#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২০)
মেরুন রঙের শাড়ির সাথে পিঠময় ছড়িয়ে আছে ঘন গোছার চুল। উল্টো দিকে ঘুরে থাকলেও একপাশে কানের লতিকায় ছোট্ট ঝুমকা জ্বলজ্বল করছে! মাহদীর পুরো মনোযোগ যখন দুলটায় এসে পড়ল ঠিক তখনই ঝুমকাটা নড়ে উঠল। চুড়ির ঝনঝন শব্দে তার কর্ণলতা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। বুকের মধ্যে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া সাইক্লোনটা থেমে গেল। ভ্রম কাটিয়ে চেতনা ফিরতে খেয়াল করল একটা মেয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছে। পাখার হাওয়াই এলোমেলোভাবে উড়ে যাওয়া চুলগুলো ঠিক করতে গিয়েই হাতটা বার বার ঝুমকোতে বাড়ি খাচ্ছে। চিকন দুটো চুড়ি একে অপরের সাথে লেগে মৃদু শব্দ তুলছে। মাহদী এক হাতে পাখা বন্ধ করল অন্য হাতে দরজায় ঝুলে থাকা পর্দা টেনে ছিঁড়ে ছুঁড়ে মারল শাড়ি পরা মেয়েটির দিকে। মাথাসহ মুখ ঢেকে যেতে মাহদী ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল,
” দুই মিনিটের মধ্যে নায়রার ব্যবহৃত জিনিস খুলে রাখবে। ”
নিহিতা ভয়ে কেঁপে উঠলেও দমে গেল না। পর্দা ফেলে মাহদির দিকে ঘুরে বলল,
” কেন? আমি কি আপুর শাড়ি পরতে পারি না? ”
মাহদি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। আগুনের ফুলকির মতো উত্তপ্ত চাহনি! নিহিতা পুড়ে যাওয়ার ভয়ে চোখ নামিয়ে নিলে মাহদী বলল,
” অবশ্যই পার। কিন্তু বউ সাজতে পার না। ”
” বউ সাজতে যাব কেন? আমি তো শুধু শাড়িটা পরে দেখছিলাম আমাকে কেমন লাগে। ”
নিহিতা দুর্বল জবানবন্দি দিয়ে মাহদীর দিকে তাকাল। খেয়াল করল সে তার হাতের চুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। নিহিতা চট করে হাতদুটো পেছনে নিলে, মাহদী রুষ্ট স্বরে বলল,
” আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। মনে রেখ, তোমার হাতে মাত্র দুই মিনিট সময়। ”
মাহদী বেরিয়ে যেতে নিলে নিহিতা জেদ ধরে বলল,
” খুলব না। ”
মাহদী দরজা চেপে ধরল শক্ত চাপে। চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করেও রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। মুখমণ্ডল কাঁপছে অনবরত!
সেই সুযোগে নিহিতা তার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বলল,
” আমি কিছু বলার আগেই সব বুঝে যান কেন, বলুন তো? আপনার এই বিশেষ গুণটি আমাকে আরও বেশি পাগল করে দেয়। এখনও দিচ্ছে। ”
মাহদী তখনও নীরব, চুপচাপ, বাক্যহীন। নিহিতা উৎসাহ নিয়ে বলল,
” ভালোই হয়েছে, আমাকে কষ্ট করে কিছু বলতে হয়নি। লজ্জা থেকে বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ। ”
নিহিতার অনুভূতি প্রকাশে মাহদী কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালে সে আরও উতলা হয়ে পড়ে। মাহদীর কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরিয়ে লাজুক কণ্ঠে বলল,
” কেমন লাগছে বলবেন না? ”
নিহিতার লজ্জামাখা তুলতুলে মুখটার দিকে তাকায় মাহদী। তাকিয়েই থাকে। তাকিয়ে থেকেই তার হাত থেকে চুড়িগুলো খুলে বলল,
” পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুখটির অধিকারী আমার নায়রা, আমার বউ। যে লজ্জা পেলে জোসনা গলে পড়ে। হাসলে তারা খসে পড়ে। কাঁদলে অমাবস্যা হয়। সেই নিষ্কলঙ্ক, পবিত্র, স্নিগ্ধ মুখটিতে প্রসাধনী মাখতে হয় না। আমি তাকালেই সৌন্দর্যের প্রলেপ ভারী হয়। ”
নিহিতার কান থেকে দুলজোড়া খুলে বলল,
” এগুলো আমার দেওয়া উপহার ছিল বলে পড়ে থাকত। মুগ্ধ করতে নয়, ভালোবাসা প্রকাশ করতে। আমার সেই বিশেষ গুণটি তৈরি হয়েছে তোমার আপুর জন্য। কারণ, সে মনের কথা মুখে আনতে লজ্জা পেত। ”
মাহদী নিহিতাকে ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। নিহিতা পিছু নিয়ে বলল,
” মানছি আপু দেখতে সুন্দর ছিল। কিন্তু আমার থেকে বেশি নয়। বিশ্বাস না হলে ভালো করে চেয়ে দেখুন। ”
মাহদী থমকে দাঁড়িয়ে না ঘুরে বলল,
” আমার চোখদুটো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নায়রা ছাড়া আর কাউকে দেখবে না। ”
নিহিতার চোখ জলে টলমল। হাল ছাড়তে রাজি নয়। দৌড়ে এসে বলল,
” যে নেই, তার নামে প্রতিজ্ঞা রেখে কী লাভ? ”
” প্রতিজ্ঞার সাথে থাকা- না থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। নিহিতা, এটা আমার থেকেও তোমার খুব ভালো করে জানা। ”
নিহিতা কিছু একটা বলার জন্য প্রস্তুত হতে দূর থেকে আসমা রহমানের গলা ভেসে এলো,
” মাহদী? কখন এলে? ”
নিহিতার দিক থেকে সম্পূর্ণ মনোযোগ সরিয়ে হালকা হাসল মাহদী। শাশুড়ির দিকে এগুতে এগুতে সালাম দিয়ে বলল,
” এইতো কিছুক্ষণ হলো। আপনারা কখন এসেছেন, আম্মা? বাসা খুঁজে বের করতে কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়? একটা কল করলেই হতো। আমি মনকে নিয়ে স্টেশনে চলে যেতাম। ”
আসমা রহমান আন্তরিক হেসে বললেন,
” কষ্ট হবে কেন? নিহিতার বাবা ছিলেন তো সাথে। ঢাকা শহরের সব চেনা হয়ে গেছে তার। ”
দুজনের কথপোকথনের মধ্যে মন বের হয়ে আসল পাশের রুম থেকে। ঘুম চোখে নানির কোমরের সাথে ঘেষে দাঁড়ালে মাহদী জিজ্ঞেস করল,
” কোথায় ছিলে তুমি? বাসার ফোন বন্ধ কেন? কামাল কোথায়? ”
কামাল এ বাসার বিশ্বস্ত কাজের লোক। মনকে দেখাশুনাসহ প্রয়োজনীয় টুকিটাকি কাজ করে। বয়সে মাহদীর চেয়ে কিছুটা ছোট হবে। মন বাবার প্রশ্ন দেওয়ার বদলে চোখ বন্ধ করে নিলে আসমা রহমান বললেন,
” কামালকে নিয়ে উনি একটু বেরিয়েছেন। এখনও আসেনি বোধ হয়। মন আমার সাথেই ছিল। আগরিবের নামাজ পড়ে একটু শুয়েছিলাম। কখন যে চোখ লেগে এসেছে বুঝতে পারিনি। ”
মনের অবস্থা দেখে মাহদী বুঝে নিল নানির সাথে সেও ঘুমিয়ে পড়েছিল, এখনও ঘুমাচ্ছে। ছেলেকে দাঁড়িয়ে ঘুমাতে দেখে তার খুব হাসি পেল। হাসি চেপে তাকে কোলে তুলে বলল,
” সমস্যা নেই, আম্মা। অনের দূর থেকে এসেছেন তো তাই শরীর ক্লান্ত। আমি মনকে শুয়িয়ে দিয়ে আসছি। ”
মনকে নিয়ে মাহদী চলে গেলে আসমা রহমানের নজর পড়ল নিহিতার উপর। চোখ কপালে তুলে বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,
” তোর পরনে শাড়ি! কোথায় পেলি? ”
নিহিতা বিরক্ত চোখে তাকাল। নিরুত্তরে মায়ের পেছনের রুমে ঢুকে পড়ল। তিনি রুমের দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রান্নাঘরের দিকে পা চালালেন।
___________
রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ, আক্রোশ, অভিমানে যখন নিহিতার চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল তখন ফোনটা বেজে ওঠল। ভেজা পাতা মেলে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাল। অপরিচিত নাম্বার দেখে প্রথমবারে ধরল না। দ্বিতীয়বারেও না। তৃতীয়বারে রিসিভ করে কানে ধরে সালাম দিল। ওপাশ থেকে সালামের উত্তর নিয়ে বলল,
” আমি আহাদ, চিনতে পারছ? ”
আহাদের নামটা শুনতে তার সর্বাঙ্গে মৃদু কম্পন সৃষ্টি হলো। বাকশক্তি হারিয়ে বসলে আহাদ বলল,
” আমি জানি তুমি ছেলেদের সাথে ফোনে কথা বলো না। হয়তো আমার সাথেও বলবে না। তাই মন চাইলেও কল দিইনি। আজ মনটা বড্ড আনচান করছিল, নিহি। কল না দিয়ে থাকতে পারলাম না। একটু কি কথা বলার অনুমতি পাব? ”
নিহিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে চোখ মুছল। ঢোক গিলে গলার স্বর স্বাভাবিক করে বলল,
” জি বলুন। ”
অনুমতি পেয়ে আহাদের কণ্ঠস্বর পালটে গেল। সহজ স্বরে ভালো-মন্দের খোঁজ নেওয়া শেষে জিজ্ঞেস করল,
” চিঠিটা পড়েছিলে? ”
নিহিতা চিঠি পড়েনি। কোথায় রেখেছিল তাও মনে নেই। এদিকে আহাদকে ‘ না ‘ বলতেও খারাপ লাগছে। তাই চুপ করে থাকল।
আহাদ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল,
” আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে চিঠি পড়ার পর তোমার কেমন লেগেছে। বলবে না? ”
নিহিতা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। তন্মধ্যে আহাদ বলল,
” আর আংটিটা কী করেছ? এখনও পরে আছ নাকি খুলে রেখেছ? ”
নিহিতা চট করে হাতের দিকে তাকাল। অনামিকা আঙুলে আংটি নেই। কোথায় গেল? সে তো খুলে রাখেনি! নিহিতা ফোন কানে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বিছানার বালিশ সরিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। সে সময় মন দৌড়ে এসে বলল,
” খালামনি, বাবা বলেছে এটা তোমার। ”
মনের হাতে আংটি দেখে নিহিতা খুশি হলো। পর মুহূর্তে মন খারাপের ঢেউ আছড়ে পড়ল মনপাড়ায়। খানিকটা ভীত হলো এই ভেবে যে, মেয়েলি আংটি না হওয়া সত্ত্বেও বুঝে গেছে এটা তার। তাহলে কি সে জানে আহাদের দেওয়া উপহার গ্রহণ করেছে?
নিহিতার মনখারাপের মধ্যে মন ছুটে চলে যাচ্ছিল। সে দৌড়ে আটকাল। কোলে করে খাটে বসিয়ে বলল,
” ছোট আব্বু, আমাকে দেখতে কেমন লাগছে? ”
মন প্রথমে বুঝতে পারল না। যখন বুঝতে পারল তখন নিহিতার দিকে তাকাল বেশ কৌতূহলে। চুপচাপ গভীর চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,
” খুব সুন্দর। ”
মনের ছোট্ট প্রশংসায় পুলক অনুভূত হলো নিহিতার। মনখারাপ উবে গেল নিমিষেই। চোখের তারায় খুলি ঝিলিক দিল। আবেগে ভেসে মনের কপালে, গালে, নাকে চুমু খেয়ে বলল,
” বাবার কাছে যাও, আমি একটু পর আসছি। ”
মন ছুটি পেয়ে চলে যাচ্ছিল। কী মনে করে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পেছন ঘুরে বলল,
” তুমি আম্মু না সেজে খালামনি সাজলে বেশি সুন্দর লাগে। ”
একটু থেমে আবার বলল,
” বাবা, বলেছে আমি এখন বড় হয়েছি। তোমার সাথে কথা বলার সময় এক হাত দূরে থাকতে হবে। খালামনি, তুমি যে আমাকে চুমু খেলে আল্লাহ কি রাগ করবে? ”
নিহিতা জবাব দিল না। ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ছে। নিজের মতো যে ছেলেকেও তার থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে খুব বুঝতে পারছে। ইচ্ছে করছে মাহদীর কাছে ছুটে যেতে। মনের জ্বালা মেটাতে যা যা করা দরকার সব করতে। মা জেগে আছে বলে রাগটা ভেতরে ধরে রাখল। এর মধ্যে বাবার গলা পেতেই মন ‘নানা’ ডাকতে ডাকতে চলে গেল।
____________
সে রাতে ঘুম হলো না নিহিতার। পরের দিন সকালে ফজরের নামাজ কাযা করে ফেলায় মায়ের হাতে বকুনি খেল খুব। যার সবটাই কর্ণগোচর হলো মাহদীর। নীরবে সবটা সহ্য করে চুপচাপ নাস্তা করে শ্বশুরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তাকে মাহফিলের স্থানে পৌঁছে দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে আসল। তিনি আজ রাতে বাড়ি ফিরবেন না। ফিরতে ফিরতে পরের দিন সকালে। শ্বশুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে পৌঁছাতে একটু দেরি হলো।
দুপুরে খাবার খাওয়ার জন্য বাসায় ফিরে রক্ত গরম হয়ে গেল মাহদীর। নিহিতা আজও নায়রার শাড়ি পরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
” সীমা লঙ্ঘন করো না, একদম ভালো হবে না। মাফ কিন্তু বার বার করা যায় না। ”
নিহিতা পেছন থেকে বলল,
” মাফ করতে বলেছে কে? আপু যদি আপনার রাগকে ভালোবসতে পারে, আমিও পারব। ”
কথার মাঝেই নিজের গাল বাড়িয়ে বলল,
” চাইলে চড়ও মারতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না। ”
চলবে
বিঃদ্রঃ দুলাভাই আর শালির প্রেমে হওয়া- না হওয়াটুকু বাদ দিয়ে অন্য কিছু খুঁজুন। এটি কিন্তু শুধু প্রেমের উপন্যাস নয়।