#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান

#পর্ব (১৮)
” আমি আম্মুকে মেরে ফেলেছি, বাবা? ”

মনকে রাতের খাবার খাওয়াচ্ছিল মাহদী। ছেলের প্রশ্নে ভাত মাখা বন্ধ করে দিল। মনের শিশুসুলভ মুখখানা গম্ভীর, দুঃখের প্রলেপ, ব্যথার আভাস চোখে পড়ার মতো। মাহদীর কলিজায় পীড়িত কামড় পড়তে চাহনি তীক্ষ্ণ হলো। বলল,
” এসব কী ধরনের কথা, মন? ”

মন একটুও ভয় পেল না। মন খারাপের মাত্রা বেড়ে গেল। ব্যাকুল হয়ে বলল,
” বলো না, বাবা। আমি কি আম্মুকে মেরে ফেলেছি? ”

মাহদী রাগ করতে গিয়েও সাবধান হলো। ভার গলায় বলল,
” তুমি মারতে যাবে কেন? তুমি যতক্ষণে পৃথিবীতে এসেছ ততক্ষণে তোমার আম্মু পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। ”
” আমি এসেছিলাম দেখেই আম্মু চলে গেছে। তাই না, বাবা? ”
” আমি কখনও এমন বলেছি? ”
” না। ”
” তাহলে তোমার মাথায় এমন প্রশ্ন আসল কেন? ”

মন নিভে গেল। ঘাবড়ানো স্বরে বলল,
” নানির সাথে যে আরেকটা নানি এসেছিলেন, উনি বলেছেন।
” আরেকটা নানি! কে সে? ”
” চিনি না। আগে দেখিনি। ”

মাহদী অস্থির হয়ে পড়ল। রেগে গেল খুব। ধরে নিল, নিহিতার সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় কেউ একজন হাসপাতালে এসেছিল। এসেই তার ছেলের কানে কুমন্ত্র ঢেলে দিয়েছে। সাথে হতাশ হলো এই ভেবে, এতটুকু বাচ্চার সামনে কী বলতে হয় সে বোধটুকু জন্মায়নি। আয়ু ফুরাচ্ছে বাতাসে বাতাসে! মাহদী রাগটুকু আড়াল করে জিজ্ঞেস করল,
” কী বলেছেন উনি? ”

মন কথাটা বলার আগেই মাহদী থামিয়ে দিল। সে চায় না তাকে বলতে গিয়ে মন সেই কথাগুলো আবার মনে করুক। মাথায় স্থায়ীভাবে চেপে বসুক। নিজেই নিজের মতো ভেবে নিল ঠিক কী কী বললে মনের মনে এমন প্রশ্ন আসতে পারে। ভাবতে ভাবতে শ্বশুরের নাম্বারে ডায়াল করল। ঐপাশ থেকে রিসিভ হলে মাহদী বলল,
” বাবা, আম্মা কি চলে গেছেন? ”
” না। রিকশায় উঠেছে। ছেড়ে দিবে। কেন? ”
” উনার সাথে একটু কথা ছিল। ”

এরশাদ রহমান আর বিলম্ব না করে স্ত্রীর হাতে ফোন ধরিয়ে দিলেন। তারা এখন হাসপাতালের গেইটের সামনে। আসমা রহমান হ্যালো বলতে মাহদী দ্রুত বলল,
” মনের সাথে দেখার করার জন্য আপনার সাথে কেউ এসেছিল? ”

আসমা রহমান কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। সহসা বললেন,
” হ্যাঁ, কলি বু এসেছিল। আমাদের পাশের বাসায় থাকে। ”
” আর কখনও উনাকে নিয়ে আসবেন না। শুধু উনাকে কেন অন্য কাউকে নিয়ে আসবেন না। ”

মাহদীর এমন কথায় আসমা রহমান বিচলিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
” কেন, বাবা? কী হয়েছে? ”

মাহদীর গলার স্বর পালটে গেল। বাচ্চাদের মতো নালিশ করার ভঙ্গিতে বলল,
” আমার ছেলেকে উল্টা-পাল্টা কথা বলেছে, আম্মা। ওর দিকে তাকাতে পারছি না! ”
” কী বলেছে? ”

মাহদী উত্তর দিতে পারল না। ব্যথিত ঢোক গিলে বলল,
” উনার সাথে দেখা হলে বলবেন, নায়রা আমার থেকে হাজারগুণ বেশি ভালোবাসত তার আল্লাহকে। তাই আমাকে ছেড়ে তাঁর কাছে চলে গেছে। আমি যাতে কান্নাকাটি না করি সেজন্য মনকে উপহার দিয়ে গিয়েছে। মন তার আম্মুকে মারার জন্য পৃথিবীতে আসেনি। আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে এসেছে। ”

ফোন পকেটে ভরে মনের কাছে এসে বসল মাহদী। সে কিছু বলার আগেই মন বলল,
” আমাকে কেন এনেছিলে, বাবা? যদি বুঝতাম আমি আসলে আম্মু রাগ করে চলে যাবে তাহলে কখনই আসতাম না। আল্লাহর কাছেই থেকে যেতাম। ”

মাহদীর বিষণ্ণ ঠোঁটে হাসির টান পড়ল। মনে পড়ল মনকে পৃথিবীতে আনার বাসনা প্রকাশের দিনটির কথা। তখন তাদের বৈবাহিক জীবনের ছয় দিন মাত্র। বিয়ের ছুটি শেষ করে অফিসে জয়েন করার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছে। বাসে উঠার পর মনে পড়ল, নায়রার হাতে ফোন নেই। এত দিন বাসায় ছিল বলে ফোনে কথা বলার প্রয়োজন পড়েনি তাই কেনাও হয়নি। এখন কথা বলার প্রয়োজন পড়েছে। মারাত্মক প্রয়োজন! প্রয়োজন পূরণ না হলে মরে যেতে পারে এমন অবস্থা। মাহদী তৎক্ষণাৎ বাস থেকে নামল। কাছের একটি মার্কেট থেকে মোবাইল কিনে বাড়ি ফিরল।

স্বামীকে অসময়ে বাসায় ফিরতে দেখে চমকে যায় নায়রা। চিন্তায়ও পড়ে। শরীর খারাপ করেনি তো? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলে মাহদী বলল,
” না। ”
” তাহলে? ”

মাহদী নায়রার হাতে ফোন তুলে দিয়ে বলল,
” আজ যেতে ইচ্ছে করছে না। ”
” সে কী! কেউ কিছু বলবে না? ”

মাহদী কাপড় বদলাতে বদলাতে বলল,
” না। বলেছি, শরীর খারাপ। ”

নায়রা কিছুক্ষণ মাহদীর দিকে তাকিয়ে থাকল। হাত থেকে মোবাইলটা খাটে রেখে নীরবে রুম থেকে বেরিয়ে গেলে মাহদী পেছন পেছন ছুটে আসে। মানানোর চেষ্টা করে বলল,
” রাগ করলে নাকি? বিশ্বাস করো এমনি এমনি মিথ্যে বলিনি। দরকার ছিল সেজন্য মিথ্যে বলেছি। ”

নায়রা কোনো উত্তর দিল না। মাহদীকে কোনো পাত্তা না দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। দুপুরের জন্য রান্না গুছাচ্ছে। মাহদী রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নায়রার কার্যকলাপ দেখল অনেক্ষণ। তারপর হঠাৎ, অকস্মাৎ বলল,
” তোমার পিরিয়ডের ডেট কবে? ”

নায়রা চকিত চোখে তাকাল। মাহদী সেই চোখে চোখ রাখতে পারল না। আঁখি নামিয়ে বলল,
” আমার বাচ্চা চাই। ”

নায়রা মৌনব্রত ভেঙে ফেলল। কণ্ঠ থেকে বিস্ময় ঝরে পড়ল,
” বাচ্চা! ”

নায়রার কণ্ঠ পেয়ে মাহদীর কণ্ঠস্বর চঞ্চল হয়ে উঠল। বলল,
” তোমাকে আটকে রাখার এছাড়া আর কোনো পথ দেখছি না। ”
” কী বলতে চাচ্ছেন? ”

মাহদী নায়রার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। বলল,
” তোমার ব্যবহারে আমি শুধু বিভ্রান্তই হই, নায়রা। এই মনে হয়, আমাকে খুব ভালোবাস। আমিই তোমার সব। আমার জন্য জীবন দিতে পার। আবার একটু পরেই মনে হয়, আমি তোমার কেউ না। খুব অপছন্দের কেউ। আমার থেকে মুক্তি পেলেই বাঁচ। ”

মাহদীর কথায় এবার নায়রাও বিভ্রান্ত হলো। নির্বাক চোখে তাকালে, মাহদী বলল,
” আমার খুব ভয় হচ্ছে। সাধারণ বিষয় নিয়ে তুমি রাগ করো, কথা বলা বন্ধ করে দেও, কাছে আসতে চাও না। যদি একটু বেশি কিছু করি। বাড়াবাড়ি পর্যায়ের কিছু তখন কী হবে? আমি অফিস থেকে ফিরে তোমাকে পাব তো? ”

প্রশ্নটা করেই মাহদী কিছুক্ষণ চুপ থাকে। মুহূর্তকাল পর আবার বলল,
” আমার তো মনে হয় যেটাকে ভালোবাসা ভাবছি, সেটা আসলে ভালোবাসা নয়। স্ত্রী হিসেবে কর্তব্য পালন করছ শুধু। ”

এ পর্যায়ে নায়রা কিছু বলতে চাইল। সুযোগ দিল না মাহদী। দ্রুত বলল,
” আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না, নায়রা। তোমার সাথে আমার কোনো মিল নেই। সম্পূর্ণ বিপরীত একজন। তোমার পবিত্র মনে আমার জন্য ভালোবাসা কখনই জন্মাবে না। না জন্মাক। আমার কোনো আপত্তি নেই। তুমি শুধু আমার সাথে থাকলেই হবে। আমার চিরকালের সাথী হবে। তার জন্য একটা বাচ্চা চাই। ”

তার দু’মাস বাদেই মন নায়রার পেটে এসেছিল। সুসংবাদটা দেওয়ার সময় নায়রা ফিসফিস করে বলেছিল, ‘ আপনি বাচ্চা চেয়েছিলেন, আমি আপনাকে আমার সম্পূর্ণ মনটাই তুলে দিব। যত ভালোবাসা লাগবে নিয়ে নিবেন। ‘

” বাবা, তুমি অনেক পঁচা। আমার মনখারাপ দেখে তুমি হাসছ। একটুও ভালোবাস না। ”

মন মুখ ফিরিয়ে নিলে মাহদী কান টেনে বলল,
” তোমার আম্মু তো আমাকে ভালোবাসা দিচ্ছিল না। তাই তোমাকে আনতে বলেছিলাম। ভালোবাসা লুট করব বলে। ”

মন বাবার কথা বুঝল না। নির্বাক চাহনি রাখলে মাহদী আবার হেসে ফেলল। ছেলের মাথায় চুমু খেয়ে ভাতের প্লেট তুলে নিয়ে বলল,
” খেয়ে, ঘুমিয়ে পড়ো। কাল খুব সকালে উঠতে হবে। ”
” ডাক্তার ছুটি দিয়েছে? ”
” হ্যাঁ। ”

_________

রাত হয়ে গিয়েছিল দেখে স্ত্রীকে আর একা ছাড়েননি এরশাদ রহমান। নিজেও রিকশায় চেপে বাড়ির গেইটে নামিয়ে সেই রিকশায় হাসপাতালে ফিরে এসেছেন। রিকশা ভাড়া মেটাতে গেলে মাহদী বলল,
” আমি দিচ্ছি, বাবা। ”

এরশাদ রহমান ইতস্ততা দেখালেও না করলেন না। ভাড়া মিটিয়ে মাহদী বলল,
” মন ঘুমাচ্ছে। আসুন একটু হেঁটে আসি। ”

ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মাহদী বলল,
” আমি কখনও চাইনি আপনাদের পরিবারের বিষয়ে কথা বলি। ভবিষ্যতেও চাইব না। কিন্তু.. ”

মাহদী থেমে গেল। শ্বশুরের দিকে ঘুরে বলল,
” একটা অনুরোধ করব। আপনার ইচ্ছে হলে রাখবেন না হলে রাখবেন না। আমি জোর করব না। ”

এরশাদ রহমান আর চুপ থাকলেন না। বললেন,
” কী অনুরোধ? ”

মাহদী সরাসরি বলল,
” নিহিতার বিয়ের ব্যবস্থা করুন। ”

এরশাদ রহমান বিস্মিত হলেন। বললেন,
” নিহিতার বিয়ে! হঠাৎ? ”

মাহদী দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল,
” ধরে নিন, ওর ভালোর জন্য বলছি। ”

এরশাদ রহমান দূর থেকে মাহদীর দিকে তাকিয়ে আছেন। সেভাবে কাটিয়ে দিলেন কয়েক মুহূর্ত। মুহূর্তকাল পর মাহদীর পাশে দাঁড়ালেন। ছুটে চলা গাড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
” প্রতিটি বাবাই চায় তার মেয়ে ভালে থাকুক। আমি ব্যতিক্রম নই। ”

__________
নিহিতা বিকেলে মনকে দেখতে যাবে ভাবলেও মাহদীর জন্য আর যেতে পারল না। তার নীরব শাসানিতে পাওয়া ভয়টা প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়ে। হাসপাতালে যাওয়ার সাহস পায় না। এদিকে মনকে এক পলক দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। রাতে আম্মু আসলে জানতে পারে মন অনেকটাই সুস্থ। পরের দিন সকালেই ছেড়ে দিবে। এই খবর শোনার পর সে যেমন খুশি হয় তেমন পূর্বের অস্থিরতাও বেড়ে যায়। রাতটা কাটে নির্ঘুমে। ফযরের নামজ পড়ে ঝিমুতে ঝিমুতে। চোখ ভর্তি ঘুম আর মাথা ভর্তি যন্ত্রণা নিয়ে বারান্দার সিঁড়িতে বসে থাকে। ক্লান্ত দৃষ্টি গেইট পানে। চোখ দুটো প্রথমে কাকে দেখবে? ছেলেকে নাকি বাবাকে?

সকালের মিষ্টি রোদ উঠোন ছুঁয়ে যখন বারান্দায় পড়ল তখন নিহিতা নড়ে উঠল। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। গেইটে পুরুষ মানুষের পদ ধূলিতে নিহিতা উৎসুক হয়ে পড়লেও পরক্ষণে হতাশ হয়। ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
” বাবা, তুমি একা? মনকে ছাড়েনি? ”

এরশাদ রহমান বাসার ভেতরে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
” হ্যাঁ, ছেড়েছে। ”

নিহিতা বাবাকে ফেলে গেইটের বাইরে উঁকি দিয়ে বলল,
” অন্য রিকশায় করে আসছে? ”
” না। ”
” তাহলে? এক রিকশায় আসলে দেখতে পাচ্ছি না কেন? ”
” এখানে আসেনি তাই দেখতে পাচ্ছিস না। ”
” এখানে আসেনি? ”
” না। ওদেরকে ঢাকার ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে এসেছি। ”

নিহিতা বুঝেও না বোঝার মতো করে বলল,
” কেন? ”
” ঢাকা ফিরে যাবে তাই। ”

বাবার মুখ থেকে কথাটা বেরোতেই নিহিতা দিশাহারা অবস্থায় গেইটের বাইরে চলে যায়। রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলে এরশাদ রহমান দ্রুত জিজ্ঞেস করলেন,
” কোথায় যাচ্ছিস? ”

নিহিতা থেমে গেল। বাবার দিকে না তাকিয়ে বলল,
” ভার্সিটিতে। ”
” এভাবে? ”

নিহিতার খেয়াল করল তার গায়ে বোরকা নেই। কুণ্ঠিত হয়ে বলল,
” বোরকা পরতে মনে নেই, বাবা। ”

এরশাদ রহমানকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না নিহিতা। উঠোনে ধূলো উড়িয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। চোখের পলকে বোরকা পরে তৈরী হয়ে বেরিয়ে আসল। বাবাকে সালাম দিয়ে গেইট পার হবে তখন এরশাদ রহমান বললেন,
” আজ যেতে হবে না। ”
” কেন? ”
” তোকে দেখতে পাত্রপক্ষ আসবে। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here