#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৬

ক্যাম্পাসের পেছনের অংশে ঘাট বাঁধানো দীর্ঘ দিঘীর টলটলে স্বচ্ছ জল, দেহ শীতলীকরণ বাতাসে দু-একটি ঢিল ছুঁ*ড়ে মা*র*ছে মিতালী। পানির বৃত্তাকার ঢেউ বিস্তৃত হলো। পাশ থেকে প্রিয়া অনেকক্ষণ ধরে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। সোহেল আর নির্ভীক গেলো আইসক্রিম আনতে। আজ গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস ছিলো বিধায় ক্যাম্পাসে এসেছে।
ক্লাসে এটেন্ড না করলেই নয়। স্কুলের দশদিন পূর্ণ হওয়ায় আজ ছুটি নিয়েই ক্যাম্পাসে পা রাখলো। ক্লাস শেষে আর বাড়ি ফিরলোনা। অনেকদিন পর সবার সাথে দেখা, কেউ ছাড়তে চাইলোনা। একটুখানি আড্ডার আসর জমাতে ক্যাম্পাসের পেছন দিকে বসলো। শান্ত, শুনশান প্রকৃতিতে ঝলমলে রোদ্দুর।
মিতালীর কাঁধে কোমল হাত রাখলো প্রিয়া। ভরসা মাখা কন্ঠে বলল,
-“কেন এত চিন্তা করছিস? তুই এমন করলে আঙ্কেল-আন্টিকে কে দেখবে? মাহা ও তো এখনো ছোট।”

চাপা দীর্ঘশ্বাস লুকালো মিতালী। বন্ধুদের আনন্দ নষ্ট করতে চায়না সে। বলল,
-“এসব বাদ দে। আমি তো ক্লাস এটেন্ড করিনা, তোর পড়াশোনা কেমন চলছে?”

প্রিয়া ঠোঁট বাঁকালো। বলল,
-“আর পড়ালেখা। তোকে নোট দিতে হয় বলে ক্লাসগুলো বাধ্য হয়ে করি। এই পড়াশোনার চাপ আর নিতে ইচ্ছে করেনা।”

মিতালী মেকি আফসোসের সুরে বলল,
-“আহারে! মেয়েটাকে কী কষ্টটাই না দিচ্ছি আমি।”
অতঃপর রগড় করে বলল,” তা বিয়েটা সেরে ফেললেই পারিস। তাহলে পড়ালেখার পাঠ ও একেবারে চুকে যাবে।”

প্রিয়ার চোখেমুখে আঁধার নামলো। বিমর্ষ হয়ে পড়লো। রোধ হয়ে আসা কন্ঠে শুধালো,
-“এখন বিয়ে সম্ভব না।”

-“কেন?”
মিতালীর প্রশ্নের জবাবে প্রিয়া হাত চেপে ধরলো তার। লুকোচুরি দৃষ্টি ফেললো চারদিকে। খানিকটা ভ*য় মেশানো গলায় বলল,
-“তোকে একটা কথা বলতে চাই। আমি এর আগে কাউকে কথাটি বলিনি।”

কৌতুহল দেখালো মিতালী। বলল,
-“কী কথা?”

খানিকটা সময় নিলো প্রিয়া। তারপর হুট করেই বলে দিলো,
-“আমি নির্ভীককে ভালোবাসি। ওর ও বয়স কম, চাকরি নেই। তাছাড়া মামার বাড়িতে থাকে একথা শুনলে আমার পরিবার আরও আগেই মত দেবেনা।”

থমকালো মিতালী। ধক করে উঠলো অন্তঃকুটির। দম বন্ধকর এক বি*শ্রী অনুভূতি। তবে প্রিয়াই কি নির্ভীকের প্রেমে পড়ার কারণ? কি আশ্চর্য! সে বোধহয় এখনো নির্ভীকের ভালো বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি। নয়তো ব্যাপারটা তার কাছে চাপা থাকতোনা। সেদিন ধ*রা পড়েও অস্বীকার করে গেলো। মিতালী মৃদু হাসলো। হয়তো হাসিতে তাচ্ছিল্য ছিলো। কে-জানে প্রিয়া হয়তো ধরতেও পারেনি।
মিতালী বলল,
-“দুজন এক হতে চাইলে পড়ালেখা মন দিয়ে কর। যখন দুজনে প্রতিষ্ঠিত হবি, দেখবি পরিবার আর বাঁধা দিতে আসবেনা।”

প্রিয়া কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেলো। মিতালীর মুখোমুখি বসায় তার পেছন দিক থেকে সোহেল আর নির্ভীককে আসতে দেখলো।
দুজনের হাতে চারটা কোন আইসক্রিম। সোহেল এসে একটা কোন মিতালীর হাতে দিলো। অগত্যা নির্ভীককে তার হাতের একটা কোন প্রিয়ার হাতে দিতে হলো। বড্ড অস্থির লাগছে, চোখ জ্বালা করছে মিতালীর। দুজনের ভাব খুব ভালোই। এখন তো তাকে ছাড়া ক্যাম্পাসে আসাও শিখে গিয়েছে নির্ভীক। দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সে। মিতালীর খাওয়ায় মন নেই। উদাসীন ভাব, নির্ভীক ঝটপট নিজের আইসক্রিম শেষ করে মিতালীকে ক্ষে*পা*নো*র উদ্দেশ্যে তার হাত থেকে আইসক্রিম কেঁ*ড়ে নিলো। বলল,

-“তুই যখন খাবিনা, তখন আমিই খাই।”

আচমকা মিতালীর কী হলো সে বুঝতে পারলোনা। নির্ভীকের হাত থেকে আইসক্রিম নিয়ে পানিতে ছুঁ*ড়ে মারলো। থমথমে গলায় বলল,
-“আমার আধখাওয়া আইসক্রিম তুই খাবি কেন?”

মিতালীর কাজে সকলে হতভম্ব হয়ে রইলো। নির্ভীক একটু বেশিই বিস্মিত হলো। এমন কত খাবার দুজনে ভাগাভাগি করে খেয়েছে। আজ কী এমন হলো মিতালীর?
মিতালী দাঁড়িয়ে বলল,
-“তোরা থাক, আমি বাড়ি যাবো।”

নির্ভীক একটু আগের ব্যাপারটা গায়ে মাখলোনা। ভাবলো মিতালী পরিবার নিয়ে চিন্তিত। তার মন ভালো করার জন্য বলল,
-“এখন বাড়ি যাবি কেন? আজ সবাই মিলে আশেপাশে ভালো করে ঘুরবো। আবার কবে সুযোগ পাবো?”

মিতালী নির্ভীকের দিকে না তাকিয়েই বলল,
-“তোরা যা, আমি তো না করিনি। আমার কাজ আছে বাড়িতে।”

নির্ভীক বলল,
-“তাহলে চল, দুজনে একসাথে বাড়ি যাই।”

প্রিয়া মন খা*রা*প করে বলল,
-“তুই ও চলে যাবি?”
মিতালীর দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের সুরে বলল,”একটু থাকনা মিতা, প্লিজ!”

প্রিয়ার চোখের ইশারা আর অনুনয়ে আর না করতে পারলোনা মিতালী। বলল,”আচ্ছা যাচ্ছি না আমি।”

জেলা সদর থেকে একটু গ্রামের দিকেই প্রবেশ করলো তারা। নীল আকাশের নিচে সবুজের সমারোহ। বিভিন্ন সবজির বাগান, রাস্তার দু-পাশে ফসলি জমি। প্রিয়া লাফিয়ে উঠলো। নির্ভীকের হাত ধরে বায়না করলো,
-“আমরা এখানে ছবি তুলবো প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!”

নির্ভীক হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,”আচ্ছা ঠিক আছে। তুই মিতাকে নিয়ে দাঁড়া। আমি তুলে দিচ্ছি।”

নির্ভীক প্রিয়া আর মিতার অনেকগুলো ছবি তুললো। প্রিয়া একা পোজ দিয়েও নিজের আলাদা কতগুলো ছবি তুলে নিলো। যাতে নির্ভীক সন্দেহ না করে তাই আলাদা আলাদা সোহেল, নির্ভীক দুজনের সাথেই ছবি তুললো। নির্ভীক বলল,
-“মিতা তুই দাঁড়া। আমি তোর কয়েকটা ছবি তুলে দিই।”

মিতালী না করে দিলো।
-“লাগবেনা।”

সোহেলের হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে মিতালীর পাশে দাঁড়ালো নির্ভীক। সোহেলের উদ্দেশ্যে বলল,
-“আমাদের দুজনের ছবি তোল।”

মিতালী বিরক্ত হয়ে সরে যেতে নিলেই নির্ভীক জোর করে দাঁড় করালো। পাশাপাশি ক্লোজ হয়ে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। নির্ভীকের অধর জুড়ে হাসি থাকলেও মিতালীর ছিলো মুখভার।

দুজনকে একই ফ্রেমে দেখে হাসলো নির্ভীক। মুখ ভার করে রাখলেও ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছে মিতালীকে। পকেটে ফোন গুঁজে মিতালীর পাশে দাঁড়ালো। প্রিয়া নিজের ছবি দেখতে ব্যস্ত, সোহেল ও একই কাজ করছে।
নির্ভীক ঢিমে স্বরে বলল,
-“মন এখনো ভালো হয়নি দেখছি। কবিতা শুনবি?”

মিতালী ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি টে*নে বলল,”যার জন্য কবিতা ধরেছিস, তাকে না শুনাতে পারলে জীবন বৃথা যাবে তোর। আমাকে কেন কবিতা শোনাতে চাইছিস?”

নির্ভীক হো হো করে হেসে ফেললো। বলল,
-“যার জন্য কবিতা ধরেছি, তাকে তো অবশ্যই শোনাচ্ছি।”

এই মুহূর্তে নির্ভীকের প্রাণোচ্ছল, সরল হাসিটুকুতে ব্যাঘাত ঘটাতে ইচ্ছে করলোনা মিতালীর। তাই আর বাড়তি প্রশ্ন করলোনা।
সে জানে নির্দ্বিধায় নির্ভীক একজন ভালো বন্ধু, একজন ভালোমানুষ। হয়তো কোনো কারণে সে মিতালীকে কিছু জানায়নি। সবারই একটা আলাদা জগৎ আছে, ব্যক্তিগত জীবন আছে।
তাই আর অযথা অভিমান বাড়ালোনা। ধীর স্বরে বলল,
-“শুরু কর।”

সরু ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে আওড়ে নিলো নির্ভীক।

“মানুষের ভিড়ে মানুষ লুকিয়ে থাকে
গাছের আড়ালে গাছ,
আকাশ লুকায় ছোট্ট নদীর বাঁকে
জলের গভীরে মাছ;
পাতার আড়ালে লুকায় বনের ফুল
ফুলের আড়ালে কাঁটা,
মেঘের আড়ালে চাঁদের হুলস্তুল
সাগরে জোয়ার ভাটা।
চোখের আড়ালে স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে,
তোমার আড়ালে আমি,
দিনের বক্ষে রাত্রিকে ধরে রাখে
এভাবে দিবসযামী।”

—মহাদেব সাহা।

মিতালী ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“তোর কি সবসময় রোমান্টিক কবিতা আবৃত্তি করতেই ভালোলাগে?”

নির্ভীক অসহায় বোধ করলো। যার জন্য আবৃত্তি করলো, সে এ কেমন প্রশ্ন করে বসলো? কোথায় একটু কবিতার ভাবার্থ বোঝার চেষ্টা করবে। তা না করে উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করছে। নির্ভীক ক্ষেপাটে স্বরে বলল,
-“খবরদার! আমার কবিতা নিয়ে কিছু বলবিনা। আমার যখন যেমন আবৃত্তি করতে ইচ্ছে হবে, আমি তেমনই আবৃত্তি করবো।”

মিতালো এতক্ষণে প্রাণ খুলে হাসলো। নির্ভীককে ক্ষে*পা*তে বলল,
-“কি বি*চ্ছি*রি আবৃত্তি।”

রাগতে গিয়েও হেসে ফেললো নির্ভীক। মিতালীর মাথায় টোকা মে*রে বলল,”বি*চ্ছি*রি হলেও তোকে শুনতে হবে।”

★★★

বন্ধুদের বিদায় দিয়ে বাড়ি না ফিরে সোজা টিউশনে গেলো মিতালী। সন্ধ্যার সময় নির্ভীককে যথারীতি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো।

পরেরদিন সকালে স্কুলে গিয়ে থমকে গেলো মিতালী। মস্তিস্কে শূণ্য লাগছে। সামনের দিকে কিভাবে কি করবে সে ভেবে পেলোনা।
আজ তার চাকরি কনফার্ম হওয়ার কথা ছিলো। বিগত দিনগুলোতে মিতালী বেশ প্রসংশা শুনেছে নিজের। সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে স্টুডেন্টদের কিছু শেখানোর। ধরেই নিয়েছিল চাকরিটা তার কনফার্ম হবে।

স্কুলের প্রধান মিরাজুল হক বললেন,
-“তোমার ক্লাস আমি দেখেছি। খুব দক্ষতা আর নিষ্ঠার সাথে তুমি বাচ্চাদের পড়াচ্ছো। কিন্তু আমি দুঃখীত ভীষণ। শিক্ষক কোটা পূরণ হয়ে গিয়েছে। পরে কখনো কোটা খালি হলে তোমাকে জানাবো।”

মিতালীর গলা ধরে আসলো। কোনোভাবে মিরাজুল হকের সামনে থেকে বেরিয়ে আসতেই দরজার সামনে সুমনার সাথে দেখা হলো। এখানেরই একজন শিক্ষিকা। মেয়েটা ভীষণ মিশুক। সে বলল,
-“মিরাজুল স্যারের কোন এক আত্মীয়কে চাকরিটা দেওয়া হয়েছে। অথচ তাকে যাচাই-বাছাই করা হলোনা। ”

মিতালী মৃদু হেসে বলল,”চাকরিটা আমার ভাগ্যে ছিলোনা।”

আর কথা বাড়ালোনা। সুমনার ভীষণ খা*রা*প লাগছে। একজন যোগ্য লোককে হারালো এরা। আজকাল যোগ্য লোকের কদর নেই। টাকা আর মামা-খালু থাকলেই চলে।

একাকী পথ ধরে হাঁটছে মিতালী। ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। দুদিন পরই আব্বা-মা, মাহার খাওয়া শেষ হবে মাহবুবের ঘরে। সে কিভাবে সব সামলাবে? বাড়ি ফিরতেই মা বললেন,”চোখমুখ এমন লাল হইয়া আছে ক্যান? আর আইজ এত তাতাড়ি চইলা আসলি যে?”

“মাথাব্যথা করছে” বলে পাশ কাটালো মিতালী। কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ না যেতেই ঔষধের বাক্স হাতিয়ে একটা নাপা টেবলেট নিয়ে আসলেন রোজী বেগম। বললেন,
-“উঠে ওষুধটা খাইয়া ল।”

মিতালী কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলল,
-“রেখে যাও, আমি খেয়ে নেবো।”

দুপুরে আর রান্না করলোনা। গতকালের মরিচ ভর্তা গরম করে রেখেছিলো। সেটা দিয়ে পানতাভাত খেয়ে নিলো। রিশাতের মায়ের দেওয়া সব টাকা খরচ করেনি। পাঁচশ টাকার টুকটাক মুদি বাজার করেছে। বাকি আছে একহাজার টাকা। দুদিন পর আব্বা- আম্মার খাওয়া আসলে কাঁচা বাজার আর মাছ নিয়ে আসবে।

★★★

পাশের রুম থেকে আব্বার স্পষ্ট আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। মাহবুব নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
মায়ের অস্পষ্ট স্বর শুনতে পেলো মিতালী। তিনি চাপা স্বরে মতিন সাহেবকে বলছেন,
-“এমন কপাল লইয়া আইছেন ক্যান দুনিয়াইতে? শেষ বয়সটা সুখ কইরা যাওনের কপাল আমগো নাই।”

মতিন সাহেব চাপা আর্তনাদের সাথে হু হু কান্নার শব্দ তুলে বললেন,
-“আল্লাহর কাছে কও, আমি যাতে তাতাড়ি দুনিয়াইরে বিদায় দিতে পারি”

দরজার পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলো মিতালী। বাবার কাছে কিছুক্ষণ বসবে বলে আসলেও আর ভেতরে ঢুকলোনা। মাহার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। তার হাতে কিছুই নেই। মুখে ওড়না চেপে কান্না রোধ করার চেষ্টা করে ভাবলো নিন্মমধ্যবিত্তদের জীবন এত কঠিন কেন?

#চলবে…..

(রি-চেইক দেওয়া হয়নি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here