#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৭)
মনকে আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করার পর ছেলেকে দেখার সুযোগ পেল মাহদী। ভয়ে, আতঙ্কে, দুশ্চিন্তায় তার ভেতরটা শুকিয়ে গেছে যেন! মৃতপ্রায় শরীরটা সামনে এগিয়ে নেওয়ার শক্তিতুকুও নেই বুঝি! হাত-পায়ের অসাড়তা কাটাতে সময় নিয়ে ফেলল কয়েক সেকেন্ড। পা দুটো জোরপূর্বক টেনে নিয়ে কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়াল। মনের আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে চোখ পড়তে তার বুকটা আরও একবার কেঁপে উঠল। আত্মা ফাটা ভয়ংকর চিৎকারটা ভেতরে চাপা দিয়ে তীরবেগে ছুটে যায় কলিজার টুকরার নিকট। কপালে, চোখে, গালে, হাতে অজস্র চুমু খেতে খেতে কেঁদে ফেলে। কান্না-বিজড়িত গলায় বলল,
” আমার বাবাটা! আমার প্রাণটা! আমার আত্মাটা! ”
মন ঘুমিয়ে থাকায় বাবার উষ্ণ ভালোবাসায় সাড়া দিতে পারে না। কান্না দেখতে পায় না। চোখ মুছে দিয়ে আদুরে কথা বলে না। মাহদীর রাত ফুরাল ছেলের হাত ধরে বসে থেকে। এরশাদ রহমান নাতিকে এক ঝলক দেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। ফোন করে মনের বর্তমান অবস্থা জানানো হলেও স্ত্রী স্বচক্ষে দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছেন। কান্নাকাটি জুড়ে দেওয়ায় তিনি আর না করতে পারলেন না। এদিকে মাহদীর আচরণও ভালো ঠেকছে না। ছেলের কাছ থেকে নড়বে তো দূর চোখের দৃষ্টি পর্যন্ত অন্য দিকে নিচ্ছে না। ছেলেটা পাগল হয়ে গেল না তো!
_________
মনের ঘুম ভাঙল পরের দিন সকালে। চোখ মেলে ঠোঁট নেড়ে ক্ষীণ স্বরে ডাকল,
” বাবা! ”
মাহদী চমকে কেঁপে উঠল। চোখের পাতা পড়ল। ভীত মুখখানায় হাসি ফুটল। দুশ্চিন্তা ভুলে মিষ্টি করে বলল,
” শুভ সকাল। বাবাটার ঘুম কেমন হলো? ”
মন সাথে সাথে উত্তর দিল না। চারপাশে চোখ বুলাল। ভীষণ উৎসুকে বলল,
” এটা কি আমাদের নতুন বাসা? ”
মাহদীও এক পলকে চারপাশটা দেখে নিল। মৃদু হেসে ছেলের মুখের দিকে ঝুকে বলল,
” না, বাবা। এটা হসপিটাল। ”
মন এর আগে হাসপাতাল দেখেনি। তাই আগ্রহ নিয়ে আরও একবার চারপাশটা দেখল। শুয়ে থেকে আরাম পাচ্ছিল না দেখে উঠতে চাইল। তার আগেই মাহদী বলল,
” উঠে না, বাবা। মাথায় ব্যথা করবে। ”
” কেন? ”
এই প্রশ্নের উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারছে না মাহদী। সে কি কাল রাতের ঘটনা খুলে বলবে? নাকি লুকিয়ে রাখবে? তন্মধ্যে ডাক্তারের আগমন ঘটল। মনের কাছে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
” কাল খুব দুষ্টুমি করেছিলে যে তাই। ”
মন ডাক্তারকে চিনতে পারল না। কৌতূহল চোখ দুটো তার মুখ ছেড়ে আটকাল গলায় প্যাঁচিয়ে থাকা স্টেথোস্কোপে। সেখানে চোখ রেখে বাবাকে জিজ্ঞেস করল,
” এই আংকেলটা কে, বাবা? ”
মাহদীর উত্তর দিতে হলো না। ডাক্তার মনের দিকে হ্যাণ্ডশেক ভঙ্গিতে ডান হাত বাড়িয়ে বলল,
” আমি ড. আমিদ। ”
মন একবার বাবার দিকে তাকাল। পরক্ষণে ভীষণ উৎসাহে হাত মিলিয়ে বলল,
” আমি বাবার ছেলে মন। ”
ড. আমিদ হেসে ফেলল। মাহদীও মুচকি হাসল। গল্প করার ছলে ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেড়ে ফেললেন ড.আমিদ। বিদায় নিয়ে চলে যেতে মন বলল,
” বাবা, আমি কিন্তু কাল একটুও দুষ্টুমি করিনি। খালামনি মিথ্যে কান্না করতে বললেও শুনিনি। তবুও ড.আমিদ আংকেল আমাকে দুষ্টু বলল। আমি কষ্ট পেয়েছি। ”
এই প্রথম ছেলের কষ্টটা মাহদীর মনে ঝড় তুলল না। সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে জিজ্ঞেস করল,
” খালামনি তোমাকে মিথ্যে কান্না করতে বলেছিল? ”
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”
” যাতে আমরা এখানে আরও কয়েক দিন থাকি। ”
মুহূর্তেই মাহদীর ভেতরটা নড়ে উঠল। ভয়ংকর কিছু ভাবতে চাপ দিচ্ছে চিন্তা-ভাবনারা। সন্দেহটা স্পষ্ট করতে বলল,
” তুমি যে খালামনির কথা শুনোনি সে রাগ করেনি? ধমক দেয়নি? ”
মন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” না। ”
মাহদী আটকে রাখা নিশ্বাসটা ফেলল। খারাপ চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। নিহিতাকে সন্দেহ করার জন্য নিজেকে গালাগালি করল মনে মনে। তারপর ছেলের পাশে বসল। নরম স্বরে বলল,
” বারান্দায় তো আলো ছিল, তাহলে তুমি পড়ে গেলে কিভাবে? সিঁড়ি দিয়ে নামোনি? ”
মন দ্রুত বলল,
” সিঁড়ির কাছে যাওয়ার আগেই তো খালামনি আমাকে ধরে টান দিয়ে নিচে ফেলে দিল। ”
মাহদী তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারল না। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল। বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। উরুতে ঘন ঘন আঘাত করতে করতে চোখ বন্ধ করে ফেলে। অকস্মাৎ মনকে ছেড়ে বেরিয়ে আসে করিডরে। হাসপাতালের গেইটের কাছে ছুটে চলে ঝড়ের গতিতে। তার সাথে ধাক্কা লেগে যে একজন বয়স্ক লোক পড়ে গেল খেয়ালও করল না। খালি রিকশায় উঠে দ্রুত ছোটার হাঁক দিল ভয়ংকর গলায়! রিকশাওয়ালা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পা রাখল প্যাডেলে।
____________
মায়ের সাথে নিহিতাও যেতে চাইল। বোরকার সাথে হাতে-পায়ে মোজা পরে বাবার পিছু নিয়েছিল। রিকশায় একপা রাখতে তার মন বদলে গেল। ইচ্ছা অনিচ্ছায় পরিণত হলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
” তোমরা যাও। আমি একটু পর আসছি। ”
আসমা রহমান বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কেন? ”
” মাথাটা ঘুরছে। ”
” ঘুরবেই তো। রাত থেকে না খাওয়া। ”
নিহিতা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
” একটু ভালো লাগলে আমি চলে আসব, আম্মু। ”
আসমা রহমান আর কথা বাড়ালেন না। মেয়েকে কিছু খেতে বলে নিজের রিকশায় স্বামীকে ডেকে নিলেন।
বাবা-মা চলে গেলেও নিহিতা ঘরে ঢুকল না। বোরকা পরা অবস্থায় বারান্দার সিঁড়িতে বসে থাকল। রাতের ঘটনা চোখের পাতায় ভেসে উঠতে চোখের কোল ভরে উঠল। তীর ভেঙে পানি গড়িয়ে পড়ার মুহূর্তে মাহদীর উপস্থিতি টের পেল। তাকে অবাক করে দিয়ে মাহদী পাশে বসল। নিহিতা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল। বেশ কয়েক সেকেন্ড পর চেতনা ফিরল। মাহদীর পাশ থেকে উঠতে চাইলে বলল,
” চলে যাচ্ছ যে? গল্প শুনবে না? ”
নিহিতা থমকে গেল। বিভ্রান্ত গলায় বলল,
” গল্প? ”
” হ্যাঁ। বসো। ভয় নেই, মা-বাবা এতক্ষণে হসপিটালে পৌঁছে গেছেন। আমাদের একসাথে দেখবেন না। গেইটটাও ভেতর থেকে লাগিয়ে এসেছি, বাইরে থেকে কেউ আসবে না। ”
নিহিতা চট করে গেইটের দিকে তাকাল। তারপরেই দৃষ্টি স্থির হলো মাহদীর মুখটার দিকে। সহজ, নরম, কোমল ভাব। এই মুহূর্তে এই স্বাভাবিক আচরণটাই তার কাছে অস্বাভাবিক লাগল। চাপা ভয় কাজ করছে। মাহদী সামান্য হেসে বলল,
” লজ্জা পাচ্ছ নাকি? ”
নিহিতা চুপ থাকলে মাহদী পুনরায় বলল,
” হাত ধরে টেনে বসাতে হবে? ”
নিহিতা চমকে গেল। ধপ করে বসে পড়তে মাহদী বলল,
” এই গল্পটা তোমার বোনকে একবার বলতে চেয়েছিলাম। কেন জানি বলা হয়নি। সে যেহেতু নেই, তাই তোমাকেই বলছি, আমি ছোটবেলা থেকেই বদরাগি ছিলাম। একটু কিছু হলেই মারামারি শুরু করে দিতাম। ছেলেমেয়ে দেখতাম না। একবার তো তন্বী নামের এক মেয়ের মাথার অর্ধেক চুল ছিঁড়ে এনেছিলাম। সেবার বাবা আমাকে খুব মেরেছিল। ঘরে বন্দী করে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রায় এক সপ্তাহ পর একটা শর্ত দিয়ে আমার শাস্তি মওকুফ হলো। কী শর্ত ছিল বলো তো? ”
নিহিতা জিজ্ঞেস করল,
” মারপিট বন্ধ করা? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” তন্বীর সাথে বন্ধুত্ব করা। ”
নিহিতা আশ্চর্য হলে মাহদী বলল,
” বন্ধুত্ব করেছিলাম। কঠিন বন্ধুত্ব! একজন অসুস্থ হলে আরেকজন অসুস্থ হওয়ার অভিনয় করে দুজন এক সাথে হাসপাতালে ভর্তি হতাম। এই কঠিন বন্ধুত্ব নিয়ে স্কুল শেষ করে কলেজে উঠলাম। ফার্স্ট ইয়ার পর সেকেন্ড ইয়ারে উঠতেই পুরো কলেজে ছড়িয়ে পড়ল আমরা নাকি প্রেমিক-প্রেমিকা। প্রকাশ্যে প্রেম করে বেড়াচ্ছি। প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ চলে গেল পর্যন্ত। তিনি তো রেগে আগুন! পারলে আমাদের তখনই কলেজ থেকে বের করে দেয়। ভদ্রলোক ধৈর্য্য ধরে আমার আর তন্বীর মা-বাবাকে ডেকে টি.সি. ধরিয়ে দিলেন। আমাদের বাবা-মা রাগে-দুঃখে সিদ্ধান্ত নিলেন তন্বী আর আমার বিয়ে দিবেন। এই বার আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। চিৎকার করে বললাম, আমি বিয়ে করব না। কারণ, আমি তাকে ভালোবাসি না। সেও আমাকে ভালোবাসে না। আমরা শুধু বন্ধু। আমার কথা তাদের বিশ্বাস হলো না। সবাই তন্বীর দিকে তাকাল। তাকে জিজ্ঞেস করল আমি সত্যি বলছি নাকি। তন্বী প্রথমে চুপ থাকলেও পর মুহূর্তে বলল, ‘ মাহদী মিথ্যে বলছে। আমরা একে-অপরকে খুব ভালোবাসি। আমরা বিয়েও করতে চাই কিন্তু এখন না। পড়ালেখা শেষ করে। ‘ কথাটা শেষ করতেই আমি ঠাটিয়ে চড় বসালাম তন্বীর গালে। একটা নয় পরপর তিনটা মেরেছিলাম। কেন বলো তো? ‘
মাহদীর আকস্মিক প্রশ্নে নিহিতার মনোযোগ ক্ষুন্ন হলো। জিজ্ঞেসা চোখে তাকালে মাহদী বলল,
” ও মিথ্যে বলেছিল। যেটা আমার একদম সহ্য হয়নি। বড় হওয়ার পর সেই প্রথম কোনো মেয়েকে আমি চড় মেরেছিলাম। এক চড়েই আমাদের কঠিন বন্ধুত্ব শেষ। তারপর থেকে মেয়েদের একদম সহ্য করতে পারতাম না। আশেপাশে থাকলেই মাথায় রাগ চড়ে বসত। অসংখ্য মেয়েকে চড়িয়েছি আমি। খুব সাধারণ কারণেই। এই যেমন কলিগের কফি অফার করার কারণে, কাজে খুশি হয়ে সিনিয়র গিফট দেওয়ার কারণে, প্রতিবেশি প্রেমে পড়ে চিঠি লেখার কারণে। শেষ চড় মেরেছিলাম কাগজে নাম্বার লিখে পাঠানোর জন্য। সে মেয়েটি কে ছিল নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ? ”
নিহিতা মাহদীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
” আমাকে এ সব কেন শোনাচ্ছেন? ”
মাহদী ঠোঁট টেনে হাসল। নিহিতার পাশ থেকে উঠে বলল,
” নায়রাকে থাপ্পড় মারার পর আমি অনুতপ্ত হই। সেই অনুতপ্ত থেকে তাকে ভালোবাসি, বিয়ে করি এবং শপথ নিই আর কোনো মেয়েকে থাপ্পড় তো দূর ভালো করে তাকাবই না। ”
মাহদী থামলে নিহিতা বলল,
” আমি কিন্তু এখনও বুঝতে পারিনি আমাকে এসব বলার কারণ কী। ”
মাহদী উত্তর দিল না। চলে যাওয়ার জন্য নীরবে পা বাড়ালে নিহিতা পেছন থেকে বলল,
” আমার মনে হয়, আপনার কথা শেষ হয়নি। ”
মাহদী থামল। সেখানে দাঁড়িয়েই বলল,
” তুমি খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে নিহিতা। বোকা সাজার চেষ্টা করে বোকামি কর না। ”
মাহদী আরও দু-পা আগালে নিহিতা বলল,
” শাসাচ্ছেন? ”
” ধরে নেও তাই। ”
চলবে