‘ধূম্রজাল’
অন্তিম পর্ব

তাবিনা মাহনূর

_________

ইমিগ্রেশন পার করার আগে বেশ কিছু দূরে বেঞ্চের সারি আছে। ওখানেই বসে আছেন আবিদা। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে সেই যে বসে আছেন, ছাড়তে চাইছেন না তিনি। বাহার দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে লোকজন খুব বেশি না হলেও নির্জন নয় জায়গাটা। এই লোকগুলো একবার সাদি আর আবিদাকে দেখে যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। তারা এসব দেখে অভ্যস্ত। প্রবাসীদের পরিবার প্রতিবারই বিদায় দিতে এলে অশ্রুর মেলা বসিয়ে দেয়। একেকজনের কান্নার ধরণ একেক রকম।

এই যেমন সাদি চোখে জল নিয়ে মুচকি হেসে মাকে সামলানোর চেষ্টা করছে। আবিদা মৃদু শব্দ করে ‘আল্লাহ’ বলছেন আর কাঁদছেন। মাঝে মাঝে দূরে থাকার কষ্ট প্রকাশ করছেন অশ্রু মিশ্রিত কণ্ঠে। বাহার কাঁদছে, তবে দৃষ্টির আড়ালে নিঃশব্দে। এই দৃশ্যগুলো এয়ারপোর্টে খুব সাধারণ। তবে আজ এয়ারপোর্টে অস্বাভাবিক কিছু বিষয় লক্ষণীয় যার দিকে সাদি বা বাহার, কারো মনোযোগ নেই।

চলে যাওয়ার সময় এসেছে। সাদি মাকে ছেড়ে দিলো। আবিদা এবার উচ্চস্বরে কেঁদে ফেললেন। সাদি আবার মাকে জড়িয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলো। মায়ের মাথায় চুমু খেয়ে সে বললো, ‘আল্লাহ চাইলে আবার দেখা হবে মা। তুমি এমন করো না। আমার কষ্ট হচ্ছে খুব।’

ছেলের কষ্ট হচ্ছে, এ কথা শুনে আবিদা চুপ হয়ে অশ্রু দমনের চেষ্টা করলেন। এবার তিনিও নিঃশব্দে অশ্রু ঝরাচ্ছেন। সাদি মায়ের দু গালে হাত রেখে কিছু কথা বললো, ‘সবসময় তাকওয়া আর তাওয়াক্কুল অটুট রাখার চেষ্টা করবে মা। এই দুটো আঁকড়ে ধরলে কোনো কষ্টই বড় মনে হয় না। আমি নিয়মিত কথা বলবো ইন শা আল্লাহ। তুমি কথা দাও, নিজের খেয়াল রাখবে?’

ছেলের হাতের মুঠোয় হাত রাখলেন আবিদা। শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘ইন শা আল্লাহ। তুইও তোর যত্ন নিবি বাবু। মানুষ বুঝে চলবি। যাকে তাকে বিশ্বাস করিস না।’

সাদি মুচকি হেসে আবারো মায়ের মাথায় চুমু খেলো। তারপর সে বাহারের দিকে তাকালো। বাহার মুচকি হেসে বললো, ‘ভালো থাকবেন, দুআ করবেন সবসময়।’ বলতে বলতে বাহার সাদিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। কথা আটকে গেল তার। কোনো কথাই মুখ থেকে বের হচ্ছে না। বিকেল থেকে দুজন ভাষাহীন চলছে, দুজনেই জানতো কথা বললে অশ্রু ঝড়বে। বাহার এবার নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি। শক্ত করে প্রিয়তমকে জড়িয়ে ধরেছে সে। ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।

সাদিও জড়িয়ে ধরেছে। এতগুলো মানুষের সামনে জড়িয়ে ধরার লজ্জাবোধ কোথায় হারিয়ে গেল? যাতনার ভার পূর্ণ হয়েছে, বাধা মানবে কে? তবু মেনে নিতে হয় বাস্তবতা। ছেড়ে দিতে হয় হাত। তাই তো সাদি ছেড়ে দিলো এখন। বাহারও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। সাদি হেঁটে যাচ্ছে, অনেক দূরে হেটে গেল সে। আবিদা তাকিয়ে আছেন নির্নিমেষ, তাকিয়ে আছে বাহারও।

হঠাৎ সাদি পেছন ফিরে তাকালে বাহার দৌড়ে গিয়ে আবারো জাপটে ধরলো সাদিকে। আবিদা চোখ নামিয়ে ফেললেন। সময়টা একান্তই তাদের, তাদের কাছে এখন এই জগতে আর কারো অস্তিত্ব নেই। শুধু তারা দুজন। দুজন অনুভব করছে নিজেদের যন্ত্রণা কাতর অনুভূতি। যেখানে মিশে গিয়ে যদি একটু স্বস্তি, একটু শান্তি পাওয়া যায়।

স্নাইপার কাঁধে টার্গেট ঠিক করছে তৌফিক। গোল কালো দাগের মাঝে যোগ চিহ্ন, এই অংশে দুজন মানুষের টার্গেট ঠিকঠাক করে ফেলেছে সে। একজন সাদা পাঞ্জাবি পরা, অন্যজন কালো বোরখা। কানে লাগানো ব্লুটুথ হেডফোনের ওপাশে থাকা লোককে তৌফিক বললো, ‘স্যার, টার্গেট পারফেক্ট।’

ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘শ্যুট দেম।’

বু-লেট ছোড়ার শব্দ। চমকে তাকালেন আবিদা। চিৎকার করার সময় পেলেন না। আবারো শব্দ ভেসে এলো। একটা নয়, দুটো নয়, পরপর বুলে-টের বর্ষণ ঘটলো সাদি-বাহারের সর্বাঙ্গে। বাহুতে প্রথম গু-লি লাগার পর সাদি বুঝে গিয়েছিল সব। বাহারকে ছিটকে দূরে ফেলতে চাইলেও পারেনি। বাহার আরো দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরেছিল তাকে। দ্বিতীয় বুলেট এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে বাহারের করোটি ভেদ করে গিয়েছে। সাদি রক্তঝরা হাতে বাহারকে জড়িয়ে ফিসফিস করে বলেছে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ!’

একই সাথে বাহারের কন্ঠ থেকে নিঃসৃত হলো মহান ধ্বনি। একের পর এক গু-লির ফোয়ারা ছুটে এসে তাদের শরীর ক্ষত বিক্ষত করে তুললো। মুহূর্তেই নিষ্প্রাণ দেহ জোড়া লুটিয়ে পড়লো বিষাক্ত ধরণীর বুকে।

__________

‘ধূম্রজালের মায়ায় বেঁধেছি মন,
সূর্যটাকে হারিয়ে অন্ধকারে কাটছে ক্ষণ।
ঠিকানা ভুলেছি, প্রদীপের অভাব,
মানুষের ভিড়ে আমার অন্ধ সাজার স্বভাব।

সব ধোঁয়াশা কেটে যাক,
মলিন সূর্য হলদে আলোয় মেখে যাক।
আমার ঠিকানায় চিঠি না আসুক,
ভুলে গিয়ে পেয়েছি যে সুখ।

হঠাৎ উপলব্ধি, জীবনের অর্থের অনুধাবন,
চোখ খুলে দেখি, মন দিয়ে বুঝি, ইবাদাতই জীবন।
ভুলেছি অতীত, বর্তমানকে আঁকড়ে ধরে গড়ছি ভবিষ্যৎ,
তারা এসে রোধ করে পথ, সঙ্গে মিথ্যের রথ।

প্রকাশ্য চোরাবালি গড়ে সেজেছে তারা উটপাখি,
ফাঁদ পাতা জীবন তীরে হাঁটছি বেঁধে জোড়া আঁখি।
গোলকধাঁধার খেলা, রক্তের সায়রে অবগাহন,
পৈশাচিক হাসি তাদের, আসমান ছুঁয়েছে আক্রোশের বাহন।

সব হিসেব লিখে রাখা আছে প্রথম সৃষ্টির স্পর্শে,
কাঙ্ক্ষিত ফল হাতে পেলে আমার দিন কাটবে হর্ষে।
উটপাখিদের স্থান হবে কাল নিকৃষ্টতম জাহান্নাম,
ধূম্রজালের সৃষ্টিকারীদের চিৎকারে কাঁপে হাবিয়া, আখেরি পরিণাম।’

___________

– গুলবাহার যে কি একটা মেয়ে! সবসময় চিন্তায় ফেলতে ভালোবাসে বেয়াদবটা।

রাগে গজগজ করতে করতে হানজালা রাতের খাবার টেবিলে রাখছেন। বাহারকে কল করেছিলেন, বাহার ধরছে না বিধায় তিনি এখন রেগে আছেন। সাখাওয়াতের খাওয়ার পূর্বে টেলিভিশন না দেখলে খাবার হজম হয় না। অভ্যাসের তাড়নায় সোফায় বসে অলস ভঙ্গিতে টিভি দেখছেন তিনি। একটু আগে সালমা কল করে বাহারের সাথে অনৈতিক আচরণ করতে মানা করে দিয়েছেন। বোনকে সম্মান করেন সাখাওয়াত, তাই বলে সংসারে নাক গলানোর অধিকার দেননি। তবু তিনি কিছু না বলে চুপ করে শুনেছেন সব। সালমা আপার জন্যই তার ভালো মেয়েটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

টিভিতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেখাচ্ছে। হানজালার রাগী স্বরের কারণে তিনি টিভির শব্দ বাড়িয়ে দিলেন। গুলনাজ হেলতে দুলতে নীচে নামছে। এই দুদিন তার আপু বাড়ি ছিল না, সে বেশ আনন্দে চলাফেরা করতে পেরেছে। কিন্তু কাল থেকে আপু আসবে। শৃঙ্খলা মেনে জীবন চলবে, এই ভেবে তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে আসছে। সংসার শুরু করেছে তার বোন, অথচ থাকবে বাবার বাড়ি। তার ভাগ্যে খারাপ ছিল বলেই বোনের ভুত ঘাড় থেকে নামছে না!

হানজালা খাবার দিয়ে জোরে ডেকে উঠলেন, ‘এই বাহারের বাবা, শুনছো? খাবার দিয়েছি, এসে পড়ো।’

সাখাওয়াত কোনো জবাব দিলেন না। হানজালা আবার ডাকলেন, ‘এইযে শুনছো? কই তুমি? নাকি বসে বসে টিভি গিলে খাচ্ছ? যত জ্বালা হয়েছে আমার! সবার দ্বারে দ্বারে গিয়ে দাওয়াত করে আসতে হবে।’ হানজালার রেডিও চালু হয়েছে। তিনি ওড়না হাতে পেঁচিয়ে ভ্রু কুঁচকে হাঁটতে হাঁটতে বসার ঘরের দিকে যাচ্ছেন। যেতে যেতেই শুনলেন গুলনাজ চিৎকার করছে।

– বাবা! বাবা তোমার কি হয়েছে?

এ কথা শুনে দৌড়ে সাখাওয়াতের কাছে গেলেন হানজালা। সাখাওয়াত কোনো কথা বলতে পারছেন না। মুখ বেঁকে আসছে তার, সাদা তরল বের হচ্ছে তার মুখ থেকে। নাজ তাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে। সাখাওয়াত এক হাত মাথায় রেখে অন্য হাত টিভির দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন। হানজালা স্বামীর মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘কি হয়েছে তোমার? মাথায় যন্ত্রনা করছে? রেবা! এই রেবা! জলদি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বল।’

রেবা কাজ ফেলে ছুটে গেল বাইরে। হানজালা সাখাওয়াতকে নিজের কাঁধে ভর দিয়ে ওঠালেন। এক পাশে নাজ ধরেছে তার বাবাকে, একপাশে হানজালা ধরেছেন। সাখাওয়াত এখনো এক হাত বাড়িয়ে রেখেছেন টিভির দিকে। হানজালা একবার সেদিকে তাকালেন। বুঝতে পারলেন না কি হচ্ছে। অনেক পুলিশ, র‍্যাব আর আর্মির সদস্য। সাংবাদিকদের মিছিলও দেখা যাচ্ছে। টিভির স্ক্রিনে লাইভ ভিডিওর পাশাপাশি একটা ছবি দেখা যাচ্ছে। ছবিটা ভালো করে দেখতে পেলেন না হানজালা। স্বামীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

কাননভিলা এখন নিভৃত বিলাসে পরিণত হয়েছে। টেবিলে পরে আছে খাবার, নাজের ঘরে ফ্যান চলছে। বাতাসে উড়ে যাচ্ছে তার লেকচার শিট। মূল দরজা খুলে রাখা। বসার ঘরে চলছে টিভি। আওয়াজ ভেসে আসছে রাত দশটার খবরের সংবাদ পাঠ।

‘শাহজালাল বিমানবন্দরে আজ রাত সাড়ে নয়টায় কাতারের উদ্দেশ্যে দুজন জ-ঙ্গি সদস্যের যাত্রা ছিল। সদস্যদের একজন পুরুষ এবং অন্যজন নারী। স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে দুজনের কাছে ছিল বিশটি গ্রেনে-ড, পনেরোটি নাইনএমএম ক্যালিবারের পি-স্তল, চারটি ডাবল ব্যারেড হোমমেড শট-গান এবং বিশ কেজি স্বর্ণের বার। ঘাতকদের আক্রমণ থেকে বিমানবন্দরের মানুষগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে আর্মফোর্স পূর্বেই তৈরি ছিল। তাদের দুঃসাহসিক পদক্ষেপের ফলে ঘাতকদ্বয়কে ধরাশায়ী করা গিয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের সাথে লাইভে আছেন….’

___________

(সমাপ্ত আলহামদুলিল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here