#প্রজাপতি মন (পর্ব-2)

♡আরশিয়া জান্নাত

“মামা চার প্লেট ফুচকা দেন। একটায় একদম ঝাল দিবেন না। আরেকটায় অনেক ঝাল দিবেন। বাকি দুইটা নরমেল।”
বলেই হাসিব গিয়ে আনহার মুখোমুখি চেয়ারটায় বসলো। তার পাশের চেয়ারে জেবিন আর অপর পাশে জেবিনের বান্ধবী নিতু বসলো।
জেবিন বলল, তুমি ঝাল খেতে পারোনা? ফুচকা কেউ ঝাল ছাড়া খায়?

হাসিব হেসে বলল, আরেহ না না। আমি ঝালখেকো বলতে পারো। আনু ঝাল খেতে পারেনা। ওর জন্যই ঐভাবে বলেছি।

জেবিন,ওহ আচ্ছা!

জেবিন হাসিবের পাশে বসলেও পুরোটা সময় হাসিব আনহার দিকেই মনোযোগী ছিল। আনহাকে ট্যিসু কিংবা পানির গ্লাস এগিয়ে দেওয়া সবকিছুতেই আনহার প্রতি তার কেয়ারটাই চোখে পড়ছিল। জেবিন বিষয়টাকে সহজভাবেই নিলো যেহেতু সবাই জানে আনহা আর হাসিব ছোটবেলা থেকেই বন্ধু। কিন্তু এ ভেবেও খারাপ লাগছে হাসিব তার দিকে মিনিমাম ফোকাস দিচ্ছেনা। এমনকি যাওয়ার সময় তাকে রিকশায় তুলে দেওয়ার বদলে আনহার সঙ্গেই রিকশায় উঠে গেল। নীতু টিপ্পনি কেটে বললো, তোর বফ দেখি তোর চেয়ে তার ফ্রেন্ডের প্রতি বেশি কনসার্ন!
জেবিন বললো, প্রথমবার মিট করেছি তো তাই হয়তো লজ্জা পাচ্ছে। ব্যপার না।

রিকশায় করে আনহা আর হাসিব বাসায় যাচ্ছে। আনহা বললো, তুই আসলেই বলদ! আমার সাথে না এসে তোর জেবিনের সাথে যাওয়া উচিত ছিল।

–কিভাবে যাইতাম ওর সাথে? রিকশায় তিনজন কেমনে যাবো?
— রিকশায় না যাস আগে ওরে রিকশা ঠিক করে যাওয়া অবধি ওয়েট করতি! তারপর নাহয় আমরা ফিরতাম। ওরা কি ভাবলো বলতো?
— আরেহ এতোকিছু ভাববে ক্যান! সবাই তোর মতো ভাবুক না।
–না হলে তো ভালোই।
–তোর এই কালারের কয়টা ড্রেস আছে?
–ক্যান?
–বলোস না। এতো প্রশ্ন করোস ক্যান?
— আছে হয়তো দুই তিন টা।
–ঐগুলো বাইরে কোথাও পড়িস না বেশি।
–মানে?
–মানে কি আবার। মানা করছি তো করছি।
–তোর মানা শুনবার সলিড রিজন দে। তাহলে শুনমু।
–বললে আমারে তুই এখন রিকশা থেকে লাথি মেরে ফেলে দিবি। তাই রিস্ক নিবোনা। তবে শোন আমি যদি এই কালারে তোরে বাইরে দেখি খুব খারাপ হবে।
আনহা আর কিছু বললো না। বাসায় গিয়ে আয়নায় দেখে বের করতে হবে রহস্য। এখন চুপ থাকাই শ্রেয়।


নিশিথা বসে বসে বোনের কান্ডকারখানা দেখছে। আনহা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার আয়নায় নিজেকে দেখছে। নিশিথা প্রথমে বিষয়টাকে পাত্তা না দিলেও দেড় ঘন্টা যাবত একটা মেয়ে বাইরে থেকে এসে ফ্রেশ না হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটা মোটেও স্বাভাবিক ঘটনা না। নিশিথা বিরক্ত হয়ে বললো, ডেটে গেল হাসিব আর জেবিন আর প্রেমে পড়ার লক্ষণ তোর মধ্যে বিরাজমান ব্যাপার কি বলতো? আয়নায় কি দেখোস এতো?

আনহা এবার বোনের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, আপু দেখতো আমার সব ঠিক আছে কি না?
একবার কাছে এসে আরেকবার হেটে দূরে গিয়ে নিজের স্বাভাবিক অঙ্গিভঙ্গি করে দেখালো।

–সব ঠিকই তো আছে। অস্বাভাবিক কি?

— আপু একটু মন দিয়ে দেখ না?

–আমার চোখ দুইটা সাধারণ মানুষের চোখ এক্সরে মেশিন না। যা দেখা যাচ্ছে তাই তো বলছি।

— আপু একটু শকুনের চোখ করে দেখ তো। মানে ছেলেদের চোখ যেমন….

–কি হইছে বল। তোরে কেউ টিজ করছে? কোন রাস্তায় করছে বল একবার, কাইয়্যুমরে বলে শালার মুখ যদি না ভাঙছি আমার নাম বদলাই ফেলবো। নিশিথার বোনরে টিজ করবে এত্ত বড় সাহস কার আছে দেখি!
–আহা আপু তেমন কিছু না তুই দেখ না খালি। ইন্নার বোঝা যাচ্ছে কোনো ভাবে?

–তুই আসলেই বলদ। বোটল গ্রীন কালারের কাতান কাপড়ে কেমনে ইন্নার বোঝা যায়? ইনফ্যাক্ট তোরে এই জামাটা পড়লে পরীর মতো লাগে। তোর গায়ের রংটা একদম ফুটে উঠে থু থু আমার নজর না লাগুক। মাশাআল্লাহ

আনহা কথাটায় সন্তুষ্ট হলোনা। হাসিব নিশ্চয়ই সৌন্দর্যের জন্য তাকে নিষেধাজ্ঞা দিবেনা। এখানে কোনো রিজন তো আছেই।
🦋🦋🦋🦋🦋🦋

নিশিথা একটা বক্স সামনে নিয়ে বসলো। বক্স খুলে দেখে বেশ কয়েকটা সিডি ক্যাসেট আর বই সাথে একটা চিঠি। চিঠির লেখা এতো বেশি সুন্দর যে কেউ দেখলে এই চিঠি লেখকের প্রেমে পড়বে। সে আনহাকে বলল, এইটা বাঁধাই করে রেখে দিবো ভাবছি কি বলিস?

আসলেই অসম্ভব সুন্দর। বাঁধাই করে রাখতে পারিস।

চল সিডিগুলো প্লে করে দেখি। অনেক রেয়ার মুভির সিডি দিছে।

তুই দেখ আমার পড়া আছে অনেক।

তোর সারাক্ষণই পড়া থাকে। এভাবে পড়াকেন্দ্রীক জীবন কাটাইলে শেষ বয়সে স্মৃতি হাতড়ানোর মতো কিছুই থাকবেনা। তখন বসে বসে বোর হবি। প্রতিটা মানুষের উচিত অনেকগুলো স্মৃতি জমানো। মৃত্যুর পরেও যেন মানুষ তার স্মৃতিচারণ করে এমন কিছু করা।

আপু একটা কথা বলবি?

বলে ফেল

তুই কাউকে ভালোবাসিস? এই যে এতো ছেলের সাথে তোর আলাপ এদের মধ্যে কাউকে বিয়ে করার মতো মনে হয়?

তোকে একটা কথা বলি তাহলে শোন। এরা আমার ভালো বন্ধু কিংবা গল্প করার সঙ্গী বলতে পারিস। না এরা আমাকে ভালোবাসে না আমি এদেরকে ভালোবাসি। আশেপাশের কোনো ছেলের সাথে যদি দুইদিন গল্প করি বাসায় রটে যাবে প্রেম করছি। কিন্তু দূরের মানুষের সাথে সুখ দুঃখ শেয়ার করলেও কি! তারা তো আর আমার বাসায় এসে সব বলে দিবেনা বা বলার জন্য ঠিকানাও পাবেনা। বিষয়টা আমি জাস্ট টাইম পাস করার বেটার অপশন হিসেবে নিচ্ছি।

কিন্তু তুই সিওর কিভাবে এদের মধ্যে কেউ তোর প্রতি আগ্রহী না? এমনো হতে পারে তোকে মোটেও টাইমপাস হিসেবে নিচ্ছেনা।

আমি শুরুতেই এই কথা বলে দেই। দু তিন জন তো জানে আমি ম্যারিড হেহেহে।

তাও কথা বলে?!

হ্যাঁ বলে তো। সবাই তো প্রেমের আলাপ করতে আসেনা।

তাহলে কেন কেউ টাকা নষ্ট করে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে!

তুই বেশি কথা বলোস। যা পড় গিয়ে।

আপু তোর এটা নেশা হয়ে গেলে? দেখা গেল বিয়ের পরো তুই অন্য ছেলের সাথে কথা বলছিস। পরে তোর বর এসব নিয়ে অশান্তি করবে! এসব ছেড়ে দে।

নিশিথা মোটেও কানে তুললো না।

আনহার বিদায় অনুষ্ঠানের দিন সবাই প্ল্যান করে শাড়ি পড়লো। সকলের খোঁপায় বেলী ফুলের মালা। ছেলেরা সবাই ফতুয়া পড়লো। আনহাকে নিশিথা জোর করে সাজিয়ে দিলো। স্কুল লাইফের শেষ দিন একটু জাঁকজমকপূর্ণ না হলে চলে?
হাসিব গেইটের সামনে এসে আনহাকে ডাকতে লাগলো। আনহা আর দেরি না করে বেরিয়ে বললো, এমন ষাঁড়ের মতো না চেঁচিয়ে ভেতরে গিয়ে বসলেই পারতি।

বাপরে এইজন্য এতোক্ষণ লাগছে! এতো সাজ দিছোস যেন তোর বিয়া লাগছে।

বেশি হইছে? সঙ লাগতেছে না? আপুরে বলছিলাম সাজাইও না শুনেই নাই। তুই দাঁড়া মুখ ধুয়ে আসি।

দিমু এক চড়। চল তো এমনিতেই লেট হই গেছে পরে যাই দেখমু অনুষ্ঠান শেষ।

আনহা মুখ ভার করে রিকশায় উঠলো।

দোস্ত তাকা এদিকে, আনহা তাকাতেই হাসিব তার ক্যামেরায় ছবি তুলে নিলো।

হাসিব তিনটা রিল এনেছিল ছবি তোলার জন্য। একটা রিলে ত্রিশটা করে ছবি তোলা যাবে। জেবিনের ছবি চার পাঁচটা তুললেও আনহার ছবিই তুললো ডজনখানেক। গ্রুপ ফটো থেকে শুরু করে ডুয়েট সিঙ্গেল সব ছবিতেই আনহার উপস্থিতি মাস্ট। আনহা যখন বিদায়ী ছাত্রছাত্রীর পক্ষ থেকে স্পিচ দিতে উঠলো, এক সেকেন্ডের জন্য অন্যদিকে তাকায় নি হাসিব। তার জীবনে আনহার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই।
এই বিষয়গুলো আর কারো চোখে না পড়লেও জেবিনের চোখে বালির মতো বিঁধেছে। ছয়মাসের সম্পর্কে একটা দিন তারা একা মিট করেনি। ফোনালাপেও বেশিরভাগ গল্প আনহাকে নিয়েই। জেবিন যতোই ভেবেছে ওরা খুব ভালো বন্ধু বলে এমন ততোই হাসিব এমন কাজ করেছে যাতে ধারণা ভুল প্রমাণ হয়। অনেক ভেবে ঠিক করলো পরীক্ষার পরেই ব্রেকাপ করে ফেলবে। এমন সম্পর্কের কোনো মানেই হয়না।



নিশু তুমি কি আজ বিকেলে ফ্রি থাকবে?

ক্যান বলোতো?

পাশেই একটা নতুন পার্ক হয়েছে। পুরোপুরি কমপ্লিট হয়নি তবে সবাই যায়। আমাদের এখানে তো এমন কোনো পার্ক আগে হয় নি তাই যেতে চাচ্ছিলাম।

কমপ্লিট হোক তারপর যেও। এখন গিয়ে কি করবা? আর সবাই ঘাস কাটলে তুমিও কি ঘাস কাটবা?

কাইয়্যুম মুখ কালো করে বললো, আমি ঘাস কেটে কি করবো!

সেটাইতো! তাহলে ইনকমপ্লিট পার্কে গিয়ে কি করবা?

আচ্ছা পার্কে না যাই এমনিতেই বাইরে কোথাও বসি? ফাস্টফুডের দোকানে যাবা? নাহয় তিতাস নদীর পাড়ে?

ঘুরতে যাওয়ার জন্য মন ছুটছে বুঝছি। গেলে ঐ পার্কে চলো। কয়দিন আগে নদীতে গেছি এখন আর যাবোনা।

কাইয়্যুম খুশিমনে বললো, থ্যাঙ্ক ইউ।

নিশিথা হাসি দিয়ে চলে গেল। কাইয়্যুমের মনে হলো তার হার্টবিট মিস হয়ে গেছে। এই মেয়েটার মাঝে কি আছে বুঝে পায় না সে। যতোই দূরে যেতে চায় কোনো এক বিশেষ শক্তি ততোই তার কাছে পাঠাতে চেষ্টা করে। দুনিয়ার কাউকে পরোয়া না করা ছেলেটা এই একমাত্র মানুষটার পরোয়া করে। তার সামনে বোকা হয়ে থাকাতেও স্বস্তি মেলে। কাইয়্যুম খুব ভালোভাবেই টের পায় তার বুকে পাহাড়সম প্রেম জমা হচ্ছে এই নিশিথা নামক মেয়েটার নামে। কিন্তু বন্ধুত্ব নষ্ট হবার ভয়ে মনের কথা বলার সাহস পায় না। সে জানেনা এই জীবনে কখনো জানানো হবে কি না তাণ্ডব তোলা অনুভূতির গল্প!

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here