#প্রহেলিকা
#পর্ব_২৫
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

আজ জগিং থেকে ফিরে জেহের সোজা গোসলের জন্য ঢুকে গেছে। সকাল সকাল ইনশিতা যেন অন্য এক জেহেরকে দেখছে। গম্ভীর হয়ে ছিল পুরোটা সময়, মুখে একটুও হাসির দেখা মিলছিল না। অথচ কে বলবে, গতকাল রাতে একটা বাচ্চার মতো ইনশিতাকে আগলে ধরে শতশত কথা বলেছে!

জেহেরের মোবাইল টেবিলের উপর দেখে ইনশিতার ইচ্ছে জাগল বাবাকে একটু কল করার। জেহেরের গোসল করে আসতে আবার বেশি সময়ও লাগবে না। তার মধ্যে তাড়াতাড়ি কথা বলে নিলে সমস্যাও হবে না। এমনিতে যোগাযোগের কোনো উপায় রাখেনি জেহের। তার উপর জেহেরের মোবাইল সে সবসময় কাছে পায় না। তাই আর আজকের সুযোগটা হাতছাড়া করা যাবে না।

মোবাইলের পাসওয়ার্ড ইনশিতা আগে একবার দেখে নিয়েছিল লুকিয়ে, জেহের আর তার নাম মিলিয়ে পাসওয়ার্ড দেওয়া। বারান্দায় এসে দাঁড়াল। খুলে দ্রুত ফোন করল বাবার নাম্বারে। কেটে যাওয়ার আগ মুহুর্তেই ইনশিতার বাবা কল ধরে।

-“হ্যালো। কে বলছেন?”

বাবার কন্ঠ শুনে ইনশিতার কন্ঠ রোধ হয়ে এলো। কোনোরকমে ফিসফিসিয়ে বলল,

-”বাবা!”

ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ চুপ থাকল ইনশিতার বাবা। পর মুহুর্তেই উত্তেজিত কন্ঠে বলে,

-“মা! তুই কেমন আছিস রে মা? তোর খোঁজ নেই কেন? তোর শশুরবাড়িতে কয়বার গিয়েও ফিরে এলাম। তারাও না কি জানে না তুই কোথায়। জেহের তোকে কোথায় নিয়ে গেছে?”

এখন যদি সে তার বাবাকে বলে সে এখন এইখানে বন্দী, বাবা অসুস্থ হয়ে যেতে পারে মেয়ের এই অবস্থা শুনে। হয়তো তার বাবা এসে পড়বে, যা কখনোই চাইবে না জেহের। পরে দেখা যাবে হিতে বিপরীত হয়ে গেছে। এই ভেবে ইনশিতা বলল,

-“আমি আর জেহের এখন অন্য এক জায়গায় থাকি। এখান থেকে আসলে জেহেরের অফিস খুব কাছে তো তাই।”

-“কোথায় সেই জায়গাটা?”

ইনশিতা চুপ করে রইল। সে তো জানে না আসলে তারা কোথায়। কথা ঘুরানোর চেষ্টা করল সে।

-“মা কোথায় বাবা? কেমন আছেন? আর তোমার কন্ঠ কেমন যেন শোনাচ্ছে। তুমি ঠিক আছো?”

-“আমি ঠিক আছি রে মা। তোর মা এখন ছাদে বোধহয়। জানিস, সবসময় তোর কথা বলে। ঐতো… নয়নিকা আসছে। নে কথা বল একটু, বেচারী তোর সাথে কথা না বলতে পেরে মনটা খারাপ করে রেখেছে।”

নয়নিকা কিছুটা দূরে এসে ইনশিতার সাথে কথা বলতে লাগল।

-“তুই সত্যিই কোথায় আছিস বলতো ইতু? আমার কিন্তু ভালো ঠেকছে না তোর ব্যাপারটা।”

ইনশিতা নয়নিকার কাছে লুকাতে পারল না। সে বলেই দিলো,

-“এখানে আশেপাশে অনেক জঙ্গল। এই জঙ্গলের মধ্যেই এই বাড়িটা। আমি জানি না কোথায় এটা। আর এখানেই না কি আমাকে সবসময় থাকতে হবে জেহের বলেছে।”ইনশিতা প্রায় কেঁদেই ফেলল।

-“কলেজ আসছিস না কেন?”

-“জেহের আমাকে কলেজও যেতে দিচ্ছে না।”

নয়নিকা অবাক কন্ঠে বলে,

-“কিন্তু জেহের না তোকে বিয়ের আগে কথা দিয়েছিল তোকে কলেজে আসতে দিবে! তাহলে?”

-“আমিও সেটাই বলেছিলাম জেহেরকে। তবে তিনি এখন মত পাল্টে ফেলেছেন। তিনি আমাকে আর কলেজে যেতে দেবেন না। তিনি চায় না আমি কারো সাথে মিশি।”

নয়নিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল,

-“তুই আজকে আসতে পারবি কলেজে?”

-“সেটা কখনোই সম্ভব না রে। উনি যেতে দেবেন না।”

-“তুই পালিয়ে আয়।”

-“অসম্ভব। আমি এখানকার রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না। বই খাতা কিছুই নেই। আর জেহের যদি জানে আমি পালিয়েছি তাহলে এখানেও আমাকে রুমে বন্দী করে ফেলবে। আমি পারবো না।”

-“ইতু, মনোযোগ দিয়ে শোন আমার কথা। তুই কোনোরকমে জেহেরের মোবাইল নিয়েই পালিয়ে আয়। বই খাতার চিন্তা করা লাগবে না। আর আঙ্কেলের শরীরটাও খারাপ করেছে।”

ইনশিতা আঁতকে উঠে বলল,

-“কীহ! কী হয়েছে বাবার?”

-“তোর খোঁজ খবর না পেয়ে ওনার প্রেশার লো হয়ে পড়েছে। খাবার-দাবারও ঠিক মতো করছেন না। কয়েকদিন উনি শয্যাতে ছিলেন। দেখলি না, কেমন করে কথা বলছে।”

-“আ-আমি আসবো। যেভাবেই হোক আমি আসব।”

বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজে ইনশিতা ফোন কেটে দিলো। কললিস্ট থেকে নাম্বার কেটে তাড়াতাড়ি রুমে ফিরতেই জেহেরের সামনে পড়ে। বিদ্যুৎ চমকানোর মতো চমকে গিয়ে মোবাইলটা ওড়নার আড়ালে নিয়ে যায় ইনশিতা।

জেহেরের কপাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। মাথা মোছেনি সে। সবসময় ইনশিতাকেই তার ভেজা চুল মুছে দিতে হয়। টাওয়াল জড়িয়ে খালি গায়েই বেড়িয়েছে সে। রোজকে দেখে কপাল কুঁচকালো। দেখে মনে হয় ভয় পেয়ে আছে কত! কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামও জমেছে। জেহের একটু এগিয়ে আসতে ইনশিতা দু’পা পিছিয়ে গেল। হাত কাঁপছে তার।

জেহের কপাল কুঁচকে রেখে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত রোজকে পরখ করে নিলো। আচমকা ইনশিতার হাত ধরে সামনে আনলো। নিজের মোবাইল ইনশিতার হাতে দেখে চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল তার। ইনশিতা মাথা নিচু করে রইল। জেহের মোবাইলটা টান মেরে চেক করল সব। চোখ উঠিয়ে ইনশিতার মুখোমুখি হয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

-“মোবাইল নিয়ে কী করছিলে?”

ইনশিতা তোতলিয়ে বলল,
-“আ-আমি, আস-আসলে… মা-মানে…”

গর্জে উঠে জেহের,
-“বলো।”

কেঁপে উঠল ইনশিতা।
-“ক-কিছু করছি-ছিলাম না। লক করা ছিল তাই কিছু ক-করতে…”

-“কী করতে চেয়েছিলে?”

-“ফ-ফোন দিতে চেয়েছিলাম।”

-“বাবা মা’কে তাই তো?”

ইনশিতা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানাল। জেহের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর গিয়ে খাটে বসল। ইনশিতা জানে এখন তাকে কী করতে হবে। আরেকটা টাওয়াল নিয়ে জেহেরের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা মুছে দিতে লাগল। জেহের ইনশিতার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে মাথাটা পেটের সাথে ঠেকিয়ে রেখেছে। ইনশিতা আমতা আমতা করে বলল,

-“আমাকে কী সত্যি আর কলেজ যেতে দিবেন না?”

জেহের কপালে বিরক্তির সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে মাথা তুলে বলল,

-“তো তোমার কী মনে হয় আমি মজা করছিলাম?”

-“না মানে, এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।”

একটু থেমে ইনশিতা স্বাভাবিক স্বরে বলল,

-“আসলে জেহের, আমি ভাবছিলাম আমি যদি চাকরি করি, মানে…তাহলে হয়ত আমাদের আরও বেশি আয়ের উৎস হবে। এতে ভবিষ্যতেও…”

জেহের টাওয়ালটা নিয়ে ছুঁড়ে মারল নিচে। ইনশিতা কিছুটা পিছু হটল। জেহের দাঁড়িয়ে গিয়ে কড়া কন্ঠে বলল,

-“আমার যা টাকা আছে তাতে ভবিষ্যতে আরও চৌদ্দগোষ্ঠী চলতে পারবে। তোমার চাকরি করার দরকার নেই। এসব চাকরি-টাকরির নাম আর যেন না শুনি।”

ইনশিতা কিছুটা মিইয়ে গেল। তবুও বাহির থেকে নিজেকে আরেকটু স্বাভাবিক করে বলল,

-“আল্লাহ না করুক, আপনার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে তো আমাকেও চলতে হবে না কি? তখন বয়সটা যদি পেরিয়ে যায় তাহলে তো আর চাকরি-টাকরি পাবো না। তখন কী করে চলব আমি?”

জেহের চোখ গরম করে তাকাল রোজের দিকে। মুখের আদল না বদলিয়ে শান্তস্বরেই বলল,

-“তুমি কী আমার মৃত্যুর অপেক্ষা করছো?”

বিস্ফোরিত নয়নে ইনশিতা চেয়ে রইল।
-“কী যা তা বলছেন? আমি কখন বললাম সে কথা?”

-“একটু আগে কী বলেছিলে তা রিপিট করো।”

ইনশিতা মনে করতে লাগল একটু আগে সে কী বলেছিল। মনে পড়তেই জিভ কাটল। আসলেই তো সে জেহেরের মারা যাওয়ার কথাটাই বলেছিল অজান্তে। কিন্তু সেটা একটা উদাহরণ ছিল মাত্র। সেটাকে এমন সিরিয়াসলি নেওয়ার কী আছে? ওহ হো! সে তো ভুলেই গিয়েছিল জেহের সব কথাকেই সিরিয়াসলি নেয়।

-“কী? মনে পড়ল?”

ইনশিতা জেহেরকে বোঝানোর জন্য হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল,

-“আরে জেহের। আমি শুধু ওটা যাস্ট একটা উদাহরণ দিলাম আর কী। কখন কী হয়ে যায় বলা তো আর যায় না। তাই না? তাই ভবিষ্যৎ ভেবেই বললাম।”

ইনশিতা নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসল। তবে জেহের সেই আগের মতোই। বোঝাই যাচ্ছে জেহের কথাটাকে একদম সিরিয়াসলি ধরে নিয়েছে।

-“আমি মারা যাওয়ার পর নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়বে? এতটা স্বার্থপর হতে পারবে? কষ্ট হবে না আমি মরে গেলে।”

শেষ বাক্যটা কেন যেন ইনশিতার বুকে তীরের মতো গিয়ে বিঁধল। জেহের না থাকলে তার কী কষ্ট হবে? হবে তো। স্বামী মারা গেলে প্রতিটা স্ত্রীর-ই তো কষ্ট হয়। তবে জেহেরের শেষ কথাটাতে ইনশিতা প্রচুর আঘাত পেল মনে। জানে না কেন? জেহেরের মুখ থেকে মরার কথাটা যেন শুনতেই পারছে না ইনশিতা। ইচ্ছে করছে জেহেরের জড়িয়ে ধরে বলতে,‘আপনি চলে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে জেহের। খুব। যেমনটা গাছ থেকে পাতা ঝরে গেলে গাছের মৃত্যু হয়, তেমনটা আপনি চলে গেলে আমারও যেন মৃত্যু হয়।’অদৃশ্য দেয়ালের মাঝে আটকা পড়ে সে আর কথাটি বলতে পারল না।

রোজের উত্তর না পেয়ে কিছুটা আহত হলো জেহের। সাথে রাগও হলো। তবে তা আড়ালে রেখে কেবিনেটের সামনে যেতে যেতে বলল,

-“বাই দ্যা ওয়ে, আমার সব প্রোপার্টির অর্ধেক মালকিন তুমি। কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সো, চাকরি করার চিন্তা ঝেড়ে ফেলো।”

বিস্ময়ে যেন ইনশিতার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। বিস্মিত গলায় বলল,

-“মানে কী! আপনার প্রোপার্টির মালকিন আমি হতে যাবো কেন?”

স্যুট হাতে নিয়ে জেহের গভীর দৃষ্টি মেলে তাকাল ইনশিতার পানে।

-“তুমি হবে না তো কে হবে? আমার সবকিছুতেই তোমার ভাগ থাকবে। হোক সেটা প্রোপার্টি কিংবা আমি। তোমার অধিকার আছে। কারণ তুমি আমার স্ত্রী, আমার অর্ধাঙ্গিনী।”

‘তুমি আমার স্ত্রী, আমার অর্ধাঙ্গিনী।’কথাটি ঝংকার তুলে বাজতে লাগল ইনশিতার কানে। জেহেরের মুখে ইনশিতাকে নিজের অর্ধাঙ্গিনী বলাটা যেন খুব শোভা পায়। ইনশিতার ইচ্ছে করছে বারবার জেহেরের মুখ থেকে কথাটি শুনতে।

জেহের চেঞ্জিং রুমে চলে গেলে ইনশিতা খাবার রেডি করতে যায়। গ্লাসে পানি ঢালতেই তার মনে পড়ল তার যেতে হবে বাড়িতে। এতক্ষণ কথাটি একদম মাথাতেই ছিল না।

জেহের এসে দেখে গ্লাস থেকে অনবরত পানি পড়ছে। গ্লাস পানিতে যে ভরে গিয়ে নিচেও পানি পড়ছে সেটা রোজের খেয়াল নেই। অথচ রোজের দৃষ্টি গ্লাসের দিকেই। আশ্চর্য! চোখের সামনে পানিতে ভেসে যাচ্ছে অথচ মেয়েটার খেয়ালই নেই! জেহের গিয়ে গ্লাসটা সরিয়ে ফেলল। তবুও ইনশিতা পানি ঢালতে লাগল খালি টেবিলে। মেয়েটা কোন ধ্যানে আছে? জেহের ইনশিতার হাত ধরে ঝাঁকি দিলে ইনশিতার হুশ ফিরে। তাকিয়ে দেখে জেহের তার দিকে সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিচে তাকাতেই দেখে পুরো টেবিল আর ফ্লোরে পানি ছড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি করে কাপড় এনে মুছে নিলো জায়গাটা। মনে মনে নিজেকে ধমকাচ্ছে সে।

জেহেরকে বসতে দিলে জেহের দৃষ্টি অপরিবর্তনীয় রেখেই বসে পড়ে চেয়ারে। ইনশিতার অস্বস্তি হতে লাগে। জেহের যেভাবে তাকিয়ে আছে সেভাবে বোধহয় ইনশিতার পালানোর প্ল্যানটাই ধরে ফেলবে।

-“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

-“তুমি কোন ধ্যানে ছিলে এতক্ষণ? পানি পড়ে সব ভেসে যাচ্ছে অথচ তোমার খেয়ালই নেই!”

ইতস্তত করে ইনশিতা বলে,

-“আমি আর কী ধ্যানে থাকব? এমনি আর কী…”

জেহের সন্দেহের চোখেই চেয়ে রইল। ইনশিতা গিয়ে অন্য একটা চেয়ারে বসলে জেহের খাবার রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। জেহেরকে খাবার খেতে না দেখে ইনশিতা ইশারায় কী হয়েছে বলল। জেহের নিরুত্তর। সে একদৃষ্টিতে দেখতে লাগে রোজকে। জেহেরের এই দৃষ্টি শান্ত হলেও ভেতরে যে পৃথিবীসম রাগের আগুন দাউদাউ করছে সেটা ইনশিতার নজর এড়ালো না। সে ভাবছে, কী এমন করল যার জন্য জেহের এভাবে তাকিয়ে আছে! ইনশিতা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। হঠাৎ জেহের ইনশিতার খাবার প্লেটটা নিজের কাছে নিয়ে নিল। ইনশিতা হতভম্ব হয়ে গেছে। জেহের তো রুটি খায় না, তার জন্য আলাদা খাবার রয়েছে। তাহলে এভাবে সামনে থেকে খাবার নিয়ে নেওয়ার মানে কী?

-“আজব! এভাবে খাবার নিয়ে নিলেন কেন? আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন আপনার খাবার অন্য আইটেম। এটা আমার।”

জেহের শীতল গলায় বলল,

-“আমি না হয় ভুলে গেলাম। তুমি কি কিছু ভুলে গেলে বেবি?”

জেহেরের এত শীতল কন্ঠ শুনে ইনশিতা শুকনো ঢোক গিলল। জেহের এত আদর করে কথা বলছে কেন? সে আবার কী ভুলবে? পরক্ষণেই মনে পড়ল সে আজ অন্য চেয়ারে বসেছে। ধীরে ধীরে চেয়ার থেকে উঠে জেহেরের কোলে গিয়ে মাথা নিচু করে বসল। বাঁকা হাসল জেহের।

খেতে খেতে ইনশিতা শেষবারের মতো জেহেরকে মানানোর চেষ্টা করল। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে, জেহের যদি কোনোভাবে না মানে তাহলে যেকোনো উপায়েই সে এখান থেকে পালাবে। তার বাবা মাকে কতটাদিন সে দেখে না। অবশ্য এখানে ফিরেও আসতে পারে সে। জেহের জোর করে আনার থেকে ভালো নিজ থেকে চলে আসা।

-“আমাকে যেতে দিলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না নিশ্চয় জেহের?”

ঘটানটা বুঝতে জেহেরের সময় লাগল না। খাবার মুখে নিতে নিতে বলল,

-“এসব বিষয়ে কথা বলতে গতকাল রাতেই বারণ করেছিলাম।”

কিছুক্ষণ পর ইনশিতা এমন ভাব করল যাতে জেহেরের মনে কোনো সন্দেহ না জাগে। আহ্লাদী সুরে বলে,

-“আচ্ছা জেহের। আমরা যদি আজ কোথাও ঘুরে আসি। ঐ যে সেদিন নদীর পাড়ে গেলাম না, সেদিনের মতো আজ কোথাও যাই। চলুন না।”

জেহের বিদ্রূপের হাসি হেসে বলল,

-“তুমি যে কৌশলে যেতে চাইছ সেটা আমি বুঝি না ভেবেছ? খাওয়ায় মন দাও। স্টুপিড!”

ইনশিতা কথা না বাড়িয়ে ভাঙ্গা মন নিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। জেহের যেহেতু মানলোই না তাহলে নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নিতে হবে। আপাতত এখান থেকে যাওয়ার চিন্তা করতে হবে।

.

.

জেহের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছিল। ইনশিতা নিঃশব্দে পিছনে এসে দাঁড়াল। জেহের না তাকিয়েই বুঝতে পারল তার রোজের উপস্থিতি। তবুও কিছু বলল না। ইনশিতা কন্ঠে বিষাদ মেখে বলল,

-“আজ আপনি অফিসে না গেলে কি বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে?”

জেহের আয়নার ভেতর থেকেই রোজের চেহারায় দৃষ্টিপাত করল।

-“হঠাৎ?”

-“না মানে, আপনি চলে গেলে আমি ঘরে একা থাকি, কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আজ থেকে যান না প্লিজ।”

ইনশিতার কন্ঠে মিনতি। ইনশিতা আজকে জেহেরকে থেকে যেতে বলেছে কারণ জেহের সবসময় মেইন গেট আটকে রেখে যায়। এখন যদি জেহের চলে যায় তাহলে তো সে যাওয়ার কোনো সুযোগই পাবে না। তাই জেহেরকে থেকে যেতে বলল।

জেহের ঘুরে দাঁড়িয়ে ইনশিতার কাছে এসে দাঁড়াল। জেহের খানিকটা ঝুঁকে ইনশিতার মুখে ফুঁ দিলো। ইনশিতা কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেলল। জেহের মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল,

-“আজ আমার বউয়ের কী হয়েছে হঠাৎ? এত ভালোবাসা?”

ইনশিতা কম্পিত কন্ঠে বলে,

-“কী আর হবে। আপনার সাথে একটু টাইম স্পেন্ড করতে মন চাইল আর কী। আর আমার স্বামীর প্রতি আমি ভালোবাসা দেখাবো না তো কে দেখাবে? ঐ শিফা?”

জেহের ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসল। হাসির রেখা ফুটিয়েই বলল,

-“উমম, জ্বেলাস?”

ভেঙচি কেটে ইনশিতা বলল,

-“জ্বেলাস কেন হবো? যা সত্যি তাই তো বললাম। আমি আপনার বউ, তাহলে আমিই তো ভালোবাসা দেখাব তাই না? যত্তসব।”

ইনশিতা রুমের বাহিরে চলে গেল। জেহের ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে গলার টাই খুলে ফেলল।

.
.
ইনশিতা শুয়ে আছে জেহেরের বুকের উপর। জেহেরকে সে একপ্রকার জোর করেই ঘুমাতে নিয়ে এসেছে। জেহের অফিস না গেলে ইনশিতা বলেছে তার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে আর সে এখন জেহেরের বুকেই ঘুমাবে। বেডে আধশোয়া জেহেরের বুকে মাথা দিয়ে রয়েছিল ইনশিতা। এখন বাজতে চলেছে এগারোটা পঞ্চাস। জেহের ইনশিতার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে ঘুমে তলিয়ে গেছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে জেহেরের। আর এই সুযোগটারই অপেক্ষা করছিল ইনশিতা। সে ধীরে ধীরে উঠে চিলেকোঠার ঘর থেকে দড়ি নিয়ে আসলো। জেহেরকে না বেঁধে চলে গেলে জেহের যে তাকে সেকেন্ডে খুঁজে নেবে তা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইনশিতা। ইনশিতা দুরুদুরু করা বুকে জেহেরের এক হাত অতি সাবধানে ধরে খাটের সাথে বেঁধে দিলো। খুব শক্ত করে বেঁধে দিলো যাতে কোনোভাবেই খুলতে না পারে। জেহের একটু নড়াচড়া করে উঠলে ইনশিতা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তাতেই জেহের গাঢ় ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়। আরেকটা হাত বাঁধতে গিয়ে বাঁধে বিপত্তি। জেহেরের ডান হাত খাটের বাহিরে ঝুলছে। ঐ হাত উঠাতে গেলে জেহেরের ঘুম ভেঙে যাবে নিশ্চিত। কিছুক্ষন ভেবে নিয়ে ইনশিতা আগের হাতের বাঁধন আরো বেশি শক্ত করে বেঁধে দিলো আরেকটা দড়ি দিয়ে। যাতে এক হাতেও আরেক হাত খুলতে না পারে।

শেষ হলে ইনশিতা কিছু টাকা আর জেহেরের মোবাইল নিয়ে পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেল ঘরের বাহিরে। মেইন গেটের বাহিরে আসতেই যেন মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। চারপাশে এত এত জঙ্গল যে দিনের বেলাকেও রাত ভেবে কেউ ভুল করবে না। সে গাড়ি চালাতে পারে না বিধায় হাঁটতে হবে তাকে। মোবাইল থেকে গুগল লোকেশনের সাহায্যে পথ এগোতে লাগল। যতই এগোতে লাগল ততই যেন ইনশিতার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে। জঙ্গলের গাছগুলো এতটাই লম্বা যে আকাশটাও ঢেকে গেছে।

দীর্ঘক্ষণ হাঁটার পর ইনশিতা হাইওয়েতে চলে আসলো। মোবাইলে দেখে নিলো সাড়ে বারোটা বাজে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে একটা ট্যাক্সি ধরে যেতে লাগল কাঙ্খিত জায়গায়।

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here