#ধারাবাহিকগল্প
#দ্বিতীয় বিয়ে
পর্ব-পাঁচ
মাহাবুবা বিথী

গুড় গুড় করে মেঘ ডাকছে।আষাঢ় মাস।যে কোন সময়ে বৃষ্টি শুরু হতে পারে।বিকেলের নরম রোদের লালচে আভা মূহুর্তে অন্ধকারে ঢেকে গেল।সম্পার
ও ঘরে ফেরার তাড়া শুরু হয়।
মাগরিবের আযান শুরু হয়।আমি আর সম্পা নামাজ পড়ে নেই।চা বানিয়ে নিয়ে আসি।চা খেতে খেতে সম্পাকে বলি
—-সম্পা, তুমি অনেক ভাগ্যবতী। তাই জাহিদের মতো স্বামী পেয়েছো। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা ভিন্ন।তাই আমি এখনও বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবছি না।যদি কোনদিন সম্পর্কে জড়াতে ইচ্ছে হয় তোমাকে জানাবো।তবে আজ তোমার সাথে আমার যে কথপোকথন তা যেন আমাদের দুজনার মাঝে থেকে যায়।
সম্পা বিষন্ন সুরে বলে
—-যদি আমি বেঁচে থাকি, তাহলে জানাতে পারবে। আর যদি না থাকি তাহলে বন্ধুত্বের দাবিটা তোমার কাছেই জমা থাকলো।
তারপর সম্পা বাসায় চলে যায়।
কিছুক্ষণ পর মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়।মাঝে মাঝে আকাশের বুকে ঝাড়বাতির আলো জ্বলে উঠে।তারসাথে প্রচন্ড নিনাদ বেজে উঠে।দুঘন্টা ধরে বর্ষণ হয়। আমি ফোন দিয়ে সম্পার খোঁজ নেই। সম্পা ঠিক মতোই বাড়ি পৌঁছে যায়।

আমার নিত্যকার রুটিন শুরু হয়।খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায়।এরপর ফজরের নামাজ পড়ে নেই।ব্রেকফাস্ট করে হাসপাতালের পথে রওয়ানা হই।

আমি লক্ষ্য করেছি, ডিভোর্সি হওয়াতে আমার যত যশ খ্যাতি সবকিছু নিয়ে আমার সহকর্মীদের মধ্যে নেগেটিভ আচরণ দেখা যায়।মাঝে মাঝে পরিচিত জনদের কথা শুনে আমার প্রচন্ড রাগ হয়।পর মূহুর্তে নিজেকে সামলে নেই।সেদিন আমার হাসপাতালের ডাক্তার সালমান আমার রুমে আসে। আমি ও তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাই।সালমান আমাকে বলে,
—-এই বয়সে আপনি যথেষ্ট সুন্দরী।অথচ আপনার রুপ যৌবন সবই বিফলে গেল।হাসব্যান্ড ছাড়াই জীবনটা পার করে দিলেন।
আমি চোয়াল শক্ত করে তাকে বললাম,
—-আসলে আমি আমার ব্যক্তিগত বিষয় কারো সাথে শেয়ার করি না।এই বিষয়গুলো একান্ত আমার নিজের কাছে রাখতে পছন্দ করি।ডাঃ সালমান আমার জরুরী কাজ আছে।আমি এখন উঠবো।
সালমান বললো,
—-ওহ সরি,আপনার মুল্যবান সময় নষ্ট করলাম।
সালমান চলে গেল। আমাকে প্রতিদিন নোংরা মনের মানুষগুলোর কুৎসিত কথাগুলো হজম করতে হয়।
আসলে এই সমাজে একজন নারীর একা জীবনযাপন করা খুব কঠিন।সে চাইলেই পুরুষের মত স্বাধীনভাবে একা জীবনযাপন করতে পারে না। কারণ সমাজ এই বিষয়ে তাকে সম্মতি দেয় না।পাশের বাড়ির প্রতিবেশী থেকে চাচাতো মামাতো ফুফাতো সম্পর্কীয় মানুষগুলো আর সর্বোপরি রয়েছে সহকর্মীবৃন্দ।প্রতিনিয়ত সবার কাছে একা থাকার কৈফিয়ত দিতে হয়।
একজন ডিভোর্সি নারীর বন্ধু থাকতে পারে।তার সাথে একটু হেসে কথা বললে অমনি এই সমাজের কিছু মানুষ বলতে শুরু করে দেয়,”নিশ্চয় আবার প্রেম করছে”। চরিত্রের পোস্টমর্টেম শুরু হয়ে যায়।

আমার যখন ডিভোর্স হয় তখন আমিও মাত্র এমবিবিএস পাশ করা একজন ডাক্তার।আমাকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইতো না।কারণ স্বামী ছাড়া কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। ওদের ব্যবহার দেখলে মনে হয় স্বামী না থাকা যেন মহাপাপ।

একবার আমি আমার এক বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম।সেখানে তার মাও বেড়াতে এসেছিলো।কিন্তু তার মা আমাকে তার বাসায় যাওয়াটা স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি।আমার বান্ধবীও ডাক্তার ওর হাসবেন্ডও ডাক্তার।দুজনেই আমার ক্লাসমেট।ওই আন্টি আমাকে বললেন,
—–তুমি বিয়েশাদি করলে না কাজটা ভালো হয়নি।তুমি কিছু মনে করোনা আমি আসলে তোমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলছি না।এটা আমাদের সমাজের ভাবনা। যে সব মেয়েদের চারিত্রিক সমস্যা থাকে তারা বিয়েশাদি করতে চায় না। তাই তোমার বিয়ে করা উচিত ছিল।সেদিনের পর থেকে আমার বন্ধুটিও আমাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে।

আমি সেদিন প্রচন্ড অপমানিতবোধ করেছিলাম। যার কারনে আমার চেনা গন্ডিটা আরও ছোটো করে ফেললাম।
একটু গুছিয়ে উঠার পর
বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে নানাবিধ সমস্যার কারণে আমি নিজের মত থাকার জন্য খুব দ্রুত এই ফ্লাট কিনেছিলাম।কিছু টাকার সমস্যা হয়েছিলো।জাহিদ আর সম্পার কাছে সে সময় লোন নিয়েছিলাম।পরে শোধ করে দিয়েছি।
এরপরও আমি খেয়াল করি নিজের ফ্লাটে থাকা সত্বেও পাশের বাড়ির প্রতিবেশী থেকে শুরু করে এই এপার্টমেন্টের কেয়ারটেকার পর্যন্ত আমার ফ্লাটে তীক্ষ্ণ নজর রাখে।ওরা ফেলুদার গোয়েন্দাকেও হার মানিয়ে দেয়।

এই ধরনের নানাবিধ পরিস্থিতি মাড়িয়ে একজন নারীর একলা পথ চলতে শারীরিক ও মানসিক জোর কতটা প্রয়োজন হয় তা এই সমাজের মানুষগুলো কখনও ভেবে দেখেনি।

এর মাঝে একদিন আমি কুমিল্লা মেডিকেলে একটা সেমিনারে যোগ দিলাম।সেমিনার শেষ হতেই রাত হয়ে যায়।ওখানে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা ছিলো।কিন্তু পরদিন আমার একটা জটিল অপারেশনের সিডিউল দেওয়া আছে।অগত্যা নিজের ট্যাক্সিতেই ঢাকার পথে রওয়ানা হই। কাঁচপুর ব্রিজের কাছে আমার ট্যাক্সি নষ্ট হয়।রাত তখন এগারটা বাজে।ড্রাইভার কোনক্রমে গাড়িটাকে ঠেলে সামনের পেট্রোল পাম্পের কাছে নিয়ে যায়।কিন্তু ড্রাইভার অত রাত্রিতে কোথাও মেকানিক খুঁজে পেল না।পেট্রোল পাম্পের ওখানে লোকজনের ব্যবহার কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো।আমি একজন ডাক্তার সেই পরিচয় দিলাম।কিন্তু ওদের দৃষ্টিভঙ্গী আমি একজন নারী।অগত্যা জাহিদকে ফোন দিলাম।রাস্তা ফাঁকা থাকাতে জাহিদ আর ওর ছেলে মাহিন ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌছে যায়।এই দুঘন্টা সময় আমার কাছে দু,বছরের মতো মনে হতে লাগলো। সে সময় নিজের গাড়ির ড্রাইভারকেও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না।আজকাল মানুষ খুব খারাপ হয়ে গেছে।ষাট বছরের বৃদ্ধা থেকে মাসুম শিশু পর্যন্ত প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হচ্ছে।কোন ঘটনা ঘটে গেলে বছরের পর বছর বিচার হয় না।বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে।এরপর আমি মাহিনের সাথে ঢাকার পথে রওয়ানা হই।জাহিদ আমার গাড়িটা নিয়ে এসে গ্যারেজে পৌছে দেয়।বাসায় আসতে ভোরের আলো ফুটে যায়।আমাকে নামিয়ে দিয়ে মাহিন বাসায় চলে যায়।আমি তো ডাক্তার মানুষ।আমাদের এরকম রাত জাগার অভ্যেস আছে।মাহিনের অফিস আছে।ছেলেটার সারারাত ঘুম হলো না।আমার নিজের কাছে খারাপ লাগছে।

আমার ভাই আত্মীয় পরিজন আছে। ওদের ধারণা আমি বিয়ে করে ফেললে তো ল্যাঠা চুকে যায়। ডাক্তার হই বা আর যাই হই না কেন এই সমাজ আমাকে মানুষ নয় একজন মেয়ে মানুষ হিসাবে বিবেচনা করে।আমার তো জরায়ু নেই।বিয়ে করলে সন্তান জন্ম দিতে পারবো না।তারপর আমার এই অক্ষমতাকে পুঁজি করে আমার জীবনের সব অর্জন হয়ত ধুলিস্যাত হয়ে যাবে। তাই বিয়েতে আমার বড্ডো ভয়।

সম্পার ঐ প্রস্তাবের পর আমি নিজেকে ওদের কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম।ওদের সাথে যোগাযোগ অনেক কমিয়ে দিয়েছি।টাকার ঋণ হলে টাকা দিয়ে শোধ হয় কিন্তু ওদের আমার পাশে থাকার ঋণের বোঝা আমি আর বাড়াতে চাই না।অথচ প্রতিনিয়ত
এই ঋণ যেন বেড়েই চলেছে। আর আমার ভবিতব্য যেন বার বার সম্পা আর জাহিদের জীবনের স্রোতে মিশে যেতে চাইছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here