়া সন্দেহজনক কারও নাম্বার নেই। মেসেঞ্জারেও তেমন কেউ নেই যাকে প্রফুল্ল ভাবা যেতে পারে। মন থেকে মুহুর্তেই সমস্ত দুশ্চিন্তা উবে গেলো নীলাক্ষীর। ফোন রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মানব মন এত অদ্ভুত কেন!
অম্লান বেরিয়ে এসে তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে বললো, “তারপর বলো, হঠাৎ কী মাথায় ভুত চেপেছিল? এমন দুম করে চলে আসলা। আব্বু আম্মুও আমাকে কিচ্ছু জানায় নাই। সবাই মিলে আমাকে সারপ্রাইজ দিয়ে দিলা তাইনা?”
অম্লান এসে ম্যাট্রেসের ওপর বসলো, “একা থাকি। খাট কিনি নাই। তুমি তো দেখি বাড়ির সব জিনিসপত্র শুদ্ধ চলে আসছো। এত বড় লাগেজ! হা হা হা।”
অম্লানকে আগের মতোই দেখাচ্ছে। কত স্বাভাবিক, কত নির্মল! শুধু কিঞ্চিৎ শুকিয়ে গেছে। নীলাক্ষী কাছে এগিয়ে এলো। এইমুহুর্তে একটা প্রবল চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। অম্লানের ঠোঁট দুটোকে ঠোঁটের ভেতর পুরে নিয়ে খুব আদর করে দিতে ইচ্ছে করছে নীলাক্ষীর।
অম্লান বললো, “কয়দিনের ছুটি?”
“আজীবনের।”
“মানে!’
নীলাক্ষী আরও কাছে এগিয়ে আসলো। অম্লানের চোখে চোখ রেখে মৃদুস্বরে বললো, ” আমি তোমাকে ছেড়ে ওই ঢাকা শহরে পড়ে থাকবো কিসের দুঃখে? আমি তো তোমার বাড়িঘরকে বিয়ে করিনি। তোমাকে করেছি।”
অম্লান মুচকি হেসে বললো, “তোমার অফিস?”
“গোল্লায় যাক। যেখানে তুমি নাই সেখানে অফিস দিয়ে কী হবে? আমার টাকা পয়সা কে খাবে?”
“হা হা। তোমার টাকা পয়সা কী আগে আমি খেতাম?”
“তা খেতে না। কিন্তু কী হবে চাকরি করে? আমার তো একটা মানুষ চাই।”
অম্লানের বুকে লুটিয়ে পড়লো নীলাক্ষী। তার ভরাট যৌবন। দেহে ও মনে টগবগ করছে প্রেমের জোয়ার। জীবনের প্রথম পুরুষ অম্লান। তার নিকট হতে অপরিসীম আদর স্নেহ, ভালোবাসা পাওয়ার পর নিজেকে কী করে দূরে রাখবে সে। কান্না পেয়ে গেলো নীলাক্ষীর। অম্লান নীলাক্ষীর মাথায় হাত বুলাচ্ছে পরম মমতায়।
সকালের নাস্তা তৈরি করলো নীলাক্ষী। আটার রুটি, সবজি ও ডিম ভাজি। সাথে আদা দিয়ে রং চা। নাস্তা খেয়ে নীলাক্ষীকে বিদায় জানিয়ে অম্লান অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। দুপুরে সে খেতে আসবে সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর নীলাক্ষীকে নিয়ে খাট ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে যাবে।
নীলাক্ষী কাথা মুড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ক্লান্তিতে দুচোখ বুজে ঘুম আসছে। কিন্তু এইমুহুর্তে একদমই ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। এখানে নতুন করে সে সংসার সাজাবে। একান্তই নিজের সংসার। যেখানে আর কেউ হাঁটাহাঁটি করবে না, তার রান্নাঘরে আর কেউ প্রবেশ করবে না। মনের মাধুরি মিশিয়ে সংসার সাজিয়ে ফেলবে সে। সেই উত্তেজনায় একদমই ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না।
চলবে..