“প্রেমে পড়া বারণ”
পর্ব ১০ ( শেষ পর্ব )

ঐন্দ্রিলা বাথরুমে গেলো চোখ মুখ ধোওয়ার জন্য।
আয়নায় নিজের চেহারা দেখে চমকে উঠলো সে।
চোখ লাল , ফোলা ফোলা … এ কি অবস্থা করেছে চেহারার !
এভাবে কি করে যাবে কনসার্টে ?
ভাগ্য ভালো যে আদিত্য স্টেজে থাকবে।
দর্শকের মাঝে ঐন্দ্রিলাকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
ঐন্দ্রিলা ভাবছে,
—আদিত্যকে দেখার জন্যে কেন সে এতো উতলা হয়ে উঠেছে ?

অন্যদিকে রূপসা ঐন্দ্রিলার ঘরে বসে গান শুনছে।

“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা।
ক্ষনিক আলোকে আঁখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে।
ওহে হারাই-হারাই সদা হয় ভয়
হারাইয়া ফেলি চকিতে ।”

ঐন্দ্রিলা শাড়ী বদলে, কালো রঙের একটা লং ড্রেস পরে নিলো। চুল পনি টেইল করে বেঁধে নিলো । চোখে গাড় করে কাজল দিল, যতটা না দিলেই নয় ট।
একটা সানগ্লাস পরতে পাড়লে খুব ভালো হতো , কিন্তু রাতের বেলা
সেলিব্রিটীদের মত সানগ্লাস পড়লে সবাই ওকে উজবুক ভাবতে পারে। হঠাৎ ওর চোখ চলে গেল বাঁ হাতের অনামিকাতে, হীরের আংটিটা
কি ভীষণ সুন্দর জ্বলজ্বল করছে !
ঐন্দ্রিলার মনটা আবারও খুব খারাপ হয়ে গেল।
সে আলতো করে আংটি টি খুলে, ওর গয়নার বাক্সে রাখলো অনেক যত্ন করে।

—ঐন্দ্রি, আর কতক্ষণ লাগবে ? তুই কি যাবি আজ, না কি বাদ দিয়ে দিবি ?
রূপসা বিরক্ত স্বরে ঐন্দ্রিলাকে ডাকলো।

একবার কনসার্ট শুরু হয়ে গেলে তো আর হলে ঢুকতে দেবে না । এটা ওদের স্ট্রিক্ট রুলস , বলে দেওয়া আছে টিকেটে ।

ঐন্দ্রিলা আর রূপসা তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যাচ্ছিল, এমনি সময়
ঐন্দ্রিলার বাবা ঘরে ঢুকলেন।

—কি ব্যাপার তোমরা দুজন এত রাতে কোথায় যাচ্ছ ?
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।

—আস্সালামু আলাইকুম আংকেল ! কেমন আছেন ? আমরা আসলে একটা কনসার্ট দেখতে যাচ্ছি বসুন্ধরা কনভেনশন
সেন্টারে।
রূপসা আগ বাড়িয়ে সব কথা বলল।
সে জানে, ঐন্দ্রিলার মনের অবস্থা খুবই ভালনারেবল আজ। সে কিছুই গুছিয়ে বলতে পারবে না।

ঐন্দ্রিলার বাবা বললেন,

—ও আচ্ছা, সেখানে তো ক্লাসিকাল মিউজিক কনফারেন্স চলছে সারা সপ্তাহ, তাই না ? আমার খুব ভাল বন্ধু , আলি রেজা , তার ছেলে আমেরিকা থেকে এসেছে ওদের লীড বেহালা বাদক হিসেবে । আ্যাজ এ ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট , ছেলেটা আমাদের সামনের সার্ভিস ফ্ল্যাটে উঠেছে। ইচ্ছে করে সে বাসায় উঠেনি, কারণ তাতে না কি ওর মিউজিকে কনসেনট্রেশন নষ্ট হয়ে যাবে। কি আশ্চর্য ! ছেলেটা আসলে একজন মিউজিক প্রডেজি !
রূপসা আর ঐন্দ্রিলা একে অপরের দিকে অবাক হয়ে তাকাল ।

ঐন্দ্রিলা ভাবল,

—পৃথিবী টা আসলেই কি ছোট। নইলে বাবা কি রকম কাকতালীয় ভাবে আদিত্য সম্পর্কে আগের থেকেই সব জানেন। আর বেচারী রূপসা ‘অপারেশন বেহালাবাদক প্রজেক্ট’ বানিয়ে তুলকালাম কান্ড করেছে !
ঐন্দ্রিলা মনে মনে একটু হাসলো।

—ওকে ঠিক আছে তাহলে তোমরা যাও । সাবধানে থেকো। জলিল ড্রাইভার কে নিয়ে যাও।
ঐন্দ্রিলার বাবা বললেন।

রমিলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলো, বড়ো আপা আর ওনার বান্ধবীকে নিয়ে জলিল ড্রাইভার বেরিয়ে গেল।

আহা! সে যদি ওদের সাথে বাইরে যেতে পারতো।
আহারে কি কপাল ওর ! এখন রাতের খাবার টেবিলে সাজাতে হবে সবার জন্য …… কত কাজ।
সে ঠিক করলো, জলিল কে বিয়ে করলে তারা প্রতিদিন বাইরে বেড়াতে যাবে।

গাড়ীতে উঠেই রূপসা বলল ,

—জলিল, একদম জোড়সে চালাও ভাই , আমাদের অনেক লেট হয়ে গেছে।

জলিল ড্রাইভার যেন একদম উড়ে উড়ে বসুন্ধরা কনভেনশন
সেন্টারে চলে এলো।
গাড়ী থেকে ওরা যখন নামল, তখন বাজে ৮টা বেজে ১৫ মিনিট।

—ইস্ ! একটুর জন্য মিস হয়ে গেলো ! ঐন্দ্রি , চল ফিরে যাই । অনেক দেরী হয়ে গেছে আজ । আই গেস ইট ওয়াজ নট মেন্ট টু বি !

রূপসা ভেতরে যেতে চাইলো না আর।
কিন্তু ঐন্দ্রিলা নাছোড়বান্দা ।

—প্লিজ একটু ভেতরে গিয়ে দেখি চল। হয়তো ওরা কনসিডার করতেও পারে ।

~~~##~~~

তন্ময় ঘরে এসে চুপচাপ বসে আছে আর ব্যাকগ্রাউন্ডে গান চলছে।কোল্ড প্লে -এর ‘ফিক্স ইউ ‘….
“When the tears come streaming down your face
When you lose something you can’t replace
When you love someone but it goes to waste
What could it be worse?
Lights will guide you home
And ignite your bones
And I will try to fix you ….”

তন্ময় ঐন্দ্রিলাকে ছাড়া কখনও আর কাউকে এত গভীর ভাবে ভালবাসে নি। ছোট খাট ক্রাশ যে হয়নি, তা ঠিক না ।
লন্ডনে অনেক মেয়েরাই ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে , কাছে আসতে চেয়েছে। কিন্তু সেই মোটা কাঁচের চশমা পড়া মেয়েটার চেহারা কেন যেন সে কখনও ভুলতে পারে নি।
আজ এত বছর পর ঐন্দ্রিলাকে প্রপোজ করতে পেরে নিজেকে কেমন হাল্কা লাগছে। আশা করি ঐন্দ্রিলা আগামীকাল ওকে খুশী হয়ে ফোন করবে ! অবশ্য ঐন্দ্রিলা অসম্ভব ইন্ট্রোভার্ট টাইপের একটা মেয়ে ।
সে নিজে থেকে কিছু বলবে না।

তন্ময়ের দাদীমা ফোন করলেন একটু পর।

—তারপর কেমন গেল সব তন্ময় ? আমার হবু নাত বউ-এর কি আংটি টা পছন্দ হয়েছে ?
দাদীমা হেসে হেসে জিজ্ঞাসা করলেন।
তন্ময় চিন্তা করছে , সত্যি কথা বলবে না কি দাদীমা কে খুশী করার জন্য একটু বানিয়ে বলবে।

সে একটু ঘুরিয়ে বলল,
—দাদীমা , ঐন্দ্রিলা অনেক লাজুক একটা মেয়ে , সে কিছু বলতে পারেনি, কেঁদে ফেলেছিল।

—আহারে বেচারী মনে হয় হঠাৎ এরকম সারপ্রাইজ আশা করে নি। থাক ওকে একটু সময় দাও পুরো ব্যাপার টা বোধগম্য হবার জন্য।
বিয়েশাদী তো আর ছেলেখেলা নয় সোনা।
দাদীমা বুঝিয়ে বললেন।

—তোমাদের লন্ডনের ফিরে যাওয়ার ফ্লাইট কবে ? তার আগে দুই পরিবারের একটু দেখা সাক্ষাত হওয়া দরকার । তোমার মা কি জানে ঐন্দ্রিলার কথা ?
দাদীমা জিজ্ঞাসা করলেন।

—জী না দাদীমা, এখনও মা- বাবা কাউকে জানাই নি । শুধু আপনি জানেন পুরো ব্যাপারটা।

—থাক, চিন্তা করো না। আমি তোমার বাবা- মায়ের সাথে কথা বলবো আগামীকাল ।
দাদীমা তন্ময়কে আশ্বস্ত করলেন।

~~~##~~~

রূপসা বললো,

—ঐন্দ্রি, দ্যাখ! আশেপাশে কোন লোকজন নেই । আমি নিশ্চিত কনসার্ট শুরু হয়ে গেছে আর দর্শকরা সবাই বোধ হয় এখন হলের ভেতরে । চল এখান থেকে চলে যাই।

রূপসার আসলে কনসার্ট দেখার কোন ইচ্ছে নাই । তার মা তাকে ছোটকালে গানের টিচার রেখে রবীন্দ্র সংগীত শিখিয়েছেন ।
এই সব ক্লাসিকাল মিউজিক শুনলে ওর গায়ে জ্বর আসে। রূপসার পছন্দ হলো হিপহপ মিউজিক।

ঐন্দ্রিলার পিড়াপিড়িতে ওরা সামনের রিসেপশন এরিয়াতে গেল।
ব্যাজ পড়া কিছু কর্মী আর সিকিউরিটি গার্ড ওদের দিকে এগিয়ে আসলো।

—আপনারা এখন কনসার্ট হলে প্রবেশ করতে পারবেন না ।
এখন ব্যান্ড ওয়ার্ম আপ হচ্ছে । দর্শকেরা সবাই ইতিমধ্যেই আসন গ্রহন করেছেন যার যার জায়গা মত।
রিসেপসনের লোকটা রোবটের মতো বললো কথাগুলো।

—প্লিজ, দেখুন না কি করা যায় ?
ঐন্দ্রিলা বিনয়ের সাথে বলল।

লোকটার মনে হয় একটু মায়া হল ঐন্দ্রিলার কথায়।

—আচ্ছা, দেখি আপনাদের টিকেট গুলো?

টিকেট গুলো চেক করে রিসেপসনের লোকটা তার কলিগদের সাথে চাপা গলায় ফিস ফিস করে কি যেন বলল।
তারপর বলল,

—আসুন আপনারা আমার সাথে । আগে বলবেন না যে আপনারা
ভি আই পি। আমরা খুবই দু:খিত যে আমরা বুঝতে পারি নাই।

কথা বলতে বলতে তারা কনসার্ট হলের ভেতরে চলে এলো।
চারদিকে পিন ড্রপ সাইলেন্স । পুরো অরকেস্ট্রা ব্যান্ড ওয়ার্ম আপ মিউজিক বাজাচ্ছে।
রিসেপসনের লোকটা ওদের একদম সামনের সারিতে নিয়ে বসাল।
রূপসা আর ঐন্দ্রিলা বিস্ময়ে হতবাক । রিসেপসনের লোকটা নিশ্চয়ই বিরাট ভুল করেছে । কিন্তু ওরা চুপচাপ বসে রইলো।
রূপসা ভাবছে সে জলিলকে পাঠিয়েছিল কনসার্টের টিকেট কিনতে। সে কি কোন ভুল করেছে ?

ওয়ার্ম আপ মিউজিক শেষ হলে পরে আজকের কনসার্টের উপস্থাপক একে একে সব ব্যান্ড সদস্যদের সাথে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দিল। আদিত্যকে যখন পরিচয় করিয়ে দিল, দর্শকেরা দাঁড়িয়ে জোর করতালি দিলো।

—বিলাই চোখ তো দেখি ফেমাস!
রূপসা ফিস ফিস করে বলল।

কনসার্টের শুরুতে মাইস্ট্রো স্টেজে এলো। কনসার্ট শুরু হয়ে গেল ।

আদিত্য একের পর এক বেহালায় অসাধারণ মিউজিক পরিবেশন করে চলেছে। সবই ক্লাসিকাল মিউজিক – বাক , মোজার্ট , বিটোভেন, সোপেন এর কম্পোজ করা সব অনবদ্য সুর। অবশ্য আদিত্য তার নিজের কম্পোজ করা দু’টো সুর বাজালো। ওর না কি নিজের কম্পোজ করা সুরের একক অ্যালবাম আছে বেশ ক’টা ।

ঐন্দ্রিলা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে। কি অসাধারণ সুর….কি যে সুশ্রাব্য ! পুরো ব্যাপারটা মনে হচ্ছে একটা স্বপ্ন !

এমনি সময় আদিত্য ইংরেজীতে বলল যে আজ যদিও তার একক সন্ধ্যা, প্রোগ্রামের শেষে সে শুধু একটা ডুয়েট করবে।
সে জানালো যে একজন ট্যালেনটেড পিয়ানিস্ট উপস্থিত আছে আজ দর্শকের মাঝে।
আদিত্য কনসার্ট হলের স্পটলাইট সামনের সারিতে ফেলতে বললো। তারপর ভাঙা ভাঙা বাংলা আর ইংরেজী মিলিয়ে সে বললো ,

—ঐন্দ্রিলা, দ্য বিউটিফুল লেডি ইন ব্ল্যাক ড্রেস, তুমি কি আমার সাথে পিয়ানো বাজাবে ? উইল ইউ প্লিজ ডু দা অনার টু প্লে বিটোভেন’স “ মিডনাইট সোনাটা “ ইন পিয়ানো উইথ মি
টু নাইট ?

ঐন্দ্রিলা প্রথমে ঠিক বুঝতে পারে নি কি হচ্ছে ।
আদিত্য ওর নাম জানল কি করে ?
রূপসাও বিস্ময়ে বিমূঢ় আজ ।

আদিত্য নিজেই স্টেজ থেকে নীচে নেমে এসে ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে স্টেজে
উঠলো। ঐন্দ্রিলা কাঠের পুতুলের মতো পিয়ানোর সামনে বসে রইলো। আদিত্য বেহালায় সুর বাজানো শুরু করবার কিছুক্ষণ পরে ঐন্দ্রিলা ধীরে ধীরে যোগ দিলো। শুধু বেহালা আর পিয়ানোর সমন্বয়ে সেই সুর ছিল স্বর্গীয় সিম্ফোনী ! দর্শকেরা মুগ্ধ হয়ে শুনছে।

রূপসা এখনো স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।

এক সময় যখন মিউজিক শেষ হয়ে এলো, সারা কনসার্ট হল গমগম করতে লাগল দর্শকদের মুহুর্মুহুঃ করতালিতে।

আদিত্য এসে ঐন্দ্রিলার হাত ধরলো। ঐন্দ্রিলার চোখে এখন আনন্দাশ্রু ! দর্শকের সারিতে বসে রূপসাও কাঁদছে ।

“My, immaculate dream made breath and skin
I’ve been waiting for you.”
( ডুরান ডুরান)

~~~~~~সমাপ্ত~~~~~~

–বিপাশা বাশার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here