#প্রহেলিকা
#পর্ব_৩৫
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

জেহেরের ঘুম আগে ভাঙ্গে। আড়মোড়া ভাঙতেই দেখতে পায় তার বুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে রোজ। আদুরে বিড়ালছানার মতো তুলতুলে দেহ জেহেরের বুকে অবলীলায় লেপ্টে আছে। হালকা হেসে গালে চুমু দেয়। তারপর কপালে, তারপর আবার গালে, আবার কপালে। ঘুমের মধ্যেই ইনশিতার চোখমুখ কুঁচকানো দেখতে পায় সে। একসময় অতিষ্ঠ হয়ে পাশ ফিরে ইনশিতা। রাগ হয় জেহেরের। মুখ উঁচিয়ে রোজের পাশে নিয়ে আবারও একই কাজ করে। অস্পষ্ট সুরে বিরক্তিকর আওয়াজ তুলে ইনশিতা। কানে নেয় না জেহের। নির্বিঘ্নে ছোট্ট ছোট্ট স্পর্শ বিলিয়ে দেয় সে। সুখের ছোঁয়ায় বাঁধা দেয় অ্যালার্ম নামক অসহ্য যন্ত্র।

ঘড়িতে মাত্র সাতটা। তবুও জেহের নিজের সাথে যুদ্ধ করে রোজের কাছ থেকে সরে গিয়ে গোসল করে নেয়। আজ রোজকে একটি চমৎকার খবর দিয়ে চমকে দেবে। ইনশিতাকে ডাকে। ইনশিতা উঠে না। আরো কয়েকবার ডাকে জেহের। ইনশিতা উঠব উঠব করে আবারও ঘুমের রাজ্যে পা ভাসায়।

-“দেরিতে উঠলে কলেজ যেতেও দেরি হয়ে যাবে। পরে কিন্তু আর কলেজ যেতে দেব না।”

ঘুমের ঘোরে ইনশিতা শুনেছে কথাটা। এক দুই তিন, চোখ খুলে চমকে উঠে ইনশিতা। বড় বড় চোখে তাকায় জেহেরের দিকে। লাফ দিয়ে বসে পড়ে। ঘুম চোখে বিস্ময়। জড়ানো কন্ঠে বলে,

-“কী বললেন? কলেজ?”

মাথা নাড়ায় জেহের।

-“সত্যি তো?”

-“ইয়াপ।”

আনন্দ ঝলমল করে ইনশিতার চেহারায়। মনে মনে জেহেরকে শত কোটি ধন্যবাদ জানায়। সে আবার কলেজ যাবে! স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখবে! পর মুহুর্তেই ইনশিতার নজর অজান্তে নিজের দিকে যায়। আঁতকে উঠে সে। এক সুতোও কাপড় নেই তার গায়ে। জেহেরের সামনে সে এভাবে বসে আছে! তড়িঘড়ি করে চাদর টেনে মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে ইনশিতা।

চাদর টানলেও লাভ হয় না। ইনশিতা শক্ত করে ধরে শুয়ে আছে। জেহের আর লজ্জায় ফেলে না। শুধু বলে,

-“পাঁচ মিনিট সময়। উঠে পড়ো।”

পাঁচ মিনিট বাদে জেহের এসে ইনশিতাকে আগের অবস্থাতেই দেখতে পায়। ঘুমিয়ে গেছে নাকি আবার! চাদর সরিয়ে দেখে সত্যিই ইনশিতা ঘুমিয়ে পড়েছে।

-“রোজ, কলেজ যেতে হবে কিন্তু। তাড়াতাড়ি উঠো। টাইম চলে যাচ্ছে।”

ইনশিতা ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলে,

-“হু, এই যে উঠছি।”

আরো কিছুক্ষণ টানাটানি করলো রোজকে। নাহ, উঠেনি। উপায় না পেয়ে জেহের শার্ট খুলে চাদরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ইনশিতাকে। এত শক্ত করে ধরে যে ইনশিতা ব্যথায় উহ্ করে উঠে। থেমে থেমে বিরক্ত নিয়ে বলে,

-“এইতো এখনি উঠবো। ছাড়ুন।”

জেহের শোনে না। তার চুল এখনো ভেজা। ভেজা চুলগুলো ইনশিতার গলায় ঘাড়ে ঘষতে থাকে। ঘুমের মাঝেই ঠান্ডায় কেঁপে ওঠে ইনশিতা।

-“একটু ঘুমাই। প্লিজ একটু…”

এবার জেহের ইনশিতার পেটে, পুরো মুখে ভেজা চুলের বিচরণ ঘটায়। চোখে পানি লাগতেই ঘুম আলগা হয়ে আসে ইনশিতার।

-“উঠছি তো, আর একটু…”

জেহের চাপা রাগ নিয়ে বলে,

-“কলেজে যাওয়ার দরকার নেই, ঘুম থেকে উঠারও দরকার নেই। আজ সারাদিন আমরা এভাবেই থাকবো।”

ইনশিতা না পেরে উঠে পড়ে। ভালোই বুঝতে পারছে জেহের তাকে না উঠিয়ে ছাড়বে না। চোখে মুখে বিরক্ত উপচে পড়ছে তার। বিড়বিড় করে জেহেরের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে চাদর জড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। জেহের নিজেই বিছানা গুছিয়ে ইনশিতার জামা কাপড় ঠিক করে রাখে। তারপর ইনশিতার বই, ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। এগুলো সে গতকালই এনেছিল।

.

.

নিচে নেমে ইনশিতা দেখে মিসেস জেসমিন আর আফজাল দুজনেই কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। তাদের কাছে এসে বলে,

-“আপনারা কী কোথাও যাবেন মা?”

জেসমিন মলিন দৃষ্টি মেলে তাকায়। দেখে মনে হচ্ছে কাল সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন। আফজাল নিজেই স্বাভাবিক গলায় বলে,

-“হু, থানায় যাব।”

ইনশিতা কৌতুহল নিয়ে বলে,

-“কী জন্য? না মানে হঠাৎ থানায়…”

ইনশিতার কথা শেষ হওয়ার পূর্বে জেসমিন জানায়,

-“জিহাদ কেন এমনটা করল তা জানার জন্য। তার এত কিসের ক্ষোভ ছিল যে কারণে তোমাদের ক্ষতি করতে দ্বিধা করল না। সব জবাব দিতে হবে ওর।”

কথাটি শুনে ইনশিতার নিজেরও মনে হলো একবার জিহাদের সাথে দেখা করার। তার যে অনেক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বাকি। সে একবার সিঁড়ির দিকে তাকাল। জেহের এখনো আসেনি। এই ফাঁকে বলে,

-“আমিও যাবো মা আপনাদের সাথে।”

আফজাল অবাক কন্ঠে বলে,

-“তুমি কেন যাবে? আর জেহের তো যেতে দেবে না।”

-“জানি বাবা। কিন্তু আমার যাওয়া প্রয়োজন। আমিও সব শুনতে চাই। আজকে কলেজ যাওয়ার নাম করে আপনাদের সাথে যাব।”

-“জেহের কলেজ যাওয়ার পারমিশন দিয়েছে?”

-“জি বাবা।”

আফজাল খুশি হলেন এই কথায়। তার একটুবাদেই জেহের এসে চেয়ারে বসে। ইনশিতা তার প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে বলে,

-“আপনি কখন যাবেন অফিসে?”

-“তোমাকে পৌঁছে দিয়েই যাবো।”

-“আপনি চলে যান। আমি নাহয় বাবা মায়ের সাথে যাবো। তারা একটু কোন আত্মীয়ের বাসায় যাবেন যেন।”

জেহের তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

-“আমি যখন দিয়ে আসবো বলেছি তার মানে আমিই। গট ইট?”

ইনশিতা হতাশার শ্বাস ছাড়ল লুকিয়ে। জেহের সাথে কলেজে গেলে তো থানায় যেতে পারবে না। আফজাল ইশারায় বললেন, কলেজ থেকেই থানায় যেতে।

খাবারের পর্ব শেষ করে জেসমিন আর আফজাল আগেই বের হয়ে যান। জেহের ইনশিতাকে নিয়ে তার গাড়ি করে কলেজের পথে বেরোয়। গাড়ি চালাতে চালাতে জেহের তাকে আদেশ নিষেধ মেনে চলতে বলছিল তার কথামতো। এই যেমন, কারো সাথে মেশা যাবে না তেমন, প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কথা বলা যাবে না, কোনো বন্ধু বানানো যাবে না ব্লা ব্লা ব্লা। ইনশিতা তখন অন্য ধ্যানে। মাঝপথে ইনশিতা জেহেরকে গাড়ি থামাতে বলে।

-“এখানে কী দরকার?”

-“ঐ যে, শপিংয়ে যাবো একটু।”

-“এখন কলেজ টাইম। আসার পথে নিয়ে আসবো।”

-“না না, আমার এখনই দরকার।”

-“ওকে, কী কিনবে আমাকে বলো। আনছি আমি।”

-“আপনি যান না, অফিসের দেরি হয়ে যাবে তো। আমি কিনেই ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাবো।”

জেহের চোখ রাঙিয়ে বলে,

-“একা যাওয়ার দরকার নেই। কি কিনবে বলো, আমি কিনে নিয়ে আসছি।”

-“আরে আপনি বুঝতে পারছেন না। ওটা আমাকেই কিনতে হবে। আপনি যান, আমি বললাম তো চলে যাবো। গিয়ে আপনাকে ফোন করবো কেমন?”

-“দরকার নেই।”

জেহের গাড়ি স্টার্ট দিলো। ইনশিতা তড়িঘড়ি করে জেহেরের হাত ধরে থামাল। জেহেরকে বোঝানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে বলে,

-“আপনি একটু বুঝুন প্লিজ। ইটস ভেরি ইম্পর্টেন্ট। এটা মেয়েদের পার্সোনাল। মানে, বুঝেনই তো। অ-নে-ক পার্সোনাল‌।”

জেহের রেগে গেল তা শুনে। ঝাঁঝাল গলায় বলল,

-“শাট আপ! আমার কাছে তোমার পার্সোনাল বলে কিছুই নেই। তোমার সবকিছুই…”

-“উফ, রেগে যাচ্ছেন কেন? আচ্ছা, আপনিও আসুন তাহলে আমার সাথে। আপনাকে নিয়েই শপিং করবো।”

এ কথায় শান্ত হয় জেহের। গাড়ি থেকে নেমে ইনশিতাকেও নামায়। ইনশিতা তখন ভেতরে গিয়ে মেয়েদের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। জেহের তখনো হাত শক্ত করে ধরে আছে ইনশিতার। ইনশিতাকে চুপচাপ দেখে জেহের বলে,

-“কী হলো? কিনবে না?”

ইনশিতা হাত ছাড়াতে নেয়। বিনিময়ে জেহের তাকে চাপা স্বরে ধমকায়,

-“সাহস তো কম না আমার থেকে হাত ছাড়ানোর!”

-“আমি ভেতরে যাবো।”

-“তো চলো। হাত ছাড়ানোর কী আছে?”

ইনশিতা ইশারায় দোকানটাকে দেখতে বলে। জেহের সামনে ফিরে দেখে এটা মেয়েদের আন্ডারক্লথসের শপ। এক মুহুর্ত ইতস্তত করে। গলা খাঁকরে বলে,

-“ওয়েল, তুমি যাও। আমি এখানেই আছি।”

ইনশিতা ভেতরে চলে যায়। জেহের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আড়চোখে কাঁচের ভেতর থেকেই ইনশিতাকে দেখতে থাকে। পনের মিনিট জেহের বাহিরে দাঁড়িয়ে। আশেপাশের লোকজন জেহেরকে দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে উল্টোপাল্টা ভাবছে। ইতোমধ্যে দুই একজন তাকে এখনে দাঁড়িয়ে থাকার কারণও জিজ্ঞেস করেছে। জেহের উত্তর দেয়নি। চোখমুখ শক্ত করে তাদের দিকে কঠিন দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়েছিল শুধু। তার কী দায় পড়েছে মানুষদের কাছে কৈফিয়ৎ দেওয়ার? এতে যেন লোকজন আরও বেশি সন্দেহ করছে তাকে। নিশ্চয়ই কোনো খারাপ মতলব আছে!

সেই মুহুর্তেই ইনশিতা বেরিয়ে আসে। জেহের হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। তার খুবই অসহ্য লাগছিল সকলের সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দু হতে। তবে ইনশিতা এসে তাকে আরো একটি মেজাজ গরম করা খবর দিয়ে যায়।

-“আপনাকে আগেই বলেছিলাম চলে যেতে। আমার আরও দেরি লাগবে।”

জেহের বিরক্ত হয়ে বলল,

-“হোয়াট দ্যা হেল! এতক্ষণ কী করছিলে?”

ইনশিতা মুখটাকে সিরিয়াস বানিয়ে বলল,

-“আপনি বুঝবেন না ওসব, মেয়েদের ব্যাপারস্যাপার। আর আমার একজন আপু মানে কলেজের সিনিয়র আপু আছেন আমার সাথে। ওনার সাথে আমি চলে যাবো কলেজে। পৌঁছে আপনাকে ফোন দেবো। আপনি যান।”

-“ডাকো তোমার সিনিয়র আপুকে।”

-“উনি ভেতরে। এখন আসবেন না। আপনি যান না, চিন্তা করবেন না। আপনার কী আপনার রোজের উপর ভরসা নেই?”

এ কথার পর জেহের আর একটি শব্দও করতে পারল না। শেষমেষ জেহেরকে বাধ্য হয়ে যেতেই হলো। জেহেরের যাওয়া লক্ষ্য করে ইনশিতা একটি ট্যাক্সি ধরে সোজা থানায় চলল। থানার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবল সে কী এসে ঠিক করেছে? চলে যাবে নাকি? না, এখন জিহাদ কিছুই করতে পারবে না তার। জিহাদের থেকে সমস্ত সত্যি জেনে তারপরই যাবে।

ভেতরে ঢুকে দেখল আফজাল আর জেসমিন চেয়ারে বসে আছেন। মূলত তারা ইনশিতার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সকলে মিলে চললেন দারোগার পিছু পিছু। জিহাদকে পুলিশ কাস্টাডিতে রাখা হয়েছে। আফজাল আর জেসমিন আগে প্রবেশ করেন। ইনশিতা দুরুদুরু বুক নিয়ে ভেতরে ঢুকে। একটি চেয়ারে বসে জিহাদ দুই হাত টেবিলের উপর একত্র করে মাথা নিচু করে বসে আছে। মাথার উপর হলুদ টিমটিমে আলো জ্বলছে। আফজাল আর জেসমিন সামনে রাখা দুটো চেয়ারে বসেন। ইনশিতা দাঁড়িয়ে থাকে আলো থেকে কিছুটা দূরে।

কারো উপস্থিতি টের পেয়ে জিহাদ মাথা তুলে। তার শরীর দুর্বল খানিকটা। শরীরে দুর্বলতার চেয়ে মনের দুর্বলতাই তার কাছে অধিক যন্ত্রণার। চোখের সামনে বাবা মাকে দেখেও তার ভাবান্তর হয় না। নিস্তেজ চক্ষুজোড়া মেলে অস্থির হয়ে খুঁজতে থাকে কাঙ্খিত ব্যক্তিটিকে। আলোর আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে ব্যস্ত এক মানবীকে চোখে পড়ে তার। নিমিষেই সে চিনে যায় মানবীটিকে। মৃদু হাসে সে।

জিহাদকে এমন নির্বিকার দেখে হুট করেই তার গালে চড় কষিয়ে দেন জেসমিন। তার চোখের কোল বেয়ে অশ্রুধারা অবিরাম ঝরছে। এমন পাষাণ ছেলেকে যদি তিনি মেরে ফেলার সুযোগ পেতেন তাহলে সেই কাজটি করতে দ্বিতীয়বার ভাবতেন না। জিহাদ চোখ বন্ধ করে বার কয়েক নিঃশ্বাস নিলো। এখন আর তার রাগ দেখানোর কোনো মানেই নেই। তার শুধু একটাই চাওয়া। অন্ধকারে ডুবে থাকা মানবীটিকে এক ঝলক চোখে দেখা। ছয় সাতটা মাসের মতো যে সে তার ভালোবাসাকে দেখেনি।

-“তোর মতো ছেলেকে আমার পালন করাই ভুল হয়েছিল। উচিত ছিল ছোটোবেলাই তোকে মেরে ফেলা। অন্তত তোর এমন জঘন্য রূপ দেখা থেকে বাঁচতাম। তোকে যদি একটা কুকুরের সাথেও তুলনা করা হয় না, কুকুরকে অপমান করা হবে।”

জেসমিনের চেঁচিয়ে ওঠা কন্ঠে জিহাদ রক্তচক্ষু মেলে তাকাল। রোষানলের আগুনে জ্বলতে লাগল তীব্রভাবে। আক্রোশে ফেটে পড়ল সে নিজেও।

-“কোন অধিকারে আপনি আমাকে মেরে ফেলার কথা বলছেন হা? আপনিতো আমার আপন মা নন, সৎ মা আপনি। শুনেছেন, সৎ মা। আর সৎ মা হয়েও নিজেকে কখনোই আমার নিকট আপন করে তুলতে পারেননি যার কারণে আমাকে কুকুর বলার অধিকারটাও আপনার নেই মিসেস জেসমিন চৌধুরী।”

টেবিলের উপর স্টিলের গ্লাসকে জোরে ছুঁড়ে ফেলল সে। তা দেখে দারোগা এসে দ্রুত জিহাদের হাত আর পা চেয়ারের সাথে বেঁধে দিলেন। জেসমিন চৌধুরী থমকালেন কয়েক মুহুর্তের জন্য। দৃষ্টিজোড়া তার নিবদ্ধ হলো জিহাদের ক্রোধপূর্ণ চোখে। এই ছেলেকে তিনি ছোটোবেলা থেকেই বুকে আগলে বড় করেছেন। মিতালী বেঁচে থাকাকালীন সময়েও এই জিহাদকেই তিনি পালন করেছিলেন। যে কিনা তার আঁচল ধরে ধরে ঘুরত সারাটাক্ষণ আজ সে-ই তাকে সৎ মা বলে দূরে ঠেলে দিচ্ছে! বুক ভার হয়ে এলো জেসমিনের। আফজাল জিহাদকে ধমকে উঠলেন,

-“জিহাদ! মুখ সামলাও। কাকে কী বলছো তুমি? তোমার জন্মের পর থেকেই কিন্তু জেসমিনের কাছেই বড় হয়েছ। ও তোমার আপন মা না হলেও আপন মায়ের চেয়ে কোনো অংশে কম না।”

জিহাদ তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে ফুটিয়ে চেয়ারে হেলে বসল।

-“হাহ! আপন মায়ের মতো হলেও তিনি দায়িত্ব পালন করেননি।”

-“কী দায়িত্ব পালন করেনি শুনি? এমন তো না যে জেসমিন তোমাকে সৎ ভেবে দূরে ঠেলে দিয়েছে।”

-“সেটাই ঘটেছে মিস্টার আফজাল চৌধুরী।”

-“নূন্যতম লজ্জাবোধটুকুও নেই তোমার যে বাপের নাম ধরে ডাকো? আর কবে তোমাকে দূরে ঠেলেছে? সৎ মায়ের মতো আচরণ করেছে কবে হু?”

জিহাদ এবার চোখেমুখে অজস্র ঘৃণা ফুটিয়ে তুলল। সোজা হয়ে বসে ঘৃণা নিয়েই বলতে লাগল সে,

-“বেশ! তাহলে তো আপনাদের সবটাই বলতে হয়। তাহলে শুনুন প্রথম থেকেই। মায়ের বেঁচে থাকার সময়ে আর মৃত্যুর পরেও আমি মিসেস জেসমিন চৌধুরীর ছায়ায় বড় হই। বলতে গেলে আমার মা বলতে শুধু ওনাকেই মানতাম। বুঝ হওয়ার পর থেকেও আমি কখনোই ওনাকে সৎ মা মানতাম না। ভালোও বাসতাম সবচেয়ে বেশি। কিন্তু জেহেরের অসুস্থতার পর থেকেই যেন আমার প্রতি ওনার কেয়ার সব কমে যেতে লাগল। জেহের মায়ের শোকে মানসিক রোগীতে পরিণত হয় সেটা কিছুটা বুঝতাম আমি।”

আফজাল বাঁধা দিয়ে বললেন,

-“এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। জেহের অসুস্থ ছিল তাই ওকে অ্যাটেনশন বেশি দেওয়া হতো শুধু।”

জিহাদ জবাব দিলো না। সে তার মতো বলে যেতে লাগল,

-“আমাকে আলাদা ঘর দেওয়া হলো। তারপর থেকে দেখতে লাগলাম জেসমিন চৌধুরী জেহেরের প্রতি খেয়াল রাখছেন বেশি। তার খাওয়া হলো কিনা, গোসল করলো কিনা, কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা আরো অনেক কিছু। যেগুলো আগে আমারও ক্ষেত্রেও করতেন। তবে তা যে কমে যেতে লাগল তা আমি বুঝতাম ধীরে ধীরে। আমাকে খাবার খাইয়ে দিতেন খুব কম, আগে আমার কাছে ঘুমিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। সেটা আর করছিলেন না তিনি। মাঝে মধ্যে আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম এই বুঝি মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবেন। কখনো তো দরজার কাছেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। জেবা আসার পরও তেমন ছিলেন। জেবা আর আমার থেকে সবকিছুতেই জেহেরকে প্রাধান্য দিতেন। তাকে সবসময় জেহেরের রুমের সামনেই ঘুরঘুর করতে দেখা যেত। ছোট হওয়ায় আমিও তাই ভাবতাম যে জেহের অসুস্থ তাই তার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা হতো। কিন্তু যখন বড় হলাম তখন? জেহের নিজ দায়িত্ব নিজে তুলে নিলো। তবুও দেখতাম সবসময় উনি সেই জেহেরের পেছনেই থাকতেন জেহের যাতে তাকে আমাদের মতোই মা ডাকে। আর সবসময় খাবার টেবিলে নিজের পছন্দের খাবার পেতাম না। সব ছিল জেহেরের পছন্দের। যে কিনা কখনোই জেসমিন চৌধুরীকে পাত্তা দিতো না তার পছন্দের সবকিছু করাটা আমার কাছে জাস্ট বিরক্ত লাগত। টাকা পয়সার অভাব না থাকলেও ভেতরে ভেতরে মায়ের ভালোবাসার প্রচন্ড অভাববোধ করতাম। তখন থেকে জেহেরের প্রতি আলাদা ক্ষোভ জন্মালো। সে এত ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য মনে হলো না আমার। আমি-আমি শুধু জেহেরকে সব ধরনের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করতে চাইতাম। তাই বড় হওয়ার পর বুঝেশুনেই ওর ঔষধের সাথে একটু একটু করে ড্রাগস মেশাতাম। আর, যখন দেখলাম আমার ভালোবাসাকে সে তখন নিজের করে নিয়েছে তখন আরও বেশি রাগ হতে লাগলো জেহেরের প্রতি। সে কেন এত ভালোবাসা পাবে? আমি দুটো বছর ইনশিতাকে ভালোবেসেছি আর জেহের কিনা মাত্র প্রথম দেখাতেই ইনশিতাকে নিজের দাবি করল? মায়ের ভালোবাসা তো পেলামই না, তারপর যেখানে ইনশিতাকে সারাজীবনের সঙ্গী বানাতে চাইলাম তাকেও পেলাম না। আমার রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছিল। ড্রাগসের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিলাম। জেহেরের গার্ডসদের মধ্যে একজন থাকতো যার সাহায্যে জেহের দেশের বাইরে থাকলে তার মাধ্যমেই ড্রাগস মেশানো ঔষধ খাওয়াতাম। যাতে ও মরে যায় আর সব ভালোবাসা আমার হয়ে যায়।”

বলেই থামল জিহাদ। তার পানির তেষ্টা পেয়েছিল বড্ড। কিন্তু হাত বাঁধা তার। আর সামনে বসে থাকা দুজনকে বলা যে বৃথা তাই আর বলল না। এই যে, সামনে তার সৎ মা নামক আপন মা বসে আছেন অথচ তিনি বুঝতেই পারছেন না যে তার ছেলের গলা তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে। এতক্ষণে ইনশিতা আফজাল আর জেসমিনের চেয়ারের পিছনে এসে দাঁড়াল। জিহাদের টকটকে লাল দৃষ্টি তার মাঝেই নিবদ্ধ। আর কেউ না দেখলেও ইনশিতা ঠিকই দেখল জিহাদের চোখের কোণে ভীড় করা অশ্রুজল।

আফজাল আর জেসমিন দুজনেই থম মেরে বসে রইল। আফজাল এমনিতেও সন্তানদের বেশি সময় দিতে পারতেন না। আর জেসমিন বোধহয় জেহেরকে অ্যাটেনশন দিতে গিয়ে ভুলেই গেছেন যে তার আরও দুটি সন্তান আছে। জেবা ছোট থেকেই ম্যাচিওরড তাই তাকে নিয়ে আলাদা করে ভাবা লাগেনি। আর জিহাদ! সে যে মনে এত ক্ষোভ পুষে রেখেছে তার কোনোটাই তো অযৌক্তিক নয়। তিনি সত্যিই সবকিছুতে জেহেরের প্রাধান্য বেশি দিয়েছিলেন। সবসময়ই জেহেরের কাছে যাওয়ার বাহানা খুঁজতেন। অথচ আরেকজন যে সবসময় তারই ভালোবাসা পাওয়ার জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতো তা তিনি বুঝেও যেন বুঝেননি। অপরাধবোধে তার মাথা হেট হয়ে যেতে লাগল।

-“বসে থাকবেন না। লজ্জা থাকলে এই মুহুর্তেই উঠে যাবেন।”

তারপর আর বসে থাকতে পারেননি তারা। কোনোরকম নড়বড়ে শরীর নিয়ে জেসমিন উঠে আসেন। এখন শুধু জিহাদ আর ইনশিতা। জিহাদের দৃষ্টি এখনো ইনশিতার উপর। কত মাস পর ইনশিতাকে দেখতে পেল সে। চোখ দুটো যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। তাতে অস্বস্তিরা দানা বাঁধছে ইনশিতার শরীরে। জিহাদ নিজেই হেসে বলল,

-“এসো, বসো। তোমারও নিশ্চয়ই তাদের মতো অনেক প্রশ্ন আছে তাই না? বলো বলো, সবার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যই তো আমার আসা। হাহ!”

ইনশিতা একবার বাহিরে গিয়ে ফিরে আসলো হাতে গ্লাস নিয়ে। এনে জিহাদের সামনে রাখে। জিহাদ এতেই যেন চরম তৃপ্তিবোধ করে। এই মেয়েটা আজ তার জীবনে থাকলে ছোট বেলার সব কষ্ট ভুলে যেত নিমিষেই।

-“সাজিয়ে রাখার জন্য কী পানি এনেছ নাকি? দেখছো না আমার হাত বাঁধা!”

জিহাদ কী চায় তা সে বুঝতে পারল। ইতস্তত করতে লাগল ইনশিতা। তবুও মানবিকতার খাতিরে সে গ্লাস নিয়ে জিহাদের পাশে দাঁড়িয়ে পানি খাওয়ায়। পানি পান করার সময়ও জিহাদের নজর ছিল ইনশিতার মুখে। তৃপ্তির একটা শ্বাস নিয়ে সে বলে,

-“যাক, জীবনে অনেক কিছু পূর্ণ না হলেও এই একটা আশা পূর্ণ হলো। যাও যাও, বসো। কী কী বলবে বলো। এখানে বসে থাকতে নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে? ফ্যান আনতে বলব?”

ইনশিতা একটা কথাও বলল না। সে টেবিলের উপর চেয়ে ছিল শুধু। একবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায় জিহাদের দিকে। জিহাদ আর জেহেরের চেহারা এক হওয়ায় যে কেউ জিহাদকে জেহের বলে ভুল করবে। যেন জেহের উশকোখুশকো চুল, বিধ্বস্ত চেহারা আর রক্তিম চোখ নিয়ে বসে আছে। জেহের সেই আগের মতো হিংস্র থাকলে তাকেও রাগের সময় এমন লাগতো। ইনশিতা মনে মনে শুকরিয়া আদায় করল জেহেরকে সুস্থ করে দেওয়ার জন্য।

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here