প্রহর শেষে
পর্ব:- ১৮
ওয়াসিয়াত চিন্তিত হয়ে বলল,’কি হয়েছে মা, আমায় বল।নাহয় তোমার পাশে কেউ থাকলে তাকে ফোনটা দাও।’
-‘কেউ নেই, সবাই হাসপাতালে গেছে।’বলে জোহরা খানম আবারো কাঁদতে লাগলেন।
-‘হাসপাতালে গেছে কেন ? কি হয়েছে? ‘
জোহরা খানম ফিস ফিস করে বললেন, ‘গুনগুন কে নিয়ে গেছে। গুনি বোধহয় আর বাঁচবে না ।’
ওয়াসিয়াতের শ্বাস প্রশ্বাস কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেল।’গুনগুন’ নামটা এতোদিন ধুলো বালি পূর্ণ ঘরের আঁধারে এক কোণে ছিল।ধীরে ধীরে সেটা উজ্জ্বল হয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো।হঠাৎ তার খেয়াল হল, ইরশাদের মৃত্যুর পর মেয়েটা কেমন আছে, কি জীবন সে যাপন করছে সবই তার অজানা ।স্মৃতির সে কোণটা একদম অন্ধকারাচ্ছন্ন।
ওয়াসিয়াতের মুখের রং বদলে যেতে লাগলো।সে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল,’কিসব বলছ মা, কি হয়েছে গুনগুনের ?’
-‘আমি জানি না। আমাকে কেউ কিছু বলছে না।’
ওয়াসিয়াত হতভম্ব হয়ে গেল।
সেলিনা একটি বেঞ্চিতে বসে আছেন।তাকে দেখে মনে হচ্ছে না যে তিনি খুব কষ্টে আছেন।দুঃখের পরিমাণ যখন সহ্য সীমার বাইরে চলে যায়, তখন দুঃখ পেলে স্বাভাবিক যে আচরণ, তা মানুষ করতে পারে না। সেলিনার ক্ষেত্রেও বোধহয় সেটাই ঘটেছে।এই অবস্থায় থেকেও তাকে মোটেই বিচলিত দেখাচ্ছে না।তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছেন।
সন্ধ্যায় পর গুনগুন ওষুধ খেতে গিয়ে দেখল প্রেসক্রিপশনে থাকা ৪টি ওষুধের মধ্যে ১টি নেই।সেলিনা বিকেলেই ওষুধ নিয়ে এসেছিলেন।বাড়িতে লোক মোটে দু’ জন।অগ্যতা ১টি ওষুধ নেই দেখে সেলিনাকেই ফের বেরুতে হল ওষুধ আনতে।গুনগুন ভরসা দিল সে একা থাকতে পারবে, কিছুক্ষণেরই তো ব্যাপার মাত্র।
কিন্তু সেলিনা বেরিয়ে যাবার পরই গুনগুন অস্থির হয়ে পরল। এঘর-ওঘর করতে লাগলো,সামান্য শব্দেই হতেই সে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল।
সেলিনা ফিরলেন রাত সাড়ে ন’টায়। আশেপাশের ফার্মেসিতে না থাকায় তাকে অনেক খুঁজে ওষুধ টা আনতে হয়েছে।দেরি হচ্ছে দেখে একবার তিনি ভেবেছিলেন প্রিয়াকে কল করে বলবেন সে যেন গুনগুনের কাছে এসে বসে, তারপর ভাবলেন গুনগুন একা বাড়িতে আছে এ খবর জোহরা খানম জেনে ফেললে ভীষণ চিন্তায় পড়বেন।
ততক্ষণে রাস্তাঘাট নিরব হয়ে গেছে।বাড়ির কাছাকাছি এসে সেলিনা বুঝলেন লোডশেডিং হয়েছে । শীতের রাত,চারিদিক কুয়াশায় আচ্ছন্ন।
ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে সেলিনা দ্রুত দরজা খুলে ভেতরে পা দিলেন এবং হতভম্ব হয়ে গেলেন।দরজার কাছে উবু হয়ে গুনগুন বসে আছে। তার হুশ আছে নাকি নেই সেটা বোঝা যাচ্ছে না।তবে মেঝেটা ভীষণ স্যাতস্যাতে।সেদিকে তাকিয়ে সেলিনার চক্ষু স্থির হয়ে গেল। মেঝে রক্তে মাখামাখি।সেলিনা চিৎকার করে উঠলেন।সাথে সাথেই আহসানউল্লাহ সাহেব এবং শাহাদাত কে ফোন করে আসতে বললেন।
গুনগুনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল রাত দশ টায়।ডাক্তারদের দেখে তেমন আশাবাদী মনে হল না।রোগীর এই অবস্থার জন্য তারা পরিবারের সদস্যদের কেই দায়ী করতে লাগলেন।
বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে আহসানউল্লাহ সাহেব, প্রিয়া বা শাহাদাত কেউ জোহরা কে এসব কিছু জানান নি।সবাই চলে যাওয়ার পর জোহরা খানম জয়কে নিয়ে একলা বাড়িতে পরে রইলেন। তিনি এসব খবর জানতে পারলেন এলাকার মানুষ জনের কাছে। কিছু লোকজন অসহায় বিধবা মেয়েটির এই দুর্দশা দেখে হাই হুতাশ করছিল।
রাত দুটোয় জানা গেল গুনগুন দুই কন্যা সন্তানের মা হয়েছে এবং মেয়ে দুটো সুস্থ আছে। আহসানউল্লাহ সাহেব আর প্রিয়া বাড়ি ফিরে জোহরা কে এ কথা জানালেন। জোহরা খানম ততক্ষণাৎ ওয়াসিয়াত কে কল করলেন।রিসিভ হতেই উত্তেজিত হয়ে মেয়ের দুটির খবর দিলেন। উত্তরে ওয়াসিয়াত শান্ত স্বরে বলল,’আমি জানি মা।’সে আর কিছু বলতে পারলো না।
জোহরা খানমের মনে হল ওয়াসিয়াত কাঁদছে, তিনি নিজেও কাঁদছেন।ইরশাদের মৃত্যুর পর জীবনে আর কখনো যে আনন্দ আসতে পারে একথা তিনি ভাবেন নি।আজকের দিনটা না এলে বোধহয় ভাবতেও পারতেন না।
গুনগুনের দুই মেয়ের নাম রাখা হয়েছে যথাক্রমে ইরিনা ও ইরিজা।জোহরা খানম নিজে ছেলের নামের সাথে মিলিয়ে এই নাম দুটো রেখেছেন। ইরিনা, ইরিজার চেহারা এক হলেও স্বভাব চরিত্রে কিছু বৈচিত্র আছে। ইরিনা হয়েছে তার বাবার মতো ছিঁচ কাঁদুনে ।সে সারাক্ষণ শুধু কাঁদে।ঘুম পেলেও সে কাঁদে,ঘুম ভাঙলেও সে কাঁদে ।তার এই দিবারাত্রি জোড়া কান্না দেখে জোহরা খানম প্রায়ই ছোট বেলায় ইরশাদের ফেচফেচ কান্নার গল্প করেন।অন্যদিকে ইরিজা হয়েছে তার সম্পুর্ন বিপরীত। তার মধ্যে কোন কাঁদা-কাঁদির ব্যাপার নেই।সে শুধু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।
সকাল হতেই জোহরা খানম এবং আহসানউল্লাহ সাহেব অস্থির হয়ে পড়েন।ওবাড়ি গিয়ে মেয়ে দুটো কে দেখে তবেই শান্ত হন।রোজ সকালে যখন মেয়ে দুটো দোলনায় শুয়ে রোদ মাখে। তাদের টুকটুকে লাল ঠোঁট, ফোলা ফোলা গাল আর মাথাভর্তি নরম বাদামি বর্ণের কোঁকড়ানো চুল দেখে জোহরা খানমের মন খুশিতে ভরে ওঠে।তাদের সাথে তিনি নানান বিষয়ে কথা বার্তা বলেন। এটাকে একপাক্ষিক কথা বার্তাও বলা চলে। কেননা সেখানে বক্তা কেবল জোহরা খানম। আর বাকি দুজন অতি উৎসাহী শ্রোতা।
ওয়াসিয়াত গুনগুনদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে । ভেতরে সে যেতে তার সংকোচ হচ্ছে। এখনই দেখা যাচ্ছে চোখে পানি এসে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে ভেতরে যাওয়া মাত্রই বাচ্চা দুটো কে দেখে সে কেঁদে ফেলবে এবং ব্যাপার টা খুবই খারাপ হবে।
জোহরা খানম একপ্রকার জোর করেই তাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। বললেন -‘রিরি’ এখন এখানেই থাকবে।(কিছুদিন ধরে ইরিনা ও ইরিজা কে একসঙ্গে তিনি ‘রিরি’ ডাকছেন। দুজনের নাম থেকেই মাঝখানের অক্ষর টা কেটে নিয়ে তিনি এই নাম আবিষ্কার করেছেন ।)
এখনই দেখা করে আয়।নাহয় পরে ঢাকা ফিরে গিয়ে কিন্তু আমাকে একদম জ্বালাতন করতে পারবি না।’
ওয়াসিয়াত মায়ের সাথে ভেতরে গেল। লাল টুকটুকে পুতুলের মতো সুন্দর দুটো মেয়ে দেখে সে ভারি অবাক হল।।দাদির আদরের রিরি’ও তাদের চাচাকে দেখে হাত পা ছুড়োছুড়ি শুরু করল।
গুঞ্জন , ওয়াসিয়াত দুজনই সবে চাকরিতে জয়েন করেছে।তবে তাদের মন সব সময় বাড়িতে পরে থাকে। কবে ছুটি পাবে আর বাড়ি এসে রিরি কে দেখবে সেই ভেবে মন অস্থির থাকে।
রিরি’র আগমনে পুরো বাড়ি যেখানে তার হারানো অনিত্যতা ফিরে পেয়েছে,সেখানে পরিবর্তন হয়নি শুধু একজনের।বাচ্চাদের প্রতি সবার এতো আদর দেখে মাঝে মাঝে গুনগুনও আহ্লাদিত বোধ করে, তবে সেটা অতি অল্প সময়ের জন্য। বেশির ভাগ সময় সে গম্ভীর হয়ে থাকে। তার সেই কিশোরী সুলভ আচরণ আর চঞ্চলতার কোন কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই।
গুনগুন বাচ্চাদের নিয়ে এবাড়িতে ফিরে এসেছে ভেশ কিছুদিন হল।সবারই মনে হচ্ছে বাচ্চাদের সে ঠিক মতো দেখভাল করতে পারছে না।মনে হয় সেদিকে তার বিশেষ খেয়ালও নেই।সে সারাক্ষণ থাকে ভাবনার জগতে।
মাঝে মাঝে দেখা যায় ইরিনা,ইরিজা গলা ফাটিয়ে কাঁদছে গুনগুন ফিরেও তাকাচ্ছে না। ঝিম মেরে বসে আছে। তার হয়তো সে খেয়ালই নেই!ফলাফল বাড়ির সবাই তার প্রতি কিছুটা অসন্তুষ্ট।যদিও সামনাসামনি তাকে কিছু বলার সাহস কারো নেই। আজকাল সবাই তাকে ভয় পায়।
দুপুরেএ শেষ ভাগ,বাইরে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়েছে। একেবারে ঘর-বাড়ি উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো ঝড়। ওয়াসিয়াত বসার ঘরে বসে পত্রিকায় চোখ বুলোচ্ছ,কিন্তু সেদিকে পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারছে না। ইরিনা আর ইরিজা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। ইরিনা, ইরিজার বয়স এখন চলছে ছ’মাস।কিছুসময় কেটে গেলেও তাদের কান্না থামার কোন লক্ষ্মণ দেখা গেল না।এবার অধৈর্য হয়ে উঠে সে এগিয়ে গেল।খানিক সামনে এগোতেই জোহরা খানম কে দেখে বলল,’কি ব্যাপার মা,বাচ্চারা এভাবে কাঁদছে কেন? ওদের কাছে কি কেউ নেই নাকি ?’
-‘আছে তো।গুনগুন তো মনে হয় ঘরেই আছে। ‘
-‘তাহলে ওরা কাঁদছে কেন? ‘
-‘কে জানে।দ্বারা আমি দেখে আসি।’
জোহরা খানম সেখানে গেলেন এবং খুব জলদিই ফিরে এলেন। এইটুকু সময়ের মধ্যে তার মুখের রং বদলে ছাই বর্ণ হয়ে গেল। ওয়াসিয়াত মাকে কে দেখে তীক্ষ্ণ গলায় বলল,’কি হল? ওরা তো এখনো কাঁদছে!ঘরে কেউ নেই? ‘
জোহরা খানম গলা নামিয়ে বললেন, ‘আছে।’
-‘তাহলে?’
জোহরা খানম উত্তর দিলেন না।এইবার ওয়াসিয়াত নিজেই যেতে উদ্ধত হলে জোহরা খানম তাকে থামালেন। অনুরোধের সুরে বললেন,’ঝামেলা করিস না ওয়াসি। গুনগুনের মেজাজ ভালো নেই।তাই ওমন ছেলেমানুষী করছে।তুই গেলে ও আরো রেগে যাবে। ‘
ওয়াসিয়াত কড়া গলায় বলল -‘এটা কি ধরনের ছেলেমানুষী মা?
বাচ্চারা কাঁদছে আর সে ফিরেও তাকাচ্ছে না। ওদের দেখাশোনা করতে যদি ওর এতোই সমস্যা হয় তাহলে সে চলে যাক।’
ওয়াসিয়াত কথা গুলো বলল গলা উঁচিয়ে, যেন গুনগুন শুনতে পায়।
গুনগুন শুনল,শুনে চোখ মুখ শক্ত করে বাচ্চাদের পাশে সে বসে রইল।তবে তার কোন পরিবর্তন দেখা গেল না।
প্রচন্ড ঝড়ের জন্য বাইরে আঁধার নেমে এসেছে। থেমে থেমে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ।লোডশেডিং হয়েছে ,ফলাফল ঘরে আঁধার নেমেছে । গুনগুন আঢ় চোখে একবার বাচ্চাদের দিকে তাকালো। কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চা দুটোর মুখ লাল হয়ে গেছে।গুনগুন স্থির তাকিয়ে রইল। তার চোখ জ্বালা করতে লাগলো। হঠাৎ সব কঠিনতা ভুলে সে বাচ্চাদের কাছে এসে ধীরে ধীরে দু’হাতে দুজন কে কাছে টেনে নিল।তাদের কে জোড়ালো ভাবে বুকে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো।
চলবে………।
অদ্রিজা আহসান।