#নতুন_কন্ঠে_ভালোবাসুক
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৫

একটি অগোছালো ঘরে আমি বসে আছি অনেক্ক্ষণ। কতোটা অগোছালো বলবো আমি জানি না। ঘরের প্রতিটা জিনিস এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। আমার কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে। ঘড়ির কাঁটার দিকে লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারলাম এখন রাত আটটা বাজে। আমাকে সন্ধ্যা সাতটায় হয়তো এই ঘরে বসিয়ে দিয়ে গেছেন ননদ,সম্পর্কে আমার ছোট ননদ। সেই থেকে এখনো বসে আছি। একা বসে থাকায় যতটা না অসস্থি হচ্ছে, তাঁর থেকে এই অগোছালো ঘরে থাকার জন্য বেশি হচ্ছে। আচ্ছা আমি যদি ঘরটা গুছিয়ে রাখি খুব কি অন্যায় হবে। যদি কেউ কিছু মনে করে। যদি ভাবে আমি এসেই নিজের অধিকার ফলাতে শুরু করেছি তখন? তাঁর থেকে ভালো আমি এভাবেই বসে থাকি। কি দরকার আগবারিয়ে কিছু করার। হঠাৎ করেই আমার মনটা ভিষণ খারাপ হয়ে গেলো। এখন আমি আমার বাড়িতে থাকলে সবার সাথে আড্ডা দিতাম। মায়ের হাতের ঝাল ঝাল মুড়িমাখা খেতাম। কি করছে ওরা। আচ্ছা ওরা কি এখনো আমার জন্য কাঁদছে। যখন আমি বিদায় নিয়ে চলে আসছিলাম তখন সোনালী,রূপালীর থেকে মোহন কাঁদছিলো বেশি। ভাইটা আমার বড্ড বেশি ছিঁচকাঁদুনি হয়েছে। মেয়েদের মতো শুধু কাঁদে। ছেলেদের হতে হয় শক্ত মনের! ও কিনা পুরো উল্টো। ওদের কথা ভাবতেই আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এর নামই ভাই-বোন। কাছে থাকলে ঝগড়া, দূরে গেলেই কষ্ট। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ পেতেই আমি চোখ তুলে তাকালাম। দেখলাম মানুষটা ঘরে ঢুকছে। সে ঘরে ঢুকেই একবার পুরো ঘরে চোখ বোলালো। পুরো ঘরে চোখ বোলাতেই অসহায় চোখে আমার দিকে একবার তাকালো। অর্থাৎ সে খুব লজ্জিত। নতুন বউ কিনা এতোটা অগোছালো রুমে বসে আছে। আমার থেকে চোখ সরিয়ে সে ঘরের জিনিস গুলো ঠিক করার চেষ্টা করতে রইলো। সোফায় রাখা তাঁর জামাকাপড় গুলো আলমারিতে রাখতেই গরগর করে ভেতরের জামাকাপড় গুলো পড়ে গেলো। সেগুলো তুলে রাখতেই আবারও পড়ে গেলো। সেগুলো রেখে ড্রেসিং টেবিলের উপরের সব গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু সেখানেও সে ব্যর্থ হলো। তারপর তার অপরিষ্কার জামাকাপড় গুলো কোন বালতি ছাড়াই ওয়াশরুমে নিয়ে গেলো। যখন বুঝলো তাঁর এই কাজটাও ভুল হয়েছে সে এবার অসহায় হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো।

_ এভাবে আমাকে লক্ষ্য না করে যদি হেল্প করতেন বেশি খুশি হতাম।

হঠাৎ উনার কথায় আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আসলে বুঝতে একটু কষ্ট হলো সে কি বললো।

_ জ্বি

_ বলছি,ঘর গোছানোর বেপারে আমি লবডঙ্কা,সেটা নিশ্চয়ই ঘর দেখে বুঝতে পারছেন। তাই প্লিজ আমাকে একটু সাহায্য করুন।

আমি কোন মতে বললাম

_ হু

তারপর সে আলমারির সব কাপড় আমার সামনে দিলো। আমি একে একে সব গুছিয়ে তাঁর হাতে দিলাম। সে আলমারিতে গুছিয়ে রাখলো। তারপর সে ছুটে গেলো একটি বালতি আনতে। আমি সেই ফাঁকে ড্রেসিং টেবিলের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। তিনি বালতি আনতেই আমি অপরিষ্কার জামাকাপড় গুলো তাঁর মাঝে ঢুকিয়ে রাখলাম। তিনি ওয়াশরুমের ভেতরে রেখে এলো। বিছানার চাদরটা ঝেড়ে নতুন করে আবারও বিছিয়ে দিলাম। অবশেষে ঘর ঝাড়ু দিয়ে ময়লার ঝুড়িতে রাখতেই তিনি বাহিরে চলে গেলেন। আমি ওয়াশরুমে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে আসতেই দেখি তিনি ঘরে এসেছে। হাতে খাবারের থালা। টি-টেবিলটা আমার সামনে রেখেই তিনি আবারও বাহিরে ছুটে গেলেন। ফিরলেন কিছুক্ষণ পর। হাতে তাঁর একটি ঔষধের বাক্স। সেটা টেবিলের এক কোণে রেখে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আমার সামনে এলেন। তখন আমি খাটের এক কোণে বসা। আমার উদ্দেশ্যে বললেন।

_ খাবারটা খেয়ে নিন,সারাদিন হয়তো কিছু খাওয়া হয়নি আপনার।

মানুষটাকে আমি যতো দেখছি ততই যেন অবাক হচ্ছি। ঘর গোছানোর বেপারে যে সে ইচ্ছেকৃত ভাবে আমাকে ডেকেছে তা আমি ভালোই বুঝতে পেরেছি। আসলে সে আমাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু একটা অচেনা অজানা মানুষের সামনে খাওয়ার বিষয়ে আমি খুব লজ্জিতবোধ করছি। আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে সে আমার পাশে বসলেন।

_ তুমি করেই বলছি কিছু মনে করো না। শোন মোনা, জীবনকে যতোটা সহজ ভাবে নিবে জীবন ততোই সহজ ভাবে ধরা দিবে। মনে রেখো মোনা,যা পাওনি,তা যে কখনো পাবে না এমনটা নয়। হুটহাট এক্সিডেন্ট আমাদের জীবনে হওয়া খুব দরকার। দেখো একজনকে ভালোবেসে বিয়ে করলাম,সংসারও করলাম! কিন্তু ধরে রাখতে পারলাম না। এমনও তো হতে পারতো তাঁর সাথে দেখা না হয়ে তোমার সাথে শুরুতেই দেখা হতো। কিন্তু হয়নি। কথায় আছে সাতঘাটের জল খেয়ে তোমার সাথে আমার দেখা,তা কি এমনি এমনি! ভাগ্য। ভাগ্য বুঝলে মোনা তুমি আমার,আর আমি তোমার ভাগ্যে লেখা ছিলাম। না-ও এবার চটপট খেয়ে নাও। এই বাড়িতে কেউ নেই,আমি তুমি আর তোমার শাশুড়ী ছাড়া। যাঁরা এসেছিলো,তাঁরা চলে গেছে। তাই লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু নেই। আজ থেকে এই বাড়ি, সংসার এখানের মানুষ সব তোমার একান্ত। এমন কী আমি টাও তোমার একান্ত। আমার সামনে লজ্জা, ঠিক আছে আমি বারান্দায় যাচ্ছি।

এই কথাটা ব’লেই মুচকি হেঁসে মানুষটা উঠে গেলো। আচ্ছা মানুষটা এমন কেন? এই নিয়ে তাঁর সাথে আমার দু’বার দেখা হলো। অথচ এমন ভাবে আমার সাথে কথা বলছে যেন অনেক দিনের পরিচিত। আমি খাবারের প্লেটে হাত দিলাম। কোন রকমে খেয়ে হাত ধুয়ে উঠেছি। তখনই তিনি সব কিছু গুছিয়ে বাহিরে রেখে এলেন। তারপর ঔষধের বাক্স থেকে একটি ঔষধ বের করলেন। আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন।

_ শুনেছি, তুমি এই ঘুমের ঔষধটা রোজ খাও। আমাকে মোহন বলেছে। আচ্ছা এটা না খেলে তোমার ঘুম আসে না।

_ আসলে

_ আজ তোমায় একটা নতুন টেকনিক শেখাবো,কি করে ঘুমের ঔষধ ছাড়া ঘুম আসে সেই টেকনিক। তো তুমি শিখবে সেই টেকনিক। দাঁড়াও আমি এটা আগে রেখে দেই।

ঔষধের পেকেটটা বাক্সে রেখেই কোন দ্বিধা ছাড়া সে আমার হাত ধরলো। আমাকে তাঁর কিছুটা কাছে টেনে নিয়ে বললো।

_ কিছু টেকনিক আজ থেকে তোমার ঘুমের ঔষধের থেকেও বেশি কাজ করবে।

তারপর সে আমাকে খাটে বসিয়ে লাইট অফ করে ডিমলাইট জ্বালিয়ে দিলো। দু’টো বালিশ খুব কাছাকাছি এনে আমাকে একটায় শুতে ইশারা করলো। আমি শুয়ে পড়তেই সে নিজের রাখা বালিশে মাথা দিলো। আমাকে তাঁর বুকে টেনে নিলো। ভয়ে আমি নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। ছোট্ট বাচ্চাদের মতো নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাঁর শক্ত হাতের বেড়াজালে বন্দী আমি কিছুই করতে পারলাম না। তিনি আমার এমন অবস্থা দেখে আবারও হেঁসে দিলেন। মানুষটা শুধু হাসে। কারণে অকারণে হাসে। আচ্ছা হাসতে পারাটা কি তাঁর আর্ট নাকি। মানুষটা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো।

_ মোনা আমাদের জীবনে এমন একজন আপন মানুষ খুব দরকার যাঁর বুকে মাথা রাখলে দিনের সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। একান্ত একটা হৃদয়,বুক আর একটা মানুষ আমাদের সবার দরকার। আজ থেকে আমি সেই আশ্রয় তোমার যেখানে তুমি দুদণ্ড শান্তি খুঁজে পাবে। আমাকে স্বামী ভাবার আগে একজন বন্ধু ভেবো! যে তোমার সকল ব্যথার উপশম ঘটাবে। আমি তোমার ছোট ছোট সকল স্বপ্ন পূর্ণ করবো ইনশাআল্লাহ। তুমি শুধু তোমার ওই নিসার্থ ভালোবাসা আমার জন্য তুলে রেখো। অতীতে কি হয়েছে, কি হয়েছিল! না আমি কখনো জানতে চাই, না জানার ইচ্ছে আছে। শুধু বলবো আমাকে বিশ্বাস করো। আর মনে রেখো মোনা জীবনটা বড্ড দামি,সেটা হেলাফেলা করে কাটিয়ে দেওয়ার কোন মানে হয় না। আজ আছি কাল তো না থাকতেও পারি। তাই যে সময়টা আমরা পাই সেটাই না-হয় কাজে লাগাই। আমি শুনেছি একজন দায়িত্বশীল নারী নিজের স্বামীর মাঝে নিজের বাবাকে খুঁজতে চায়। তাঁর বাবা যেমন তাঁকে আগলে রাখতো,তাঁর স্বামীও যেন তাঁকে আগলে রাখে এটাই চায়। আমি সব সময় তোমায় আগলে রাখার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। তোমাকে আরো একটি সত্যি কথা বলি! তোমাকে আমি আরো ছয়মাস আগে দেখেছি। সেদিন প্রথম আমার মনে হয়েছে জীবনের খাতায় কিছু অপূর্ণতা থাকা দরকার তুমিনামক কিছু পূর্ণতা পাওয়ার জন্য। আজ আর কিছু বলবো না। বাকিটা অন্য একদিন বলবো।

তাঁর কথা গুলো আমার হৃদয়ে গিয়ে কড়া নাড়লো। মনে হলো,এমন করে কেউ কখনোই আমাকে বলেনি। হ্যা এটা ঠিক! প্রতিটা মেয়ে তাঁর বাবার মতো একজন দায়িত্বশীল স্বামী চায়। যে স্বামী ভুল কম বুঝবে,সঠিকটা আন্দাজ করবে। কিন্তু আজকাল এসব আর দেখা যায় না। যদি দেখাই যেত,তাহলে ডির্ভোস নামের কোন পেপার উকিলদের তৈরি করতে হতো না।
মানুষটা একনাগাড়ে আমার মাথায় হাত বুলাতে রইলো। বাবা মা-রা যাবার পর এই প্রথম আমি ঘুমের ঔষধ ছাড়াই নিজের চোখে ঘুম অনুভব করলাম। তাহলে কি সত্যিই দিন শেষে নিজের একান্ত আশ্রয় দরকার! যা শুধুই আমার।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here