#দ্বিপ্রহরের_রাত্রি
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

৮.
জার্নি করে শরীর কেমন ঝিম ধরে গেছে অরিত্রর। ঢাকা থেকে শ্রুতিদের বাড়িও কম দূরে নয়। সেখানে একদিনেই যাওয়া আবার ফিরে আসাটা ক্লান্তির কারণ তো হবেই। বাড়ি ফিরেই অরিত্র ঘুমিয়ে নিয়েছে। অদিতি বেগম শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন,’ঠিক মতো পৌঁছে দিয়ে এসেছিস?’
অরিত্র শুধু মাথা নাড়িয়েছিল। যার অর্থ ‘হ্যাঁ’ কে নির্দেশ করে। বালিশে মাথা রেখে ক্লান্ত হওয়া চক্ষুযুগলকে বন্ধ করে নেয় সে।চোখের পাতায় ভেসে ওঠে তখন শ্রুতির মুখটি। ফিরে আসার পথেও ভীষণ শূন্য শূন্য লাগছিল। পাশের সিটে তখন আর শ্রুতি ছিল না। এতদিন একই সাথে থেকে মায়া জন্মে গেছে। মানুষের মন তো এমনই। ভাবনার মাঝেই একসময় অরিত্র ঘুমিয়ে পড়ে।
.
বাড়ি আসার পর থেকে পিয়ুশ চোখগুলো ছোটো ছোটো করে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এতে বেশ অস্বস্তিই হচ্ছিল তার। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলার উপায় নেই আবার কোথাও যাওয়ারও উপায় নেই। বৃষ্টি তো একদমই হাত ছাড়া করছে না তাকে। পাশে বসিয়ে রেখেছে। খাওয়ার সময় হোক কিংবা গল্পের সময়ে হোক। হাত ছাড়েনি একবারও। এখানেই বোঝা যায় বৃষ্টির সাথে শ্রুতির সখ্যতা ঠিক কতটা ছিল। বৃষ্টি ক্লান্ত না হলেও শ্রুতি ক্লান্ত ছিল। লং জার্নি করলেই তার ভীষণ ঘুম পায়। না পেরে আর বলেই বসল,’আমার খুব ঘুম পাচ্ছে রে। তুইও রেস্ট নিয়ে নে এখন। ঘুম থেকে উঠে কথা হবে।’
‘ঘুমাবি এখন? আচ্ছা ঘুমিয়ে পড় তাহলে।’
গল্প করছিল এতক্ষণ বড়ো মামার ঘরেই। শ্রুতির ঘরটা একদম শেষের দিকে। সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল পিয়ুশ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে শ্রুতির জন্যই অপেক্ষারত অবস্থায় আছে। এমনকি শ্রুতি নিজেও চাচ্ছিল এই ব্যাপারটা নিয়ে ক্লিয়ার কথা বলতে। অন্য কোনো প্রসঙ্গ না তুলেই ডিরেক্ট জিজ্ঞেস করল শ্রুতি,’কিছু বলবেন?’
‘আমি যদি ভুল না হই তাহলে আপনি…’
‘হ্যাঁ, আমিই সে মেয়ে।’
‘কোন মেয়ে?’
‘যার কথা আপনি ভাবছেন।’
‘আমি তো কারো কথা ভাবিনি।’

পিয়ুশের এ কথায় ভ্রুযুগল কুঁচকে তাকায় শ্রুতি। পিয়ুশের চোখেমুখে দুষ্টুমির ছাপ। এর মানে কী? সে ইচ্ছে করে মজা নিচ্ছে? শ্রুতিকে নিরব হয়ে যেতে দেখে পিয়ুশ বলল,’আমি তো বলতে চাচ্ছিলাম, আমি যদি ভুল না হই তাহলে আপনি আমার বেয়াইন হন।’
‘সেই পরিচয় তো আরও আগেই পেয়েছেন। নতুন করে এটা এখন জানার কিছু নেই নিশ্চয়ই?’
‘আপনি ক্ষেপে যাচ্ছেন বেয়াইন।’
‘আপনি মশকরা করছেন।’
‘আপনার সাথে আমার সম্পর্কটা তো মশকরারই। আদারওয়াইজ, আমরা বেয়াই-বেয়াইন।’
‘আচ্ছা। আমি এখন যাই। ঘুমাব।’
শ্রুতি সাইড দিয়ে চলে যাওয়ার সময়ে পিয়ুশ পেছন থেকে বলল,’সেদিন কামড়টা কিন্তু বেশ জোরেই দিয়েছিলেন।’
শ্রুতি এক মুহূর্তের জন্য পিয়ুশের দিকে তাকাল। সে মুচকি মুচকি হাসছে। না, শ্রুতি এখানে কোনো প্রত্যুত্তর করেনি। তার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে না।

ঘুমাতে যাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। যখন ঘুম ভেঙেছে তখন সন্ধ্যা। আলস্য ভঙ্গিতে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে ছিল। বুকের ভেতরটায় কেমন যেন হাহাকার করছে। ঘরে তখন বড়ো মামি আসেন। ব্যস্ততার সাথে বলেন,’তোর ঘুম হয়নি? এখনও শুয়ে আছিস। উঠ তাড়াতাড়ি। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে আয়।’
শ্রুতি ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল,’যাও। আসছি।’
বড়ো মামি চলে গেলেন। এখন আরও বেশি খারাপ লাগছে শ্রুতির। অদিতি বেগমের কথা মনে পড়ছে খুব করে। সন্ধ্যা হলেই সকল কাজকর্ম সেরে দুজনে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসতেন। চা খেতে খেতে কখনও কখনও শ্বশুরবাড়ির কথা, বিয়ের আগের কথা, বিয়ের পরের কথা, অরিত্রর ছোটোবেলার কথা কিংবা রাজা-রানির গল্প শোনাতেন শ্রুতিকে। কখনও কখনও দুজনে মিলে টিভিতে দেখত সিরিয়াল কিংবা কার্টুন। আজ সেই মানুষটা নেই। তার থেকে অনেক দূরে রয়েছে শ্রুতি। সুলায়মান রহমান! যার থেকে সে বাবার ভালোবাসা পেয়েছে। যে সবসময় হাসির কথা বলত। হাসাতো সবাইকে। আজ তার কথা শুনে ঐ বাড়ির বাকি সবাই হাসতে পারলেও শ্রুতি পারবে না। অনিক এখন কী করছে? এই পিচ্চিটা তো সবসময় শ্রুতির গা ঘেঁষে বসে থাকত। স্কুলে দিয়ে আসার জন্য বায়না করত। বন্ধুরা পরে যখন জিজ্ঞেস করত তোর সাথে ঐ সুন্দরী আপুটা কে এসেছিল রে? অনিক গর্বের সাথে বলত আমার ভাবি হয়। বাড়িতে ফিরে আসার পরে এসব কথা আবার শ্রুতিকে বলত। নিজের খাওয়ার টাকা দিয়ে শ্রুতির জন্য চকোলেট কিনত। এখন থেকে অনিক কার জন্য চকোলেট কিনবে? পরে রইল বাকি অরিত্র! সে আসলে কেমন? জানা নেই বিশেষ কিছু। তবে ভালো সে।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়েই আরও বেশি খারাপ লাগছিল শ্রুতির। দম বন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছিল। বলা চলে তার কান্নাও পাচ্ছে। আর শুয়ে না থেকে উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। চোখেমুখে ভালোমতো পানির ঝাপটা দেয়। বের হয়ে দেখে ঘরে আগে থেকেই বৃষ্টি আর রিমি বসে আছে। বৃষ্টি অভিযোগের সুরে বলে,’তুই কত ঘুমাতে পারিস রে? কয়বার এসেছিলাম আমি জানিস?’
‘জার্নি করলে এমনই হয়। ঘুম পায় আমার।’
‘আচ্ছা এখানে বোস এখন। তোর গল্প বল।’ শ্রুতির হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে বলল বৃষ্টি। শ্রুতি তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,’গল্প আবার কী? কিছুই না।’
‘কিছুই না বললেই হলো? কীভাবে পালিয়ে গেলি? কার কাছে ছিলি?’
শ্রুতি সংক্ষেপে সব বলল। শুধু পিয়ুশের সঙ্গে দেখা হয়েছিল এই কথাটাই লুকিয়ে গেছে। দরজায় তখন তিতাস নক করে বলে,’আসব?’
শ্রুতি বলল,’আসুন দুলাভাই।’
তিতাসের পিছু পিছু পিয়ুশও আসলো। পিয়ুশ পিঞ্চ মেরে বলে,’একা একাই গল্পে করছেন দেখি। আমাদের সাথেও একটু গল্প করুন।’
‘আরে ভাই, রাখ তোর গল্প। আমি তো আসছি আমার শালীকাকে ধন্যবাদ দিতে।’

ওদের দুজনকে বসার জায়গা দিয়ে সরে বসেছে শ্রুতি, বৃষ্টি আর রিমি। এখানে রিমি জিজ্ঞেস করল,’কাকে দুলাভাই?’
‘শ্রুতিকে।’
‘আমায়? কিন্তু কেন?’ জিজ্ঞেস করল শ্রুতি।
‘তুমি সেদিন পালিয়ে গেলে বলেই তো বৃষ্টির সাথে আমার বিয়েটা হলো। ভাগ্যিস পালিয়ে গিয়েছিলে! না হলে তো বৃষ্টির মতো মিষ্টি বউ পেতাম না।’ কথা বলে সে নিজেই হাসি শুরু করে। সঙ্গে হাসে পিয়ুশ, শ্রুতি আর রিমিও। শুধু বৃষ্টিই লজ্জা পাচ্ছিল। পিয়ুশও হাসতে হাসতে বলল,’আর আমি পেয়ে গেলাম সুন্দরী বেয়াইনকে।’
হাসি থেমে যায় শ্রুতির। কোনো এক অজানা কারণেই পিয়ুশের মশকরা তার পছন্দ হয় না। যদিও লোকটা খারাপ নয় এবং খারাপ কিছু বলেনি। তবে পাঁচ জনের গল্পও এক সময় জমে ওঠে। আর একটা সময়ে শ্রুতিও আনন্দে মেতে উঠে ভুলে যায় কিছু সময়ের আগের হাহাকার করা অনুভূতিগুলো।
.
.
অনেকদিন বাদে আজ অরিত্র রাতে হাঁটতে বের হয়েছে। এতদিন বাইরে তেমন আসা হয়নি। সিগারেটে ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে সে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকে। তার অবচেতন মন তাকে নিয়ে আসে সেখানে, যেখানে শ্রুতির সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল। এই মুহূর্তে সে সেই টং দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে যেখানে সেদিন শ্রুতিও দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু সে লক্ষ্য করেনি। আজ সেই রাত আছে, সেই দোকান আছে, আছে অরিত্রও। শুধু নেই শ্রুতি! মেয়েটা থাকাকালীন কখনই অরিত্রর এমন কোনো অনুভূতি হয়নি। আর আজ যখন যোজন যোজন দূরে ঠিক তখনই প্রচণ্ড পরিমাণে তার কথা মনে পড়ছে। দূরত্ব সব সম্পর্ক কেবল নষ্টই করে না, মাঝে মাঝে ব্যক্তির অনুপস্থিতি তার গুরুত্বও বুঝিয়ে দেয়। শ্রুতির চিন্তা মাথা থেকে তৎক্ষণাৎ নামিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। দোকানের বেঞ্চে বসে সিগারেট খেতে খেতে কানে হেডফোন গুঁজে গান শোনে। হাত ঘড়িতে সময় তখন রাত ১টা বেজে ২৫ মিনিট। এখন বাড়িতে যাওয়া প্রয়োজন। এখান থেকে অলি-গলি ঘুরে সে বাড়িতে পৌঁছায়। যাতে অতিরিক্ত হাঁটার ফলে অতিরিক্ত পরিশ্রম হয় এবং রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমও চলে আসে। হয়েছেও তাই। বাড়িতে ফিরে শোয়ার পরই ঘুম চলে এসেছে। রাতে খায়নি। সকালে উঠতেও লেট হয়েছে। সকালের নাস্তাও মিস হয়ে গেছে। অদিতি বেগম অনেকবার জোর করেও খাওয়াতে পারেনি। সোফায় বসে যত দ্রুত সম্ভব মোজা পরছিল সে।

অনিকের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। সুলায়মান রহমান তাড়া দিয়ে বললেন,’তাড়াতাড়ি খা বাবা। তোকে স্কুলে দিয়ে আমি অফিসে যাব।’
‘ভাবি কি আর কখনও আসবে না আব্বু?’ খাওয়া বাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করল অনিক।
অরিত্রর হৃদস্পন্দন কাঁপতে থাকে শ্রুতির নাম শুনে। তাড়াহুড়া এবং ব্যস্ততার মাঝে থাকায় সকালে একবারও মনে পড়েনি।কিছু্ক্ষণ স্তব্ধ হয়ে সুলায়মান রহমান বললেন,’না।’
এই ‘না’ শব্দে আরও বেশি যন্ত্রণা অনুভব হয় অরিত্রর। সে চলে যায় অফিসে। অফিসের সময়টাও তার ব্যস্ততার মাঝেই কাটল। তবে এর মাঝেও হুটহাট কয়েকবার মনে পড়েছিল শ্রুতির কথা। তবে ব্যস্ততার জন্য সে কাবু হয়ে যায়নি।

অফিসের সমস্ত কাজ শেষ হতে হতে তার আবারও ঘুম পাচ্ছিল। কোনো রকম মাথা রাখার জায়গা পেলেই ঘুমিয়ে পড়তে পারবে বলে মনে হচ্ছে। ক্লান্ত হয়ে সে বাড়িতে ফিরে। হাতে আজ চটপটি। কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দেন অদিতি বেগম। মুহূর্তেই অরিত্রর ভাবনায় ভাঁটা পড়ে। সে জিজ্ঞেস করে,’শ্রুতি কোথায়?’
তিনি একদৃষ্টিতে কিছু্ক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। হাত থেকে চটপটির প্যাকেট নিয়ে বলেন,’ভুলে গেছিস?’
অরিত্র আর কিছু বলল না। নিরবে চলে গেল ঘরের ভেতর। অসহ্য রকম কষ্ট হচ্ছে তার। শ্রুতি আজ দরজা খুলে দেয়নি। আজ বাড়ি ফিরেই তার হাসিমাখা মুখটা দেখতে পায়নি অরিত্র। হাসফাঁস লাগছিল তার। ভারী তপ্ত দীর্ঘ নিঃশ্বাস বুকজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। স্বগতোক্তি করে সে বলে,’আই মিস ইউ শ্রুতি।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here