প্রহর শেষে
পর্ব-১৪
ওয়াসিয়াত খানিকটা দ্বিধা নিয়েই ফোন কানে তুললো। ওপাশে নানান হিজিবিজি কথা শোনা যাচ্ছে।সে সচকিত হয়ে সোজা হয়ে বসলো।
অনেক গুলো সম্মিলিত কণ্ঠস্বর কথা বলছে ফলাফল সে কোন কথাই বুঝতে পারছে না।সে কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করলো ওপাশ থেকে কি বলছে। তার হৃৎপিন্ডের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হল।অবশেষে সে শাহাদাতের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। তার কথাও পরিষ্কার না, কণ্ঠ বিধস্ত। ক্রমশই ওয়াসিয়াতের ভয় বাড়তে লাগলো। ততক্ষণে ওপাশ থেকে শাহাদাত বলে উঠল,’ওয়াসি, তুই জলদি বাড়ি আয়, ইরশাদ……। ‘
‘দুঃখ গুলো কি সবসময় সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ?’
-নয়?
তবে তারা কেন একের পর এক আসে? আর আসতেই থাকে?
ওয়াসিয়াত চুপচাপ বসে আছে। মাঝ রাস্তা পর্যন্ত এসেই বাসটাকে থামতে হয়েছে । সামনেই বোধহয় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। চারিদিকে উৎসুক জনতার ভিড়।কয়েকজন মারাও গিয়েছে বোধহয়। কারণ কিছুটা দূরেই দেখা যাচ্ছে এক মা তার মৃত সন্তানের ছোট শরীর টাকে জাপটে ধরে চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছেন। বাসের সব যাত্রী জানালা দিয়ে মাথা বের করে উৎসুক হয়ে সেই করুন দৃশ্য দেখছে। নির্বিকার শুধু ওয়াসিয়াত।তার কোনো অনুভূতি হচ্ছে না।
সে ভাবছে, এই লোকগুলো কি তার দুঃখ বোঝে? তার বুকের সমস্ত রক্ত যে শিরা উপশিরা ছিঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, তা কি তারা জানে?অপ্রকাশিত বলে সে কোনো সমবেদনা পাচ্ছে না।কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। যদি তারা জানতো তবে কি তারাও তার দিকে করুনার দৃষ্টিতে তাকাতো? হয়তো।
বিকেলে শাহাদাত যখন ওপাশে ফোন রেখে দিয়েছিল,ওয়াসিয়াত তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। পাথরের মূর্তি হয়ে সে দাঁড়িয়ে ছিল,এক আকাশ বিষ্ময় নিয়ে।শুধু বুঝতে পারছিল ধীরে ধীরে তার শ্বাস প্রশ্বাস থেমে আসছে।
সেই চেনা পরিচিত গলিটির সামনে এসে সে দাঁড়িয়ে পড়লো। লোকজন স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে। ওয়াসিয়াত একটা শুকনো ঢোকা গিলল।ফোন রাখার পরমূহুর্তেই সে ঠিক করেছিলো ভেঙে পড়বে না।সেই মূহুর্তে সমস্ত কান্না,যন্ত্রণা আর অনুভূতির তীব্রতা গুলোকে সে মুছে ফেলেছিল।প্রথম যে কথাটা তখন মাথায় এসেছিল সেটা হলো, ‘মা কেমন আছে? এই শোক সামলানোর শক্তি তো মায়ের নেই।তাহলে সে এখন কি অবস্থায় আছে? যেভাবেই হোক মা কে তার বাঁচাতে হবে। ‘
অপেক্ষার যন্ত্রণা যে কতটা তীব্র আহসানউল্লাহ সাহেব তা বুঝতে পারছেন।আজ এই ষাটোর্ধ বয়সে এসে তাকে জীবনের সবচেয়ে বিষাক্ততাপূর্ণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে।মৃত ছেলের লাশ আসার অপেক্ষা!
এই কয়েক ঘণ্টায় তার শরীর ভেঙেছে, সেই সাথে হারিয়েছে বেঁচে থাকার সমস্ত আগ্রহ।তিনি অদূরে বসে থাকা মরণোন্মুখ স্ত্রীর দিকে তাকালেন।সেদিকে তাকিয়ে তার দীর্ঘশ্বাস আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হলো।
শাহাদাত এলোমেলো ভাবে হাটছিল আর অনবরত কাউকে ফোন করে যাচ্ছিল।ওয়াসিয়াত কে আসতে দেখে সে দ্রুত এগিয়ে এলো। খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,’ তুই এসেছিস….,আমি আর পাড়ছি না ওয়াসি।’
ভাইকে ছেড়ে ওয়াসিয়াত সোজা হয়ে দাঁড়ালো।তাকিয়ে দেখলো ভাইয়ের ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে, দু’চোখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।
-‘কিভাবে এমন হলো? ‘এতো শান্ত ভাবে সে জিজ্ঞেস করল যে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল।
শাহাদাত একে একে সব বলে চলল।ওয়াসিয়াত দু’কান দিয়ে সব শুনছিল, সেই সাথে তার শ্বাস রোধ হয়ে আসছিল যন্ত্রণায়।
ভাইকে পেরিয়ে যখন সে জোহরা খানমের সামনে এসে দাঁড়ালো,তখন তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত কাঁপছিল।কি বলা উচিত, কি করা উচিত কিছুই তার খেয়ালে আসছিল না।ভাইয়ের মৃত্যুর থেকে মাকে হারানোর ভয় টাই তখন তার মনে প্রবল হয়ে উঠেছিল। জোহরা খানম তাকে দেখে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন।অদ্ভুত ভাবে হাসলেন। ওয়াসিয়াত সেই হাসি সহ্য করতে পারলো না। মাকে জড়িয়ে ধরলো। ছেলের বুকে মুখ লুকিয়ে জোহরা খানম চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন।তার-ও বুঝি দম ফুড়িয়ে এলো!
রাতের গভীরতা যত বাড়তে লাগলো, শোকের ছায়া যেন তত গাঢ় হতে লাগলো ।গুনগুনের মুখটা ভয়াবহ রকমের ফর্সা দেখাচ্ছে।সে নিস্তেজ হয়ে বিছানার এক কোণে পড়ে আছে। কিছুটা দূরে বসে জোহরা খানম হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।তার আর কিছুই করার নেই !
সকালের পর থেকে গুনগুন একবারও কথা বলে নি।সারা বিকেল নিষ্প্রভ ও নিস্তেজ হয়ে বসে ছিল ।ভীত হরিণির মতো সকলের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল বারবার ।সবাই যখন তাকে স্বাভাবিক করতে উঠে পড়ে লাগলো গুনগুন আচমকা এক চিৎকার করে উঠল,ভীষণ তীব্র চিৎকার।এবং পরমূহূর্তেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লো।
টানা চব্বিশ ঘণ্টা গুনগুন নিথর হয়ে বিছানায় পড়ে রইল। যখন তার জ্ঞান ফিরলো তখন সে এই দুনিয়ার বাইরের কোন মানুষ, তার আচরণ অস্বাভাবিক।চারিদিকে সে বিষ্মিত চোখে তাকিয়ে হুট করে উঠে দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।সেই শব্দে পুরো বাড়ি যেন কেঁপে উঠল। এই অস্পন্দ দেহে এতো জোড় কোথা থেকে এলো কেউ খুঁজে পেল না।
গুনগুনের আচরণ স্বাভাবিক হওয়ার বদলে দিনে দিনে আরও অস্বাভাবিক হতে লাগলো।সারাক্ষণ নিজেকে সে ওই নিভৃত কুঠুরিতে বন্দী করে রাখে, নিজের সাথে প্রতিনিয়ত কথা বলে।দিনের অধিকাংশ সময় সে কাটায় জায়নামাজে বসে।
ওয়াসিয়াত বেতের ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে শুয়ে আছে।পুরো ঘরে আঁধারের গাঢ় ছায়া। পুরনো দিনগুলোর মতো আজও সে নিষ্প্রভ ও স্নিগ্ধ ।আজও তার সেই অসাধারণ রৌদ্রজ্বল বিকেলের কথা মনে পরে। সেই বিকেলের শেষ টাও হয়তো অসাধারণ হতো যদি না সেই দুঃস্বপ্নেরা আসত।
ছোট বেলা থেকেই ওয়াসিয়াতের একটা স্বপ্ন ছিল,খুব সুখী একটা পরিবারের স্বপ্ন। সে বরাবরই খুব খুশি ছিল এই ভেবে যে তার পরিবারটা তার স্বপ্নের মতোই সুন্দর বরং তার চেয়েও বেশি সুন্দর ।
কিন্তু স্বপ্নেরও কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে , স্বপ্ন মানেই অবাস্তব আকাঙ্খা। স্বপ্ন যদি সবসময় পূরণই হওয়ার, তবে তাকে আর যাই হোক স্বপ্ন বলা চলে না।সেটা হয়ে যায় ইচ্ছে পূরণের জাদুর কাঠি!
তাই বোধহয় ওয়াসিয়াত এত সাধের স্বপ্ন ভঙ্গ হল!
ওয়াসিয়াত মায়ের ঘরের সামনে । ভেতরে যেতে তার ইচ্ছে করছে না।কারণ যে কথা সে বলতে এসেছে, সে কথা বলার সৎ সাহস তার নেই।
-‘কে ওখানে? ‘
-‘মা,আমি….আমি ওয়াসিয়াত।’
-‘ওহ ওয়াসি,আয় ভেতরে আয়।’জোহরা খানম হাত নেড়ে ওয়াসিয়াত কে ডাকলেন।
তিনি বিছানায় শুয়ে ছিলেন। ওয়াসিয়াত ঘরে ঢুকতেই হাতের ইশারায় তাকে পাশে বসতে বললেন।ওয়াসিয়াত মায়ের পাশে মাথা নিচু করে বসল। কিছুক্ষণ পর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’তুমি ভালো আছো, মা?’
জোহরা খানম বাচ্চা মেয়ের মতো হাসলেন। বললেন -‘ভালো থাকব না কেন, ওয়াসি? অবশ্যই ভালো আছি।এই যে দেখ, আজ আমার বুক ধড়ফড়ও করছে না,হাতের ব্যাথাটাও নেই।’
তারপর ঘাড় নেড়ে আনমনে বলে চললেন , ‘আমি খুব ভালো আছি, আমি খুব ভালো আছি। ‘
ওয়াসিয়াত মাথা নিচু করে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো, ভেবে পেল না কিভাবে মাকে জানাবে তার এখন ঢাকা যাওয়া প্রয়োজন।
-‘ওয়াসি। ‘
ওয়াসিয়াত মায়ের হাত ধরে বলল -‘জ্বি, মা।’
জোহরা খানম ভীত কণ্ঠে বললেন -‘শাহাদাত কোথায়? ‘
-‘বাড়িতেই আছে মা।তুমি ভয় পেয় না।’
-‘ও সত্যিই বাড়িতে আছে তো?’
-‘হ্যাঁ। ‘
জোহরা খানম স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।বললেন, ‘তোরা কেউ কিন্তু বাইরে যাবি না।জানিস তো মায়ের কথা না শুনলে কি হয়।মনে থাকবে তো? ‘
-‘হুম। ‘
-‘ওয়াসি, সেলিনা কে এই বাড়িতে নিয়ে আয় না।গুনি মা তো ওবাড়ি যেতে পারবে না। তুই গিয়ে সেলিনা কে নিয়ে আয়।বেচারি একা একা খুব কষ্টে আছে। কি রে, যাবি তো?’
-‘যাব মা,কিন্তু চাচি কি…..?’
-‘আমি কিচ্ছু জানি না, তোকে আনতেই হবে। ‘জোহরা বাচ্চাদের মতো জেদ করতে লাগলেন এবং খানিক পরই ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। ওয়াসিয়াত মায়ের পাশে বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে রইল।
জোহরা খানমের এসব আচরণ আজ নতুন নয়।কথায় কথায় কেঁদে ওঠা, বাচ্চাদের মতো জেদ করা এখন তার নিত্যকার স্বভাবে দাঁড়িয়েছে।ওয়াসিয়াতের হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।ওয়াসিয়াত হাত ছাড়াতে গিয়েও পাড়লো না, মা এমন ভাবে ধরে রেখেছে যেন হাত ছাড়লেই সে ছুটে পালিয়ে যাবে।
____________
প্রকৃতি তার নিয়মেই চলছে।জানালার বাইরে যে সুন্দর চঞ্চল পৃথিবীটা আছে গুনগুনের কাছে তা এখন প্রচ্ছন্ন। সে শুধু নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকে। আর হিসেব কষে সকল পাওয়া না পাওয়ার । কথা বলে তার অনাগত সন্তানের সাথে।
দরজায় কেউ কড়া নাড়তেই গুনগুন ঘুরে বসলো।মুখ গম্ভীর করে সামনে তাকিয়ে রইল। সেলিনা হক দরজা ফাঁক করে ঘরে ঢুকলেন। মেয়ের পাশে এসে বসে স্মিত হেসে বললেন,
‘কি রে গুনগুন, এভাবে বসে আছিস কেন? বাড়িতে তোর বড়মা, প্রিয়া সবাই আছে তাদের সাথে কথা বল।তোর বড়মা যে সারাদিন একা একা বসে থাকে তুই একটু সঙ্গে বসতে পারিস না?’
গুনগুন গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো -‘কথা বলতে আমার ভালো লাগে না।’
চলবে………
অদ্রিজা আহসান