#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১২)

বাসর রাতে বউয়ের ঘোমটা না খুলেই প্রশ্ন করল মাহদী,
” বিয়েতে রাজি হলে কেন? ”

নায়রা নিরুত্তর, নিশ্চুপ, নিষ্ক্রিয়। মাহদী আরেকপা এগিয়ে আসল। ঘোমটা তোলার খুব একটা আগ্রহ ধরা পড়ল না। হাত দুটো বুকে বেঁধে এক পায়ে ভর ছেড়ে কাত হয়ে দাঁড়াল। চোখেমুখে শক্ত ভাব। সন্দেহ চোখে চেয়ে থেকে বলল,
” আমার প্রেমে পড়ে গেছ এমন হতেই পারে না। এই কয় দিন তোমাকে অনেক জ্বালিয়েছি, বিরক্ত করেছি। তবুও এক বারের জন্য নিজ থেকে আমার দিকে তাকাওনি। তাহলে হঠাৎ মন পাল্টে গেল কীভাবে? আমি কারণ জানতে চাই,নায়রা ”

এবারও নীরব থাকল নায়রা। সামান্য নড়ল না পর্যন্ত! মাহদী আর ধৈর্য্য ধরতে পারল না। আচমকা ঘোমটা সরিয়ে ফেলল। ক্রোধান্বিত দৃষ্টি ফেলে বলল,
” অনেক চুপ থেকেছ আর নয়। এবার কথা বলতে শিখ। মুখ তোলো। ”

নায়রা কাঁপল বোধ হয়। নিশ্বাস আটকে রাখল। তবুও মুখ তুলল না। মাহদী ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। চোখের রক্তিম আভা গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ। নাকের পাতা ফুলে উঠতেই নায়রার থুতনি চেপে ধরল। মুখ তুলে বলল,
” বিয়ে যখন করেছ আমার দিকে তাকানোও অভ্যাস করো। এখন তো পরপুরুষ নই। ”

মাহদীর বলে যাওয়া কথার মধ্যেই আরও কয়েক বার কেঁপে উঠল নায়রা। বন্ধ চোখের পাতা ও আশেপাশের অংশে হালকা কুঁচকে যাওয়ার দাগ পড়ল। সেই দাগ ডুবিয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল চোখ থেকে। মাহদী ভেজা চোখজোড়াই চোখ রেখে বলল,
” বুঝেছি। প্রশ্নটা তোমার বাবাকেই করতে হবে। চিন্তা করো না, নাম্বারটা এখনও সেইভ আছে। ”

মাহদী নায়রার থুতনি থেকে হাত সরিয়ে নিল। পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন বের করে কানে ধরতে হাত চেপে ধরল নায়রা। অনুরোধের সুরে বলল,
” আমার বাবাকে আর কষ্ট দিবেন না, প্লিজ! ”

মাহদী সাথে সাথে কিছু বলল না। অন্তর্নিহিত দৃষ্টি রাখল নায়রার মুখে। সহসা বলল,
” তাহলে বিয়ে করার কারণ এটাই? ”

নায়রা মাথা নিচু করে ফেলল। হাত সরিয়ে নিতে গেলে অন্য হাত দিয়ে আটকে নিল মাহদী। বিজয়ী হেসে বলল,
” তার মানে আমার অক্লান্ত পরিশ্রম বিফলে যায়নি! বাবা মেয়ে দুজনই হারল? ”

নায়রার ঝুকে থাকা মুখখানা আরেকটু বুকের দিকে চেপে গেল। মাহদী উত্তরের অপেক্ষা না করে বলল,
” তুমি কি সারাজীবন এমন মাথা নিচু করেই থাকবে? আমার সাথে কথা বলবে না? আমাকে দেখবে না? ”

নায়রা চুপ থাকলে মাহদী বলল,
” তুমি তো আমাকে ভালোবাস না। তাহলে কি আমরা এক বিছানায় শুব না? ”

নায়রা এবার সস্বভাব থেকে বেরোতে বাধ্য হলো। বিস্মিত চোখে তাকাল মাহদীর উপর। তার চোখে-মুখে অসহায়ত্ব! করুণ স্বরে বলল,
” আমার কি ভদ্র ছেলেদের মতো অন্য রুমে শোয়া উচিত? নাকি মা-বাবা জেনে যাবে সে ভয়ে সোফায় কিংবা নিচে বিছানা পেতে শুতে হবে? নায়রা, এভাবে তাকিয়ে থেকো না। আমি তো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি! ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কায় আছি! ”

নায়রার চাহনি বদলাল না। উপরন্তু বিস্ময়ের ছটা চোখ ছেড়ে পুরো মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। ঝরে পড়া অশ্রুকণা শুকিয়ে চোখের কোল ছেড়েছে। মাহদী ভারী নিশ্বাস ছাড়ল। নায়রার পাশ থেকে একটা বালিশ নিয়ে বলল,
” তুমি কিন্তু ভালোবাসতে বেশি সময় নিও না। ভালোবাসা হয়ে গেলে সাথে সাথে জানাবে। আবার লজ্জা দেখাতে গিয়ে বুকে চেপে রেখো না। তুমি তো জানোই আমার ধৈর্য্য খুব কম। একেবারেই নেই! ”

মাহদী মেঝেতে বালিশ ফেলে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করতে করতে বলল,
” ধৈর্য্য বাড়ানোর কোনো দোয়া আছে? আমাকে শিখিয়ে দেও তো! ”

নায়রা কিছু বলার পূর্বেই মাহদী নায়রার মুখের কাছে মাথা নিয়ে আসল আকস্মাৎ। অনুরোধ করে বলল,
” শেখাতে হবে না। তুমি মনে মনে পড়ে আমার মাথায় ফুঁ দিয়ে দেও। ”

নায়রা প্রথমে ভয় পেল পর মুহূর্তে হেসে ফেলল। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি রেখে কিছু একটা বিড়বিড় করল। অতঃপর মাহদীর মাথার তালু বরাবর ফুঁ দিল কয়েক বার। মাহদী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে নিলে নায়রা শরীরের গয়না খুলল সাবধানে। শাড়ি পালটে বাতি নিভিয়ে পুনরায় বিছানায় আসল। বালিশে মাথা রেখে ডানপাশে কাত হতে মাহদীর গলা ভেসে এলো,
” ভদ্র ছেলে হওয়া অনেক কষ্টের! ”

নায়রা ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল। অন্ধকারেও বুঝতে পারল মাহদী বিছানায় উঠছে। তার পাশে শুলো নীঃশব্দে। নায়রা তাৎক্ষণিক ঘাড় সোজা করল। নিশ্বাস আটকে চোখ বন্ধ করে নিতেই মাহদীর হাতের স্পর্শ পড়ল কোমরে! কানের কাছে নিশ্বাসের শব্দ পৌঁছানোর পূর্বে ঠোঁটের নরম ছোঁয়া পড়ল গলদেশে! নায়রার নিশ্চুপতাতে সঙ্গী করে মাহদী বলল,
” নায়রাকে পেয়েছি, নায়রার মনও পাব। তার জন্য দূরে থাকা কেন? আমি এত ভদ্র ছেলে নই। তাহলে তো তোমার সাথে দেখাই হতো না। নায়রা, তোমার দোয়া কাজ করেনি। মন থেকে পড়োনি, তাই না? ”

ঘড়ির কাটা তিনটা ছুঁই ছুঁই। নায়রার মাথা বুকে চেপে ধরে শুয়ে আছে মাহদী। চোখ বন্ধই ছিল। হঠাৎ খুলল। বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল,
” তোমার মনে কি একটু ভালোবাসা জমেছে? ”

নায়রা ঘুমিয়ে পড়েছিল প্রায়। মাহদী জোর করে মুখ তোলায় তা ছুটে গেল। দুর্বল চোখে তাকালে মাহদী আবার বলল,
” জমেছে? ”

নায়রা তখনও বুঝতে পারল না। সেকেন্ড কয়েক পর কিছু বলতে চাইল। তার আগেই মাহদী ওর মুখ ছেড়ে দিল। বুক থেকে সরিয়ে দিল। অন্য বালিশে মাথা রেখে ভার স্বরে বলল,
” একটুখানি ভালোবাসা জমতে এত সময় লাগে? আমার তো লাগেনি! ”

নায়রা তাকে মানানোর জন্য কাঁধে হাত রাখল। নরম স্বরে ডাকল,
” শুনুন না? রাগ করছেন কেন? একটা রাত তো পার হতে দিন! ”

মাহদী ফিরল না। কাঁধ থেকে নায়রার হাত সরিয়ে দিল। রাগ নিয়ে বলল,
” ভালোবাসা জমতে রাত পার হতে হয়? আমার তো হয়নি। কয়েক সেকেন্ডে ভালোবাসা জমে গেছিল। ”

নায়রা আবার হাত রাখলে মাহদী এবারও সরিয়ে দিল। বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
” ঘুমাতে দেও। বিরক্ত করো না। সরো এখান থেকে। ”

নায়রার অভিমান হলো। কষ্ট হলো। চোখে অশ্রু জমল। মাহদীর কাছ থেকে সরে অন্য দিকে মুখ ঘুরে শুয়ে বলল,
” আপনাকে একটুও বুঝতে পারি না। আপনি খুব অদ্ভুত। ”

মাহদীর মন টলল না। রাগ কমল না। পূর্বের গলায় বলল,
” পারবেও না। এখন মনে হচ্ছে তোমাকে বিয়ে করাই ভুল হয়েছে! ”

নায়রা আর মাহদীর বিবাহ জীবনের প্রথম পাতাটি মনে করতে করতে হাঁটছিল মাহদী। হঠাৎ কেউ একজন তাকে টেনে সরিয়ে আনল রাস্তার কিনারে। সেই সময় একটা লাল রঙের গাড়ি তীব্র বেগে ছুটে গেল পাশ দিয়ে। জানালা গলিয়ে মাথা বের করে একজন চিৎকার করে বলল,
” পাগল নাকি? রাত-বিরাতে গাড়ির তলে মরতে এসেছে! ”

মাহদী হতভম্ব চোখে গাড়িটির চলে যাওয়া দেখছিল। তখনই এরশাদ রহমান ধমকে উঠলেন,
” কী সমস্যা? এত রাতে এই পথে কী করছ? আমার আসতে আরেকটু দেরি হলে কী হতো বুঝতে পারছ? একদম পিষে দিত! ”

মাহদী তখনও চিন্তাশক্তির বাইরে। বোকা চোখে চেয়ে আছে শ্বশুরের দিকে। তিনি আবার বললেন,
” কী হয়েছে? তোমাকে এমন লাগছে কেন? ”

মাহদীর কী যে হলো! আচমকা জড়িয়ে ধরল একশাদ রহমানকে। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল,
” আপনি প্রথম দিনে রাজি হননি কেন, বাবা? তাহলে তো নায়রাকে আরও কয়েকটা দিন বেশি পেতাম! ”

এরশাদ রহমান কিছু বলতে পারলেন না। মাহদীকে সান্ত্বনা দেওয়ার বদলে নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন।

_______________
মাহদী বাসায় ফিরল শ্বশুরের সাথেই। তার ধারণা ছিল মনকে নিয়ে নিহিতা নিজেরের ঘরে গিয়েছে। হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়েও পড়েছে। তাই শ্বশুরের সাথে সে ঘরের দিকে এগুচ্ছিল। এক কদম এগুতে তার ধারণা ভুল প্রমাণ হলো। নিহিতার অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে এলো কানে। সে কিছুটা অবাক হলো। খানিকটা সন্দেহ মনেই দক্ষিণ দিকের ঘরটির দিকে এগুলো।

খালামনির মুখে মায়ের গল্প শুনতে শুনতে প্রশ্ন করল,
” আম্মুও তোমার মতো বোরকা পড়ত? ”
” হ্যাঁ। ”
” কখনই ছেলেদের সামনে আসত না? ”
” না। ”
” তাহলে তুমি আসো কেন? ”

এ পর্যায়ে চটপটে উত্তর দিতে পারল না নিহিতা। পাল্টা প্রশ্ন করল,
” কখন আসলাম? ”
” এখন। ”

নিহিতা সতর্ক চোখে আশপাশ দেখে বলল,
” এখানে তো কোনো ছেলে নেই। ”

মন নিহিতার হাতের বাঁধন থেকে ছুটে দাঁড়িয়ে বলল,
” এই যে আমি আছি। খালামনি, আমি ছেলে না? ”

নিহিতা অবাক হলো। পরক্ষণে একগাল হাসল। মনকে জড়িয়ে আদুরে গলায় বলল,
” তুমি তো আমার ছোট বাবা। ”
” ছোট বাবার সামনে আসা যায়? ”

নিহিতা উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেল না। দরজায় ঠকঠকের শব্দ হলো। মন দরজার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কে? ”

মাহদী জবাব দিল,
” তোমার বাবা। ”

মন তাৎক্ষণিক চোখ নিয়ে আসল নিহিতার দিকে। নিহিতার ঘাড়ে পড়ে থাকা ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে দিল সযত্নে। তারপর বলল,
” এবার আস, বাবা। ”

ভেতরে ঢোকার অনুমতি পেয়েও ঢুকল না মাহদী। বাইরে থেকে বলল,
” নিহিতা, বাবা এসেছেন। ”

নিহিতা ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। মাথা নিচু করে চলে যেতে গিয়েও থেমে গেল। দূরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আমার আপু কি আপনাকে ভালোবাসতে পেরেছিল? ”

মাহদী ভ্রূ কুঁচকে তাকাল। নিহিতা আবার বলল,
” আপুকে ভালো রাখতে পেরেছিলেন? সুখী করতে পেরেছিলেন? ”

মাহদী বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নিল। অন্ধকারে ডুবে থাকা উঠোনের দিকে চেয়ে থেকে নিজের ছেলেকে ডেকে আনল। আদেশের মতো বলল,
” মন, তোর নানিকে ডেকে নিয়ে আয়। ”

মন নানিকে ডাকতে দৌড় দিলে নিহিতা শঙ্কিত স্বরে বলল,
” আম্মুকে ডাকছেন কেন? আম্মুকে দিয়ে কী হবে? ”

মাহদী কাঠ গলায় বলল,
” অপেক্ষা করো। ”

চলবে

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here