দুঃখগাথার রাজকন‍্যা
কলমে:লাবণ‍্য ইয়াসমিন
পর্ব: ১০

রাত্রীকে পেছনে ফিরতে দেখে আরাভ ভ্রু কুচকে ফেলল। মেয়েটার চোখেমুখে বিষাদের চিহ্ন। কপাল কেটে রক্ত পড়ছে।রাত্রীর চোখের পাপড়িতে অশ্রু মুক্তদানার মতো চিকচিক করছে তবু কেনো পিছনে ফিরলো ও বুঝতে পারছে না। ব‍্যাথা পেলে মানুষ চিৎকার করে অথচ সে নীরব। কতটা সহ‍্য ক্ষমতা থাকলে ঠোঁট টিপে চোখের পানি আড়ালে লুকানো যায়। কথাগুলো ভেবে আরাভ ফিসফিস করে বলল,
> নাম বলো কে এমন করেছে?
> বাথরুমে পা পিছিলে পড়ে গিয়েছিলাম ঠিক পাইনি। আপনি চিন্তা করবেন না।
> আমি আঘাতের চিহ্ন দেখে বুঝতে পারি। আমার থেকে লুকানোর কিছু নেই। যাও রেডি হয়ে আসো আমরা এই বাড়িতে আর থাকবো না। নিজের বাড়িতে ফিরবো এবার। আমি বলেছিলাম আমার জন্য তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। আমি কথার বরখেলাপ করিনা। যাও দ্রুত রেডি হও আমি আসছি।

আরাভ সময় নষ্ট করলো না। তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে চলে আসলো। ব‍্যাগে বইগুলো গুছিয়ে লাগেজ নিয়ে বাইরে বের হতেই সোনিয়া মির্জা চিৎকার চেচামেচি শুরু করলেন। উনি বিলাপ করছেন আর কাঁদছেন। বলছেন,রাত্রীর জন্য ছেলেটা উনার পর হয়ে গেলো। উনার এমন মরা কান্না দেখে আরাভ নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে শান্ত কন্ঠে বলল,

> খালামনি তোমার বাড়িতে আমার স্ত্রীর উপরে অন‍্যায় করা হচ্ছে সেটা দেখেও চুপচাপ হজম করবো তোমার এমন ভালো ছেলেতো আমি নই। তুমিই আগে আমাকে বলতে সব সময় অন‍্যায়ের প্রতিবাদ করতে। তাহলে হঠাৎ এখন এমন কেনো বলছো? মেয়েটার মাথায় ওভাবে আঘাত করাটা কি ঠিক হয়েছে?

> মীরা ভুল করে ফেলেছে। তুই জানিস তো মেয়েটার কেমন রাগ। রাত্রীও তেমন ওকে ঠান্ডা চা দেবার কি প্রয়োজন ছিল? তুই শান্ত হয়ে ঘরে যা বাবা। আমি কথা দিচ্ছি ওকে আর কেউ কিছু বলবে না।

আরাভ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রাত্রী ধীরপায়ে সিঁড়ির কাছে এসে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলল,

> আপনি শুধু শুধু রাগ করছেন। এইটুকু লেগেছে এখুনি ঠিক হয়ে গেছে। মীরা আপা ইচ্ছে করে মারেনি। উনি চা ছুড়তেই আমি সামনে চলে এসেছি। দোষ আমার।

রাত্রীর কথা শুনে দক্ষিণের ঘর থেকে মিরা বেরিয়ে আসলো। এতক্ষণ সে চুপচাপ শুনছিল। আরাভকে ও ভয় পাই তাই ঘর থেকে বের হয়নি। কিন্তু যখনই রাত্রী ওকে সাপোর্ট করলো অমনি ও নিজের দোষটা ঝেড়ে ফেলতে চিৎকার করতে করতে বাইরে আসলো,

> বিয়ে নাই করতেই বউয়ের আঁচল ধরে বসে আছো। দুদিন পরে তো আমাদের চিনতেই পারবে না। লোক লজ্জা বলে কিছু নেই। ছি আরাভ তুমি তো এমন ছিলে না?
আরাভ মীরার কথায় প্রতিবাদ করলো না। যার জন্য যুদ্ধ করতে এসেছিল সেই অপরাধীদের পক্ষে। সেখানে ও কিবা করতে পারে কথাটা ভেবে ও চুপচাপ নিজের ঘরে ফিরে আসল। রাত্রীর দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে সোনিয়া মির্জা গটগট করে চলে গেলেন। মীরা রবিকে চায়ের অর্ডার দিয়ে বাগানের দিকে গেলো। রাত্রী সেখানে একা ঠাই দায়িত্ব আছে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে ঠোঁটে এসে ঠেকলো। নোনতা পানির ফোটা ওর থুতনি দিয়ে মেঝেতে টপটপ করে পড়ছে। রান্নাঘরে রবি বিড়বিড় করছে,

> কর্মদোষে কপাল পুড়াইয়া দোষ দিবা কারে।

রাত্রীর কানে আওয়াজটা বিষের মতো না অমৃতের মতো লাগলো। না সামান্য দুঃখে ভেঙে পড়ার মতো মেয়ে ও না। চোখের সামনে নিজের মায়ের খুন হতে দেখা মেয়েটার চোখে সেদিনই আগুন লেগে গিয়েছিল। সেই আগুনের কাছে এই আগুনতো সামান্য। কথাগুলো ভেবে ও চোখের পানি মুছে রান্নাঘরে গিয়ে বিকালের নাস্তা তৈরীতে মনোযোগ দিলো। কাজ শেষ করে রাত্রী নাস্তা নিয়ে আরাভের রুমে আসলো। ছেলেটা কখনও নিজের রুমে খাবার খাইনা। রাত্রী নাস্তার ট্রে নামিয়ে রেখে আশেপাশে তাঁকালো। রুমে আরাভ নেই কিন্তু বেলকনির দরজা খোলা আছে। সেদিক থেকে দমকা হাওয়া এসে জানালার পর্দা উড়িয়ে দিচ্ছে। রাত্রী একপা দুপা করে দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। আরাভ পশ্চিমে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ পেছনে কারো পায়ের শব্দ শুনে ও না তাকিয়েই বলল,
> খেতে মন চাইছে না। একা থাকতে চাই।
আরাভ না তাকিয়ে আন্দাজ করে বলেছে দেখে রাত্রী একটুও অবাক হলো না। এই ছেলেটা মানুষকে চমকে দিতে উস্তাদ। ও ভাবনাগুলোকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
> অসুস্থ হয়ে যাবেন। শুনেন সব বিষয়ে এতোটা ঝামেলা করা ঠিক না। ঝগড়া ঝামেলা সব বাড়িতেই হয়। পরে আবার ঠিক হয়ে যায়। আসুনতো খাবার এনেছি।
> একটু বেশিই কথাবলো তুমি। যাও যখন ক্ষুধা পাবে খেয়ে নিবো। তোমার মতো দাঁত কামড়ে কষ্ট সহ‍্য করি না আমি।
আরাভের কথায় রাত্রী সামান্য হাসলো। তারপর ফিরে আসতো চাইলো কিন্তু পেছনে থেকে আবারও ডাক আসলো,
> রাত্রী শুনো!
আরাভের ডাকে ও থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে ইশারা করে জানতে চাইলো। আরাভ উত্তরে কিছুই বললো না। চুপচাপ ভেতরে এসে ড্রয়ার থেকে কিছু ওষুধ বের করে রাত্রীর হাতে দিয়ে বলল,
>মনে করে খেয়ে নিবে। এখন ব‍্য‍াথা করছে না কিন্তু পরে করবে তখন যন্ত্রণায় কষ্ট পেতে হবে। অসুস্থ হলে কেউ তোমাকে সাহায্য করবে না। শুনো কেউ কাউকে ভালোবাসে না। মানুষ মানুষের কর্মকে ভালোবাসে।তোমার কর্ম ফুরিয়ে যাবে চারপাশের মানুষের ভালোবাসার রঙও বদলে যাবে। তখন সবার কাছে বোঝা হয়ে উঠবে।
রাত্রী চুপচাপ আরাভের মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে। ছেলটার চোখ পানিতে ছলছল করছে হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই টুপকরে ঝরে পড়বে। রাত্রী জানে এই অশ্রুসিক্ত চোখদুটিতে ভীষন যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে। আজকে ওর কষ্ট দেখে লোকটার সেসব মনে পড়ছে। রাত্রীর ধ‍্যান ভাঙলো আরাভের ধমক শুনে,

> কি বললাম মনে থাকবে?
> থাকবে না আবার। মনে না থাকলে আপনি আছেন না ধমক দেবার জন্য। আমি যাচ্ছি। সবাইকে খাবার দিতে হবে।
> আচ্ছা।
রাত্রী ওষুধগুলো নিয়ে চলে আসলো। নাস্তার টেবিলে বেশ শোরগোল উঠেছে। রবী সবাইকে খাবার দিয়ে দিয়েছে। রাত্রী ঔষধগুলো আচলে বেধে কাজে মন দিলো। ওকে দেখে সবাই চুপচাপ হয়ে গেলো।রাতের বেলা রাত্রী নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়লো। কপালের ব‍্যাথাটা প্রচণ্ড বেড়েছে। সঙ্গে জ্বর উঠেছে। নির্জনতা ভেঙে হঠাৎ ওর দরজায় টোকা পড়লো। রাত্রীর বিরক্ত লাগলো তবুও বারবার দরজা ধাক্কানোর শব্দে ও আর শুয়ে থাকতে পারলো না। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো আবছা অন্ধকারে আরাভ দাঁড়িয়ে আছে। ওকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাত্রী ভ্রু কুচকে জিঞ্জাসা করলো,
> এতো রাতে আপনি?
> রুমে চলো। আমাদের আলাদাভাবে দেখলে সবাই সন্দেহ করবে।
> করলেই বা। বিয়ে হয়ে গেছে তাই ওসবে এখন আর কিছুই যায় আসে না।
> বিয়ে ভাঙতে সময় লাগে নাকি। দেখবে সব আগের মতোই করে ফেলেছে। ওসব ঝামেলা করতে পারবো না। হয় তুমি আমার সঙ্গে যাবে নয়তো আমি তোমার সঙ্গে এখানেই থাকবো।
রাত্রী ওর কথায় ঢোক গিলে ফিসফিস করে বল‍ল,
> পাগল হয়েছেন? লোকজনে কি বলবে। সম্মান নিয়ে টানাটানি করছেন আপনি ।
আরাভ ওকে ঠেলে দিয়ে ভেতরে চলে আসলো। রুমটা আর আগের মতো নেই। সুন্দর করে পরিপাটি করে সাজানো গোছানো আছে। আরাভ সোফায় বসতে বসতে বলল,
> দারুন গুছিয়ে নিয়েছো। যাইহোক শুনো তুমি বিছানায় শুয়ে পড়ো আমি সোফায় আছি। আর তোমার যদি অসুবিধা না হয় তাহলে আমি বিছানায় আসি?
আরাভের এমন প্রস্তাব শুনে রাত্রী চমকে উঠে তাড়াতাড়ি বিছানায় পা তুলে বসতে বসতে বলল,

> না না এতো ছোট বিছানায় দুজনকে ধরবে না। আপনি ওখানেই থাকুন।

আরাভ ওর কথায় সামান্য হেসে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। কেনো জানি রুমে কিছুতেই মন বসছিল না। রাত্রীর জন্য টেনশন লাগছিল। তাই কিছুই না ভেবে চলে এসেছে। রাত্রী আপত্তি করবে তাই কিছু কথা ও নিজের মতো করে বলেছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আরভের চোখটা ধরে আসলো। ও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। রাত্রীর ভীষণ জ্বর এসেছে। ও জ্বরের জন্য অচেতন হয়ে কিছুই ঠিক পাচ্ছে না। বাইরে থেকে আবারও দরজা ধাক্কনোর শব্দ ভেসে আসলো। আরাভ ধরফর করে উঠে বসতেই দেখলো রাত্রী ঘুমিয়ে আছে কিন্তু বাইরে থেকে কেউ দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। আরাভ ভ্রু কুচকে বিরক্ত হয়ে দরজার পাশে আসতেই বাইরে থেকে ফিসফিস করে আওয়াজ আসলো,
> রাত্রী তাড়াতাড়ি উঠে আমার জন্য কফি তৈরী করে দাও।
আরাভ অবাক হলো। এই বাড়িতে সন্ধ্যায় রবি সবার রুমে চা কফি রেখে আসে। যার যখন দরকার হয় সে নিয়ে খেতে পারে। নিচে এসে তৈরী করার দরকার হয়না কিন্তু লোকটা হঠাৎ এভাবে রাত্রীকে ডাকছে কেনো? ফিসফিস শব্দের জন্য ভয়েজটা ঠিক চেনা যাচ্ছে না। কে হতে পারে ভাবতে ভাবতেই আবারও সেই শব্দটা ভেসে আসলো,

চলবে

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here