#পুষ্পবৃষ্টির_সেই_দিনে💙
#মাইশাতুল_মিহির
#প্রথমাংশ
[ছোটগল্প]
বর্ষণমুখর দিনে ঘন কালো মেঘে আকাশ আবৃত হয়ে আছে। উত্তর দক্ষিনে বইছে প্রভাহমান মৃদু বাতাস। হাল্কা শীতের আমেজ চারদিকে। কদম ফুল গুলো ভীজে টুইটুম্বুর হয়ে আছে। সদ্য বানানো বাবুইপাখির বাসা বৃষ্টির সাথে না পেরে সুদীর্ঘ তালগাছ থেকে নিচে পরে আছে। মানুষ কাথা মুড়িয়ে আয়েশে শুয়ে আছে বোধ হয়। বৃষ্টিকাল মানেই গ্রামের কাচা রাস্তা ভিজে কাদা হওয়া। অসাবধানতায় পা ফেললে পিছলে কোমড় ভেঙ্গে বড়সড় একখান বোয়াল মাছ ধরার সুযোগ হবে।
মেইনরোড থেকে অটো গাড়ি গ্রামের রাস্তায় নামে। বৃষ্টি হওয়ার কারনে রাস্তার অবস্থা বেশ অবনতি ঘটেছে। সে দিকে বিন্দুমাত্র ধ্যান নেই যুবকের। সে তো চোখ বন্ধ করে ভেজা মাটির ঘ্রান নিতে ব্যস্ত। উপভোগ করছে বর্ষনে ভিজে যাওয়া গ্রামের পরিবেশ। আজ কত দিন পর গ্রামে এসেছে সে। পড়াশোনার জন্য এতো ব্যস্ত থাকে যে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় বছর হবে গ্রামে আসে না। মাঝ রাস্তায় গাড়ি আটকে পরায় ড্রাইভার হাক ছেড়ে বলে, ‘বাবু সাহেব। গাড়ি আর যাইতো না। আফনে কস্ট কইরা বাহি রাস্তা যান গা।’
বিরক্ত হলেও প্রকাশ করেনি নিভ্র। চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে পকেট থেকে টাকা বের করে ড্রাইভার কে দেয়।
‘বাবু সাহেব। আমি ত মাইঝ রাস্তা লাহান আইছি খালি। আমারে ত অদ্ধেক বারা আনা দিবেন। আফনে বেসি দিয়া লাইছেন।’
নিভ্র মৃদু হেসে বলে, ‘চাচা এইটা আপনি রেখে দেন। দিতে হবে না।’
লোকটি চটে গিয়ে বলে, ‘কি কন মিয়া? হালাল কামাই হাই। আমি যদ্দুর যাই নাই ত হেদ্দুরের লাইজ্ঞা ভারা নিমু ক্যান? না বাবু সাহেব বাহি টেহা আফনে নিয়া লন।’ নিভ্রের হাতে বাকি টাকা টা দিয়ে চলে যায় ড্রাইভার। অবাক হয়ে যায় সে। গ্রামের মানুষ, ড্রাইভার হলেও কি হবে আত্মসম্মানবোধ আছে প্রবল। পকেটে টাকা রেখে ট্রাভেল ব্যাগ কাধে ঝুলিয়ে হাটা ধরে নিভ্র। আকাশের অবস্থা ভালো ঠেকছে না তাই দ্রুত পা চালাচ্ছে সে। কিন্তু তাড়াতাড়ি হাটলেই কি হবে? রাস্তা যে পানিতে ভিজে কাদা কাদা হয়ে আছে। জুতার অবস্থা খারাপের চেয়ে খারাপ হয়ে গেছে। নিভ্র জুতার দিকে তাকিয়ে নাক কুঁচকে সামনের দিকে হাটতে থাকে।
এতো বছর পর গ্রামে আসায় সে কিছুই চিনতে পারছে না। রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়া এক ভদ্র লোকের দিকে নজর গেলো তার। এগিয়ে গেলো তার দিকে। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আঙ্কেল, মোস্তফা কামাল এর বাড়িটা কোন দিকে?’
লোকটা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো নিভ্রর দিকে। নিভ্র ভ্যাবাচেকা খায়ে যায়। লোকটা গম্ভীর মুখে ‘সোজা রাস্তায় যাও।’ বলেই চলে যায়। নিভ্র অবাক হয়ে নিচু গলায় ভেঙ্গ করে বলে, ‘সোজা রাস্তায় যাও।’ বিরক্ত লাগছে তার। কেনো যে আসতে গেলো তাও আবার বৃষ্টির দিনে। সাথে কেউ থাকলে একটা কথা ছিলো কিন্তু না বাহাদুরি দেখিয়ে একা এসেছে।
কিছুক্ষণ হাটার পর একটা বৃদ্ধকে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘দাদু, মোস্তফা কামাল উনার বাড়িটা কোন দিকে?’
বৃদ্ধ ভাঙ্গা গলায় উত্তর দিলো, ‘সুজা রাস্তায় গেলে তো বাজান মেলা সময় লাগবো। তুমি এইহান দিয়া নাইমা খেতের মাঝ খান দিয়া যাও। এর পরে ডাইনে ঘুরবা। সামনে একখান বড় পুকুর দেখবা। পুকুর পাড়ের সামনেই মোস্তফাদের বাড়ি।’ নিভ্র বৃদ্ধ লোকটাকে ধন্যবাদ দিয়ে নেমে যায় রাস্তা থেকে। রাস্তার ডান পাশে জমি, আর বা পাশে বসতবাড়ি। জমির মাঝখান দিয়ে হাটতে আরো কষ্ট হচ্ছে তার। মনে মনে কানে ধরেছে এই জীবনে আর বর্ষাকালে গ্রামে আসবে না। পুকুরপাড়ে এসে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে নিভ্র। পুকুরপাড়ে বিশাল ইট দিয়ে পাকা করা সিঁড়ি আছে। এই পুকুরটা তার চেনা। ছোট বেলায় এখানেই সাতার শিখেছিলো সে। ভেবেই ভালোলাগা কাজ করে মনে।
পাড় দিয়ে হাটার সময় নিভ্রর কানে হাসির আওয়াজ আসে সাথে ঝুমুর ঝুমুর নূপুরের আওয়াজ। নিভ্র ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে শব্দের উৎস খুজছে। তখনি নজর যায় পুকুর পাড়ের সিঁড়ির উপর। সেখানে লাল পারের সাদা শাড়ি পরা এক রমনীর হাত বাড়িয়ে উচু গাছের ডাল থেকে কদম ফুল পারার আপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে। দুই হাতে লাল কাচের রেশমি চুড়ি, চুল গুলো বেনী করে একপাশে আনা, শাড়ির আচল কোমড়ে পেছানো। নিভ্রের মনে এক অজানা অনুভূতি হানা দিচ্ছে। বুকের বা পাশের হৃদযন্ত্রটা দ্রুত গতিতে চলছে। অপলক চোখে মুগ্ধকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই শুভ্র রাঙ্গা রমনীর দিকে।
‘শুভ্রতা, দাদাভাই জানতে পারলে বকবে। আর ফুল লাগবে না চলে আয়।’ নিলুর কথায় শান্ত হয়ে দাঁড়ায় শুভ্রতা। সিঁড়িতে পরে থাকা কদম ফুল গুলো হাতে নিয়ে বলে, ‘হ্যা চল। দাদাভাই ঘুম থেকে উঠার আগে ঘরে গেলেই চলবে।’ চলে যায় তারা এখান থেকে।
শুভ্রতা যেতেই নিভ্রের ধ্যান ভাঙ্গে। নিজেকে এখন অধম বলে গালি দিচ্ছে ইচ্ছে করছে তার। একটা সামান্য মেয়ের দিকে কেমন বেহায়ার মতো তাকিয়ে ছিলো এতোক্ষন। নিজের মাথায় নিজেই দুইটা চাপড় দিয়ে হাটা শুরু করে।
.
অবশেষে নিভ্র এসে পৌচালো তার দাদার বাড়িতে। বাড়ির সামনে গেইটের ভিতর দাঁড়িয়ে প্রহর করছে বাড়িটা। একটা বিশাল আঙ্গিনা জুড়ে দাড়িয়ে আছে দুই তলার বাড়িটি। বাড়িটির সামনে বিশাল উঠান। একপাশে গোসলখানা, তার সাথে লাগানো টিউবওয়েল তার চারদিকে টিন দিয়ে ঘেরা যেনো বাহির থেকে কিছু দেখা না যায়। অপর পাশে বিশাল রান্না ঘর। বাড়ির দুই তলার সামনে লম্বা বারান্দা। স্মিত হেসে উঠানের সামনে এসে ডাক দিলো, ”দাদাভাই! চাচাজান! চাচিমা!”
রান্না ঘর থেকে শাড়ির আচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বের হলো বাড়ির বড় বউ। নিভ্র কে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। চিনার পর ঝাঁপিয়ে পরলো নিভ্রের উপর। ডাক দিতে লাগলো সবাইকে। মুহূর্তে শোরগুল পাকিয়ে গেলো মোস্তফা কামালের বাড়ি। এতো বছর পর তাদের বাড়ির ছেলে বাড়ি এসেছে খুশী আত্মহারা সবাই।
মোস্তফা কামাল হলো নিভ্রের দাদা। উনি গ্রামের চেয়ারম্যান ছিলো বিধায় এক নামে সবাই চিনে। নিভ্রের বাবারা তিন ভাই এক বোন। নিভ্রের বাবা মেজো। তিনি ঢাকা বিডিআর এ জব করে বিধায় প্রথম থেকেই ঢাকা থাকে। নিভ্রের বড় চাচা গ্রামে ব্যবসা করে। আর ছোট চাচা বাজারে থাকা দোকানপাট দেখে থাকেন। বড় চাচার তিন মেয়ে, নিভ্রর একটা ছোট বোন আছে, আর ছোট চাচার দুই মেয়ে। মানে মোস্তফা কামালের পরিবারে বংশের প্রদীপ শুধু মাত্র নিভ্র। তাই এতো আদর, আহ্লাদ।
বসার ঘরে নিভ্রকে বসিয়ে তার বড় চাচি আর ছোট চাচি রান্না ঘরে গিয়ে রান্নার আয়োজন শুরু করে দিয়েছে। নিভ্রের বড় চাচা উপজেলায় গেছে ভালো ভালো মাছ মাংস বাজার করতে, আর ছোট চাচা গেলো গ্রামের বাজারে সবজি আর বাকি সব সদায় আনতে। এতো দিন পর ছেলেটা এলো ভালোমন্দ খাওয়াতে হবে তো।
নিভ্র এখানে একা একা বসে থাকতে ভালো লাগছে না। আশেপাশে তাকিয়ে তার চাচাতো বোন গুলো খুঁজছে। এমন সময় বড় চাচার বড় মেয়ে নিলাশা, ছোট চাচার ছোট মেয়ে শুভ্রা আসে। দুইজন নিভ্রের সাথে বসে গল্প করছে। এমন সময় নিলাশার মেজো বোন নিলা লেবুর শরবত হাতে নিয়ে এলো। নিভ্রকে দেখে লজ্জামাখা হাসি দিয়ে বলে, ‘এই নিন নিভ্র ভাই।’
নিভ্র মুচকি হাসি দিয়ে গ্লাস হাতে নিয়ে এক চুমুকে সবটা শেষ করলো। নিলাশা বললো, ‘কিরে নিলা, নিলু আর শুভতা কোথায়?’
‘আর বলো না আপু। বৃষ্টি থামার পর দুইজন যে বেড়িয়েছে কদম ফুল আনতে তার পর থেকে আর দেখিনি। হয়তো ছাদের চিলকোঠায় বসে আছে দুইজন।’
নিলাশা চটে কন্ঠে রাগ ফুটিয়ে বলে, ‘আসুক দুই মেয়ে। ওদের কান মলাই যদি না দিয়েছি।’ তারপর নিভ্রের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘নিভ্র তুই অনেক বড় রাস্তা পাড়ি দিয়ে এসেছিস, এখন রেস্ট নে। পরে কথা বলবো।’
বেরিয়ে যায় তিন জন। নিভ্র ভাবছে নিলার কথা। তার মানে শুভ্রতা আর নিলু তখন পুকুরপাড়ে ছিলো। ওদের চেহারাও তো মনে নেই। স্নিগ্ধ মায়া ভরা মেয়েটি কে? নিলু নাকি শুভ্রতা?
.
সন্ধ্যা সাত টায় ঘুম ভাঙ্গে নিভ্রের। বাড়ির প্রত্যেক টা রুমের সাথেই এক্সট্রা বাথরুম আছে। নিভ্র ফ্রেশ হয়ে নিচে বসার রুমে গেলো। দুই চাচা আর নিভ্রের দাদা বসে চা খাচ্ছে। নিভ্রকে দেখে মোস্তফা কাপাকাপা গলায় বলে, ‘নিভ্র বাবা আসো এখানে।’ নিভ্র এগিয়ে বসলো দাদার পাশে। বড় চাচা জোড়ে বলে উঠে, ‘নিলু এক কাপ চা দিয়ে যা তো।’
সবাই আড্ডায় মশগুল হয়। নিলু এসে নিভ্রকে চা দিয়ে কুষলবিনীময় করে চলে যায়। নিভ্র চা কাপে চুমুক দিচ্ছে আর ভাবছে তাহলে শুভ্রতা ছিলো সেই মেয়েটা!’
নিভ্রের চাচিরা রান্নার আয়োজন শেষ করে নিভ্রকে আদর যত্ন করে খাওয়ালো। বেশ কয়েক প্রকার পিঠাপুলি, কয়েক রকমের মাংস তরকারি, বিভিন্ন মাছ তরকারি দিয়ে নিভ্রকে খাওয়ালো। নিভ্রর মনে হচ্ছে এতো খাবার সে তার ২৫ বছর জীবনে খায় নি কখনো।
.
ভোরের স্নিগ্ধ পাখির কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙ্গে নিভ্রের। বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে গায়ে নীল টি-শার্ট পরে বের হলো রুম থেকে। ব্যালকনির রেলিং এ দুই হাতের ভর দিয়ে দাঁড়ালো। তখন নজর গেলো বাড়ির পাশের টিউবওয়েলের সামনে। গাঢ় রানী গোলাপি পারের কাচা হলুদ শাড়ি পরা মেয়েটির দিকে। দুই হাতে হলুদ রেশমি চুড়ি, সেই দিনের মতো আচল কোমড়ে বাধা। হয়তো টিউবওয়েল থেকে হাত মুখ ধুয়েছে। মুখে লেগে থাকা জলের বিন্দু কণা মুক্তের ন্যায় চিকচিক করছে। এই ষোড়শী কন্যার মধ্যে কি এমন আছে যা আমাকে বারবার মুগ্ধ করে? গায়েল করা মতো স্নিগ্ধ হাসিতে মন উতালপাল করে দিচ্ছে কেনো? তবে কি আমি এই ষোড়শী মায়াবিনী কন্যার প্রেমে পরেছি? শুভ্রতা কে উপরে আসতে দেখে নিভ্র তড়িঘড়ি করে রুমে ঢুকে যায়। এই মেয়ের সামনে আর পরা যাবে না। মস্তিষ্ক জোড়ে শুধু এই মেয়েই বিচরণ করছে। কি সাংঘাতিক!
চলবে??