#ত্রিমোহনী
(৬)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
_________________________
চমকহীন চাঁদের উপস্থিতি গভীরভাবে উপলব্ধি করার আপ্রাণ চেষ্টা ইকবালের। নদীর পাড়ে শীতের আগমনী হাওয়া পশমের গোঁড়ায় যেন একটু একটু চিমটি কাটছে। এই চামড়ার চিমটি কাটা অনুভূতিটা চামড়া ভেদ করে সোজা হৃৎপিণ্ডটাকেও খুঁচিয়ে দিচ্ছে তার। সেকি ব্যথা, এই খোঁচানোর নাকি এ ব্যথা রুপশ্রীর বিয়ের! কাউকে ভালোবাসলে কাঁদতে নেই।রুপশ্রী তো সুখী হবে তবে সে কেন কাঁদবে। প্রিয়রা খুশি থাকলে নিজেরও খুশি থাকা উচিত। আর দুঃখই বা কেন করবে? রুপশ্রীকে মন খুলো কখনো বলাই হয়নি, ‘ভালোবাসি।’ কিন্তু কক্সবাজার থেকে ফেরার আজ পনেরোদিন হলো তাকে একটিবার দেখারও সুযোগ পায় নি ইকবাল। তনুশ্রী কিংবা রুপশ্রী এতদিনে একটিবারও বারান্দা আর ছাঁদে পা রাখেনি। শ্রেয়সীই একমাত্র ইকবালের সামনে গেছে এ কদিনে বহুবার। ইরফানকে অনুরোধ করতে সে যেন তনুশ্রীর সাথে একটিবার কথা বলে। সেদিন কক্সবাজারে ইকবালের কাছে ইরফানও গিয়েছিলো। ইকবাল কোন হোটেলে উঠেছে আগেই জানিয়েছিলো। ইরফান আবারও একটি চাকরির সুযোগ পেয়েছিলো এক বন্ধুর মাধ্যমে তবে এবার চট্টগ্রাম নয় একেবারে কক্সবাজারে এক নামী হোটেলে। কাজ তার একটাই সেটা হলো ফরেইনার ট্যুরিস্টদের সাথে ঘোরাঘুরি এবং তাদের বিভিন্ন জায়গা,স্থান সম্পর্কে ধারণা দেওয়া।অনার্স পাসের পর থেকেই বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছিলো ইরফান। প্রায় প্রতিবারই টাকা অথবা লোকের অভাবে চাকরি হই হই করেও হলো না। মাস্টার্স পাস করার পর একটা বেসরকারি কলেজে চাকরি পেয়ে মাস পাঁচেক করেই তা ছাড়তে হলো এক মেয়ের কারণে। ইরফান দেখতে সুদর্শন, শিক্ষিত আবার স্বভাবেও রগচটা আর মেয়েরা হয়তো সেকারণেই তাকে না চাইতেও একটু অন্য চোখে দেখে।সে দেখা ভালোলাগা আর ভালোবাসায়ও গড়িয়েছে অনেকের। অনেকের মধ্যে একজন ছিলো যে ছিলো উন্মাদিনী ইরফানের প্রেমে। সেই মেয়েটি এমনইভাবে পেছনে লেগেছিলো যার ফলে মেয়েটির পরিবারও একসময় ইরফানকে ফোর্স করে মেয়েটিকে বিয়ে করতে। মেয়েটি সুন্দরী, অর্থবিত্তেও বিত্তবান। সেই মেয়েটিকে বিয়ে করলে নিঃসন্দেহে ইরফানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার প্রয়োজন হতো না।কিন্তু ইরফানের মনে তো আগে থেকেই বসত কারো। সে কি করে চাইতো ওয়েলসেটেলড হওয়ার জন্য অন্য কোন মেয়েকে! তার ধারণা ছিলো সে যদি কলেজে না যায় রোজ রোজ মেয়েটি তাকে না দেখলে হয়তো ভুলে যাবে। প্রেমের পাগলামি সরে যাবে তার মন থেকে; তেমন কিছুই হয়নি। ইরফান চাকরিটা ছেড়ে চলে এলো। জুনিয়রদের সাথে বাজিতে ক্রিকেট খেলা নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলো ভালো আরেকটা চাকরি না হওয়ায়। সেই মেয়েটির পরিবার তার খোঁজে এলাকাতেও এসেছিলো কোন লাভ হয় নি। সে ভালোবাসে তনুশ্রীকে কথাটা জানিয়েছিলো মেয়েটিকে। তাতে ফায়দা কিছু না হলেও ক্ষতি অনেকটা করে দিয়ে গেছে সেই মেয়েটি। খোঁজ লাগিয়ে তনুশ্রীর পরিচয়, ঠিকানা নিয়ে সবটা তনুশ্রীর বাবা তাহমিদ দেওয়ানকে বলেছে। ফলস্বরূপ, তাহমিদ দেওয়ান ইরফানকে ডেকে অনেক কথাই শুনিয়েছে তবে সবটা গোপনে। ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি দু বাড়ির অন্য সদস্যরা। দেওয়ান বংশের শেষ উত্তরসুরী তনুশ্রীরা তিন বোন। তাদের বাবা চাচাদের আর কোন বংশধর নেই তাই ইরফানের মত মধ্যবিত্ত আর বয়সে দ্বিগুণ বড় ছেলেকে তারা তনুর জন্য কখনোই মানবেন না। তনুর বাবা যেদিন ইরফানকে ডেকে বললেন, ‘তুমি কি লোভে পড়ে তনুকে ফাঁসিয়েছো?’ কথাটা তনুর বাবা যতোটা স্বাভাবিক স্বরে বলেছিলেন ইরফানও ততোটা স্বাভাবিক রেখেছিলো নিজেকে। একটুও চমকায়নি বরং মনে মনে গুছিয়ে নিলো কিছু কথা। তার প্রস্তুতি হয়তো আগে থেকেই ছিলো। তনুশ্রীর বয়স সবে আঠারো আর ইরফানের বয়স ঊনত্রিশ । বয়সটার দূরত্ব জেনেই ইরফান নিজের অনুভূতিগুলো বন্দী রেখেছিলো হৃৎপিণ্ডের এক অদৃশ্য দেয়ালে। সেই দেয়াল ঠুঁকে ঠুঁকে তনুশ্রীই বের করেছিলো তাদের। ভালোবাসলেই তাতে অধিকার খাটাতে নেই এই নীতিটা মেনেছিলো ইরফান। তনুশ্রীর বাবার প্রশ্নের জবাবে সে মার্জিত জবাব দিয়েছিলো এবং নিজেও প্রশ্ন করেছিলো কয়েকটা। ঋণাত্মক জবাব পেয়ে সে আর রা করেনি। তার শেষ প্রশ্ন ছিলো, ‘আমি যদি তনুশ্রীকে আমার মত করে সুখী করতে পারি আর তনুশ্রী যদি সেই সুখই চায় তবুও কি আপনি অমত করবেন?’ তাহমিদ দেওয়ান সাথেসাথেই বলেছিলেন, ‘আমি কখনও তোমার সাথে মেয়ে বিয়ে দিবো সে কথাটাই তুমি ভুলে যাও।’ রেগে গিয়েছিলো ইরফান প্রচণ্ড ক্রোধ সে নিজের মধ্যে চেপে চলে গিয়েছিলো। তনুশ্রীর সাথে দেখা করে সে সবটা বলেছিলো এই সম্পর্ক সে আর এগিয়ে নিতে পারবে না। আগেও তনুশ্রীকে বলেছিলো সে কথাগুলো সম্পর্কের সূচনা তখনও হয়নি। তনুশ্রীর অগাধ বিশ্বাস ছিলো তার বাবা কখনও অর্থবিত্তের দোহাই দিয়ে ইরফানকে অপছন্দ করবে না। মানুষটার অর্থ না থাক শিক্ষা আছে,সভ্য সমাজে সততা আছে তার পরিবারের সবার। অপছন্দ করার মত যুৎসই কারণ আছে বলে মনে করেনি তনুশ্রী। কিন্তু তার বাবার মতামত জানতেই সে ইরফানকে বলেছিলো অত ভাবতে হবে না। কিন্তু ইরফান আর এক পাও আগাতে রাজী নয় তনুশ্রীর প্রেমে। প্রেম পুষে রাখবে সারাজীবন মনের আঙ্গিনায় তবুও কোন বাবা মায়ের অভিশাপ কিংবা মনোকষ্টের দায় নিতে রাজী নয় মোটেই। তনুশ্রীর বয়স কম আজ আবেগে তার জন্য উতলা কাল ঠিকই অন্যকারো ভালোবাসা পেলে ভুলে যাবে এই কৈশোরে পাওয়া যন্ত্রণা। ঠিক গুছিয়ে নেবে নিজেকে অন্যকারো রঙে। আর শেষবারের মতোই এই কথাগুলো সে চিঠিতে করেও লিখেছিলো তনুশ্রীকে। বিনিময়ে তনুশ্রী শুধু বলেছিলো, ‘কাপুরুষ।’ কাপুরুষই সে সাহস থাকলে ভালোবাসার মামুষকে কেন কষ্ট দিবে কেন লড়তে পারবে না তাকে পাওয়ার জন্য! ইকবাল,ইরফান দুজনই কাপুরুষ তনুশ্রীর নজরে। যে কাজ করাটা ইরফানের চোখে অন্যায় সে কাজটাই তনুশ্রীর নজরে ভালোবাসার সম্মান দেওয়া। ইরফান ভুল করেনি তনুকে ভালোবেসে তবে ভুল করতো যদি তনুকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তনুর বাবাকে কষ্ট দিলে,তনুর বাবার সম্ভ্রমে কালি তার কারণে লাগালে।ইকবালও ব্যতিক্রম নয়। ভালোবাসা কখনও নিস্পৃহ কখনও বা উদ্বেল। তারা দু ভাই ভালোবাসার অসম্মান করেনি শুধু পাওয়ার লোভটাকে সংবরণ করার চেষ্টা করেছে মাত্র ।ইরফান শক্ত মনের সে সামলে নিয়েছে নিজেকে হয়তো আগে থেকেই প্রস্তুত রেখেছিলো এই পরিস্থিতির জন্য কিন্তু ইকবাল তা পারেনি। যত দিন যাচ্ছে তত তার ভেতরের দূর্বলতা স্পষ্ট হচ্ছে। কাল রুপশ্রীর গায়ে হলুদ অথচ আজ ভোরেই ইকবাল শ্রেয়সীকে বলেছে রুপশ্রীর ফোন নম্বর দিতে সে কিছু বলতে চায়। শ্রেয়সী কি বুঝলো কা জানে সে বলল, ‘ভাইয়া আপুর ফোনটা কাল রাতে চুরি হয়েছে।’ মিথ্যে বলেছে শ্রেয়সী ফোন চুরি হয়নি রুপশ্রীর। আর একদিন পরই বোনের বিয়ে এখন আর ইকবালের অনুভূতিদের রুপশ্রীর মনযোগ আকর্ষণের অধিকার নেই। এমনটা ভেবেই সে মিথ্যেটা বলেছে।
গায়ে হলুদে কনেকে সাজানো হবে বিউটি পার্লারে। পার্লারের বন্দোবস্ত নয়নের বোন নিশি করেছে। তাই দুপুরের খাবার খেয়েই পার্লারে চলে গেছে রুপশ্রীকে সাথে নিয়ে তনুশ্রী আর শ্রেয়সী। সাথে আছে নয়নের বড় বোনের বারো বছর বয়সী মেয়েও। তিন বোন একসাথেই সেজেছে। সেই সাজ শেষ হতে হতে সন্ধ্যা পেরুলো। সময়টা নভেম্বরের শুরু।শীত নেই নেই করে একটু আধটু অনুভব করা যাচ্ছে। নয়নের পাঠানো গাড়িতে করেই ফিরছিলো তারা। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই রাস্তার কিনারায় চোখে পড়লো ইকবালকে৷ সে হাত উঠিয়ে গাড়ি থামাতে ইশারা করছে।নয়নের ড্রাইভার ইকবালের পরিচয় না জানলেও মুখ পরিচিত বলে মনে হলো তার। রুপশ্রীদের বাড়িতে আগেও আসতে গিয়ে দেখেছিলো তাকে। পরিচিত কেউ ভেবেই রুপশ্রীকে বলল, ‘সামনে একজন ছেলে গাড়ি থামাতে বলছে।’ ততক্ষণে শ্রেয়সী মুখটা দেখেছে ইকবালের তাই অস্পষ্টই বলল, ‘ইকবাল ভাইয়া।’ ভয় ছলকে উঠলো মেয়েটির। সে তার পনেরো বছরের জীবনে এই প্রথম বোধহয় এতোটা আতঙ্কিত হলো। কিশোরী বয়সের শ্রেয়সী এখন অব্ধি প্রেম ভালোবাসা নামক অনুভূতি নিজের অস্তিত্বে টের পায়নি। দেখতে সুন্দরী হওয়ায় স্কুলে কয়েকটা প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছে সে। কিন্তু সেই প্রস্তাবগুলো শুধু প্রাঙ্ক ছাড়া কিছুই মনে হয়নি তার। কিন্তু আজ এই পরিস্থিতে শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে প্রেম, ভালোবাসা ভয়ঙ্কর সুন্দর জিনিস। যা মানুষকে উন্মাদ করে। এই যে ইকবাল ভাইয়া এভাবে প্রাণহীন এক মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে সেজন্য আপুর বড় কোন ক্ষতিও হতে পারে,আবার হতে পারে আজকের পর ইকবাল ভাইয়া সারাজীবনের জন্য নিঃস্ব জীবনধারণ করবে। শ্রেয়সী মনে মনে এসব ভাবতেই তার কানে এলো, ‘গাড়িটা একটু সাইড করে থামান।’
গাড়িটা থামতেই রুপশ্রী বের হলো গাড়ি থেকে। তনুশ্রী কিছু বলল না তবে বাঁধা দিলো শ্রেয়সী। আজ এই মেয়েটা হঠাৎ করেই যেন অনেক বড় হয়ে গেছে। ভালো মন্দ বুঝতে পেরেই যেন রুপশ্রীকে আটকাতে চাইলো। রুপশ্রী শুধু বলল, ‘ এক্ষুনি চলে আসবো।’
রুপশ্রী গাড়ি থেকে নেমে ইকবালের সামনে যেতেই নয়নের ভাগ্নি বলল, ‘আন্টি একটু বের হই আমিও।’ তনুশ্রীর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেই মেয়েটা ফোন হাতে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়েই সে নয়নকে ভিডিও কল দিলো।
___________________________
বহু বছর পর এক গৌধূলিবেলায় ডুপ্লেক্স বাড়িটির উত্তরের খোলা প্যাসেজে বসে আছে তিন মধ্যবয়স্কা নারী। রুপশ্রী, তনুশ্রী, শ্রেয়সী তিনটিবোন আজও একই ছাঁদের তলায়। নদীর মোহনার মতোই তারা দেওয়ান বাড়িরটিই তাদের মিলনকেন্দ্র রয়ে গেছে আজীবনের মতন। রুপশ্রীর বারান্দা থেকে পাশের বাড়ির টিনের চালার যে ঘরটি চোখে পড়তো তা আর আগের মতন নেই। এখন সেটা ইট,সিমেন্টের একতলা পাকা পাড়ি। সে বাড়ির দুই ছেলে ইকবাল,ইরফান কেউই বছর বাইশ হলো বাড়িতে পা রাখেনি। তাদের মা-বাবাও ষোলো কি সতেরো বছর আগে এই একতলা বাড়িটির কাজ সম্পন্ন হতেই চলে গেলেন ছোট ছেলে ইকবালের কাছে চট্টগ্রামে। সাজানো সংসার ঠিক যেন সাজানো এক ফুলের বাগানের মত । থেমে থেমে কোথাও একটা কোকিল ডাকছে তারস্বরে। কোথায় কোন গাছে সে চোখে পড়ছে না। চায়ের কাপ হাতে ঝাপসা চোখে এদিক ওদিক খুঁজছে রুপশ্রী পাখিটা কিছুতেই খুঁজে পেল না। নিচতলা থেকে চেঁচিয়ে ডাকছে তনুশ্রীর ছেলে তন্ময়। চায়ের কাপটা ছোট্ট টি টেবিলটায় রেখে উঠে দাঁড়ালো তনু। এক পা বাড়িয়ে নিচে যেতে উদ্যত হতেই চোখের কোণে ভেসে আসলো পাশের বাড়ির উঠোনে কিছু মানুষের ছায়া। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই অবাক হলো সে৷ ইকবালদের বাড়ির উঠোনে একটা পনেরো,ষোল বছর বয়সী এক মেয়ে তারই পাশে তনুশ্রীর বয়সী এক মহিলা। আর সাথে দু’জন বয়স্ক পুরুষ,মহিলা।রুপশ্রীর কাঁধ ছুঁয়ে তনু ডেকে উঠলো, ‘আপু ইকবাল ভাইয়ার বাবা-মা।’ রুপশ্রী ফিরে তাকালো। শ্রেয়সী সব দেখেও যেন দেখলো না, শুনেও শুনলো না। সে স্বাভাবিক তবে তনু আর রুপশ্রী অবাক নয়নে দেখছে তাদের। ওই কিশোরী মেয়ে আর মহিলাকে দেখে বেশ কৌতূহলী। তনুর মন বলল, ‘ইরফানের পরিবার!’ রুপশ্রীর মন বলল, ‘ইকবালের পরিবার!’ পেছন থেকে তনুর ছেলে আবার ডাকলো, ‘মামনি দেখো এই আঙ্কেলটা বড় মামনিকে খুঁজছেন।’
চমকে তাকালো দু বোন শুধু শ্রেয়সী হাসিমুখে এগিয়ে গেল ইকবালের দিকে।
‘কেমন আছো ভাইয়া?’ শ্রেয়সী প্রশ্ন করলো।
তুমি কেমন আছো শ্রেয়?
রুপশ্রী অবাক হয়ে দেখছে সামনে দাঁড়ানো ইকবালকে৷ আগের মতোই আছো লোকটা পরিবর্তন বলতে পোশাক আর গালভর্তি কাঁচাপাকা দাঁড়ি। বয়সটা শুধু দাঁড়ি দেখেই ধরা গেল। তনুশ্রী চুপচাপ কয়েক মিনিট ইকবালের দিকে তাকিয়ে নেমে যেতে চাইলো। ইকবাল তাকে আটকে দিলো।
‘কেমন আছো তোমরা?’ ইকবাল এবার প্রশ্ন করলো সবার উদ্দেশ্যে৷ কেউ যেন জবাব দিবে না বলেই পণ করেছে। ইকবাল আবার বলল, ‘কেমন আছো রুপশ্রী? নয়ন সাহেব,তোমার ছেলে মেয়েরা কেমন আছে?’ রুপ আর তনু বোবা মূর্তি বনেছে। বিষ্ময় নাকি অন্য কিছু বোঝা গেল না তারা তখনও নিশ্চুপ রইলো। শ্রেয়সীই মুখ খুলল, ‘বড় আপুর বিয়ে হয়নি কখনও।’ এবার বিষ্ময়ের বজ্রপাত যেন ইকবালের উপর হলো। শ্রেয়সী তার কাছে লুকিয়েছিলো এতগুলো বছর এই কথাটা! অবিশ্বাসের নজরে শ্রেয়সীর দিকে তাকাতেই সে আবার বলল, ‘ক্ষমা করে দিও ভাইয়া।তুমি চলে যাওয়ার পর আমি তোমাকে জানাতে চেয়েছিলাম সবটা।তুমি যেমন চট্টগ্রাম গিয়েও আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছিলে তেমনই ইরফান ভাইয়াও রেখেছিলো আর তা আঙ্কেল, আন্টি মানে তোমার বাবা-মাও জানতো। তাই আন্টি একদিন আমায় চুপিচুপি ডেকে নিয়ে গিয়ে হাতজোর করেছিলেন আমি যেন তোমাকে কিংবা ইরফান ভাইয়াকে না বলি আমাদের পরিবারের কোন কথা। উনি তো তোমাদের মা হয়তো তোমাদের মঙ্গলের জন্যই বলেছিলেন।ওয়াদা করেছিলাম আন্টির কাছে কখনও তোমাকে বলবো না আপুর কথা ইরফান ভাইয়াকেও বলিনি তনু আপুর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা। ইরফান ভাইয়া যেদিন বিদেশে যাবে বলেছিলো সেদিন মন বলছিলো তাদের অন্তত এক হওয়ার পথ করে দেই। কিন্তু ওয়াদা! তনুর চোখ ছলছল করছে শ্রেয়সীর কথায় তবুও সে কাঁদছে না। ইকবাল ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে বুকের বা পাশে একটু একটু চিন চিন ব্যথা। ব্যথাটা কি তার নিঃশ্বাস আটকে দিবে? দিলেই বুঝি শান্তি মিলবে তার। এতগুলো বছর তো সে মায়ের কথা ভেবেই সংসার করলো আজ কি একটু নিজের কথা ভাববে! তখনই চোখ গেলে নিজের বাড়ির উঠনো সেখানে তার একমাত্র কন্যাকে দেখা যাচ্ছে। বুকের ব্যথার ধারটা খানিক কমে গেল মুহূর্তেই। রুপশ্রী স্তব্ধ কি বলবে সে?
পরিশিষ্টঃহলুদের সন্ধ্যায় রুপশ্রী গাড়ি থেকে নামতেই নয়নের বোনের মেয়ে নয়নকে ভিডিও কল দেয়। আর দূর থেকেই রুপশ্রী আর ইকবালকে একসাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে নয়ন ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তার ক্ষোভ শুধু রুপশ্রীর কোন ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলায় নয় বরং এই ক্ষোভের শুরু বিয়ে ঠিক হওয়ার দুদিন পর থেকেই ছিলো৷ নয়ন রুমডেটের আয়োজন করায় রুপশ্রী তাকে অপমান করে এমনকি বিয়ে ভাঙার ধমকিও দেয়। আর তাতেই রেগে যায় নয়ন। যেখানে বাগদান থেকে বিয়ের তারিখ পর্যন্ত ঠিক সেখানে সাথে ইন্টিমেট হতে এত কেন আপত্তি থাকবে তার! মনে মনে জমতে থাকা রাগ ওই এক ভিডিও কলেই বিষ্ফোরক হয়ে ধ্বংস করে নতুন সম্পর্কের সূচনা। সেদিন ইকবাল চট্টগ্রাম চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই দাঁড়িয়েছিলো শেষবারের মত রুপশ্রীকে দেখতে। আর সেই দেখাই কাল হয়েছে রুপশ্রীর জীবনে। এরপর আর রুপশ্রীকে জোর করেও বিয়ের পিড়িতে বসাতে পারেনি কেউ । বছর কয়েক পরে তনুশ্রীর বিয়ে ঠিক করা হয় এক বিত্তশালী ব্যবসায়ী অভ্রের সাথে। তনুশ্রী সে বিয়েতে রাজী ছিলো না বলেই বিয়ের দিন পালিয়ে যায় বাড়ি থেকে। বরযাত্রী আসার পর জানাজানি হলে অভ্র নিজের সম্মানে দাগ লাগবে ভেবেই খুঁজে বের করে তনুশ্রীকে আর জোর করেই বিয়েটাও করে। সেই বিয়ে টিকে আছে আজও এক ভাঙাচোরা আসবাবের মত। তার একটি মাত্র সন্তান তন্ময়। তনুশ্রী কিংবা অভ্র কেউ কাউকে ভালো না বাসলেও সন্তানের খাতিরেই সংসারটাকে আগলে রাখছে। আর বাড়ির সবচেয়ে ছোট মেয়ে শ্রেয়সী! মনের মত বর এবং মনের মত ঘর হয়েছে তার। দু বোনের জীবনে ভালোবাসার মানুষদের হারিয়ে যাওয়া দেখেই বোধহয় সে ভালোবাসার বন্ধন থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো নিজেকে। পড়াশোনা শেষ করে বাবা মায়ের পছন্দ করা ছেলেকেই সে বিয়ে করেছে বিনিময়ে ভালোবাসাও পেয়েছে অফুরান৷ শুধু সুখ নামক পায়রাটা তাকে সন্তানধারণের সুখটাই দিতে নারাজ রয়ে গেছে। তিনটি বোনের জীবনের শেষটাতে একটা করে দুঃখপায়রা থেকেই গেছে। তবুও তারা হাসিমুখে বেঁচে আছে এই ধরনীতে।
__________________সমাপ্ত______________
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখব