প্রহর শেষে
পর্বঃ৮
ওয়াসিয়াতের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে গুনগুন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বুকের ভেতর এই হাহাকার কেন হচ্ছে সে জানে না, তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই তার করার নেই।
অথচ গুনগুন সেদিন জানতে পারলো না তাদের এই বিচ্ছেদ কতটা দীর্ঘস্থায়ী আর যন্ত্রণাদায়ক হতে চলেছে।
_______________________
গুনগুন কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে।তার পড়নে চা-পাতা রঙা খুব সুন্দর একটা বোরকা।মাথায় হিজাব টা পেচিঁয়ে সে পেছন ফিরে ঘড়ির দিকে তাকালো। হাতে সময় বেশি নেই,তাড়াহুড়ো করে সব গুছিয়ে ব্যাগটা কাঁধে তুলে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
মাঝখানে অনেক দিন কেটে গেছে। কিছুদিন হলো সে কলেজে ভর্তি হয়েছে। স্কুল জীবনের সমাপ্তির পর এখন কলেজ নামক নতুন অধ্যায় শুরু করেছে।কিন্তু কলেজে যেতে গুনগুনের একদমই ভালো লাগে না। কারন কলেজে ওঠার পর বন্ধু গুলো সব একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নতুন কারো সাথে এতো সহজে সে মিশতেও পারছে না।গুনগুন তাই রোজ কলেজে যায় মন ভার করে।তবে আজকাল কলেজের আপাদমস্তক ঢেকে থাকা ‘আফরিন’ কে খুব ভাল লাগে গুনগুনের। মেয়েটা সবসময় কালো বোরকা, নিকাব ও হাতমোজা পড়ে থাকে।কখনো মেয়েটার মুখ পর্যন্ত কেউ দেখেনি। ব্যপার টা গুনগুনকে সবসময় অবাক করে।
কলেজে পৌঁছেই গুনগুন বুঝতে পারলো আজ সে ভয়ানক দেরি করে ফেলেছে।ক্লাসে ঢুকতেই সকলে চোখ বড় বড় করে তাকালো।গুনগুন জানে এখন তাকে প্রত্যেকের এই চাহনি সহ্য করতে হবে, দেরি করে এলে সবাই এমন ভাবেই তাকায় ।মেডামও রোল কল করা ছেড়ে তার দিকে তাকালেন।সে অসস্থিতে পড়লো।দ্রুত হেটে পেছনে একটু খালি জায়গা পেয়ে বসে পড়লো।
পাশ ফিরে তাকিয়ে সে একটু অবাক হলো। কারণ তার পাশেই ‘আফরিন’ বসে আছে।গুনগুন কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা একটু অসস্থিতে পড়লো, সে ভদ্রতা সূচক হাসলো।সেই হাসির জবাবে গুনগুন কথা বলতে শুরু করলো।
আফরিনের সাথে কথা বলার পর গুনগুন আবিষ্কার করলো মানুষকে মুগ্ধ করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা তার আছে। তার প্রতিটি কথাই শিক্ষনীয়,এমন যা শুনলে মন ভালো হয়ে যায়। গুনগুন বুঝতে পারলো না কেন এতো মিষ্টভাষী আর ভালো একটা মেয়ের সাথে কলেজের কেউ মেশে না।এই মেয়ে আর বাকি ছেলেমেয়েদের মাঝে যেন অদৃশ্য এক দেয়াল আছে যা ভেদ করতে কেউ আগ্রহী নয়।
___________
হুট করেই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল গুনগুনের । সকল বিষয়ে তার ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও দ্বীনি জীবন-যাপন গুনগুনকে ক্রমশ আকৃষ্ট করতে থাকল।
কিন্তু সর্বদাই মেয়েটা কোমল অথচ দৃঢ় অদৃশ্য এক সীমারেখা নিজের চারপাশে টেনে রাখে।তার সব কথাতেই আশার বার্তা থাকে। দিনদিন তাদের বন্ধুত্ব আরও গভীর হতে থাকল।
গুনগুনের আজকাল মনে হয় তার একটা পরিবর্তন আসছে। এই একইরকম জীবন-ধারা আজকাল তার ভালো লাগে না।নিজের করা কাজগুলোর মধ্যে সে ভালো খারাপের হিসেব নিকেশ করে। তখন নিজের করা প্রতিটি খারাপ কাজের জন্য তার মনে তীব্র অনুশোচনা হয়।
শ্রাবণ মাস,আকাশ জুড়ে মেঘের আনাগোনা।গুনগুন সেই ভীষণ কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে ।আজ তার মন ভীষণ অস্থির।দ্বিধার দেয়াল গুলো চারপাশ থেকে চেপে ধরেছে।শুধু মনে হচ্ছে, এভাবে চলবে না। কিছু একটা ঠিক নেই যেটা তাকে ঠিক করতে হবে।
কিছু একটা যে ঠিক নেই সেটা আজকাল প্রায়শই তার মনে হয়। তবে আজ যেন একটু বেশিই অসস্থি হচ্ছে । নিজের মনের কাছেই সে প্রশ্ন করে,’আচ্ছা এগুলো কি আফরিনের কথার প্রভাব?
উত্তর আসে , ‘হ্যাঁ, আফরিনের কথারই প্রভাব।’
ছোট বেলা থেকেই গুনগুনের মধ্যে একধরনের ‘অনুকরণপ্রিয়তা’ আছে। কেউ দারুণ কিছু করে ফেললে তার মধ্যেও জেদ জন্মে যায় সেই কাজটি করার। এক্ষেত্রেও কি সেটাই হচ্ছে?
আফরিনের দ্বীনি চলাফেরা, নম্রতা, নিজেকে সকলের থেকে আড়ালে রাখার যে চেষ্টা সেটা কি তাকে আকর্ষণ করছে?
এতো সবের মাঝেও গুনগুনের কেবল মনে হতো কিছু একটা ঠিক নেই,এই পথটাও তার জন্য নয়।সবকিছুতেই বিভ্রান্তি। তবে কি আজ সঠিক পথটা পাওয়া গেছে?
যে পথে গেলে কখনোই তুচ্ছ ব্যাপারে মন ব্যথিত হবে না, চাওয়া-পাওয়ার এই প্রতিযোগিতা থাকবে না?
গুনগুন আরও গুটিসুটি মেরে বসল।ছোট থেকেই তার কেবল মনে হতো এই পৃথিবীতে কেউ তার আপন নয়। বাবা নামক গাছের ছায়া যে মেয়ের মাথার ওপর নেই, সে মেয়েই জানে জীবন কেমন হয়।কাছের মানুষগুলো কিভাবে দায় এড়াতে দূরে সরে যায়।নিজের মা’ও সর্বদা অশুভ আশংকায় ভীত থাকে।
গুনগুন ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগলো।নিজেকে বিশেষ কিছু বানানোর আগ্রহ আর পূর্বের সকল কাজের জন্য অনুশোচনাই তাকে বদলাতে সাহায্য করলো।সে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রিয় হবার তাড়না অনুভব করলো।তার মধ্যে জেদ চেপে গেল।এজন্য প্রথমেই কে কি ভাববে, কে কি বলবে তা ভাবা সে বাদ দিল।আফরিনের বলা একটা কথা তার কানে বাজতে লাগলো,
‘তুমি যদি পুরো দুনিয়ার মন জয় করে ফেল কিন্তু আল্লাহ যদি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকেন তাহলে প্রকৃত অর্থে তুমি আসলে ব্যার্থ,কিন্তু তুমি যদি শুধু আল্লাহ কে সন্তুষ্ট করতে পার আর নিজের কাজ দ্বারা খুশি করতে পার তাহলে জেনে রেখো পুরো দুনিয়া তোমার বিপক্ষে থাকলেও আসলে তুমিই বিজয়ী। ‘
কথাটাকে সে মনে প্রাণে ধারণ করে নিল।
নিজের ঘরে যেতে গিয়েও সেলিনা ঘুরে দাঁড়ালেন।ঘড়িতে সময়ের কাটা ৩টা ছুই ছুই।গুনগুনের ঘরে বাতি এখনো জ্বলছে। এই রাতদুপুরে তো তার জেগে থাকার কথা নয়।ঘরের ভিরানো দরজা হালকা ফাঁক করে তিনি ভেতরে তাকালেন।গুনগুনকে নামাজরত অবস্থায় দেখে তিনি ভীষণ অবাক হলেন। সেই সাথে তিনি কিছু একটা ভাবতে চেষ্টা করলেন। কিছুদিন যাবৎই তিনি নিজের মেয়ের একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলেন।
গুনগুন এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই পড়ছে।সে যেন একটু চুপচাপ হয়ে গেছে, আগের মতো টিভি দেখা কিংবা গান শোনায় মেতে থাকছে না। বেশিরভাগ সময় সে ঘরের ভেতর থাকছে। তাছাড়া ঘরে গেলেই দেখা যাচ্ছে সে জায়নামাজে বসে আছে নয়তো কোরআন শরিফ পড়ছে।
কিছুদিন আগেই একরাতে খাবার পর বারান্দায় বসে তিনি ‘হিসনুল মুসলিম’ বইটি পড়ছিলেন। এটা তার অতন্ত্য প্রিয় বই।গুনগুন হটাৎ পাশে এসে বসলো।তা ভাবভঙ্গিতে ইতস্ততভাব স্পষ্ট। কিছু একটা বলা প্রয়োজন বলেই বোধহয় সে বলল,’কি করছো মা?’
সেলিনা আড় চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন।তাদের মা-মেয়ের সম্পর্ক কিছুটা চোর-পুলিশের সম্পর্কের মতো। একজন আরেকজনের গা বাচিঁয়ে চলে। তিনি বললেন, ‘বই পড়ছি।কিছু বলবি? ‘
গুনগুন ইতস্তত করে বলল, ‘ইয়ে……… মা, ফজরের সময় তুমি আমাকে একটু ডেকে দেবে?আসলে……. এলার্ম দেওয়ার পরও কাজ হচ্ছে না। উঠতে পারছি না।’
সেলিনা মেয়ের কথা শুনে অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েকে নামাজের কথা বলে বলে তিনি ক্লান্ত। আর আজ মেয়ে নিজেই তাকে ডেকে দিতে বলছে।নিজের খুশিকে যতটা সম্ভব আড়াল করে তিনি বললেন, ‘দেব।’
তবে আড়াল করাটা বোধহয় ঠিকঠাক ভাবে হলো না কারণ গুনগুনকে খুব উৎফুল্ল দেখালো।কিছু বোঝার আগেই সে হুট করে চলে গেল এবং প্রায় সাথে সাথেই ফিরে এলো। তার হাতে ‘কোরআন শরিফ’।মুখটা হাসি হাসি করে এক হাতে মাথা চুলকে সে বলল,’অনেকদিন পড়া হয়নি তো তাই…. ঠিকঠাক পড়তে পারছিলাম না। একটু দেখিয়ে দেবে ?’
উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে মায়ের পাশে বসলো।
সেলিনার চোখে পানি এসে গেল।তিনি ওজু করে এসে হাত ধরে মেয়েকে কোরআন পড়ানো শুরু করলেন। তার মন খুশিতে ভরে গেছে। মেয়েটাকে তিনি সবসময় নিজের মতো করে গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটা ঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।মেয়েটা হয়ে গেল একরোখা স্বভাবের। তাদের মা-মেয়ের মধ্যেও দূরত্ব বাড়তে লাগলো। অথচ আজকের এই গুনগুন কত আলাদা। তার সারা মুখে কি নিষ্পাপ কোমল সারল্য!
সেলিনা দরজা থেকে সরে এলেন। প্রশান্তির নিশ্বাস ফেললেন। মেয়েটা বদলাচ্ছে। যদিও সে তা বুঝতে দিতে চাইছে না তবুও তিনি বুঝতে পারছেন।
গুনগুন আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে। তাকে একইসাথে উত্তেজিত এবং প্রচণ্ড খুশি দেখাচ্ছে। সে আবার আয়নায় তাকালো।আয়নায় যে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে তাকে আগের সেই গুনগুন বলে চেনার কোন উপায় নেই। গুনগুন ভাবছে বাইরে গেলে সবাই কি তার দিকে আড় চোখে তাকাবে?
কথাটা ভেবে সে নিজের মনেই হেসে উঠল। সবাই অবাক হয়ে তাকাবে কিভাবে, কেউ তো তাকে চিনতেই পারবে না!
গুনগুন বেরিয়ে পরার আগে মায়ের কাছে গেল। সেলিনা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আজ তিনি নিজের মেয়েকেই চিনতে পাড়ছেন না।কালো বোরকা, নিকাব, হাতমোজা পড়া এই মেয়েটা তার!
মেয়েকে সর্বদাই তিনি এভাবে দেখতে চেয়েছিলেন। তাই যখন গুনগুন জানালো সে বোরকা পড়তে চায় তিনি তৎক্ষনাৎ আনানোর ব্যবস্থা করলেন। প্রচন্ড খুশি হলেও তিনি মেয়েকে বুঝতে দিলেন না।বুঝতে না দেওয়াই উচিত বলে মনে হল, কারণ মেয়েটা ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে।
চলবে…………
লেখিকাঃঅদ্রিজা আহসান