বন্ধ_দরজায়_তুমি🖤Part: 36.
#Written_By_Mêhèriyâr_Mêhèr
……

সন্ধ্যা ৭টা….

তীব্র তাইয়্যানকে নিয়ে তীরের জন্মদিন পার্টিতে যাচ্ছে। তীব্র অবশ্য যেতে চাইনি। কিন্তু তাইয়্যান জন্মদিনের পার্টির কথা শুনে লাফিয়েছে। আর তাও আবার রিদ্ধর আশকারায়। রিদ্ধ তাইয়্যানকে জন্মদিনের পার্টিতে যাবার কথা বলেছে। আর তাই তাইয়্যান বাবার কাছে গিয়ে বায়না করেছে যাতে ওকে নিয়ে যায়। ছেলের কোন আবদার ফেলেনা তীব্র। জন্মদিনের পার্টিতে যেতে চেয়েছে, অন্যায় তো কিছু চায়নি। তাই নিজের অনুভূতি পাশে ফেলে ছেলেকে নিয়ে তোয়ার বাড়িতে যায়।

গাড়িতে বসে তীব্র ল্যাপটপে কাজ করছে। তাইয়্যান এতক্ষন পাজেল নিয়ে খেললেও এখন গাড়ির বাইরের দিকে তাকিয়ে নিজের দেশটাকে দেখছে। এতদিন ভিন্ন দেশে সবকিছু সাজানো গোছানো পরিপাটি দেখেছে। যাতে সবকিছুতেই আভিজাত্যের ছোয়া ছিল। পরিপক্ক পরিষ্কার-পরিছন্ন রাস্তাঘাট, নকশা খচিত আভিজাত্যপূর্ণ বাড়িঘর, আর্দশ নগরায়ন। আর একরকম চেহারার অনেক মানুষ । কিন্তু এখানে ব্যাপারটা ভিন্ন। বিভিন্ন চেহারার মানুষ, ধুলোময় পরিবেশ। সব কিছু যেন ছন্নছাড়া ভাবে বেড়ে উঠেছে। এর আগে এমন কিছু দেখেনি তাইয়্যান। রাতের পরিবেশে নিজের দেশের সবকিছু গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ।

গাড়ির সিগন্যালের মধ্যে পরতে তাইয়্যান গাড়ির কাচ নামায়।বাইরে উঁকি দেয়। বেশ বড় বড় গাছ রাস্তার পাশে। যার গোড়ায় সাদা রং করা। ওদের গাড়ির থেকে অনেকটা দূরে গাছের নিচে একটা টং দোকান দেখা যাচ্ছে। তার পাশেই একটা লোক ঠেলায় করে বাদাম, বুটসহ নানা রকম ভাজা বিক্রি করছে। ঠেলার মাঝে টিপটিপ করে কুঁপি জ্বলছে৷ রাস্তায় লাইটগুলো জ্বলছে কিন্তু গাছের নিচে থাকা দোকানগুলো আলোকিত করতে পারছে না। তাইয়্যান অবাক হয়ে ব্যাপারগুলো খেয়াল করছে। তখনি টং দোকানের সামনে প্রচন্ড গতিতে একটা বাইক থামে। তাইয়্যান ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে? দূর থেকে তাই তাদের স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তাইয়্যান আরো গভীর ভাবে খেয়াল করে দেখল, বাইক থেকে দু‘টো ছেলে নামছে। কিন্তু পরক্ষনের বুঝল পিছনের জন মেয়ে। কারন তার সিল্কি চুল গুলো ঝুটি বাঁধা। ছেলেটা দোকানে নেমে কিছু একটা কিনল। কী নিল? পরক্ষনেই তাইয়্যান বুঝতে পারল ছেলেটা সিগারেট কিনেছে। কারন সে সেখানের একটা লাইটার দিয়ে তা জ্বালাল। পরের ব্যাপারটা আরো অদ্ভুত লাগে তাইয়্যানের কারন ছেলেটা মেয়েটাকে সিগারেট বাড়িয়ে দিল।

তাইয়্যান কোনদিন ওর পাপাইকে সিগারেট খেতে দেখেনি। অন্যদের যখন দেখত পাপাই বলেছে এগুলো ভালো না। তাই ও তীব্রকে ডাকে,
—– ” পাপাই…. পাপাই…. ”

তীব্র ছেলের ডাকে ল্যাপটপ বন্ধ করে ওর দিকে তাকায়। তারপর একটু বিরক্ত হওয়ার রাগী মুড নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
—– ” কি হয়েছে? ”
—— ” তুমি বলেছিলে না যারা ভালো তারা সিগারেট খায় না। ”

ছেলের কথায় অবাক হয় তীব্র। হঠাৎ করে এমন প্রশ্ন কেন করল তাইয়্যান। ও কিছুটা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— ” হ্যা, কিন্তু, কেন পাপাই? ”

—– ” ওই দেখ… ( টং দোকানের দিকে ইশারা করে। ) ওখানে একটা ছেলে নিজেও সিগারেট খাচ্ছে আরেকটা মেয়েকে দিচ্ছে। ”

তীব্র বাইরের দিকে এটা দেখে। ছেলেটার চেহারা লাইটের দিকে থাকার কারনে বোঝা যাচ্ছে কিন্তু মেয়েটার না। তীব্র বেশ বিরক্ত হয়ে জানালার গ্লাস তুলে দিল। তাইয়্যানের কপাল চুমো দিয়ে বলল,
—– ” সব সময় ভালো কিছু দেখতে হয়। যদি খারাপ কিছু দেখ তাহলে সেটা শুধরানোর চেষ্টা করতে হয়। আর যদি তা তোমার আয়ত্তে না থাকে তবে সেটা ইগনোর করা উচিত। বুঝলে? তুমি এখন ছোট তাই ওগুলো না দেখাই ভালো। যারা বুদ্ধিমান বাচ্চা তারা এমনই করে। ”

—- ” আচ্ছা। ” নিজেকে বুদ্ধিমান প্রমান করতে চায় তাইয়্যান। তারমানে পাপাইয়ের কথা মানতে হবে। কারন বুদ্ধিমান বাচ্চারাই পাপাইয়ের কথা শোনে। ভালো কাজ করে।

—- ” গুড। ” তীব্র আবার ল্যাপটপে হাত দিতে যাবে। তার আগেই তাইয়্যান বলে উঠল,
—- ” পাপাই তুমি কী এখনো কাজ করবে? ”

ছেলের কথায় ওর দিকে তাকিয়ে ” কেন ” জিজ্ঞেস করে? উত্তরে তাইয়্যান বলে,
—– ” আমার না খেলতে ভালো লাগছে না। ”

ওর কথায় তীব্র হেসে উঠল। তারপর সব কাজ রেখে তাইয়্যানকে কোলে নিয়ে বলল,
—– ” আচ্ছা। তারচেয়ে বড় আমরা দুজনে বরং রাস্তা বর্ননা করতে করতে যাই। ”

কথাটা শুনে বেশ খুশি হলো তাইয়্যান। তীব্র ওকে কোনটা কোন রাস্তা? কী নাম? কোথায় কী আছে? সবকিছু হাত দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে বলে। একটা সময় মন খারাপের একাকিত্বতা দূর করতে ড্রাইভিং করত এইসব রাস্তায়। ৫ বছরে রুপটা বদলেছে কিন্তু তৃপ্তি সেই আগের মতই আছে। নিজের অস্তিত্ব হারায়নি এই পরিবেশ। ছেলেকে সবকিছুর বর্ননা দিতে দিতে নিজ গন্তব্যে চলল তীব্র।

——————————-★—————————–

—– ” কিহল তুর ধরছ না যে।? ”

—— ” হ্যা, কিছু বললে? ” নিজের মনে কিছু একটা ভাবছিল তুর। রিদামের কথায় ওর ঘোর ভাঙে।

—– ” তখন থেকে ধরতে বলছি কিন্তু তুমি? নিজের ভাবনায় ব্যস্ত। কী ভাবছ? তখন থেকে দেখছি মন নেই তোমার। শরীর খারাপ দেখি। ”

তুরের কপালে হাত দিতে নেয়। কিন্তু তার আগেই তুর নিজের হাত ওর সামনে দিয়ে ওকে থামতে বলে,
—— ” প্লিজ রিদাম। আগেও বলেছি অযথা কেয়ারিং আমার জন্য দেখাবে না। ভালো লাগে না আমার। আমি ঠিক আছি। ”

বেশ বিরক্ত নিয়েই বলল কথাটা। অন্যদিকে ফিরে নিজের অস্থিরতা দূর করার চেষ্টা করল। কেন জানি আজ ওর অদ্ভুত লাগছে?কিছুই ভালো লাগছে না। ভেবেছে বাইরে এসে ঘুরলে বোধহয় অস্থিরতাটা কমবে। কিন্তু না। আরো বেশি অস্থির লাগছে। বার বার মনে হয় কিছু একটা ঘটতে চলেছে আজ। যা ওর অবচেতন মন বলতে চাইলেও মতিষ্ক বুঝতে পারছে না।

আর ওদিকে রিদামের মাথায় যেন আগুন জ্বলছে। ইচ্ছে করছে তুরকে কুঁচিকুঁচি করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। ৩ বছর ধরে ওর পিছে পরে আছে। কোনদিন কোন মেয়ের পিছনে এতটা টাইম দেওয়ার কথা ভাবেনি। কিন্তু এই মেয়েটা? এতদিনে কাছে যাওয়া তো দূর হাত ধরার পর্যন্ত সুযোগ পায়নি। ড়্রিংক করে এতবার মাতাল হয়েছে কিন্তু নিজেকে এমন ভাবে সামলেছে তা বলার মত না। কথায় আছে না, ” যাতে মাতাল তালে ঠিক। ” সেরকম কিছু মনে হয় ওকে। মাঝে মাঝে তো মনে হয় তুর ইচ্ছে করেই বেশি ড্রিংক করে না বাইরে। আর না ওদের সাথে রাতে বেশিক্ষন থাকে। যেদিন ওকে বেশি ডিপপ্রেস লাগে সেদিন বাইরে থেকে ড্রিংক বাসায় নিয়ে যায়। বাবা -মায়ের অবাধ্য তাই কী বলবে না বলবে তা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। তবুও রিদাম ওর পিছে পরে আছে শুধুমাত্র টাকার লোভে। কোনভাবে ওকে কব্জা করে বিয়ে করতে পারলেই কেল্লাফতে। সেই ইচ্ছায় ও বসে আছে। কিন্তু কিছুতেই তুরকে রাজি করাতে পারছে না। আর ওকে প্রেসার দিতেও পারছে না। তাহলে ওর লস। এখন যা পায় তাও পাবে না। তাই অতিরিক্ত লোভের আশায় তাতি নষ্ট করতে চায় না। ঠান্ডায় মাথায় তুরের সব কথা শোনার চেষ্টা করে।

এইসব ভেবে আবার সিগারেট বাড়িয়ে দেয় তুরের দিকে। তুর সিগারেট টা নিতে গিয়েও নেয় না।

—- ” কী হল? ”
—- ” ইচ্ছে নেই। ”
কথাটা শুনে ভ্রু কুচকায় । তুরের এরকম অনীহার কারন খুজে পায় না।

_— ” কেন? ”

খানিকটা উদাসীনতা নিয়েই না বলার মত করে বলল,
—- ” এমনি। ”
রিদাম কিছুটা ভেবে, ” আচ্ছা তাহলে ক্লাবে চল। মুড ফ্রেশ হয়ে যেতে পারে। ”

—- ” নাহহ। কোথাও যেতে ভালো লাগছে না। ”
—- ” তাহলে.. ”
—– ” আমাকে বাসায় দিয়ে এসো। আমি বাসায় যাব। ”

রিদাম কিছু বলতে যাবে তার আগেই একটা কল এলো। কল আসতেই ও অন্যদিকে চলে গেল। কথা শেষ করে এসে বলল,
—- ” আচ্ছা ঠিক আছে। তোমাকে বাসায় দিয়ে আসছি। ”

তুর আর কথা বাড়াল না। রিদাম বাইকে উঠে বসে হেলমেট পরতেই তুর উঠে বসল। বাইকে স্টার্ট দেওয়ার আগে রিদাম বলল,

_—- ” বাসায় ফিরতে অনেক টাইম লাগবে তাই না। ”

—– ” কেন? ” গম্ভীর গলায়।

_— ” আসলে আমাকে একটু যেতে হবে। আমি তোমাকে ওখানে গিয়ে গাড়িতে তুলে দিলে ম্যানেজ করতে পারবে। ”

তুর কিছুক্ষন ভেবে বলল,
—– ” এত কষ্ট করতে হবে না। তুমি যাও আমি নিজেই যেতে পারব। ”

বাইক থেকে নেমে গেল। রিদাম কিছু বলতে যাবে তার আগেই একটা সিএনজি ডেকে তাতে চড়ে বসল। রিদামকে আর কথা বলার সুযোগ দিল না। বড্ড বেশি বিরক্ত লাগছে রিদামের সাথে কথা বলতে। তখন থেকে যাওয়ার কারন খুঁজছিল। রিদাম যাওয়ার কথা বলাতে আর সময় নিল না। আর তুরের ওমন বিহেভে রিদামের রাগটা যেন আরো বেড়ে গেল। রাগে গজগজ করতে করতে ও চলে গেল।

তুর সিএনজির দরজার সাইডে মাথা দিয়ে বেখেয়ালী ভাবে বাইরে টা দেখছিল। কী ভাবছে বলতে পারবে না। তবে কিছু একটা ভাবছে।
সিএনজি ড্রাইভার তুরকে কোথায় যাবে জিজ্ঞেস করলে তুর আপনমনে তোয়ার বাড়ির ঠিকানা বলে। সিএনজি ড্রাইভার তুরকে তোয়ার বাড়ির সামনে এনে দেয়।

—- ” আফা আইসা পরছি। ”

ড্রাইভারের কথায় ঘোর ভাঙে তুরের। ও বাইরে তাকাতেই রেগে যায়।
—– ” আপনি এখানে নিয়ে এলেন কেন? ”
—- “ আপনি তো বললেন। “
—_- ” আমি বলেছি মানে… [ কিছুটা থেমে যায়। বেখেয়ালে বলেছে হয়ত। ] ”

—- ” আফা। কি করমু? অন্য কোথাও নিয়া যামু? ”

তুর বলতে ধরে নিয়ে যেতে। আবার কি মনে করে থেমে যায়। বাড়িটার দিকে তাকাতেই দেখে সাজানো।
—– ” লাগবে না। আমি নেমে যাচ্ছি। ”

তারপর তুর নেমে লোকটাকে ভাড়া মিটিয়ে দেয়। তারপর কিছুক্ষন গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে দরজার ভিতর প্রবেশ করে। কিন্তু কি মনে করে আবার বেড়িয়ে যেতে নিলেই কেউ এসে আটকে দেয়। পিলে চমকে উঠে তুরের।
—– ” কিরে চলে যাচ্ছিস কেন? ”

পিছনে তাকিয়ে দেখে তোয়া। বেশ ইতস্তত হয়ে পরে। তারপর বেশ ঝাঝালো কণ্ঠে বলে,
—– ” ভুল করে এসেছি। চলে যাচ্ছি। ”

আলত হাসে তোয়া।
–_- ” ভুল করে যখন চলেই এসেছিস তাহলে থেকে যা। ”

চুপ করে আছে। থাকতে ইচ্ছে করছে। কোথাও তো শান্তি পাচ্ছে না। এখানে এসে যদি একটু শান্তি পায়। দেখতে ক্ষতি কী? কিন্তু বাধছে কোথাও তোয়াকে বলতে। সেটা তোয়া বুঝল।
—- ” প্লিজ আয়। আমার এমনিতে কেমন লাগছে। জানি তোর ভালো লাগবে না। তবুও প্লিজ… ”

—– ” আচ্ছা। কিন্তু আমাকে এই ড্রেসে দেখলে….” রাগী কন্ঠে।

তোয়া খুশিতে গদগদ হয়ে দ্রুত বলে উঠল,
—- ” আমি তোর ড্রেস আনিয়ে রেখেছি। ”

ভ্রু কুচকালো তুর।
—- ” না মানে… আমি একটা ড্রেস আনিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা ফিট হয়নি। তোর হয়ে যাবে। ”

তুর কোন রিয়েক্ট করল না। সামনে হাটতে শুরু করল।
_— ” আমি জানি তুর। তুই নিজেকে খারাপ প্রমান করার জন্য উঠে পরে লেগেছিস। সবাই তোকে খারাপ ভাবুক তাই তুই চাস। আর এইজন্য এতকিছু। তুই এখনি পুরোপুরি নিজেকে বদলাতে পারিস নি। কোথাও না কোথাও আগের সে তুর রয়েই গেছে। ”

তোয়া তুরকে নিয়ে নিজের রুমে যায়। তুরকে পরার জন্য হলদে-কমলেটে রঙের একটা ল্যাহেঙ্গা দেয়। যা দেখে তুরের মাথা গরম হয়ে যায়। ও মেয়েদের কাপর পরা কবে ছেড়েছে মনে নেই। ও কিছু বলবে তার আগেই তোয়া বলে, ” প্লিজ না করিস না।।আমার অন্য ড্রেস তোর মাপের হবে না। প্লিজ। ”

তুর আর না করল না। ওয়াসরুমে গিয়ে হালকা শাওয়ার নিয়ে ল্যাহেঙ্গা পরে কিছুক্ষনের মধ্যে বেড়িয়ে এলো। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই যেন কোথাও হারিয়ে গেল। অনেকদিন পর নিজেকে এরুপে দেখছে। অদ্ভুত লাগলেও কেন জানি রাগ লাগছে না। তোয়া ওকে সাজাতে আসলে,
—- ” এটা বেশি হয়ে যাচ্ছে। ”

আলত হাসে তোয়া। কিছুবলে না। জানে এখন কিছু বললে রেগে যাবে। যেহেতু তুর ওমনিতেই ফর্সা তাই আর তেমন কিছু দিল না। শুধু চোখে গাঢ় কাজল আর ঠোঁট হালকা ভিজিয়ে দিল। চুল গুলো ফুলিয়ে ছেড়ে দিল কার্ল করে।হালকা অনামেন্ট পরিয়ে দেয়। তুরের রাগ লাগছে কিন্তু না করতে পারছে না। সাজানো হয়ে গেল তোয়া খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
—- ” কেমন লাগছে? ”
—- ” একটু বেশি বাড়াবাড়ি। সং সাজানো হচ্ছে। ডং যতসব। ”

বলেই বেড়িয়ে যায় তুর। এটা দেখে তোয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।
—– ” তোর তীব্র এখানে আছে তুর। আমি জানতাম তুই আজকে আসবি। আমি চাই ভাইয়া তোকে এই রুপে দেখুক যে রুপে সে তোকে চায়। ভালোবাসার রুপটাই না হয় আগে দেখুক। ঘৃনার পার্ট পরের জন্য তোলা থাক। ”
——————————★—————————-

এদিকে তীব্র তাইয়্যানকে কোনভাবেই সামলাতে পারছে না। পার্টিতে এসে যেন বাদরের বড় ভাই হয়ে লাফাচ্ছে। বার বার শান্ত করার চেষ্টা করলেও হচ্ছে না।

—– ” এরকম বাদর ছানার মত লাফাচ্ছ কেন? ”
—- ” বাদর ছানা তাই। ” খিলখিলিয়ে হেসে। তীব্র বুঝল ছেলের হাসির মানে। অপমান ওকে নয় নিজেকে করেছে।
—– ” পাপাই…..এমন করো না। তুমি বরং খেয়ে নেও। তোমার ক্ষিদে পেয়েছে। ”
—- ” না পায়নি। আমি তোমার মত না। ”
—- ” তাইয়্যান। ” চোখ গরম করে।
—- ” আজব। না পেলে মিথ্যে বলব। ”
—- ” তাও ঠিক। আচ্ছা তাহলে ওদের সাথে খেল। নাহলে তোমার পিচ্চি লাল ডলের সাথে খেল। ”

তীব্রের কথায় ও তীরের দিকে তাকায়। লাল ফ্রক পরে আছে।
—– ” ওর সাথে কি খেলব? খেলতে গেলেই খামচি দেবে? ”
—– ” আচ্ছা। তুমি তাইলে আদর করে দিও।”

তাইয়্যান কিছুক্ষন ভাবল। ” আচ্ছা ” বলেই দৌড়। তীব্র ওর দৌড় দেখে হেসে দিল।

—– ” যাক বাবা সামলানো গেল। কিন্তু যা বুঝলাম কষ্ট করে আর ছেলের বউ আর খুঁজতে হবে না। ” বলেই হেসে উঠে। তারপর চলে গেল এতদিন সবার সাথে দেখা করতে।

ওদিকে , তাইয়্যান দৌড়াতে দৌড়াতে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পরে যায়। যার সাথে ধাক্কা খায় সেও। তখনি তাইয়্যানের উপর মানুষটি চেচিয়ে উঠে।
—- ” এই কে রে? বিনা মেঘে বজ্রপাত করলি? ”

তাইয়্যান উঠে দেখে পাটকাঠির মত চিকন একটা মেয়ে। মেয়েটি অন্য কেউ নয় তুর। পার্টিতে একপাশে দাঁড়িয়ে মুখে “সেন্টার ফ্রেশ” চিবোচ্ছিল। পার্টিটা তায়ানের বাড়ির বাগানে করা হয়েছে। তাই উল্টো দিক থেকে দৌড় দেওয়ার ফলে নিজে তো পরেছে সাথে তুরকেও।

—- ” এই পিচ্চি এটা কি অলিম্পিকের ২০০ কি. দৌড় প্রতিযোগিতার ময়দান যে টেম্পুর মত দৌড়াচ্ছিস। মানুষ দেখে চলতে পারিস না।”

তুরের কথায় তাইয়্যানও রেগে যায়।
—_ ” এরকম তাল পাতার সিপাহির মত মানুষকে কেউ চোখে দেখে। ”
—- ” এই কি বললি? ” বেশ রেগে।
— ” শুনতে পাও না নাকি কাঁলা। ”
—- ” অসভ্য ছেলে। কানের নিচে একটা দিলে বুঝবি। একে তো ফেলে দেওয়া। তারউপর আমাকে ইনস্লাট হচ্ছে। ”
—– ” আমার বয়েই গেছে। ”
প্রচন্ড রেগে যায় তুর।
—– ” দেখ। ভালভাবে বলছি… ”
—– ” না শুনলে কি করবে? খামচি দেবে? দিলে দেও। তুমি খামচি দিলে আমিও ছেড়ে দেব না। ”
—- ” হ্যা, তাই দেব। কি করবি তুই? ”

—– ” শোন। মাথাটা একটু নিচে নামাও। তারপর বলছি। ”
হাত দিয়ে ওকে মাথা নিচে নামাতে ইশারা করল। তুর কিছুটা ভ্রু কুঁচকালো। কিন্তু ছেলেটা কি করবে তা জানার ইচ্ছে হলো। তাই ও ইতস্তত হয়ে বসে পরতেই তাইয়্যান বাবার শেখানো যুদ্ধে জেতার অব্যর্থ অস্ত্র হিসেবে তুরের গালে কিস করল। এটা দেখে ভিষন চমকালো তুর। ও ভ্রু কুঁচকে তাইয়্যানের ‍দিকে তাকিঁয়ে বলল,
—- ” এটা কি ছিল? ”

তাইয়্যান দুলতে দুলতে বলল,
—– ” বাবা বলেছে। গার্লসরা আদর করার জিনিস। তুমি তো গার্ল। তাই খামচি দেওয়ার কথা শুনে আদর করে দিলাম। ”

পিচ্চির মুখে কথাটা শুনেই পিলে চমকে উঠল। কারন এই কথাটা তীব্র বলত। যখন ও ভয় পেয়ে দূরে সরে যেত। তখন…
-_– ” কিহল…. ”

—- ” কিছুনা। ( বিরক্ত হয়ে। ) ” তারপর বিড়বিড় করে বলল, ” ছেলে যে আওয়ারা বাবটা না জানে কি? ওইটা তো মনে হয়…. ”

—- ” কি বিড়বিড় করছ? ”
—- ” এই যা ত যা। পাকনা পোলাপাইন। ”

ভেংচি কাটে তাইয়্যান।
—– ” খাওয়া দাওয়া করো না। বাবা খাইয়ে দেয় না। এরকম রোগা কেন? বাতাস আসলে তো উড়ে যাবা। কেমন একটা কঙ্কাল লাগছে। ”
—- ” এই শোন। আমি না ঠিক আছি। এমন হব না তো কেমন হব? ”

তাইয়্যান হাসল। তারপর বলল, ” ওইরকম। ওদের দেখতে সুবিধা। ” তুর তাকায় দেখে প্রচন্ড মোটা একটা লোক। তুর ক্ষেপে যায়। ” আমি ওরকম হব। ”

—– ” না করেছে কেউ। ওনাকে তোমার চেয়ে সুন্দর লাগে ”

—- ” তবে রে৷ ” বলেই তাইয়্যানের পিছনে দৌড় দেয়। হঠাৎ করেই তাইয়্যান পরে যেতে নেয়। তার আগেই তুর ওকে ধরে বসে পরে। আর সঙ্গে সঙ্গে তাইয়্যান ভয়ে চোখ বন্ধন করে জড়িয়ে ধরে মায়ের গলা। তুরের গলা ধরতেই তুর যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। অদ্ভুত এক অনুভূতি জাগে। যেন এই স্পর্শ ওর চেনা। খুব চেনা। অন্যরকম এক অনুভুতি জাগে তুরের মনে। এতক্ষনের ছটফটানি অস্থিরতা যেন এক নিমিষেই কোথাও মিলিয়ে যায়। তুর নিজের অজান্তেই তাইয়্যানকে দুহাতে জড়িয়ে বুকে আকরে ধরে। অতৃপ্ত স্বাদের অনুভূতি হয়।

তাইয়্যান ও যেন ওকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের অজান্তেই তুরের চোখে পানি গড়িয়ে পরল। যেন বহুল কাঙ্খিত কিছু পেয়েছে। যার অপেক্ষায় ছিল ও। ও আরো শক্ত করে তাইয়্যানকে আগলে নেয়। কিছুক্ষন পর তাইয়্যান তুরকে ছাড়িয়ে নিতে চায়। তুর প্রথমে ছাড়ে না। অন্য এক অনুভূতির স্বীকার। পরে তাইয়্যান ওকে ছাড়িয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে,
—– ” আমি ইচ্ছে করে ধাক্কা দেয়নি। সো সরি & থ্যাংক ইউ… ”

তুর আর কিছু বলতে যাবে; তার আগেই তাইয়্যান ওকে ছাড়িয়ে দৌড় দেয়। তুর ওকে ধরতে গিয়েও পারল না। ও যাওয়ার পর কান্না থামানোর মত করে নিজের হাত দেখল। যেন ওর প্রিয় কোন জিনিস ওর থেকে দূরে চলে গেল। জানেনা ছেলেটা যাওয়ার পর অস্থিরতাটা যেন বেড়ে গেল। ও আর সেখানে দাঁড়ালো না। দৌড়ে বাড়ির পিছন দিকটাই চলে গেল।

প্রচন্ড হাইপার লাগছে। এমনটা আগে কখনো লাগেনি। বুক ফেঁটে যেন কান্না করতে ইচ্ছে করছে।নেশার কারনে হয়নি। এটা বলতে পারবে। কিন্তু তবুও তার এখন কিছু করতে হবে নিজেকে সামলানোর জন্য। ও আশেপাশে দেখে। না কেউ নেই। চোখে পানি আর প্রচন্ড হাইপার হয়ে ও সিগারেট জ্বালানোর চেষ্টা করছে দেয়ালের দিকে ফিরে। কিন্তু জ্বলছে না। কান্না আর বিরক্তি উভয় মিশে তুর প্রচন্ড ভাইলেন্ট হয়ে গেছে। হাত-পা প্রচন্ড কাঁপছে। লাইটার জ্বোলেও জ্বলছে না। শেষমেষ অনেক পর লাইটার জ্বালায় কিন্তু সিগারেট জ্বলানোর আগেই কারো পায়ের আওয়াজ পায়। হঠাৎ হাইপার হয়ে চমকানোর কারনে দু’একটা ঢোক গিলল। বুঝতে পারল পাতার মরমর শব্দের পায়ের আওয়াজটা এদিকে আসছে। ও দ্রুত হাতের সিগারেট পিছনে রেখে সামনের দিকে ফেরে। সামনে থাকা মানুষটাকে দেখতেই থমকে যায়।

হঠাৎ করেই যেন পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে ওর সামনে। বার বার চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছে। ব্যাপারটা সত্যি না মিথ্যে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। তাই বারবার অবচেতন মন চেতন মনের অজান্তেই চোখের পলক ফেলছে। মানুষটা যতটা না কাছে আসছে ততই যেন নিশ্বাসের গতিবেগ বেড়ে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে হৃদয়ে লুকানো ধুকপুকানি, এতদিনের জমানো অস্তিরতা, ভয় , ভয়ংকর আবেগ আর …… না বোঝা অদ্ভুত হাজারো কিছু অনুভূতি। যা নিজের ভিতর দাফন করা ছিল।

মানুষটি আসতে আসতে কখন যে ওর একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তা বুঝতেও পারে না । দুজন-দুজনার মুখোমুখি। একে-অপরের দৃষ্টি ‍নিজের মাঝে আবদ্ধ করে রেখেছে দুজনেই। গভীর দৃষ্টিতে দুজনেই এক ভাবে তাকিয়ে আছে দুজনের চোখে। একজনের চোখে একরাশ নেশামিশ্রিত প্রগাঢ় ভালোবাসার রাগ, অভিমান , নেশা আর সামনের মানুষটাকে কাছে পাবার সীমাহীন সমুদ্রের ন্যায় প্রবল আকুতি। প্রতিক্ষিত মানুষটিকে কাছে পাবার তাড়না এতটাই গ্রাস করেছে তাকে যে অতীতের সব বিষাক্ত স্মৃতি আর বর্তমানের দূরত্ব সব ভুলে তার দিকে বাড়িয়ে ‍দিল নিজের ভালোবাসার কম্পিত হাত। স্পর্শ করল তার গাল। এতদিন পর সেই চেনা স্পর্শে তুরের মাঝে বিদ্যুতের বেগের মত কম্পন সৃষ্টি হয়। না চাইতেও কেন জানি বন্ধ হয়ে যায় চোখ গুলো। মানুষটির নিশ্বাস ওর মুখে পরতেই শিহরিত হয় ও। নিশ্বাস যেন থাকতে চাইছে না শ্বাসযন্ত্রে। বেড়িয়ে আসতে চাইছে। বাতাস এতটাই ভারী হয়ে পরেছে, কষ্ট হচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য শ্বাস নিতে। তুরের মনে হচ্ছে এত কষ্টে নিশ্বাস না নিয়ে মরে যেতে। পিছনে লুকিয়ে রাখা সিগারেট কখন পরে গেছে জানা নেই। সামনের মানুষটির হাত ওর পুরো চেহারা যেন দখল করে নিয়েছে। তার বুড়ো আঙ্গুলেন ছোয়া নিজের বাম চোখের কোনে অনুভব করতে পারছে। পানি পরছে দু‘চোখ বেয়ে । হ্যা কাঁদছে তুর। নিজের অজান্তেই তার চোখ গুলো বেহায়ার মত পানি ফেলছে। সত্যি আজ নিজেকে বেহায়া মনে হচ্ছে । কিন্তু কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। শুধু কাঁপছে । এভাবে মানুষটির সাথে কখনো দেখা হবে ভাবেনি । কাঁপাকাঁপা ঠোঁটে শুধু এতটুকুনি উচ্চারন করতে পারল,

—–“ তীব্র…”

আর কিছু বলার সুযোগ পেল না তুর। তার আগেই তীব্র ওকে টেনে নিজের বুকের মাঝে নেয়। একহাতে পিঠ জড়িয়ে আরেকহাতে মাথাটা শক্ত করে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরে। জানে তার তুর বড্ড বেশি অভিমানি, জেদি, ছেলে মানুষী। অবশ্যই এতদিন পর ওকে ছাড়াতে চাইবে। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইবে ওর থেকে। কিন্তু তার আগে তীব্র নিজের জমানো আবেগটাকে মিটিয়ে নিতে চায় একার্থক ভাবে। তুরের অভিযোগ না হয় পরে শুনবে।

তীব্র আরো শক্ত করে জড়িয়ে নেয় ওকে। তুর কি করবে বুঝতে পারে না। তীব্রের আকস্মিক আগমন এখনো স্বীকার করতে পারেনি ওর মতিষ্ক। সব কিছুই যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে, না দুঃস্বপ্ন । ঘুম ভাঙ্গলেই হারিয়ে যাবে। নেশা না করেই মাতাল লাগছে নিজেকে। তীব্রকে আকড়ে দেওয়া বা ছাড়িয়ে নেওয়া কোন কিছুই যেন তার মতিষ্কের বোধগম্য হচ্ছে না।

তীব্র ওকে জড়িয়ে কানের ছিদ্রের পাশে গভীরভাবে ঠোঁট ছোয়ালো। তুর হালকা নড়ার চেষ্টা করতেই ওর আবেগময় ভালোবাসার গভীরে প্রবেশ করল। সবকিছুর উর্ধ্ধে গিয়ে তুরের অধরে ভালোবাসা একে দিল। দুজনেই অদ্ভুত মোহনীয় মায়ায় ডুবে রয়েছে। তীব্র এত বছর পর তুরকে কাছে পেয়ে ভুলে গেছে নিজের অভিমান। আর তুর নিজের রাগটা ভেবে পাচ্ছে না। এত বছর পর ভালোবাসার হালকা ছোঁয়াও যেন হিতাহিত জ্ঞান ভুলিয়ে দিতে পারে। পরবর্তী‍‍ সময়ে কী হতে চলেছে তার কোন খেয়াল না দিয়ে।

দুজনের মধ্যকার পিনপতন নিরবতা কাটিয়ে তীব্র মুখ তুলে তুরের চোখের দিকে তাকিয়ে ,আলত ভাবে ঠোঁট ছোয়ায় ওর ভেজা চোখে। তুর বড় বড় শ্বাস ফেলে কিছুক্ষন ওভাবেই তীব্রর বাহু বন্ধনে থাকে। চোখ এখনো বন্ধ। এতক্ষন পর যেন বুঝতে পেরেছে, যা ঘটেছে তা ওর অবচেতন মনের খেয়াল নয়। ওর সামনে সত্যি তীব্র। এই ছোয়া , এই অনুভূতি ,এত আবেগ না মিথ্যে , না কল্পনা। সবটাই বাস্তব। এতক্ষন পর ও চোখ মেলে। আস্তে আস্তে তাকায় তীব্রের চোখের দিকে……..
🖤
🖤
🖤
🖤
🖤
🖤
🖤
🖤
[ বাকিটা পরের পর্ব গুলোতে জানবেন ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here