#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ১৮
___________

৪১.
দুপুরের কড়া রোদের উত্তাপের সাথে মিশে আঞ্জুমানের লতানো দেহখানিও উত্তাপিত হওয়ার জোগাড়। মগ্ন ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে যেন দিনমণির এতশত কলাকৌশল। তাই নিজের অগ্নিশিখার রেখা ফেলে ঘুমন্ত পরির হাঁসফাঁস বাড়িয়ে দিয়ে ঘুম ভাঙালো। আড়মোড়া ভেঙে ওঠে কিছুক্ষণ বসে রইল আঞ্জুমান। মাথায় কিছু ঠাওর করতে পারছে না নিজের বিষয়ে। সে কে? কোথায়? তাৎক্ষণিকভাবে মস্তিস্ক অচল হয়ে রইল। মিনিট দুয়েক গড়ালে বিছানা থেকে নামার উদ্দেশ্যে সম্মুখে পা বাড়াল মাথা কেমন করে ঝিমঝিমিয়ে উঠল। চারিদিকে তাকিয়ে ঝাপসা চোখে আঁধারের খেলা দেখতে পেল। এরমাঝে কেবল উন্মুক্ত বারান্দা দিয়ে আলোর পসরা সাজানো চক্ষু বিদ্ধ হলো। এগিয়ে গেল আলোর দিকে হাতছানি দিতে। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে বাগানের ফাঁকফোকর দিয়ে আগত আলোর ঝলকানিতে স্পষ্ট হয়ে এলো নিম্নে দোলনায় বসে থাকা আলীকে। একটু পরে ওঠে দাঁড়ালো আলী। তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। আলীকে দেখে মস্তিষ্কে সেদিনের কলঙ্কিত হয়ে তকমা পাওয়ার ঘটনাটা স্মৃতিতে হানা দিলো। বারান্দার রেলিঙে তাকালো একবার আবার তাকালো আলীর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে। দেখতে পেল আতংকিত হয়ে আলীর পাংশুটে মুখ।

৪২.
এতবার হসপিটালের দোরগোড়ায় আলী এ-জীবনে কখনো আসেনি। যতটা না আঞ্জুমানের জন্য আসতে হলো তাকে। তখন তার রুমের বারান্দায় আঞ্জুমানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুকের ভেতর কেউ খামচে ধরেছিল। অশুভ আশংকারা ভর করেছিল। আগেপিছু কিছুই ভাবার অবকাশ পায়নি। তড়িৎ গতিতে দৌড়ে নিজ রুমে প্রবেশ করে দেখে, আঞ্জুমান বারান্দার রেলিঙে পা তুলছে মাত্র। হামলে গিয়ে টেনে ধরে আঞ্জুমানের হাত। ঝাপটে ধরে নিজের দিকে ফিরাতে গিয়ে দু’জন একসাথে ফ্লোরে পড়ে। ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে আঞ্জুমান। অতঃপর একপ্রকার দুশ্চিন্তার ভারে জ্ঞানহীন আঞ্জুমানকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আলী। বর্তমানে ডাক্তারের কক্ষে অবস্থান করছে আলী। ডাক্তার এলেন কিছুক্ষণ পরেই।

‘মেয়েটার হাসবেন্ড হোন দেখলাম ফরমে।’

‘জি।’

‘বয়স বেশ অল্প দেখলাম। কিছুক্ষণ পরপর জ্ঞান হারাচ্ছে যে, ভালো লক্ষ্মণ নয় সেটা।’

আলীর উদ্বিগ্নতা দ্বিগুণ হারে বেড়ে চলেছে। খারাপ কিছু হয়নি তো আঞ্জুমানের। অস্থিরতার সহিত চিন্তান্বিত প্রশ্ন তার,

‘কারণ কী? বড়ো ধরনের রোগ হয়েছে?’

‘একটা কথা কী। সকল রোগের বড়ো রোগ হচ্ছে মানসিক অবসাদ। সেখানে থাকে নানাবিধ জল্পনা-কল্পনা দুশ্চিন্তার। এসব চিন্তা থেকে শরীরে বাসা বাঁধে রোগেরা। আর বেশিরভাগ রোগের ওষুধ হলো হাসিখুশি থাকা। যা বর্তমানে খুবই বিরল, মেলা দুষ্কর। যার কারণে জীবনের ঢেউ থমকে যায় হঠাৎ করেই।’

বিরক্ত হওয়া আলীর মুখে তাকিয়ে কথাগুলো ব্যাখ্যাতে নিয়ে গেলেন না আর ডাক্তার সাহেব মোদ্দা কথায় পৌঁছে বললেন,

‘যাইহোক, আঞ্জুমান মেয়েটাকে অবজারভেশন করে দেখলাম, মেয়েটা বেশ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। মেডিকেল হিস্ট্রোরিতে আরো দেখলাম, কিছুদিন আগেও না কি হসপিটালাইজ করতে হয়েছে তাকে। তাও সুস্থ হওয়ার আগেই বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। যেটা মোটেও ঠিক হয়নি। এত অল্প বয়সে কী এমন হলো যাতে করে এত্ত টেনশন তার মাঝে?’

আলীকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ফের বললেন,

‘যদি বিষয়টা ব্যক্তিগত হয়, তাহলে আমার বলা উচিত সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে সময় দিন মেয়েটাকে। নিজেদের মধ্যে মানসিকভাবে ভালোবাসার প্রবণতা সৃষ্টি করেন। আগলে রাখার মাধ্যমে যত্ন-আত্তির মাধ্যমে নিজের ভালোবাসা জাহির করুন। একসাথে বসে সমস্যার সমাধানে এগুনোই বুদ্ধিমানের কাজ। বুঝতে পারছেন কী বুঝাতে চাচ্ছি। নাহলে হিতে বিপরীত ঘটে, মেয়েটা কোমায় চলে যাবে।’

আলীর মধ্যে উশখুশতা দেখা দিলো। সে তো আর যেচে বলতে পারবে না আঞ্জুমানকে বিয়ে করার জঘন্যতম ক্রীয়ার ঘটনা। তাই ডাক্তারের কথাগুলো আমলে নিয়ে এবার থেকে ভালোবাসা দেখিয়ে আঞ্জুমানকে সুস্থ করে কাছে টানবে, ধৈর্য্যের পরীক্ষা দেখাবে সে। এই দৃঢ় সংকল্পে বেরিয়ে পড়ল আঞ্জুমানকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে।

৪৩.
আজকের পুরো দিনটা মোটেও সুখকর ছিল না রিমার জন্য। ক্ষণে ক্ষণে আলীকে স্মরণে হৃদয় পুড়ছে রিমার। এবার যাচ্ছে কতদিনের জন্য। থাকবে কী করে আলীকে ছাড়া? আলীর গায়ের গন্ধ স্পর্শবিহীন? দমবন্ধ হয়ে মারা না পড়লেই হয়। ভালোয় ভালোয় বিয়ের অনুষ্ঠানে নিজের হৃদয়, ধ্যানটাকে সংযত করলেই হয়। অবশ্য কথা বলার মাধ্যমে যদি-ও একটু কাছে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা শিথিল হয়। এজন্য যাওয়ার আগে ড্রাইভার দিয়ে শপিংমল থেকে কিনে আনা মোবাইল পাঠিয়ে দিয়েছে আলীর কাছে। ইস! মাঝে মাঝে আফসোস হয়, সে যদি গ্রামীণ পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতো কতই না ভালো হতো তাহলে। সারাদিন সম্মুখে প্রিয় মানুষটাকে দেখে চোখ জুড়াত। কিন্তু সেই সুযোগ তো নেই। তার অভ্যাস নেই গ্রামের শুষ্ক পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার। উপরন্তু কোনকিছুই সেখানে হাতের নাগালে পাওয়া যায় না। বহু পথ পারি দিয়ে শেষে গিয়ে পৌঁছাতে হয় গঞ্জে। ভাবতই গা কাটা দিয়ে ওঠে। এতএত ঝক্কি সামলানোর মতো মেয়ে নয় সে। সোনার চামচ মুখে দিয়ে বড়ো হয়েছে। বাবা-মা তো কখনোই দিতে চাইবেন না। সেজন্যই তো আলীকে রাখা ঘর জামাই যাকে বলে। বিমর্ষ চিত্তে রিমা গোছগাছ করছে জামাকাপড়ের। ছোটো ভাবির মামার বিয়ের পনেরো দিন আগে থেকে সেখানে উপস্থিত থাকবে। আসলে এমনটা করার পিছনে কারণও রয়েছে। সে জানে, আলী ইলেকশনের কাজে ব্যস্ত থাকবে। তাই খুব একটা সময় তাকেও দিতে পারবে না তাকে। গ্রামে ইলেকশনের প্রচারে দৌড়াদৌড়ি করে আবার ঢাকায় এসে তাকে সময় দিবে, বেচারার অবস্থা হবে কাহিল। শেষে দেখা যাবে অসুস্থ হওয়ায় একূল-ওকূল দু’কূলই যাবে। তারচেয়ে ক’দিনের জন্য আলীকে সে অব্যাহতি দিলো তাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া থেকে। নিজেকেও ব্যস্ত রাখল এ-ক’দিনে। বেচারি! সে তো আর জানে না, আলী আগে থেকেই চেয়ারম্যান পদচ্যুত। সেখানে নির্বাচনে দাঁড়ানোর কোন কথাই না সেখানে।

‘মায়াজালে বন্দি তুমি,
মিথ্যের শিকলে বাঁধা হৃদয়,
মৃগতৃষা আমি,
ধু ধু হাওয়ার মরুভূমির মরিচীকার ন্যায়।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here