“প্রেমে পড়া বারণ”
পর্ব ৪
রমিলা আর জলিল অনেক দিন পর আবার এক সাথে বেরাতে বেরিয়েছে।আজ জলিল ওকে কোথায় নিয়ে যাবে সেটা বলছে না, এটা একটা চমক হিসেবে রেখেছে। খুব আনন্দ আর উত্তেজনার মাঝে ঘর থেকে তারা বেরিয়ে পড়ল।
দুজনার চোখে-মুখে অনাবিল হাসি।
তিন তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঐন্দ্রিলা মুগ্ধ হয়ে দেখছে ওদের। ভালোবাসার কি অদ্ভুত সুন্দর এক প্রতিচ্ছবি।
রমিলা মেয়েটার জন্য ঐন্দ্রিলার অনেক মায়া। অনেক ছোট বয়স থেকেই ওদের বাড়ীতে আছে। কাজকর্মে সে যেমন পটু তেমনি বাড়ীর সবার মন বুঝেও চলতে পারে। ওদের বাড়ীর নাড়ি-নক্ষত্র সবই রমিলার নখদর্পনে।
ঐন্দ্রিলার মা মিসেস জেরিন বানু একটা চ্যারিটী এনজিও নিয়ে সারাদিন ভীষণরকম ব্যস্ত থাকেন। রেইপ ভিকটিমদের পুনর্বাসন করাই সেই এনজিওটির মূল কাজ।
খুবই মহৎ একটি উদ্দেশ্য।
ঐন্দ্রিলা আর ঐশীকেও তিনি মাঝে মাঝে নিয়ে যান তার কাজে স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবে।
অসম্ভব ধনী পরিবারগুলোর বড় সমস্যা হলো, এদের ছেলেমেয়েরা একটা Bubble- এ বড় হয়।আশেপাশের আর্থসামাজিক সমস্যাগুলো কিছুই ওদের যেন স্পর্শ করে না।
এটা সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য।
তবে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নতশীল একটি দেশে সেই আর্থসামাজিক বৈষম্য আরও বেশি প্রকট।
মিসেস জেরিন বানু আশা রাখেন ভবিষ্যতে তার মেয়েরাও যেন সহানুভূতিশীল ভাবনা নিয়ে বড় হয় আর সামাজিকভাবে তারা যেন সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
ঐন্দ্রিলার আজ তন্ময়ের সাথে দেখা করার কথা।
প্রথম দেখা দীর্ঘ সাত বছর পর।
এর মাঝে ওরা দুজন কৈশোর পেড়িয়ে বিশের কোঠায় পা রেখেছে। ঐন্দ্রিলা এখন চোখে কনটাকস্ পরে। ভাড়ি চশমাটি শুধু বাসার জন্য, রাতের বেলা চশমাটা পরতেই ভালো লাগে তার। সে দেখতে আরও অনেক সুশ্রী হয়েছে। চোখের ঘন পল্লব আর দীঘল কালো রেশমের মতো চুল।তাকে দেখায় পারস্য দেশের রাজকুমারীর মতো।
ঐন্দ্রিলা বুঝতে পারছে না সে কি ধরনের কাপড় পর্বে আজ?
এ পর্যন্ত সে কখনও ফরমাল কোনো ডেইটে যায়নি।জিন্স -টপ্স , কামিজ সেট না কি শাড়ী ?
তন্ময় তো অনেক বছর ধরে লন্ডনে স্থায়ী হয়ে গেছে।শাড়ি পরে গেলে আবার ‘ক্ষ্যাত’ ভাবতে পারে।
রূপসাকে ঐন্দ্রিলা কিছু জানায়নি। নইলে ওর মতামত নেওয়া যেতে পারতো।
শেষ পর্যন্ত সাদা রঙের আড়ংএর মসলিনের কামিজ সেটটা পরবে ভাবল। সকাল থেকে ভীষণ একটা উৎকণ্ঠা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে।
এরকম তো কখনই হয় নি আগে ।
প্রথম কে কথা বলবে ?
কি বলবে ?
তন্ময় বলেছে বিকেলে চারটার দিকে ঐন্দ্রিলাকে এসে নিয়ে যাবে।
কোথায় নিয়ে যাবে, তা সে গোপন রেখেছে। কিছুই বলছে না, বলেছে সারপ্রাইজ।
ঐন্দ্রিলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, ঠিক তখন কলিং বেল বেজে উঠলো। ঐন্দ্রিলার হৃদকম্পন শুরু হল…. তন্ময় এসেছে নিশ্চয়ই ! সে দৌড়ে তার ঘরে গিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে নিলো একটু।
সব পরিপাটি আছে তো ?
চোখের কাজলটি কি আরও একটু গাঢ় করবে ?
হাল্কা গোলাপী রঙের লিপস্টিকটাই বেশী মানায় ওকে। চুল আরেকবার ব্রাশ করে নিলো।
কাজের বুয়া দরজা খুলেছে।
ঐন্দ্রিলা অপেক্ষা করে আছে। বুয়া এসে জানাল , মাছওয়ালা এসেছিল, কিন্তু যেহেতু রমিলা বাড়ীতে নেই তাই পরে আসবে।
ধ্যাঁত মাছওয়ালা !
ঐন্দ্রিলার এখন ভীষণ অস্থির লাগছে, ঘড়ি দেখলো, চারটা বাজতে ৫ মিনিট। ঐন্দ্রিলার মোবাইল বেজে উঠল, সেল্স কল,
‘এক মাস কল রেট অর্ধেক যদি আরও একটা ফোন কানেকশন নেয়’।
উফ্ ! আর ধৈর্য পরীক্ষা করবে ?
কেন যে এইসব ফালতু ব্যাপার গুলো হচ্ছে!
তন্ময় হাঁদারামটার সকাল থেকে কোন খবর নেই ।
আসনেই আসবে তো আজ ?
না কি লাস্ট মিনিটে পিছ পা হয়ে গেল?
আবার বাড়ীর কলিং বেল বাজছে ! এইবার হয়তো দুধওয়ালা এসেছে, কে জানে ?
ঐন্দ্রিলা নিজে গিয়েই দরজা খুললো।
সামনে প্রায় ছয় ফুট লম্বা একজন সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে , পরনে হাল্কা নীল রংএর সার্ট আর জিন্স প্যান্ট।
—ওমা তন্ময় কবে এতো হ্যান্ডসাম হল !
ঐন্দ্রিলা মুগ্ধ চোখে দেখছে আর মনে মনে ভাবছে।
ঐন্দ্রিলা একটা ঘোরের ভেতর চলে গেল। অনেক কষ্টে সে হাসিহাসি ভাব করার চেষ্টা করলো কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুচ্ছে না, আর তার গলা শুকিয়ে আসছে।
তন্ময় ঐন্দ্রিলার দিকে অপলক তাকিয়ে।
—কেমন আছ ঐন্দ্রিলা ? অনেক দিন পর দেখা, তাই না ?
—হুম !
ঐন্দ্রিলা অস্ফুটস্বরে বললো, আর মাথা নাড়ল।
—যা ভেবেছিলাম, তুমি দেখতে আরও অনেক বেশি সুন্দরী হয়েছো।
তন্ময় কথা বলে চলেছে, কিন্তু ঐন্দ্রিলা আজ নির্বাক ।
ঐন্দ্রিলা ওকে ঘরে আসতে বলতেও ভুলে গেছে।
—তুমি কি রেডি ? চলো যাওয়া যাক।
তন্ময়রে কথায় ঐন্দ্রিলার ঘোর কাটলো। সে তাড়াতাড়ি করে ওর ব্যাগটা নিয়ে এলো। তারপর তারা দুজন বেরিয়ে পড়ল।
লিফটে দুজন মুখামুখি দাঁড়িয়ে । ঐন্দ্রিলা আঁড়চোখে লিফটের আয়নায় আরেকবার তন্ময়কে দেখে নিলো।
—ইস্ ! সিং মাছ কিন্তু ভীষণ হ্যান্ডসাম হয়ে গেছে !
গাড়ীতে উঠবার সময় তন্ময় নিজেই এসে গাড়ীর দরজা খুলে দিল।
—বাহ্ কি জেন্টলম্যান !
ঐন্দ্রিলা লাল হয়ে গেল লজ্জায়।
গাড়ী ছুটে চলেছে গুলশান ছাড়িয়ে ঢাকা শহরের পথে।
দুজন পাশাপাশি বসে ….
অনেক কথাই মনে আসছে , কিন্তু কেউ কিছু বলছে না, চুপচাপ ।
রেডিও ফূর্তিতে আবহ সংগীত মৃদু সুরে অর্নবের একটি গান বাজছে,
“ভালবাসা তারপর দিতে পারে
গত বর্ষার সুবাস
বহুদিন আগে তারাদের আলো
শূন্য আঁধার আকাশ …”
—-বিপাশা বাশার
(চলবে)